অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
জাতি - ধর্মের সমস্ত সীমারেখা মুক্ত লালনের ধর্মীয়চেতনা -ডঃ সুবীর মণ্ডল

"মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষেরই সনে"
     মানুষের মুখে মুখে লালন শাহ বা লালন ফকির নামের একজন বাউলের কথা অবশ্যই সকলেই শুনেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম একজন। একাধারে তিনি বাউল সাধক, বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তাঁকে বাউল সম্রাট হিসাবেও অভিহিত করা হয়। গান্ধীরও পঁচিশ বছর আগে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তাঁকে মহাত্মা উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর গানের মধ্য দিয়ে ধর্ম সমন্বয়ের প্রয়াস করেন। তাঁর জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য সকলের কাছে অজানা। তবে মানুষের অজানাকে জানার আগ্ৰহ বরাবরই বেশি।
     মরমী কবি লালন শাহ ১৭৭২ খ্রীঃ ১৪ ই অক্টোবর (১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১লা কার্তিক) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার অন্তর্গত হরিশপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান এবং মাতার নাম আমিনা খাতুন। হরিশপুর ও তার আশেপাশের গ্রামগুলোতে তখন ধুয়োজারী গানের প্রচলন ছিল। এ গানের গায়েনগণ বয়াতি নামে অভিহিত। সংগীত প্রিয় লালন এই গানে আকৃষ্ট হন। প্রথমে তিনি শ্রোতা ও পরে শিল্পী হিসেবে গানের দলে যোগ দেন।
     গান প্রিয় ঘরছাড়া পাগলা লালনকে সিরাজ আশ্রয় দেন তাঁর বাড়িতে। সিরাজ বেহারা ছিলেন পালকী বাহক। হরিশপুর গ্রামেই  ছিল তাঁর বাড়ি। মূলত পালকী বাহক হলেও তিনি ছিলেন সুফি তত্ত্ব অনুসারী মরমী সাধক বিখ্যাত সুফী শাহ আমানত উল্লাহর ঘরানা অনুসারী দরবেশ আগর মানিক শাহ তাঁর গুরু। সিরাজ লালনকে পালিত পুত্র বলে গ্ৰহণ করেন। লালন ও সিরাজকে পিতা বলে ডাকেন।
    "সবার উপরে মানুষ সত্য" এ প্রাচীন বাণীর সারবস্তু তিনি লাভ করেন গুরুর কাছ থেকে। ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত লালন তাঁর গুরুর সান্নিধ্যে অবিরত সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। পালকী বাহক সিরাজ 'সাধক সিরাজ শাহ 'রূপে, তাঁর অন্তরঙ্গ শিষ্য এবং পালিত পুত্র লালনও 'সাধক লালন শাহ' পরিচিত হন।
     বাংলাদেশ - ভারতের বহু তীর্থ ক্ষেত্রে তিনি গিয়েছিলেন। প্রখ্যাত বৈষ্ণব লীলাভূমি নবদ্বীপ তখন ছিল উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান। বৈষ্ণব সাধকদের আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে লালন পদ্মাবতীর আশ্রমে এসে পৌঁছেলেন। পদ্মাবতী ছিলেন একজন বৈষ্ণব সাধিকা। তিনি পদ্মাবতীকে মা বলে ডাকেন। পদ্মাবতী লালনকে ধর্ম পুত্র বলে গ্ৰহণ করেন। কিন্তু নবদ্বীপের অনুষ্ঠান ভালো না লাগায় তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে ঘুরে ঘুরে রাজশাহীর প্রেমতলীস্থ বিখ্যাত খেতুরীর বৈষ্ণব মেলায় হাজির হন।
     তবে জানা যায়, তরুণ বয়সে লালন তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে পথে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে ফেলে চলে আসে। পরে মলম শাহ ও তাঁর স্ত্রী মতিজানের সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় বসবাস শুরু করেন। মতিজান অতি গুণবতী রমণী ছিলেন। তিনি ছিলেন আখড়ার কর্মী এবং শিষ্যদের গুরু মা।
     লালনের নিজের ধর্মবিশ্বাস কী ছিল তা নিয়ে বির্তক আছে। কেউ তাঁকে হিন্দু, আবার কেউ মুসলিম বলে মনে করেন। কিন্তু লালন এবিষয়ে কিছু বলেননি। তাই তিনি গান বেঁধেছেন, " সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।।" লালনের প্রথম জীবনী রচয়িতা বসন্তকুমার পাল প্রবাসী পত্রিকায় লিখেছেন যে, "সাঁইজি হিন্দু কি মুসলমান, এ কথা আমি স্থির বলিতে অক্ষম।" বাস্তবে হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। জাতপাতের ঘোর বিরোধী লালন কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।
     লালন বিশ্বাস করতেন, সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। সেই মনের মানুষের কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদ নেই। তাই তিনি গান করে বলেন, "মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষেরই সনে।" বা
"আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গান ও দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
     লালন শাহ ছিলেন মূলত তত্ত্বজ্ঞ সাধক। তত্ত্বকথা শ্রবণ, তত্ত্বসার গ্ৰহণ এবং তত্ত্ব বিষয়ক চিন্তাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ আধ্যাত্মা সাধনায় তাঁর হৃদয়ে যে জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছিল, তা প্রকাশ করার জন্য তিনি সুর ও ছন্দ অবলম্বনে করেন। এ কারণেই তাঁকে তাত্ত্বিক কবি বলা হয়েছে। তত্ত্বই যার আসল, কবিত্ব সেই তত্ত্ব কথার বাহন মাত্র। হরিশপুর গ্রাম বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল। সকল শ্রেণীর হিন্দু মুসলমান পরস্পর মিলিতভাবে তারা বসবাস করতেন। সুফী ফকিরদের মধ্যে জহরদ্দীন শাহ, পিজিরদ্দীন শাহ, ফকির লালন শাহের শিষ্য দ্যুদমল্লিক শাহ ইত্যাদি সুফী তত্ত্ববিদ, সাধু ও হিন্দুদের মধ্যে মদন দাস গোস্বামী, যদুনাথ সরকার, হারান চন্দ্র কর্মকার প্রভৃতি সমবেত ভাবে বৈষ্ণবধর্ম ও বেদান্তের সুক্ষ্ম তত্ত্ব, ইসলামের সুউচ্চ তত্ত্ব এবং চৈতন্য চরিতামৃত গ্ৰন্থের বিষয়সমূহ আলোচনা করতেন। প্রায়ই সুফী ফকির ও বৈষ্ণবগণ একসাথে হয়ে সুফী মতবাদ সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতেন। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা  মানে পদ্মাপারের রবি-লালনতীর্থ। জাত-ধর্মের বিরুদ্ধে আজীবন তিনি লড়াই চালিয়েছেন,  পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে লালন চর্চার  প্রাসঙ্গিকতা  আমরা  অস্বীকার  করতে  পারিনা।   

ডঃ সুবীর মণ্ডল,
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