রহস্যের মায়াজাল ( তের ) - সুজিত বসাক
রাকিব বলতে শুরু করল — এখনো পর্যন্ত যেটুকু পেয়েছি তার সংক্ষিপ্তসার দাঁড়াচ্ছে একরকম … মহারাজা বীরেন্দ্র প্রতাপের ভাই ধীরেন্দ্র প্রতাপ খুন হন দীপঝিলে সাঁতার কাটতে গিয়ে। যদিও ডাক্তারি রিপোর্টে সেটাকে হার্ট অ্যাটাক হিসাবে দেখানো হয়। যে ডাক্তার সেই রিপোর্ট দিয়েছিলেন তারপরই নিরুদ্দেশ হয়ে যান। সম্ভবত প্রচুর টাকা দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে তাকে দিয়ে কাজটা করানো হয়েছিল। তখন সবাই ঘটনাটি একটা অ্যাক্সিডেন্ট হিসাবেই মেনে নেয়। খুনের তত্ত্ব বহুদিন পর ঘটনাচক্রে উঠে এসেছে। তার একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও রয়েছে … হীরুদা। এতদিন সে ভয়ে ব্যাপারটা কাউকে বলেনি। যেহেতু খুনি মুখোশ পড়ে ছিল তাই হীরুদা তাকে চিনতে পারেনি। হীরুদার দেওয়া তথ্য থেকেই জানা যায়, শেষদিকে ধীরেন্দ্র প্রতাপের নেশা হয়ে উঠেছিল রাজবাড়ির লুকানো গুপ্তধনের সন্ধান করা। ধীরেন্দ্র প্রতাপ প্রথম গুপ্তধনের ম্যাপটা দেখতে পান লন্ডনে খেলতে গিয়ে স্মিথসাহেবের বাড়িতে। গোপনে সেটা সে চুরি করে। বাড়িতে ফিরে সেটা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমনকিছুর সন্ধান পান যাতে তার কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। ওটাই তার ধ্যানঞ্জান হয়ে ওঠে। কিন্তু মুশকিল হল ঠিক একই রকমের একটা ম্যাপ এখানে আরও একজনের কাছে ছিল। সেও দীর্ঘদিন ধরে গুপ্তধনের সন্ধান করে যাচ্ছিল। সে চায়নি একাজে তার কোনও দোসর থাকুক। সে মুখোশ পড়ে রাতবিরেতে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন জীবজন্তুর ডাক নকল করতে পারে।
একটু থামল রাকিব। তারপর বলল — যদি কোনো গ্যাপ থাকে ধরিয়ে দেবেন। আপনি আমার চেয়ে আরও বেশি জানেন।
—চেষ্টা করব। লোকটা মৃদু হেসে বলল।
—এদিকে দীপঝিলের ওপারে মৃত্যুবনে দুজন রহস্যময় ব্যক্তি বসবাস করছে। ওদের সাথে মায়া নামের মেয়েটির একটা যোগসূত্র ছিল। ওরাও গুপ্তধনের সন্ধানে জড়িত। সম্ভবত ওদের জোর করে জড়ানো হয়েছে। মায়া আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। নিশ্চয়ই মারাত্মক কোনকিছু জানা ছিল মায়ার। যেটা জানলে অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যেত হয়তো। মায়ার খুন রহস্য আরও জটিল করে দিয়েছে। আমারও কপাল খারাপ, সেদিন যদি মুখোশধারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারতাম তাহলে হয়তো … কী আর করা যাবে! যাইহোক, ধীরেন্দ্র প্রতাপের ম্যাপটা ঘেঁটেঘুটে যেটুকু বুঝেছি তাতে ওই ম্যাপে গুপ্তধনের কোনও হদিস নেই। হীরুদার তথ্য অনুযায়ী মহারাজার বাবা তেজেন্দ্র প্রতাপ নিজের হাতে আসল ম্যাপের দুটো কপি করেছিলেন। একটা পাঠিয়ে দেন অ্যালান স্মিথের কাছে, যেটা পরে চলে আসে ধীরেন্দ্র প্রতাপের কাছে, বর্তমানে অবশ্য আমার কাছে রয়েছে। অন্যটা সম্ভবত ওই মুখোশধারীর কাছে আছে। এমনও হতে পারে আসলটায় সত্যি সত্যি কোনো গুপ্তধনের সন্ধান ছিল। কপি করার সময় তেজেন্দ্র প্রতাপ নিপুণ হাতে সেগুলো বদলে দেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসল ম্যাপটা কী তিনি মরার আগেই নষ্ট করে দিয়েছিলেন? নাকি গোপন কোনও স্থানে লুকিয়ে রেখে গেছেন? আমার কিন্তু সন্দেহ হয়, ওটার ব্যাপারে হীরুদা আরও কিছু জানে। রাজকুমারী শুভ্রাজিতা আবার একটা নতুন তথ্য দিয়েছেন। মায়া রাজকুমারীকে অদ্ভুত রহস্যময় একটা সঙ্কেত বলেছিল। মহাদেবের ত্রিশূল পেলে ত্রিনয়ণ জেগে উঠবে। এই সঙ্কেতের অর্থ কিছুটা বুঝেছি আমি। কিন্তু আরও একটা সূত্র দরকার। সত্যি কথা বলতে, সেটার সন্ধান করতে করতেই এখানে আসা। আপাতত এই পর্যন্ত এসে ঠেকেছি, এবার আপনি বলুন এরপর কীভাবে এগোনো যেতে পারে?
গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক। উস্কোখুস্কো চুল, একমুখ বুনো দাড়ি। চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন পাশের ঘরে। দুটো মগ হাতে করে নিয়ে এসে আবার বসলেন। একটা মগ রাকিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন — এটা খান, ভাল লাগবে। এক ধরনের ফলের জুস, শুধু এখানেই পাবেন।
রাকিব একটু ইতস্তত করছে দেখে মুচকি হেসে বললেন — ইচ্ছে করলে নাও নিতে পারেন, আপনার মর্জি।
রাকিব মগটা কাছে টেনে নিল। উনি খুশি হয়ে বললেন — আপনাকে আমার ভাল লেগেছে। নিঃস্বার্থ মানুষ আমি পছন্দ করি। আমি আশা করি এই সব রহস্যের সমাধান আপনি করতে পারবেন।
রাকিব হাসল— আমি পুলিশ নই, নেহাত ঘটনাচক্রে এই রহস্যের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। চেষ্টা করছি , কতটুকু সফল হতে পারব সময়ই বলবে।
—মানুষের ইচ্ছা শক্তি মারাত্মক এক জিনিস, সব রহস্যই তার কাছে একসময় খুলে যায়। যাকগে, এবার কাজের কথায় আসি। এসবের পেছনে কে আছে বলে আপনার মনে হয়?
—সন্দেহ তো অনেকের ওপরেই হয়। রাজমাতা, শিবনারায়ণ, অম্বরলাল, জীতেন্দ্র প্রতাপ, নরেন্দ্র প্রতাপ…. আমার মনে হয় প্রথমে উদ্দেশ্যটা জানা দরকার।
—একদম ঠিক বলেছেন। সবকিছু ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।
—রাজমাতার উদ্দেশ্য নরেন্দ্র কে সিংহাসনে বসানো। শিবনারায়ণ চান ভাগ্নেকে সামনে রেখে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে। অম্বরলাল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুটো ক্ষমতাই চান। জীতেন্দ্র প্রতাপ ও নরেন্দ্র প্রতাপ দুজনেই অসম্ভব ক্ষমতালিপ্সু। এদের সবার কাছেই গুপ্তধনের সম্পদ কাঙ্ক্ষিত। কারণ সত্যি যদি গুপ্তধন থেকে থাকে তাহলে সেটা এদের আশাপূরণ করতে পারে। সুতরাং এরা গুপ্তধনের পিছনে ছুটবে সেটাই স্বাভাবিক। আপনি কি বলেন?
—আপনার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। আপনার কথা অনুযায়ী আসল ম্যাপটার সন্ধান যদি হীরুর জানা থাকে তাহলে কিন্তু ওর জীবন বিপন্ন হতে পারে।
—সে ভয়টা আমারও করছে। আমি নিশ্চিত, হীরুদাকে ওরা শুধু ভয় দেখানোর জন্য তুলে নিয়ে যায়নি। আচ্ছা, ধীরেন্দ্র প্রতাপের ডাইরিতে একজন সাহেব চরিত্রের উল্লেখ আছে, সে সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা আছে?
একটু সময় ভাবলেন ভদ্রলোক, তারপর চিন্তিত মুখে বললেন — সত্যিকারের সাহেব বলতে এখানে দুটো নাম আসে, এক, অ্যালান স্মিথ, দুই, টনি লুইস।
—টনি লুইস এইমুহুর্তে কোথায় আছেন আপনি জানেন?
—ওর কাজে বিরক্ত হয়ে ওকে আফ্রিকাতে ট্রান্সফার করে দিয়েছিল হাইকম্যান্ড। তারপর আর জানি না।
—আমার অনুমান তিনি এখানেই আছেন, তবে গা ঢাকা দিয়ে।
—আর ইউ সিওর?
—কিছুটা সিওরই বলা যায়। আমি নিজে দেখিনি, তবে যে বলেছে সে মিথ্যে বলবে না।
—তাই যদি হয় তাহলে সেটা কিন্তু ভাল খবর নয়। লুইস অসম্ভব ধূর্ত আর লোভী। নিশ্চয়ই ওর কোনো বড় টার্গেট আছে।
—আপনি ঠিকই বলেছেন। আরও অবাক করে দেওয়ার মতো খবর আছে। নরেন্দ্র প্রতাপের সাথে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হয় লুইসের। মনে হচ্ছে চক্রান্তের জাল অনেক দূর বিস্তৃত। কে জানে আপনি যে এখানে আত্মগোপন করে আছেন সেটাও হয়তো কারো কারো অজানা নয়।
—হুঁ, ভয়েরই ব্যাপার। এসব খবর আপনাকে কে দিয়েছে?
—অবিনাশ।
—অবিনাশটা কে?
—মৃত্যুবনে যে দুজন রহস্যময় ব্যক্তি রয়েছে তাদেরই একজন। ওদেরকে আবার একজন ব্ল্যাকমেল করছে।
—কে?
—অম্বরলাল।
—কেন?
—সে অন্য এক কাহিনী। অন্য এক সময় বলব। অম্বরলাল ওদের এক দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওদেরকে জোর করে গুপ্তধনের সন্ধানে নামিয়েছে। ওরা নিরূপায়, অম্বরলাল যা বলছে তাই করতে হচ্ছে। আমরা পাতালপুরীতে আটকা পড়লে ওই অবিনাশই আমাদের উদ্ধার করেছিল। তখনই বলেছে এসব।
—আপনি মৃত্যুবনে গিয়েছিলেন?
—রহস্যের টানেই যেতে হয়েছিল। গিয়ে কত যে অভিজ্ঞতা হল! মানুষের কত রূপ! সময় আসুক সব বলব। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন।
চুপ করে গেলেন সামনের ভদ্রলোক। অন্যমনস্ক ভাবে কী যেন ভাবলেন। জানালা দিয়ে গভীর বনানীর দিকে তাকিয়ে বললেন — সেদিনের আমাদের সেলফমেড নাটকটা বোধহয় কিছুটা হলেও কাজে দিয়েছে রাকিব। ওরা হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছে। এতে আপনি কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন।
রাকিব হাসল — তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন স্মিথসাহেব। তাছাড়া তো কোনো উপায়ও ছিল না। আপনার সাথে বিচ্ছেদটা জরুরি ছিল। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ওদের চোখে ধুলো দেওয়া গেছে। আপনি এই বাড়ির সন্ধান পেলেন কী করে?
অ্যালান স্মিথ হেসে বললেন — কারণ আমার বাবা উইলিয়াম স্মিথ এটা তৈরি করেছিলেন। আপনি হয়তো জানেন না, আমার বাবা ও মহারাজা তেজেন্দ্রপ্রতাপ প্রাণের বন্ধু ছিলেন। দুজনেই শিকার করতে ভালবাসতেন। এই পাহাড়, জঙ্গল, নদীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন আমার বাবা। লোকালয় থেকে বহুদূরে এই গভীর জঙ্গলে স্থানীয় উপজাতির মানুষের সহায়তা নিয়ে তৈরি করেছিলেন এই বাংলো, একসময় যার নাম ছিল স্মিথ ম্যানসন। দিনের পর দিন এখানে কাটাতেন। বাইরের লোক এই বাড়ির কথা সেভাবে জানত না। আমিও না। মারা যাবার কিছুদিন আগে বাবা আমাকে এই বাংলোর কথা বলে যান। সেই সঙ্গে বিরাট একটা দায়িত্বও দিয়ে যান। কিন্তু যেভাবে ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে পড়ছে তাতে এখন রীতিমতো ভয় হচ্ছে, শেষপর্যন্ত বাবার দেওয়া দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করতে পারব তো?
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো স্মিথসাহেবের অন্তস্থল থেকে। রাকিব সান্তনা দিয়ে বলল — হতাশ হবেন না মিস্টার স্মিথ। সত্যের পথ কঠিন, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য। আপনি সত্য পথে থাকলে, তা একদিন প্রকাশিত হবেই।
—আপনাকে দেখে আমার আশাটা বাড়ছে। যদি সফল হতে পারি চিরকাল আপনার কথা মনে থাকবে।
—এইমুহূর্তে আমরা এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে। ওরা বেপরোয়া খুনি। সুতরাং বড় ধরনের প্রত্যাঘাতের জন্য তৈরি থাকুন। একটা সময় আমাদের নাটক ঠিক ধরে ফেলবে। আপনি এখানে আরও কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকুন। ওদিকের খবর আমি রিংলুর মারফত পাঠিয়ে যাব। রিংলু পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য তো?
—অবশ্যই। ওর দাদু বাবার সঙ্গী ছিল। উপজাতির লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে জানে না। আপনি এখানে এসেছেন কেউ জানে না তো?
—না না, কাউকে বলিনি। এমনকি রাজকুমারীকেও জানাইনি। কোনওরকম ঝুঁকি আমি নিতে চাইনি। সতর্ক থাকাটাও এখন আমাদের একটা জরুরি অস্ত্র। তবে আপনার সাথে দেখা পাব কিনা সেটা নিয়ে একটু সংশয় ছিল। কারণ জায়গাটা সম্পূর্ণ অচেনা অজানা। রিংলু অবশ্য এত সুন্দর করে ডিরেকশন দিয়েছিল, কোন অসুবিধা হয়নি। আচ্ছা, এবার তবে উঠি, দিনে দিনে পৌঁছুতে না পারলে ওদিকে আবার অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগবে যেটা কাম্য নয়।
উঠে দাঁড়াল রাকিব। উঠে দাঁড়ালেন অ্যালান স্মিথ। রাকিবকে স্মিথ ম্যানসনের সদর গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন — সাবধানে যাবেন।
এই সময় রাকিবের নজর গেল স্মিথ ম্যানসনের পিছন দিকটাতে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখতে লাগল। স্মিথ সাহেব কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
আপন মনেই স্বর্গতোক্তি করল রাকিব — আপনার বাবা হঠাৎ এই গহন বনে একটা বাড়ি বানাতে গেলেন কেন, এ প্রশ্ন কখনো আপনার মনে জাগেনি মিঃ স্মিথ?
অ্যালান স্মিথ অবাক হয়ে বললেন — না তো …।
রাকিব মৃদু হেসে বলল — একজন খ্রীস্টানের বাড়িতে শিবের ত্রিশূল … একটু বেমানান লাগেনি আপনার? আপনার বাবা শিবভক্ত ছিলেন?
অ্যালান স্মিথ কোন উত্তর দিতে পারলেন না প্রথমে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন রাকিবের দিকে। একটু পরে বিস্ময় মাখা গলায় বললেন — ঠিক বুঝলাম না। সেভাবে নজর করে তো দেখিনি সব। কী দেখলেন একটু খুলে বলুন তো।
রাকিব চিন্তিত মুখে বলল — এই বাড়ি কোনও সাধারণ বাড়ি নয় স্মিথসাহেব। মনে হয় খুব শিগগিরই এই বাড়িতে আবার আসতে হবে আমাকে।
সুজিত বসাক। পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
16-01-2021
-
-