অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
একটি ঝুলন্ত বৃক্ষডাল ও একজন সিন্ধুতাই - চিরঞ্জীব সরকার

     কোন একটি বিশেষ ঘটনা বা দৃশ্যপট একটা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। আমরা অনেকেই এ গল্পটা জানি। একবার এক লোকের জুতা ছিলনা বলে নিজেকে খুব দুঃখী ভাবত। কিন্তু সে লোকটি  আবার যখন দেখল অন্য একটা লোকের পা নেই তখন সে উপলদ্ধি করল ও লোকটার দুঃখের কাছে তো আমার দুঃখ কিছুই না। এ জগতে আমরা সবাই যেন একটা নাগরদোলায় বসে আছি। এখানে সবসময়ই কেউ না কেউ আমাদের চেয়ে উপরে থাকবে এবং কেউ না কেউ  সবসময় আমাদের চেয়ে নীচে থাকবে। তাই আকাশ যেমন স্পর্শ করা অসম্ভব তা আমরা যতটাই উপরে উঠি কিনা তেমনি আমরা পাতালেও প্রবেশ  করতে পারব না তা আমরা যতই নীচে নামি না কেন। এ ব্যাপারটা যদি  একটু ভালভাবে উপলদ্ধি করতে পারি তাহলে আমরা অনেকটাই শান্তিপূর্ন ও অর্থবহ জীবন যাপন করতে পারব। একটা স্বার্থপর চেতনার জীবনধারা থেকে বেড়িয়ে এসে একটা সামগ্রিক কল্যানকর জীবনের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকব। এরকমই এক মহীয়সী নারীর নাম সিন্ধুতাই যিনি কিনা একদা হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ট্রেনের লাইনে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু গাছ থেকে ঝুলে পরা একটি  কর্তৃত বৃক্ষ ডালও চূড়ান্ত পতনের আগে কাউকে ছায়া প্রদানে সক্ষম এ দৃশ্য অবলোকন করে তাঁর জীনবোধকে শানিত করে মানবতাধর্মী এক মহাকর্মযজ্ঞের  মাধ্যমে আজ নিজেই একটি আশার নদীতে পরিনত হয়ে সহস্র অনাথের জননী হয়েছেন। তাঁর  বাস্তব  জীবনের গল্প  কাল্পনিক সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
     পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের ওয়ার্ধা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে সিন্ধুতাইয়ের জন্ম। পশুপালন হল পেশা। মাত্র দশ বছর বয়সে সিন্ধুতাইয়ের বিয়ে হয়ে যায় ত্রিশ বছর বয়সী শ্রীহরির সাথে। ওই গ্রামে এক গুন্ডাটাইপের লোক ছিল। সে গ্রামের সিন্ধুতাইদের মত লোকদের দিয়ে শ্রমের কাজগুলি করাত কিন্তু তাঁদের পরিশ্রমলদ্ধ শ্রমের যথোপযোগী পারিশ্রমিক দিত না। গ্রামের গরিব লোকগুলি কত কষ্ট করে গোবর থেকে ঘুটে তৈরী করত যা জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয় তা ওই ষন্ডামার্কা লোকটি নামমাত্র মূল্যে বা কখনো কখনো বিনামূল্যে তাঁকে দিতে বাধ্য করত। ওই বদমাস প্রভাবশালী লোকটির এসব অন্যায়ের কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না। এ গ্রামের লোকগুলির উপর অত্যাচারের কান্না এ গ্রামের নরম মাটিতেই মিশে যেত। কিন্তু সিন্ধুতাই এ অন্যায়ের শুধুমাত্র নীরব সাক্ষী হয়ে থাকতে চাইল না। গ্রামের লোকদের সংঘঠিত করে গুন্ডা এ লোকটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন এবং  স্থানীয় কালেক্টরের সহায়তায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে তাঁকে এহেন কূকর্ম থেকে নিবৃত্ত করে। এরপর  ওই লোকটি নানারকম ফন্দি খুঁজতে থাকে কিভাবে সিন্ধুতাইকে শায়েস্তা করা যায়। নানা চেষ্টা করেও যখন সিন্ধুতাইর কিছু করতে পারছিল না তখন সে  তখন একটা বু্দ্ধি আটে বিষ দিয়ে বিষক্ষয়ের মত। সিন্ধুতাই তখন গর্ভবতী। সে সিন্ধুতাইয়ের স্বামী শ্রীহরিকে গিয়ে বলে সিন্ধুতাইর চরিত্র খারাপ। সে সকলের সাথে অবাধে মেলামেশা করে। সিন্ধুতাই এরি মধ্যে তিনটি সন্তানের মা হয়েছেন। এখন ঊনিশ বছরের সে চতুর্থ সন্তান গর্ভে ধারন করে আছে।
