অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আন্তর্জাতিক নারী দিবস। একটি পর্যালোচনা.. - মো: রবিউল আলম

নারী মানে মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, দাদী, নানী, চাচী, খালা, মামী, বান্ধবী ইত্যাদি পরম মমতাময় এবং জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের নাম। প্রত্যেকেই জন্মের আগে অজানা পৃথিবী মাতৃগর্ভে থেকেই এ নারীর সাথে সম্পর্কিত। নারীদের সংস্পর্শ ছাড়া পুরুষত্ব এবং পিতৃত্বের সাধ গ্রহন করা অসম্ভব। এই পুরুষত্ব দেখাতে গিয়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই  নারী কে অপমান অপদস্ত করি যা মোটেই শুভনীয় নয়।

আমরা যেহেতু মানুষ তাহলে নারীদেরকে আলাদাভাবে দিবস পালন করতে হবে কেন? আপনারা খেয়াল করে দেখবেন যে যতগুলো দিবস পুরো বছর ধরে পালিত হয় তা সমাজে অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় সম্পর্কিত কিংবা বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্ঠির লক্ষ্যে প্রচারণা করা। যেমন আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস, মা দিবস, বিশ্ব জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ দিবস, আন্তর্জাতিক শিশুপাঠ্য দিবস, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ইত্যাদি। সকল ক্ষেত্রে হয়তো অধিকার আদায় নতুবা সামাজিক বিষয়গুলোতে সচেতনতা সৃষ্টি করা এর মূল লক্ষ্য থাকে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস এর লক্ষ্য একই। অধিকার আদায়। আমরা পুরুষরা যুগযুগ ধরে তাদের অধিকার ও যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান দেই না বলেই এ দিবস পালিত। নারী দিবসের লক্ষ্য হিসেবে কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি বেশি গুরুত্ব পায়। এবার জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতিপাদ্য  হিসেবে বলা হয়েছে করোনাকালে নারী নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব এবং যথার্থই এ দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বনাম ছিলো আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস। এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদকজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়ঃ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে (সুত্র https://bn.m.wikipedia.org/wiki)

কিন্তু আজও এই আধুনিক বিশ্বে মজুরী বৈষম্য রয়েই গেছে। এর জলন্ত প্রমান হিসেবে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সংবাদ প্রতিষ্ঠান বিবিসি এর মজুরী বৈষম্যের কথা বলতে পারি। ২০১৭ সালে বিবিসি এর বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে পুরুষ কর্মীর চেয়ে মহিলা কর্মী সমান অবস্হানে কাজ করার পরও কম বেতন পাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে ক্রিস ইভান্সের বেতন ছিলো বার্ষিক ২ মিলিয়ন পাউন্ড থেকে ২.২ মিলিয়ন পাউন্ড অপরদিকে ক্লাউডিয়া উইনকলম্যান এর বেতন ছিলো বার্ষিক  ৪শ ৫০ হাজার থেকে ৫০০ হাজার পাউন্ড। আমাদের দেশে ও এরকম বৈষম্য রয়েছে এবং তার নিরসন খুবই জরুরী। সমপরিমান কাজ করার পরও শুধু শারিরীক গঠনের জন্য কম পারিশ্রামিক প্রদান মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়। কর্মক্ষেত্রে আমরা নারীদের সম অধিকার, সম্মান ও পারিশ্রামিক দিলেই তবেই পূর্ণ হবে নারীর অধিকার।

আবার নারীদের সম্মান ও মর্যাদা যেমন পুরুষকে দিতে হবে, তেমনি নারীদেরকে ও একে অপরের প্রতি যথাযথ সম্মান দিতে হবে। যেমন ধরুন বউ আর শাশুড়ির সম্পর্ক। আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখি পরিবারগুলোতে শাশুড়ি বউদের উপর দখলদারিত্বের মনোভাব নিয়ে শাসন করা কে অত্যাচারের পর্যায়ে নিয়ে যান। অপরদিকে আধুনিকতার ছোয়ায় অনেকেই একক পরিবার গঠন করে শাশুড়িদেরকে উটকু ঝামেলা মনে করেন। তারা আবার নিজের মা কে অন্য রকম আদর ভালবাসা দিয়ে রাখেন। ভুলে যান তিনি ও একদিন শাশুড়ি হবেন। তাই নারী পুরুষ সকলেই যার যার অবস্হান থেকে একে অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

নারী স্বাধীনতা বা অধিকার মানে এই নয় যে, নারীদের ছোট পোষাক পড়ে ঘুরে বেড়ানো, যৌন আবেদন সৃষ্ঠি করার ভঙ্গিতে চলা, মুক্তমনে সিগারেট খাওয়া। এগুলো অপসংস্কৃতির বহি:প্রকাশ বটে। নিজের শালীনতা রক্ষা করে স্বাধীনভাবে চলা,  মত প্রকাশের অধিকার থাকা, সিদ্ধান্ত গ্রহনের সুযোগ থাকা, সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে সমভাবে যোগ্যতানুসারে ভুমিকা পালন করা  এসব নারী স্বাধীনতার উদাহরণ। এখন কিন্তু এসব বিষয় গুলো আমাদের দেশে শুরু হয়েছে, নারীদের অধিকার রক্ষা  ও উন্নয়নে বিভিন্ন ইতিবাচক কর্মসুচী গ্রহন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তারপরও এসব বাস্তবায়নে মূল প্রতিবন্ধকতা হলো আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীদের নিয়ে সামাজিক কু দৃষ্টিভঙ্গি যেদিন পরিবর্তিত হয়ে সুদৃষ্টিতে দেখা হবে সেদিন হবে যথাযথ মূল্যায়ন। আমাদের সমাজ কে পুরুষশাসিত সমাজ থেকে মুক্ত করে সমাজের সকলকে নিয়ে সুস্হধারার ভারসাম্যপূর্ন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। আর এ জন্য নরনারীকে একই সাথে একে অপরের সহযোগি হিসেবে কাজ করতে হবে।

নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছেন “তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো” এতেই বুঝা যায় একজন শিক্ষিত নারী জাতি গঠনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। আমাদের দেশে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ ও এর বেশি বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষার হার দাঁড়িয়েছে ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশে। এর মধ্যে পুরুষদের মধ্যে শিক্ষার হার ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৭১ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়ভাবে শিক্ষার হার ছিল ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ। এ হিসাবে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষার হার বেড়েছে। সাত বছর ও এর বেশি বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে সাক্ষরতার হার গড় ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে এ অংশের সাক্ষরতার হার ছিল ৭২ দশমিক ৩ বছর। সুত্র(নাসরিন জামান | উইমেননিউজ২৪) কিন্তু সেই তুলনায় ৮০’র দশকে নারী শিক্ষার হার ছিলো ন্যূনতম। নি:সন্দেহে অগ্রগতি হয়েছে। নারীদের অধিকার রক্ষায় সরকার নারী ও শিশু মন্ত্রনালয় গঠন সহ বিভিন্ন কর্মসুচী গ্রহন ও আইন প্রনয়ন করেছে।

আসুন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন, প্রতিহিংসাপরায়ণ বন্ধ করা, অহেতুক নারীদেরকে নির্য়াতন করা বন্ধ করে, সমাজে তাদের প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান দিয়ে নারীদের অধিকারের সঠিক বাস্তবায়ন হোক আজকের নারী দিবসের অঙ্গীকার। পরিশেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কিছু লাইন দিয়ে শেষ করছি-   

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।

মো: রবিউল আলম
এম.এস.এস। সমাজকর্ম বিভাগ। ৫ম ব্যাচ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট