অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
কবিতা-কারিগর সৈয়দ শামসুল হক - ফজলুল হক সৈকত

সৈয়দ শামসুল হক (জন্ম: ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫; মৃত্যু: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) প্রসন্নতা, অগ্রগমণ, রহস্যময়তা আর মাটিলগ্নতার কবি। কেবল কবি বলি কেন তাঁকে; তিনি কবিতাচাষের পাশাপাশি রোপন করেছেন গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধের বীজ ও চারাগাছ। লালন করেছেন কাব্যনাট্যের বৃক্ষরাজি। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল সাহিত্যসাধনায় সক্রিয় থাকার ব্যাপারটিও কোনো সামান্য ঘটনা নয়। সময়-পরিসরের বিবেচনায় যেমন, তেমনি সৃজন-অবদানের দিক থেকেও সৈয়দ হক সহজকথায় অসামান্য শিল্প-প্রতিভা। পূর্বপাকিস্তান, পূর্ববাংলা, বাংলাদেশ- এসব ক্যানভাস ছাড়িয়ে এখন তাঁর সাহিত্যআভা বিশ্বপ্রেক্ষাপটের বিরাট জমিনে দাঁড়িয়ে; শিল্পকথক সৈয়দ শামসুল হক যেন বাংলাদেশের এক উঁচু ভবন থেকে উচ্চারণ করছেন ভাবনা-প্রকাশের সূত্রাবলি, শিল্প-প্রকাশের মর্মবাণী। আর তা নানান তারে ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিক। দেখা-না-দেখা আর ধরা-না-ধরার সাহিত্যমায়া তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যেন সেই ঘোরলাগা প্রথম কবিতাপ্রহর থেকে- ‘রংগপুরের কনকরঙা মেয়ে/ হঠাৎ সাড়া জাগিয়ে দিয়ে লুকোয় পরান পণে।/ এই দেখেছি এই দেখিনি বৃষ্টি ভেজা মাঠ।’ তারপর থেকে তাঁর দুরন্তযাত্রা- আজও যার দিক-নিশানা নেই; নেই সমাপ্তি ইঙ্গিত। সৃজনযাত্রায় তাঁর সাধনা ‘চেতনার গূঢ় মূলে জল’, বীজ, শস্য, হাসি আর ‘উপদ্রুত হৃদয়ের বাঁধ’ভাঙা ভক্তির বন্যা।

কাব্যনাট্যের সফল নির্মাতা সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কবিতায় খুব সহজেই বুলিয়ে দিতে পেরেছেন নাটকের শরীর ও প্রাণ। গঠন-কাঠামো আর পরিবেশন-কৌশল তেমন ভাবনারই স্বাক্ষর বহন করে। আর এতে জটিল বিষয়াদিও তাঁর বর্ণনায় হয়েছে উপভোগ্য এবং সাবলীল। বুর্জোয়া অর্থনীতি, ধনতান্ত্রিক সমাজ-রাজনীতির অহমিকা আর ফলত মানবতার অসহায়তা শিল্পের প্রতিকূল। শিল্পীর চিন্তাভুবন সেই যন্ত্রতন্ত্রের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তিঅন্বেষণায় ব্যাকুল। কবি সৈয়দ হকের কবিতাকথায় এই অনুভবের প্রকাশ দেখি আমরা-
না, সে এসেছিল নিজে, মানে সে মহিলা  
সহসা ছড়িয়ে ঘ্রাণ উন্মীলিত গাঢ় ‘বুর্জোয়া’-র।
‘আমার সময় আছে, এবং হৃদয়।
তোমরা সবাই ভাবো আমার হৃদয় নেই- নাকি?
কথা বলো।’
(পুরনো প্রাসাদ- ৪)

