অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
একটি বিচিত্র মৎস্য শিকারের কাহিনী – চিরঞ্জীব সরকার

বহমান বাংলার আর দশটা গ্রামের মত আমাদের গ্রামটাও ছিল ছায়া সুনিবির শান্তির নীড়। আক্ষরিক অর্থেই তখন পাখির ডাকে ঘুমিয়ে  পাখির কলককলিতেই ঘুম থেকে জেগে উঠতে হত। যান্ত্রিক যানের চলাচলের কারনে  গ্রামের সে শান্তভাব এখন অনেকটা বিদায় নিলেও জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি, জলসিঁড়ির মত এখানে এখনোও টিকে আছে রুপালী নদী,ছোট খালের কিনারের কাদায় সাদা বকের আনাগোনা,ছোট মাছ ধরার জন্য বৃক্ষডালে প্রতিক্ষারত মাছরাঙ্গা, ঠক্ ঠক্ শব্দে নিভৃতে গাছে গর্ত করতে ব্যস্ত কাঠঠোকরা। জীবনের প্রথম ষোলটা বছর কেটেছিল খালে পুকুরে ঝাপ দিয়ে,জল কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে,কলমি শাপলা আর জঙ্গলে ফুটে থাকা ভাট ফুলের একান্ত সান্নিধ্যে। ডোবা জলাশয়ের ঝোপের কাছে দেখতাম চিকন রঙ্গীন পায়ের ছোট্ট ডাহুকের নিঃশব্দ পদচারনা আর রাতের অন্ধকারে জোনাকীর টিপটিপ করা আলোর ঝলক। সে সময়টা ছিল শীতের কুয়াশার চাদরকে ভেদ করা নব প্রভাতের সূর্যোদয়,শিশির কনায় সিক্ত দূর্বাদলে খালি পায়ে পদচারনা, আমের মুকুলের মাদক করা ঘ্রানে চৈত্রের দুপুরের অলস সময়ের সাগরে বনচারী জীবনের এক বর্নিল অবগাহন।

পুকুরে, দিঘীতে ফুটে থাকত লাল ও শ্বেত বর্নের শাপলা ফুল। কলমিদামের চাদরে ঢাকা থাকত অযত্নে থাকা পুকুরগুলি। কলমিফুলগুলি যখন ফুটত তখন মনে হত মজা জলাশয়গুলি যেন বলছে তোমরা আমাদের দিকে না তাঁকালেও আমাদের বুকতো শূন্য করে রাখেনি প্রকৃতি,তাইতো সে কত যত্ন করে ফুলে ফুলে আমাদের সাজিয়ে রেখেছে। পুকুর,দিঘী,খাল,নদী যেখানেই তাঁকাতাম সেখানেই দেখতাম কত বিচিত্র কায়দায় মৎস্য শিকারের আয়োজন।কেউ মাছ ধরছে বড়শি দিয়ে,কেউবা জালে।শীতকালে আবার পানি সেচে মাছ ধরার কাজটি করা হত। আবার অনেকে মাছ ধরত চাঁই পেতে।ছোট ছোট চিংড়ি মাছ ধরত অনেকে ছাবি পেতে। খালে দেখতাম গাছের ডালপালা ফেলে ‘জাইল’ নামক এক ধরনের বিশেষ পদ্ধতিতে মাসে একবার বা দুবার মহা উৎসাহে মৎস্য ধরার পর্ব। কেউ কেউ আবার লোহার কাঁটা দিয়ে তৈরী কোচ দিয়ে মসলী নিধন করত। নদীতেতো আর কোন কথাই নেই। ছোট ছোট অসংখ্য নৌকায় শত শত জাল প্রতীক্ষারত কখন এসে ধরা দেবে সে মহাআরাধ্য ইলিশ। তবে আমার দেখামতে মাঝেমাঝে কিছু বড় ইলিশ এসমস্ত জালে ধরা পড়লেও বৃহদাংশই হল জাটকা বা ছোট ইলিশ।গৃহ থেকে দুপা ফেলে এহেন মৎস্য আহরনের বিশাল যজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে অনুধাবন করি সেই প্রবাদের কথা  মৎস্য ধরে সুখে থাকা। হতভাগা মাছকে মনে হয় বৃক্ষ ছাড়া অন্য সকল প্রানীরই এক পরম উপাদেয় খাদ্য।

আমারও ছিল কয়েকটা বড়শি।একটা দিয়ে ধরতাম পুটি মাছ। আর একটা দিয়ে সেই পুটি মাছ বড়শিতে গেঁথে শোল বা গজার মাছ ধরার জন্য পেতে রাখতাম। অন্য আরেকটা বড়শি ছিল যেটাকে আমাদের এখানে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পাতা বড়শি। এটাতে কেঁচো দিয়ে গেঁথে ধানের ক্ষেত যখন পানিতে পরিপূর্ন থাকে তখন বিকেলের দিকে জমিতে পুতে রেখে চলে আসলেই হল। সকালে ভাগ্য ভাল থাকলে দেখা মিলতে পারে একটি প্রমান সাইজের বেলে,কই বা বাইম মাছের। যদিও কেঁচো ধরাটা খুব একটা সুখকর কাজ নহে এবং এটা হাত দিয়ে ধরতেও একটা মারাত্মক অস্বস্তি কাজ করত তবুও কিশোর বয়সের উত্তেজনায় এহেন কর্ম থেকে বিরত হতাম না। সে সময়ের আরও কিছু কাজ যেমন ঝোপ ঝাড়ের চারিদিকে নেট পেতে গাছের ডাল দিয়ে ওগুলিকে পিটিয়ে ডাহুক ধরা, দল বেধে প্রতি বর্ষাকালে শৃগাল ধরার কাজে সামিল হওয়ার  কর্মগুলি একেবারেই সঠিক ছিল না। কিন্তু এ কথাও সত্য সে সময়ে গ্রামে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে কোনরকম সচেতনতা ছিল না। এখন কম বেশি সবাই মোটমুটি পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে অনেকটাই সচেতন।

শোল মাছ যখন পুটি খেতে ছোঁ মারত তখন কখনো কখনো বড়শিতে ধরা খেত। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দেখা যেত পুটি মাছ নিয়ে সে পানিতে বেশ আলোড়ন সৃস্টি করে উধাও। এক্ষেত্রে বেশ কষ্ট লাগত। প্রথমত পুটি মাছটা ধরতেও তো এনার্জি ব্যয় হয়েছে। মাছ তো পাওয়া গেল না উল্টো বড়শির মাছটাও লাপাত্তা। এযেন আম ছালা দুটিই হারানো। মাছ না উঠা একটা ভিন্ন বিষয় কিন্তু খোট দিয়ে উঠতে উঠতেও যদি ধরতে না পারা যায় সেটা অধিক কষ্টদায়ক। তাইতো বলে না পাওয়ায় বেদনা আছে তবে পেয়ে হারনোর বেদনা অধিকতর। বড় শোল মাছ অনেক সময় সুতা ছিড়ে  পুটিমাছ বড়শিসহ নিয়ে চলে যেত। ট্রিপল লচের এ বেদনা বড়ই ম্যাসিভ।

যাক্ একদিন বাড়ির সামনের বড় পুকুরে ছিপ নিয়ে বড়শিতে পুটি মাছ গেঁথে ছিপটা পারে মাটিতে ঢুকিয়ে পানিতে বড়শিটি রাখলাম। সুতার বড়শিতে পিঠে গাঁথা পুটি মাছটি পানিতে নির্দিষ্ট গন্ডির ভিতর  এদিক ওদিক নড়াচড়া করছিল। এদিকে আমি বড়শিটা রেখে বাগানে হাটাহাটি করছিলাম। একটা বড়শির সামনে দীর্ঘক্ষন বসে থাকা এটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। তারচেয়ে বরং এদিক ওদিক হাটলে দুএকটা গাছের ফল বা মাটিতে বাদুরে খাওয়া কাঠবাদাম পাওয়া যেতে পারে। দিনের বেলা ছোট খেজুর গাছের মাথার দিকের কাটা অংশ যেখান থেকে হাড়িতে রস সংগ্রহ করা হয় সারা রাত্র ধরে সেখান থেকে ফোটায় ফোটায় পড়া রসও হাতের তালুতে করে খেয়ে কত সোনালী দুপুর পেরিয়ে এসে এখন ফোরজি ফাইভজির জীবন অতিবাহিত করছি। সেদিন হঠাৎ শুনতে পেলাম পুকুরে খুব আলোড়ন। পানিতে কি যেন ছটফট করছে। আমি ভাবছিলাম বড়শিতে হয়ত বড় কোন মাছ বিঁধেছে। দৌড়ে ছুটে এলাম ছিপের কাছে। দেখি মাছের বদল বড় একটি ঈগল বেঁধেছে বড়শিতে।পুটি মাছে ছোঁ মারতে গিয়ে বড়শিতে ওর গলা বিঁধে গেছে। ঝপ্ঝপ্ করে ও পুকুরের পানিতে ডানা পিটাচ্ছিল। লোকজন জড়ো হতে খুব একটা সময় লাগল না। একজন এসে ঈগলটির মুখ থেকে বড়শি ছাড়িয়ে পাখিটিকে নিয়ে চলে গেল। গ্রামবাসীরা বলাবলি শুরু করল পাখিটি হয়ত সে খেয়েছে। আবার অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করল না। একটা রহস্য থেকেই গেল সেদিন পাখিটির পরিনামে কি ঘটেছিল।

চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা