ফ্লিইং ফ্রম ফ্লেমিঙ্গো – চিরঞ্জীব সরকার
পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়াতে আমি ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিন বছর ছিলাম। আমার অবস্থান ছিল নাইরোবীতে। কিন্তু যাযাবর মন বারবার ছুটে যেত দেশটির বিশাল খোলা আকাশের নীচে দিগন্তছোঁয়া তৃনভূমিতে মাথা নীচু করে তৃনলতা চিবানো জেব্রদলে কিংবা দীর্ঘ গলার মাথা উঁচু করে কন্টকযুক্ত বৃক্ষে ভক্ষনরত লম্বাপায়ের জিরাফগুলির দিকে। কেনিয়া নামক এ দেশটিতে রয়েছে বিশাল কতগুলি লেক যেমন লেক ভিক্টোরিয়া, লেক নাইভাসা এবং লেক নাকুরু। লেক নাকুরু বিখ্যাত ফ্লেমিঙ্গো দর্শনের জন্য। নাকুরু লেকের স্বচ্ছ পানিতে লাল সাদার এ ফ্লেমিঙ্গোর ঝাঁক এক অপূর্ব সৌন্দর্যের অবতারনা ঘটায়। এর আগে দেখেছিলাম লেক নাইভাসায় জলহস্তী পরিবারের অবাধ বিচরন ও লেক ভিক্টোরিয়ার বিপুল জলরাশির সদম্ভ প্রবাহ। লেক নাকুরুর নয়নাভিরাম ঝাঁকে ঝাঁকে ফ্লেমিঙ্গো নামক বিহঙ্গকুলকে দর্শন নিমিত্তে কোন এক সকালে গাড়ি নামক যান্ত্রিক যানে চেপে সপরিবারে নাকুরুর দিকে যাত্রা শুরু করি।
নাইরোবীকে মোটামুটি চিরবসন্তের শহর বলা চলে। যখন বড় বড় জ্যাকারান্ডা বৃক্ষগুলি নীল নীল ফুলে ছেয়ে যায় তখন মনে হয় স্বর্গের নন্দনকানন কোন এক অভিলাষে এখানে ক্ষনিকের তরে বেড়াতে এসেছে। ঘন্টাদেড়েক গাড়ি চলার পর আমরা থামলাম রাস্তার পাশে কিছুটা বিশ্রাম ও একিসাথে গ্রেট রিফট্ ভ্যালিকে অবলোকনের আশায়। এ যেন রথ দেখার সাথে সাথে কলা বেচার পর্বটাও সেরে ফেলা। প্রকৃতির এক অবাক বিস্ময় এ গ্রেট রিফট্ ভ্যালি। সুদূর এশিয়ার লেবানন থেকে শুরু হয়ে আফ্রিকার মোজাম্বিক পর্যন্ত এর বিস্তার। নীচের সমতলকে অনেক নীচুতে রেখে মেঘরাশির ভেলা আকাশগঙ্গায় ভেসে চলেছে। কখনো বা এ মেঘরাশি আলিঙ্গন করে যাচ্ছে পাহাড়কে। এখানের রেলিং-এ হেলান দিয়ে অবাক বিস্ময়ে যখন রিফট্ ভ্যালির বিশাল প্রান্তরকে প্রত্যক্ষ করছিলাম তখন দেখলাম ছোট্ট একটি ছেলে কাগজের কার্টনে করে কালো কুচকুচে দুটি খরগোশের বাচ্চা নিয়ে আমার ছেলেমেয়েদের কাছে হাজির। খরগোশের বাচ্চাদুটি খুবই কিউট,একেবারে চিক্চিক্ করছে। আমার কেনার ইচ্ছে ছিল না কারন বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। কোন প্রানীকে তাঁর সহজাত আবাস থেকে তুলে অন্য একটা স্থানে রেখে যতই আরাম আয়েসের ব্যাবস্থা করা হোক না কেন আসলে ওটা ওদের জন্য কারাবাস ছাড়া আর কিছুই নহে। অবশ্য দুএকটা প্রানী যেমন কুকুর বা বেড়াল বহুদিন ধরে মানুষের একেবারে সান্নিধ্যে থাকার ফলে গৃহে থাকতেই মনে হয় বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশে কুকর বেড়ালের জীবনযাত্রা দেখলে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটা সুপারস্টোরে পেট্স সেকশনে কত কিছুর আয়োজন সাজিয়ে রাখা হয়েছে এসমস্ত গৃহপালিত প্রানীদের জন্য। সাবান, সুগন্ধী, বিছানা, খাদ্য কোন জিনিসের অভাব নেই এহেন সারমেয়দের জন্য।
আমার মেয়ে ফিজি বহুদিন থেকেই প্যানপ্যান করছিল তাঁকে যেন একটা কুকুরছানা কিনে দেয়া হয়। পেট্ পালনের নানাবিধ প্রতিকূলতা সম্বন্ধে বিবিধ লেকচার দিয়ে প্রতিবারই আমি বিষয়টি এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আজকে আমি ত্রিমুখী আক্রমনের সন্মুখীন হলাম। ছেলেমেয়ে দুজন ও খরগোশের মালিক ছোট্ট সে ছেলেটি একসাথে আমাকে ঘিরে ধরল। ছেলেমেয়েদের অভিব্যক্তি অনেকটা রকম, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমাদের খরগোস দুটি চাই আর বিক্রেতা বালকটি যেন বলতে চাচ্ছে, জেন্টেলম্যান ইটস্ নট এ বিগ ডিল, হোয়াই আর ইউ ডিপ্রাইভিং মি অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ ইওর কিডস্ ঠু। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা লেখায় পড়েছিলাম একবার তাঁর কন্যারা কিসের জন্য যেন তাঁদের বাবার কাছে আবদার করেছিল। তিনি তাঁর কন্যাদের সে আবদার পূরন করেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে তাঁর ছেলেমেয়েদের ছোটখাট চাওয়া পাওয়া যা তাঁর সাধ্যের মধ্যে তা তিনি সবসময় মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করেন কারন আগামী দিনগুলিতে এরা কোথায় কি অবস্থায় থাকবে তা তো তিনি এখন জানেন না। তখন যাতে কোন অনুতাপ করতে না হয় তাই ওদের বায়নাগুলো সে বাস্তবায়ন করার যথাসাধ্য্য চেষ্টা করেন কেননা বাবা হিসাবে ওদের মুখে হাসি ফোঁটাবার তিনি তো এখন সুযোগ পাচ্ছেন। দুশত কেনিয়ান শিলিং দিয়ে খরগোশ দুটি কিনে নাকুরুর দিকে আবার রওহনা হলাম। খরগোশ দুটি পেয়ে ওরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। গাড়ির ভিতরই বুম্বে ও কিয়ারা নামে ওদের নামকরন করা হল। কিন্তু এটি কোন ভাষার নাম তা বুঝতে পারলাম না। বুম্বে হয়ত বুঝলাম বম্ব বা বোম্বাই থেকে আসতে পারে কিন্তু কিয়ারার বুৎপত্তি আমি ভেবে পেলাম না।
ঘন্টা চারেক পর আমরা পৌঁছলাম লেক নাকুরুর একটা পারে যেখানে রয়েছে বড় বড় সাইজের প্রস্তরখন্ড এবং বেশ কিছু বিশাল বৃক্ষ। এসকল বৃক্ষের শাখাতে দেখলাম সুঠামদেহী অনেক শাখামৃগ বা বানর। বেশ কিছু পর্যটক জড়ো হয়েছে এ জায়গাটায়। বানরগুলিকে দেখলাম ফ্রিস্টাইলে এসে পর্যটকদের যাদের হাতে পলিথিনের ব্যাগে খাবার আছে তা ব্যাগ থেকে বের করে ওদেরকে দিতে একটু বিলম্ব বা ইতস্তত করছে তাঁদের কাছে এসে বিশাল দেহ নিয়ে সন্মুখে ঝাঁপ দিয়ে বা হেটে এসে টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতো মনে হচ্ছে এখানে রিয়েল জঙ্গলরাজ চলছে। যাদের কাছ থেকে এরকম খাবারের ব্যাগ বানর কর্তৃক ছিনতাই হচ্ছে তাঁদের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অনেকটা এরকম। আসলে গাইড ছাড়া অচেনা জায়গায় ভ্রমনে অনেক সময় নানাবিধ বিচিত্র পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হয়। আমার কাছেও একটা খাবারের পলিথিন ব্যাগ ছিল।সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি আগেই একটা বড় বোল্ডারের উপর পলিথিনের প্যাকেটটি রাখলাম যাতে বানরদের আর আমাদের দিকে ধেয়ে এসে ওটি টান দিয়ে নিয়ে যেতে না হয়। বানররা মনে হয় বেশ খুশিই হল। ব্যাগটির ভিতরের খাবার মহাতৃপ্তির সাথে খাচ্ছিল। আমিও অযাচিত ঝামেলা থেকে বাঁচলাম । কোন কারনে যদি বন্য প্রানীর নখের খোঁচা বা কামড় খেতে হয় তাহলে তো আবার ইনজেকশনের চক্করে পড়তে হবে। আগে শুনেছি যারা কুকুরের কামড়ের শিকার হয় তাঁদের নাকি চৌদ্দটি ইনজেকশন দিতে হত তলপেটে নাভির চারদিকে।
আমরা লেকটার যে দিকটায় আছি সেদিকে কোন ফ্লেমিঙ্গো দেখতে পেলাম না। ফ্লেমিঙ্গোর ঝাঁক দেখা যাচ্ছে বিশাল লেকটির অন্য প্রান্তে অনেক দূরে। গাড়িতে উঠে ওদিকটাতেই রওহনা হলাম কারন মেলা দেখতে এসে যদি হাওয়াই মিঠাই না খাওয়া হল তবে আর মেলায় যাওয়ার তাৎপর্য কি রইল। লেকের ও প্রান্তটায় যেতে কোন রাস্তা নেই। পাথুরে তৃনভূমিতে গাড়ির চাকা একটু একটু করে এগোতে লাগল। যখন প্রায় লেকটার কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম যে দিকটায় ফ্লেমিঙ্গো নামক বিহঙ্গকুল জলে অবগাহনরত তখন দেখি কয়েকশ বুনো মহিষ এখানে বসে বিশ্রামরত অবস্থায় আছে। আমাদের ওদের টেরিটরিতে আগমন মনে হয় মহিষকুলের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। আমরা একে একে গাড়ি থেকে নামলাম। আর কিছুটা পদব্রজে অগ্রসর হলেই ফ্লেমিঙ্গো দর্শন। কিন্তু এমন সময় বিশ্রামরত মহিষকুলের চেতনায় কি ভাব যেন জাগ্রত হল। মহিষগুলি সবাই দাঁড়িয়ে এক দৃ্ষ্টিতে আমাদের দিকে তাঁকিয়ে থাকল। ওদের মাথার শিংগুলি এতটাই বিশাল সাইজের যে মাত্র একটা মহিষই গাড়িসহ আমাদের ভবের লীলা সাঙ্গ করার জন্য যথেষ্ট। এরকম শত শত বন্য আফ্রিকান মহিষের সামনে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পরোক্ষ অর্থ হল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য অপেক্ষা করা। আমি একবার একজন শিক্ষিত মাসাই ট্রাইবের কেনিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন জন্তু সবচেয়ে বেশি মানুষকে আক্রমন করে তাঁদের ওখানে। আমি ভেবেছিলাম তাঁর উত্তর হবে সিংহ বা হায়েনা। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে জানাল যে প্রানীটির নাম সেটা হল দলছুট অথবা বয়স্ক মহিষ।
সময় নষ্ট না করে গাড়িতে উঠে চালককে বললাম এখনি সর্বোচ্চ বেগে পালাতে। একটু এদিক ওদিক হলে সাধের এ জীবন নাকুরুর বুনো মহিষেরা না করে দিবে। মাত্র চার পাঁচ হাত দূরে এরা দাঁড়িয়ে। একটা যদি এসে গাড়ির সামনে দাঁড়ায় তাহলে সবাইকে হয়ত ছবি হয়ে যেতে হবে। সেবার আর কাছ থেকে সখের ফ্লেমিঙ্গো দর্শন হল না, ভীতিকর মহিষ দর্শন শেষে কোন রকমে পলায়ন করে প্রানটুকু নিয়ে নাইরোবীতে প্রত্যাবর্তন করি।
চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা
-
গ্রন্থালোচনা // ভ্রমণ
-
02-03-2021
-
-