সবসময় তিনি খোঁজেন নির্ভার আনন্দ, মনে লালন করেন ‘দুর্লভার চুম্বন তৃষ্ণা’। আর নীটশের মতো তিনি যেন এক অন্ধকার অরণ্য- ‘দীর্ঘ, ঋজু, সুপ্রচুর, বিশাল বিস্তৃত’। গাঁয়ের ছেলে সৈয়দ শামসুল হক আজো খুঁজে ফেরেন ব্যাপক বাতাস, সহজতা, স্বাভাবিক ভীতি, ফেলে-আসা কিংবা নিয়ে-আসা আপনজন। চাওয়া তাঁর খুব সামান্য; পাওয়ার তৃপ্তি অনেক। যেহেতু প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মোহবিদ্ধ দ্বন্দ্বে আটকে পড়েনি তাঁর ভাবনাবলয়, তাই অনায়াসে সাজাতে পেরেছেন সৃজনমনন-আলোকসভা। কবির বিনম্র বিবৃতি-
আমি এক নিতান্তই গেঁয়ো লোক, সহজেই ভীত।
পরম করুণা মানি সামান্য রুটি ও জল,
আর স্ত্রীলোকের ত্রিসীমায় মাড়াইনি ছায়া,
ঘরে আছে প্রিয়তমা, তাকে প্রেম- সন্তানেরা,
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
দেবতার বিষয়ে আমি অজ্ঞ চিরকাল
আর সহজেই ভীত।
(আসন্ন অরণ্যদেশ) 

শুভ-অশুভবোধের চক্রতাড়িত কবি দেখেছেন কোকিলের পরাজয়ে কাকের আনন্দ-উৎসব। তিনি জানেন- কল্যাণচিন্তা যখন পরাজিত হয়, তখন মন্দভাবনা জেঁকে বসে দেশ-জাতির ভাগ্যে। আর তখন তিনি পাখির মতো স্বাধীনতা প্রত্যাশা করেছেন। চেয়েছেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে অফুরন্তআলো। অতীত, অদৃষ্ট আর আসন্ন মৃত্যুর হিমশীতল ঠাণ্ডা কবিকে ক্লান্ত করে প্রতিনিয়ত। চারপাশের বাস্তবতা আর নিজেকে বড়ো অচেনা ঠেকে তখন। পৃথিবীময় তখন, তাঁর চোখে গভীর নিস্তব্ধতা। সৈয়দ হক লিখছেন-
শৈবাল লতার মতো আমি
পিচ্ছিল, ভাবনাহীন, প্রয়াসহীন, প্রসারিত, প্রবাহিত, ঠাণ্ডা, নিমগ্ন
হলাম।
বাতাসে আমার পাজামা অতলে ফুলে উঠে
আস্তে আস্তে নির্বাপিত হয়ে
সেঁটে রইলো শরীরে।
(কি মুহূর্ত। দুই)

আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন কবি ইমরুল কায়েস তাঁর চাচাতো বোন উনায়যার প্রতি ছিল গভীরভাবে অনুরক্ত। কিন্তু এ ভালোলাগা ছিল একেবারেই একমুখি। কোনো এক নির্জন বাগানে উনায়যাকে কাছে পাবার এক বিরল সুযোগ, যা তিনি হারিয়েছেন, আর পরবর্তীকালের দীর্ঘ বিরহপ্রহর নির্মিতি লাভ করেছে তাঁর কবিতায় অতিআবেগঘন বর্ণনায়। তিনি লিখেছেন- ‘আমার বন্ধুরা একটু দাঁড়াও/‘দুখুল ও হামলে’ জীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা আমার প্রিয়তমার বাড়িটিকে/স্মরণ করে কিছুক্ষণ কেঁদে নিই।/...গাছের ছায়ায়/নীরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না/বন্ধুরা বলছিলো- ধৈর্য ধরো, এভাবে নিজেকে নষ্ট করো না।/আমি বললাম- তোমরা কি বোঝ না চোখের পানিই এখন আমার একমাত্র সান্ত্বনার উপায়/যদিও জানি বিলুপ্ত এই মোকামে দাঁড়িয়ে কান্নকাটি করে কোনো লাভ নেই।’ আর সৈয়দ শামসুল হক হারানো বৈভব-ঐতিহ্য ফিরে পেতে উৎপাদনমুখী সভ্যতা গড়তে হয়ে পড়েছেন আবেগনিবিড়; কখনো বা মুখর প্রতিবাদে-উত্তেজনায়। নিজেদের অসাবধানপ্রসূত ভুল আর ভাগ্যাহত চাষার ফিরে দাঁড়াবার অসীম সাহসের সমাচার তাঁর কবিতায় প্রত্যয়-আবদ্ধ-
১. তুমি সেই ভাগ্যবান চাষা। তবে দাঁড়াও এখানে
রক্তিম নৃত্যের পর উঠে এসে দমকানো কান্নার পাড়ে।
দাঁড়াও, দাঁড়াও।
(না নির্বোধ, না মহাপুরুষ)
২. কিন্তু আমরা সৃষ্টি করি আমাদের মৃত্যুকে
আর জীবনকে ফেলে রাখি ছুরির মতো বিপজ্জনক বাতাসে।
(একদা এক রাজ্যে)
৩. কার্নিশে প্রেমিক দাঁড়ালো দূর বাড়িটার মেয়েটির জন্যে,
আর দিন দাঁড়ালো মিছিলে, স্বর ভাঙলো শ্লোগানে,
পতাকা উঠলো বাড়ির মাথায়, নহবৎ বাজলো বিবাহে।
(সেই তুমিই তো)

সৈয়দ হক ছায়া চান না, পদচিহ্ন-আঁকা পথ কিংবা সিঁড়ি তাঁর আরাধ্য। তিনি চান বিশ্রামের রাত্রির অন্ধকারে কষ্টের মোম গলে দিনের সূত্রপাত হোক; সমস্ত মানুষ থাকুক কেবল ঘরমুখো- আপন বিবর হোক তাদের দিনরাত্রির অশেষ সাধনা। যা গত হয়েছে, তা নিয়ে কোনো যন্ত্রণা নেই তাঁর; আছে আগন্তুককে নক্ষত্রআলোয় স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি। কবিতো জানেন পূর্বাচলকে আঁধার রাখতে পারে না কোনো রাত। যদিও বুকের ভেতর তাঁর বিস্তর নিঃশ্বাস, জ্যোৎস্নাভুক সর্পফণা চোখের সামনে, তবু তিনি আশাবাদী প্রবল। বিব্রত ভানারাজ্যে তিনি কেবল স্থির থাকেন ‘সারারাত সোপানে, স্বপ্নে, দালানের ছায়ায়’, তাঁর ‘দৃষ্টি পলকহীন-
আমরা সারারাত না নবী না ঐন্দ্রজালিক-
এ রকম আমরা ক’জন।
যেন উৎসবের বাতি, লোক চলে গেলেও জ্বলছে,
আর বাতাসে ঘুরছে সুবাস।
(বিচ্ছিন্ন নোট)

স্বপ্নচারি কবি সৈয়দ হক মাঝে মাঝে স্বপ্ননৌকায় চড়ে পরিভ্রমণ করেন দেখা-দারিদ্র্যের ভুবন আর ফেলে-আসা শৈশবের স্মৃতিবাড়িতে। কবিতা আর শিল্পসিদ্ধির রাজপথে দাঁড়িয়ে তিনি অবলোকন করেন হারানো প্রসন্নতা। উপরে ওঠার সিঁড়ি অতিক্রম করতে করতে তিনি একরকম ক্লান্ত। খ্যাতির দৌরাত্ম্যে প্রবল প্রতিকূলতা পার হতে থাকা সৃজনভাবুক মধ্যে মধ্যে একা হয়ে পড়েন; অনিকেত বোধ করেন। চারপাশে বিচরণশীল মানুষের ক্রিয়াকলাপে দেখেন কেবল হতাশা। নিজের জগতের বাসিন্দা মনে হয় না কাউকেই। বড্ড অচেনা লাগে সবকিছু। অভিনয়বৃত্তি, পলায়নপরতা, অবসন্নতা আর আড়মোড়ার আওয়াজ শুনতে পান তিনি সংসারযাপনের প্রত্যহলিপির পাতায় পাতায়। আঁকেন বাস্তবতার এক নিবিড় ছবি-
আঁটোসাটো
ঘর করছে লোক, যেন ডুবে যাচ্ছে জাহাজ,
দ্রুত অঙ্কের অক্ষর,
নতুন ধাঁধার মধ্যে ঠেসে দিচ্ছে পুরনো উত্তর,
অনেকটা সবাই খুঁজছে
অন্যকক্ষে অন্যকারো স্তন!-
আর ফেরাচ্ছে মখ যখন খুলে যাচ্ছে বাতাসে দরোজা।
(বলতে পারা যায়)

দায় আর দায়িত্ব এড়িয়ে চলা আমাদের স্বভাবজ অনুষঙ্গ। অন্যের ওপর দোষ ও দায় চাপাতে অভ্যস্ত আমরা। স্ত্রী-কন্যা-পুত্রের অসুস্থতা-অশান্তির জন্য, ব্যবসার ব্যর্থতার জন্য, সাংসারিক অসাফল্যের জন্য আমরা দায়ী করতে থাকি সরকারকে। স্বস্তি পাই না আপন বিবরে; ‘চলে যাবো ইরান-তুরান’ বলে অবজ্ঞা প্রকাশ করি নিজের জন্মভূমির প্রতি। বিদেশপ্রীতির অদ্ভুত আকর্ষণে কাতরাতে থাকি শেকলে বাঁধা পাখির মতো। নির্ঘুম রাত্রিযাপন, দুঃস্বপ্ন- ফলত নিদ্রাবিভ্রাট আর বিভ্রান্তিতে আটকে পড়ে আমাদের স্বাভাবিক জীবন। ‘মেয়েটার বাড়ছে বয়স,/ছেলেটা বখাটে হতে আর দেরী নেই,/আমার সঞ্চয় চাই, আত্ম ছাড়া চিনি না অপর।’- এমনই এক আবর্তনে বিপন্ন আমরা।  এমন অসুখ-অপ্রসন্নতায় সৈয়দ শামসুল হক স্বদেশকে নিজের সংসার ভাবতে, মানতে প্রত্যয়নিবিড়। দেশমৃত্তিকালগ্ন কবি লিখছেন-
হে জননী
তোমার মুখ যখন দুঃসহ কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে
আমার আত্মা হয়েছে অগ্নিপুষ্পের স্তবক;
তোমার শরীর থেকে যখন রক্তপাত হচ্ছে
আমি সহস্রের হাতে সমর্পন করেছি
আমার অস্থির আঙ্গুল;
যখন তোমার চোখ থেকে উদ্গত হচ্ছে উষ্ণ অশ্রুর ধারা
আমি একটা তরুণীর মতো ঋজু হয়েছি
ধাবিত হবার জন্যে।
(একটি গাথার সূচনা ও মৃত্যু-৪)

মানুষের অন্তরালধর্মীতা কিংবা পলায়নপ্রবৃত্তি যেন স্বাভাবিক-সহজাত। দ্বিচারীচরিত্র থেকে মুক্তি নেই, বোধকরি, আমাদের। আমরা নিজস্ব মতামতের কথা বলি, বলি ব্যক্তিস্বাধীনতার কথাও; অধিকার আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যোগ দেবার অভিজ্ঞতা আমাদের নেহায়েত কম নয়। রাজপথে, মিডিয়ায় আমরা সোচ্চার বক্তব্যকথনে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা বড়ো নিরুপায়; আমরা যেন ছকে-বাঁধা যন্ত্রমানব- নেই চলবার, বলবার কোনো ইচ্ছে অথবা সাহস। যা বলতে চাই, প্রকৃতঅর্থে তা বলতে পারি না, অবিনাশী বন্ধু কিংবা বিবেকের কণ্ঠও থাকে বড্ড নিশ্চুপ। মানুষের এই প্রাতিস্বিকতা-বিরোধী প্রবণতা সম্বন্ধে সৈয়দ হক লিখছেন-
বারান্দায় সারি সারি রঙ্গীন টব। তাতে ফুল।
আমারো নিজস্ব মত অবশ্যই আছে।
মতামত সম্পন্ন আমি আজীবন বসে থাকি
চেয়ারে, টবের কাছে- বলা ভালো
টবের মতো চেয়ারে\
(আত্ম-প্রতিকৃতি)

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় ইতিবাচকতার আভা কবিতা-পাঠকের জন্য প্রেরণা আর শোভনযাত্রার ইঙ্গিতবাহক শব্দরাজি। তিনি জানেন- ‘আলোর অভাব মানে অন্ধকার নয়,/ অন্ধকার তার সুনিশ্চিত সম্ভাবনা।’ কবিতা, গান, ভালোবাসা, গণতন্ত্র, দুঃখ আর সংসারকে কবি মনে করেন স্বপ্নপণ্য; যা আমরা সঞ্চয় করি ইচ্ছে-প্রতিকৃতির আঁকা স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে- কেননা, আমাদের প্রত্যাশা শিল্প-সংসারের দিকে অভিযাত্রা। আর পরিবর্তন বলতে আমরা যা বুঝি, বাস্তবে তার হিসাব ভিন্ন; ‘কিছুতেই আসে না যায় না/ কিছু, যেমন সমস্ত ছিল, অবিকল/ তাই আছে।’ বিদ্রোহ, ঈদের ছুটিতে শ্বশুরবাড়িতে ছুটে যাওয়া, সিনেমার জুটি-ভাঙার গল্প, কারো কারো আর্থিক সাফল্য-বিদেশগমন-মিডিয়া কাভারেজ-খাবার টেবিলে ইলিশের গন্ধ; বিক্ষোভ-অশ্রু-দুঃখ-পরাজয়-মানুষের বেঁচে থাকা-সুরাপাত্রে শয়তানের হাতছানি- সবকিছু থেকে যায় আগের মতো, অপরিবর্তনশীল। বদলায় না এসব কিছু বদয় হয় কেবল মানুষের অস্তিত্বের-
শ্যামলের বোন আত্মহত্যা করে কোন
দুঃখে দূর কুড়িগ্রামে- আজো, রোজ করে-
আজো মাঝে মাঝে রাত দুপুরের গাড়ি
এইখানে বাঁশী দেয়। রবীন্দ্রনাথের
গানে বাংলার কি হয়, কিভাবে হৃদয়
ভাঙ্গে, নড়ে ওঠে স্বপ্নের বোমারু, জোড়া
লাগে রূপালী দরোজা, অলৌকিক স্পর্শে
নতুন গর্ভের মতো ফুলে ওঠে পেট-
সে সব সংবাদ কারো অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাকে নিজের তুমি করবার আগে,
লোকে বলে, হয়ে যাবে তুমি এ বাংলার।
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা)

মোহময়তা, প্রতারণা, অস্পষ্টতা, বাজীকর কিংবা সম্মোহনকারীর সকল শক্তি, মানুষের অজানা বেদনার জ্বালা, প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ, নীরব জিজ্ঞাসা সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার এক বিরাট ক্যানভাস। পরিবর্তিত এই সমাজ-সভ্যতায় তিনি দেখতে পান প্রতিকূলতার প্রাবল্য; চিন্তা ও কর্মের দারুণ সংকট। মানুষের সবকিছু হরণ করেও যেন শান্তিপায় না অপর কোনো মানুষ; অথচ জানে না, কেনো তার মনে এতো আকুলতা, কেনো নদী মধ্যে মধ্যে হয়ে ওঠে নির্দয়- সৃষ্টির অপার রহস্য সত্যি থেকে যায় অনুদ্ঘাটিত। চতুর্পাশ্বে কান্নার নামা কণ্ঠস্বর শুনতে পান তিনি। হয়তো টের পান প্রতিবাদের ইঙ্গিত বারতারও। তবে কবি যেন বুঝতে পারেন না মানুষের অব্যক্ত যন্ত্রণা আর নিত্য-অনুসন্ধানের দৃশ্যাবলি। ‘আগো, চেনা কেউ আছো কোনোখানে?’- এই চিৎকারে কবি প্রকাশ করতে থাকেন মানুষের অসহায়তা। বিনিদ্র রাত্রি অতিক্রম করতে করতে তিনি খুঁজতে থাকেন সেই বৃক্ষ, সেই নদী, সেই নারী, সেই শস্য, সেই মৃত্যু, সেই কথা, সেই নেশা- যেখানে পরানের গহীনে নিশ্চিন্তেরাখা যায় আরেক পরান। কবির কষ্ট আর জিজ্ঞাসা-
আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়?-
...     ...       ...
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
(পরানের গহীন ভিতর)

দীর্ঘ কবিতা রচনা সৈয়দ হকের একটি বিশেষ প্রবণতা; বিশেষ করে তাতে থাকে যাপিতজীবনের অলি-গলি পরিভ্রমণের চিত্রাবলি- নাটক কিংবা উপন্যাসের বিস্তৃত ক্যানভাস। সংলাপ-পরিবেশ, আলো-শব্দ সংকট আর উত্তরণের ভাষা-নির্মাণ করে সেসব কবিতা। যেমন ‘এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি’তে তিনি আঁকেন ভালোলাগা-মন্দলাগা, ইচ্ছা আর প্রতিভার আশ্চর্য প্রকাশ, সীমাবদ্ধতা, হৃদয়-পুজোর অকৃত্রিমতা, টিকে থাকার সংগ্রাম, স্মৃতিলগ্নতা আর একাগ্রতার নিবিড়তা-
রবীন্দ্রনাথের গান তুমি ভালোবাস। তাই সম্প্রতি
লেখাপড়া, ঘুম, সংসার, স্বজনের প্রতি
আমার মনোযোগ নেই। নিজের ভীষণ ক্ষতি
হচ্ছে, তা হোক;
একে যদি কেউ বলে রোগ
বা পাগলামো, বলুক, বাথরুমে আমি শিখছি রবীন্দ্র সঙ্গীত!
কারণ তুমিই তো আমার ভবিষ্যৎ, বর্তমান, অতীত।
(এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি)

বর্ণবাদ আর সাম্প্রদায়িক সংকট বিশ্বের দুই প্রধান সমস্যা। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আর শাদা-কালোর যন্ত্রণা থেকে যেন মানতবার মুক্তি নেই। সৈয়দ হক দেখেছেন শাদা-কালোর সহাবস্থান, বিবাদ আর ফলত বিভীষিকার ছবি; যেন সবসময় এক নোংরা, ভয়ংকর কুকুর এ সংকটের পেছনে ধাবমান এক বিরাট অন্ধকার হাতে নিয়ে। শাদারা সুবিধাভোগী- উদ্দেশ্য অস্পষ্ট; কালোরা বঞ্চিত, টার্গেট স্থির-মজবুত। তিনি মনে করেন বর্ণবাদের এ সংকট থেকে উত্তরণ যতই বিলম্বিত হবে ,ততই বিপর্যস্ত হতে থাকবে মানুষ, বিপন্ন হবে সকল সম্ভাবনা আর প্রসন্নতার প্রসঙ্গ। শাদা-কালো দ্বন্দ্বের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে কবি আঁকেন এভাবে-
কালো মানুষটি টেনে টেনে চলে। শাদা মানুষটি লাফিয়ে লাফিয়ে,
একই সঙ্গে- পাশাপাশি- দুজনের ছায়া ইতিহাসে  
দু’রকম, এখনও তা আছে।
যদিও আকাশটা লালও নয় আর, রোদেও নয় আর- কালো এখন কালো।    
অন্ধকারে শাদা মানুষ, অন্ধকারে কালো মানুষ, দু’জনেই এখনও অন্ধকারে।
(কালো মানুষ শাদা মানুষ)

প্রতিকূলতা আর মৃত্যুর অনিবার্যতাকে কবি সৈয়দ হক মোকাবেলা করতে চান কবিতার শক্তি দিয়ে। সময় আর কর্মের ব্যাপ্তি ও পরিধি বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে মানুষের স্পৃহা ও ক্ষমতা; যোগ হতে থাকে মৃত্যুর হীমশীতল স্পর্শ। সৈয়দ হকও অনুভব করছেন মৃত্যুদূতের আবির্ভাব-বারতা। টের পাচ্ছেন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে চারপাশের পরিচিত-পরিজন, বন্ধু-শত্রু। একা হয়ে পড়ছেন ক্রমাগত। হয়তো বিনাশের হুংকার মোকাবেলার শক্তি হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু বিপরীতে তিনি যেন অবলোকন করতে পারেন কবিতাযাপনের দীর্ঘপ্রহরের প্রশান্তিআর প্রতিরোধের অভিব্যক্তির আলোক। তিনি এক কবিতালগ্ন মানববৃদ্ধ, বুঝি টের পাচ্ছেন- যতই সরে যাক, মরে যাক বন্ধুসকল, নিভে যাক একে একে সমূহ বাতি, দাঁড়িয়ে থাকবেন তিনি একা কবিতার উজ্জ্বল চাবি হাতে। কলমের নিবে কিংবা ল্যাবটবের চাবিতে লিখে যাবেন অমরতার সূত্রাবলি। কবি লিখছেন-
এখনো আমার কবজিতে নেই 
 সাহসের কোনো কমতি,
 কিম্বা নির্মাণের, সৃজনের।
আসলে এই জীবনের
কীর্তিকথাই আমি অবিরাম লিপিবদ্ধ 
করে চলেছি মৃত্যুর বিরদ্ধে-
এরই জন্যে তো আমি সেই কবে
থেকে গিয়েছি কত যুদ্ধে;
 (মোকাবেলার শক্তি এই কবিতাই)

বর্তমানে নগর এবং গ্রামে বিরাজমান শ্বাপদের গর্জন; আছে ‘বৃক্ষরব পশুরব’, বিপরীতে রয়েছে শিকড়প্রোথিত মানুষের নিবিড় আর্তনাদ। সভ্যতায় সাঁতারের কলাকৌশল আর বন্দিত্ব-মোচনের মানসিক পরিভ্রমণ মানুষকে দেখায় মুক্তির সবুজ প্রান্তরে যাবার পথ। প্রত্যাশানিবিড় নির্বিকার মানুষ যেনো কোনো মেঘবর্তী দিনে বসে থাকে নিশ্চুপ কার্নিশে, কাকের মতো। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে হারিয়ে-যাওয়া ব্যগ্রতা আর চাঞ্চল্য। কিন্তু অজান্তেই হয়তো সকল সৃষ্টিশীল মানুষ জন্ম দিতে থাকে সত্য-বিপরীতের অন্তর্গত শব্দের বিরল প্রতিবাদ। সৈয়দ হকের বিবৃতি-
মেঘ থেকে বৃষ্টির দু’ফোঁটা! উড়ে গেলে তুমি!
কোথাও কি খাদ্য চোখে পড়েছে হঠাৎ? বৃষ্টির বিশুদ্ধ জল
তবে পড়ে আজও পৃথিবীতে?- আমিও তো উড়ে যেতে চাই
বৃষ্টিজলে মানুষের স্নাপিত সংসারে\
(আমিও তো)

স্বাধীন বাংলাদেশে পশুর তাণ্ডব দেখে এক সময় সৈয়দ হকের মনে জমেছে হতাশা ও ক্ষোভ, বেড়েছে প্রতিরোধের স্পৃহা; স্বাধীনতার অপূর্ণতা আর জাতির পরিকল্পনাহীন অগ্রযাত্রায় তিনি দেখেছেন দেশগড়ার কারিগরদের বিবর্ণ মুখ। যেন অর্জিত নয়, আরোপিত স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা; আমাদের আত্মা আর প্রতিভার অনালোক তরঙ্গ যেন ক্রমাগত ধ্বনিত শব্দহীন চিৎকারে। ‘বিবর্ণ দর্পণে মুখ’ দেখতে চান না তিনি; নির্মাণ করতে চান অন্নময়-কাব্যময় প্রসন্ন ভুবন-
কেউ যেন আর বেরিয়ে না আসে প্রেমহীন জরায়ুর সুড়ংগ থেকে
এমন এক পৃথিবীতে যেখানে অন্ন এবং কবিতার বদলে
অস্ত্র এবং কুচকাওয়াজ,
অস্ত্র এবং কুচকাওয়াজ,
অস্ত্র এবং কুচকাওয়াজ,
এবং
সিঁড়ির ওপর অনবরত লুটিয়ে পড়ছে পিতার গুলিবিদ্ধ দেহ।
(আমি জন্মগ্রহণ করিনি)

জীবনের প্রতিপাদে প্রবল বণিকস্বভাব সৈয়দ হককে বিচলিত করে; ক্লান্তকরে। কবিতা আর প্রকৃতির নির্মলতা থেকে যেন দিনদিন সরে পড়ছে পৃথিবী-মানুষ-লতাপাতা; একে একে মরছে সকল নদী। ওঝার বিষনিবারক মন্ত্র কিংবা পাখির উড়ে চলার প্রশান্তিও যেন বিগত। অন্ধ-বোকাদের হাতে ক্রমে ক্রমে জমে উঠছে সভ্যতার সকল দায় ও দায়িত্ব। তিনি লিখছেন, এক নির্বিকার কবিতাকথকের মতো-
শব্দের সুগন্ধে আজ উপচিত বাগান কোথায়?
কোথায় অভিধাগন? বিনষ্টির যজ্ঞ হলো কবে?
এখন সূর্যের চোখ জ্বলে শুধু হাতলের নবে-
অক্ষর নিয়েছে বাসা বণিকের অসংখ্য চোথায়।
(নাভিমূলে ভস্মাধার)

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি সৈয়দ শামসুল হক এদেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব আর মর্যাদা রক্ষার প্রতি সোচ্চার কণ্ঠস্বর। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত হলেও আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির পরিসর বিস্তৃত নয়; ঘাতক মৃত্যুর অধিকারে যেন আমরা বিভ্রান্ত, জীবনে জীবনে বুঝি আটকে আছে নদীর পরিচিত স্রোতধারা। দেশলগ্ন কবি সৈয়দ হকের সাম্প্রতিক বোধ ও প্রত্যাশা-
এই তেরো শত নদীমাতা দেশে অতঃপর
বুলেট নিষিদ্ধ হবে।
মানুষ দখল নেবে রাষ্ট্রক্ষমতার।
রক্তরাজপথ হবে অতঃপর
মানবিক কৃষির জমিন।
সব স্বৈরশাসকের কারফিউ ভঙ্গ করে
নক্ষত্রসকল
জ্যোৎস্নার স্লোগান দেবে।
মাতৃদুধ শুকোবে না আর এ বাংলায়।
অতঃপর উৎসারিত হবে ঝর্ণাধারা
প্রতি করতল থেকে।
(স্বাধীনতার স্বপ্ন)

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় বাস্তবতার বিশ্বস্ত বিবরণ আছে, আছে প্রতিবাদ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনার চিত্র আছে, আছে প্রবল আশাবাদ; বিষণ্ণতার আড়ালে তিনি অনায়াসে নির্মাণ করতে পারেন প্রসন্নতার দারুণ ইতিহাস। বৃষ্টিস্নাত মাঠে কবি রোপন করেছেন কবিতার মোহময়তা-স্নিগ্ধতা আর সৌকর্য। সৈয়দ হকের কবিতা তাই আমাদেরকে আশান্বিত করে, উদ্যমী করে; গতিশীল করে আমাদের চিন্তাযন্ত্রকে, প্রসারিত করে আমাদের বিচরণভূমির আবছাজমিন।

ফজলুল হক সৈকত। ঢাকা, বাংলাদেশ