     ওই দু্ষ্ট গুন্ডা লোকটি সিন্ধুতাইর স্বামীকে বুঝায় সিন্ধুতাইের গর্ভে  বর্তমান যে সন্তান তাঁর বাবা সে নিজেই অর্থাৎ ওই গুন্ডা লোকটি। তাই সে শ্রীহরিকে পরামর্শ দেয় সে যেন সিন্ধুতাইয়ের গর্ভের অবৈধ সন্তানকে মেরে ফেলে সাথে সাথে দুঃশ্চরিত্রা  স্ত্রী সিন্ধুতাইকেও। আর যদি শ্রীহরি এ কাজটি না করতে পারে তাহলে সে নিজেই  কাজটি করবে। অবিবেচক শ্রীহরি দুষ্ট লোকের প্ররোচনায় পা দিল। বাড়িতে এসে সিন্ধুতাইয়ের উপর হিংস্র বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পরে। মহাআক্রোশে স্ত্রীর বুকে, তলপেটে আঘাত করতে থাকে। সিন্ধুতাইকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ক্রমাগত প্রহার করতে থাকে। একটা সময় সিন্ধুতাই নিস্তেজ হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পরে। পাষন্ড স্বামী ভাবল ও মরে গেছে। লোকজন যাতে না বুঝতে পারে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেজন্য সিন্ধুতাইর  নিথর দেহটিকে  টেনে টেনে যেখানে গরু মহিষ থাকে সে গোয়ালঘরে এনে ফেলে রাখে। এটা করল এটা ভেবে যে সবাই ভাববে গরু মহিষের পদদলনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। শ্রীহরিকেও আর থানা পুলিশের জেরার মুখে পরতে হবে না।
     এবার সিন্ধুতাইয়ের জীবনে অলৌকিক কিছু ঘটতে লাগল। ওই গোয়ালঘরের একটা গরু সিন্ধুতাইেয়র দেহের দুপাশে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকল যাতে অন্য কোন গরু মহিষ পদদলন বা শিং দিয়ে তাঁকে আক্রমন  করতে না পারে। কয়েকঘন্টা পর শ্রীহরি ও তার পরিজন যখন পরিস্থিতি অবলোকন করতে আবার গোয়ালঘরের কাছে আসে গরুটি তখন ক্ষিপ্রবেগে লাফ দিয়ে প্রবল আক্রোশে ওদের দিকে ধেয়ে যায়। ওরা সেদিন আর দ্বিতীয়বার গোয়ালঘরের কাছে আসতে সাহস পেল না। সিন্ধুতাইকে সুরক্ষাপ্রদানকারী গরুটি ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে আবার দ্রুত আগের মত দাঁড়িয়ে থেকে এ অনাথ গর্ভবতী অসহায় মেয়েটিকে সুরক্ষা দিতে থাকে। এদিকে ওই গরুটির নীচে শায়িত অবস্থায় সিন্ধুতাই তখন একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। অনেকক্ষন পর যখন একটু সম্বিত ফিরে পান তখন সিন্ধুতাই  বুঝতে পারে তার গর্ভের সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে। হাতের কাছে পাওয়া একটা পাথরের টুকরো দিয়ে নিজেই ইউম্বিকল কর্ড বা নাড়িটি অতি কষ্টে কাঁটেন। যখন চলার মত শরীরে একটু শক্তি পেল তখন নবজাতক কন্যা সন্তানটিকে নিয়ে গোয়ালঘর থেকে বের হয়ে আসল। তবে আসার আগে সিন্ধুতাই একটা প্রতিজ্ঞা করল গোয়ালঘরের গরুটা যেভাবে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর মত অসহায় একজনকে সুরক্ষা দিয়েছে এখন থেকে সেও যদি সুযোগ পায় তবে অনাথ ও অসহায়দের সে হবে এক নির্ভীক আশ্রয়স্থল।
     কোলে সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় ভিক্ষা করল সিন্ধুতাই। বাপ মা আশ্রয় দিল না। এরপর পরিচিতদের কাছে। তাঁরাও তাঁকে ফিরিয়ে দিল। এ বিশাল পৃথিবীর সমস্ত ঘরের দুয়ার সিন্ধুতাইয়ের জন্য মনে হয় অলিখিত  ভাবে  একে একে বন্ধ হয়ে গেল। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল এ বিপদগ্রস্ত নারী। দেহ দূবৃত্তরা তাঁদের লোলুপ দৃষ্টি ফেলাতে লাগল চার সন্তানের জননী ঊনিশবছরের  সমাজের এ অবলা পরিত্যক্তা মেয়েটির দিকে। এ দ্বিপদী হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পাবার জন্য সিন্ধুতাই তাঁর কোলের কন্যাসহ আশ্রয় নিল শ্মশানে। এখানে সে এক ধরনের সুরক্ষা পেল। সবাই পাগলী ভেবে তাঁর কাছে আসতে সাহস পেত না। মৃতদেহ দাহ করার পর গম ও অন্যন্য কিছু খাদ্যকনা  ছিটিয়ে দেয়া হত চিতার  দিকে অন্তিম সংস্কারের অংশ হিসাবে। শ্মশানের এ ছিটানো গম  দিয়ে কোন এক ধরনের রুটি বানিয়ে চিতার আগুনে তা গরম করে খেয়ে ক্ষুধা নামক ভয়াবহ এক চিরন্তন প্রবৃত্তির সাময়িক নিবৃত্তি সে এভাবে ঘটাত। কিন্তু কাহাতক এ জীবন। একটা সময় জীবনের উপর ঘৃনা জন্মে গেল। আর বাঁচতে চাচ্ছিল না সে। ঠিক করল সন্তানসহ চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিবে। এরকম চিন্তা করে কোলের সন্তানকে নিয়ে রেল লাইনের কাছে এসে একদিন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এমন সময় দেখল একজন পঙ্গু ভিখারী ক্ষুধার জ্বালায় ছট্ফট্ করছে এবং একটু রুটির জন্য চিৎকার করছে। এ দৃশ্য দেখে তার খুব মায়া লাগল। ভাবল দেখি রেল স্টেশনে ভিক্ষা করে তাঁর জন্য কোন খাবার আনতে পারে কিনা। তারপর নয় সে রেলের চাকায় জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিবে। স্টেশন থেকে ভিক্ষা করে কিছু খাবার এনে  সেই পঙ্গু ভিখারীটিকে দিল এবং অদূরে একটা গাছের নীচে গিয়ে বসল। খাবার পেয়ে ভিখারীটির মুখে হাসি ফুটল। সিন্ধুতাইর একটা নতুন উপলদ্ধি ঘটল। সেও অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম এ করুন পরিস্থিতির মধ্যেও। গাছটির দিকে চেয়ে দেখল তার মাথার উপর একটি কর্তিত ডাল কোনরকমে ঝুলে আছে গাছটির সাথে রজ্জুর মত ক্ষীন একটু ছাল দ্বারা। তবে এ অবস্থায়ও বৃক্ষডালটি সিন্ধুতাই ও তাঁর কোলের সন্তান যার নাম মমতা তাঁদের ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্যপট সিন্ধুতাইয়ের মনোজগতে এক দার্শনিক ভাবের আলোড়ন ঘটায়। তাঁর ভিতর প্রত্যয় উৎপন্ন হল বৃক্ষডালটি যেমন চূড়ান্ত পতনের আগ পর্যন্ত সেবা দিতে সক্ষম তেমনি মানুষের দেহে যতক্ষন পর্যন্ত প্রান আছে ততক্ষন পর্যন্ত মানুষও কোন না কোন সেবা দিতে সক্ষম।
     সিন্ধুতাই ফিরে আসে জীবনে। তার কন্ঠ ভাল ছিল। স্টেশনে স্টেশনে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করে যা উপার্জন করত তা দিয়ে অনাথ শিশু, বৃদ্ধ, আশ্রয়হীনদের খাবার যোগান সহ পরিচর্যার ব্যবস্থা করত মমতায়ী একজন মায়ের মত। তাঁর এ মহতী উদ্যোগ দেখে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আজ তিনি অসহায় অনাথদের জন্য বেশ কয়েকটি আশ্রম পরিচালনা করছেন যেখনে দেড় সহস্রাধিক অবহেলিত মানুষ আশ্রয় ও সুশিক্ষা পেয়ে বিভিন্ন পেশায় সমাজের জন্য অবদান রেখে চলেছে। তাঁর আশ্রমে একদিন এক বৃ্দ্ধ এসে আশ্রয় ভিক্ষা করেন। সিন্ধুতাই ভাল করে তাঁকে অবলোকন করে বুঝল এ বৃদ্ধটি অন্য কেউ নয়, সে হল তার সেই গুনধর স্বামী শ্রীহরি। মহিয়সী নারী সিন্ধুতাই তাঁকে ফিরিয়ে দেননি। তাঁকেও আশ্রয় দিয়েছেন এ আশ্রমে । তবে স্বামী হিসেবে নয় ছেলে হিসেবে। আশ্রম পরিদর্শকদের কাছে শ্রীহরিকে পরিচয় করিয়ে দেন একটি বয়স্ক ছেলে হিসাবে যে কিনা একটা সময় বেশ দুষ্ট ছিল। গোয়ালঘরে জন্ম নেয়া মমতা এখন একজন চিকিৎসক। সমাজ সেবার জন্য দেশ বিদেশ থেকে এখন পর্যন্ত সাতশর মত পুরস্কার পেয়েছেন। জয়তু মহীয়সী  অনাথ জননী সিন্ধুতাই।

চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা