অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
স্বাধীনতার ৫০ বছর ও বাঙালির ভাষা - আলী রেজা

জাতিসত্ত্বার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে সংগ্রাম করেছে । হাজার বছরের সংগ্রাম শেষে একাত্তরে (১৯৭১ খ্রি.) এসে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে তার আত্মপরিচয়। একাত্তরপূর্ব বিভিন্ন কালপর্বে সাংস্কৃতিক শোষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলা যায় , পালপূর্ব যুগে বাংলায় চন্দ্রগোমিন ও গৌড়পাদ ছাড়া আর কোন বিশিষ্ট বাঙালি গ্রন্থকারের নাম পাওয়া যায় না। অথচ তখন বাংলায় বহু সংস্কৃত কবি ও পণ্ডিত ছিলেন এবং তাঁদের গ্রন্থ ভারতবর্ষের সর্বত্র বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। পালপূর্ব যুগের রাজনৈতিক আনুকূল্যের কারণেই সংস্কৃত ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। আর এ কারণেই বাঙালি পণ্ডিতগণও সংস্কৃত ভাষায় লিখতেন। ফলে বাংলা ভাষা পিছিয়ে পড়েছিল। পালপূর্ব প্রাচীন বাংলায় এভাবেই বাংলা ভাষা অনাদরে ছিল। ভাষার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সাংস্কৃতিক শোষণের শুরু বোধ হয় তখন থেকেই।

রাজা শশাঙ্কের শাসনামলের অবসান হলে বাংলায় কোন রাজশক্তির উত্থান না হওয়ায় কিছুকাল ব্যাপক অরাজকতা বিরাজ করে। সবলেরা দুর্বলের উপর অত্যাচার শুরু করে। বাংলার এই দুঃসময়কে ইতিহাসে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে অভিহিত করা হয়। পাল রাজাগণ ক্ষমতায় এসে বাংলায় বিরাজমান এই অরাজকতা দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পালশক্তির খ্যাতি বাংলা থেকে সর্বভারতে এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছিলেন পাল রাজাগণ। কিন্তু পাল রাজাদের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ছিল একমুখি। তাই সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি বিশেষ ভাষা (সংস্কৃত) ও একটি বিশেষ ধর্মের (বৌদ্ধধর্ম) ব্যাপক পৃষ্টপোষকতা দিয়ে পাল রাজাগণ অন্যান্য ভাষা ও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তাই পাল যুগে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐক্য যতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাংস্কৃতিক ঐক্য ততটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধ ধর্মকে ঘিরেই। সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধধর্মকেন্দ্রিক এই উন্নয়ন ও অগ্রগতি অন্যান্য ভাষা ও ধর্মের অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত ইতিহাস, আইন, ধর্মাচরণ ও চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ ও বৌদ্ধ বিহার বা বিদ্যাকেন্দ্রগুলোতে সেগুলো গুরুত্বের সাথে পঠিত হলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা ততটা গুরুত্ব পায়নি। ফলে বাঙালি পণ্ডিতগণ সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’গুলো অষ্টম শতক থেকে রচিত হলেও চারশত বছরের পাল যুগে সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি চলে গিয়েছিল বাংলার বাইরে নেপালে। এতে বোঝা যায় তখন চর্যাপদ অনাদরেই ছিল। অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপ নিয়ে বাংলা শাসন করলেও পাল রাজাগণ সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করেছেন, বিশেষ পৃষ্টপোষকতা দিয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সুদৃষ্টি থাকলে পাল আমলেই চর্যাপদ আলোর মুখ দেখতো এবং বাঙালি পণ্ডিতগণ ব্যাপক হরে বাংলার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষা চর্চা করতেন না। তাই সুদীর্ঘ পাল যুগেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কোন প্রকার সমাদর লাভ করেনি। এই সাংস্কৃতিক শোষণ অব্যাহত ছিল পরবর্তী যুগেও। 

পাল রাজবংশের পতনের পর বাংলায় সেনবংশ রাজত্ব করে প্রায় দু’শ বছর। পাল যুগের মতো সেন যুগেও সংস্কৃত ভাষা বিশেষ রাজানুকূল্য পায়। সেন যুগেও খ্যাতিমান বাঙালি পণ্ডিতগণ সংস্কৃত ভাষা কাব্য রচনা করেন। ফলে সেন যুগেও সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে বাংলায় বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেন যুগের দু’শ বছরে বাংলায় সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষ রাজানুকূল্যে একটি বিশেষ ধর্ম ও ভাষা শক্তিশালী হয়ে উঠলে সাধারণ মানুষের অন্যান্য ধর্ম ও ভাষা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে এক ধরণের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ধর্ম সাধারণ মানুষের প্রধান পালনীয় বিষয়। আর ভাষা হলো শিক্ষার মাধ্যম। তাই এ দুটি বিষয়ে শাসক শ্রেণির পক্ষপাতিত্ব জাতিগত সংকট সৃষ্টি করে। এটা এক ধরণের সাংষ্কৃতিক শোষণ এবং এই শোষণ পাল যুগের মতো সেন যুগেও বাংলায় বিরাজমান ছিল।

বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের ফলে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তা প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরেরও অধিককাল (১২০৪- ১৭৫৭ খ্রি.) স্থায়ী হয়। এ সময় বাংলার সাধারণ মানুষের সাথে শাসক শ্রেণির সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বাংলার সাধারণ প্রজাবর্গ তখন শাসকের জয়-পরাজয় কিংবা পরিবর্তন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। রাজ সিংহাসনের প্রতি অনুগত থাকাই ছিল প্রজার ধর্ম। তাই রাজার পরিবর্তনে সাধারণ প্রজার জীবনের কোন পরিবর্তন হতো না। ইলিয়াসশাহি ও হোসেনশাহি বংশের শাসনামলে উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তনের ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। পাল ও সেন যুগের সংস্কৃত প্রভাব থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মুক্তি পায়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সেনযুগে উজ্জীবিত হিন্দু ধর্ম এ যুগে এসে কোন সংকটে পড়েনি। ফলে বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় ধর্মই রাজানুকূল্য লাভ করে। 

ইলিয়াসশাহি শাসনামলে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত মহাকাব্য ও কিছু কিছু পৌরাণিক উপাখ্যানের অনুবাদ হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় এ সময়ই অনুবাদ হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ইলিয়াসশাহি শাসকদের পৃষ্টপোষকতার এই ঐতিহ্য হোসেনশাহি যুগেও অব্যাহত ছিল। বলতে গেলে হোসেনশাহি আমলে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটে। এ যুগে আলাওল ও দৌলত কাজির মতো পণ্ডিত ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাঁদের ভাবপ্রবণ ও মানবতাবাদী কাব্য বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। হোসেনশাহি আমলে যশোরাজ খান, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, শ্রীধর- প্রমুখ পণ্ডিতগণ রাজদরবারের পৃষ্টপোষকতা লাভ করেন। বিজয়গুপ্ত ও বিপ্রদাস এ যুগেই মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। দীর্ঘদিন ধরে আরবদেশ ও উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে এবং বাংলার জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার ফলে বাংলার সুলতানগণ বাঙালিধর্মী হয়ে ওঠেন এবং বাংলার ভাষা ও সাহিত্য মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন। মুসলিমপূর্ব  পাল ও সেন যুগে বাংলায় সংস্কৃত ভাষার যে প্রভাব ছিল, মোগলপূর্ব মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষা সেই প্রভাব লাভ করে।

তবে মোগল আমলে এসে মোগলপূর্ব মুসলিম শাসনামলে বিদ্যমান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব খর্ব হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য রাজানুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়। এ সময় রাজভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে ফারসি ভাষা। পাশাপাশি আরবি-উরদু ভাষারও কদর বাড়ে। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয় ফারসি ভাষা। এজন্য উচ্চ সরকারি পদ লাভের আশায় অভিজাত হিন্দুরাও ফারসি ভাষা শেখা শুরু করে। কবি রামপ্রসাদ সেন, কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, রাজা রামনারায়ণ প্রমুখ পণ্ডিতগণ ফারসি ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন এবং ফারসি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বাংলার নবাব ও মুসলিম অভিজাতগণ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতা প্রদান করা শুরু করেন। এভাবে ইরান তথা পারস্যের ফারসি ভাষা বাংলায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তখন সাধারণ মানুষের ভাষা ও সাহিত্যে পরিণত হয়।  এভাবে আবার বাংলা ভাষা সাংস্কৃতিক শোষণের শিকার হয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এই ফারসি ভাষার অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় স্থায়ী আসন লাভ করে ঐ সময় বাংলা ভাষার বিকাশ ব্যাহত হয়। বাংলা ভাষা নিম্নবর্গের মানুষের ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয় বলে যথাযোগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়। 

মোগল আমলের শেষের দিকে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা বাংলায় আসতে শুরু করে। মূলত তাঁরা ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তবে তাঁরা ইংরেজিভাষী ছিলেন বলে তাঁদের সংস্পর্শে এসে অনেক বাঙালি ইংরেজি ভাষা শিক্ষা লাভ করে। এভাবে বাংলায় ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটে। বাংলায় ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা হলে ফারসি ভাষার বদলে ইংরেজি ভাষা রাজভাষার মর্যাদা লাভ করে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি হিসেবেই থেকে যায়। রাজানুকূল্য পাওয়ার জন্য অনেক অভিজাত বাঙালি পণ্ডিত ইংরেজি ভাষা চর্চা করা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান সম্প্রদায়ের চেয়ে এগিয়ে যায়। কারণ মুসলমানদের কাছে তখন ইংরেজি ভাষা বিজাতীয় এবং ধর্মীয় দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। 

বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও রাজনৈতিক অধিকারবোধপ্রসূত জাতীয়তাবাদী চেতনার ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা বাড়তে থাকে। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা বাড়াতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকগণ। বিশ শতকের গোড়া থেকেই ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী চেতনা জোরালো হতে থাকে। প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামের চেতনায় গণসাহিত্য ও গণসংগীত রচিত হয়। রাজভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষায় দাপ্তরিক কাজ করা হলেও জনচেতনার ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। তারপরও ব্রিটিশ আমলে বাংলা রাষ্ঠ্রীয় মর্যাদা লাভ করেনি। বাংলা সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাষা হয়েই থাকে। শাসকগোষ্ঠী ও শাসকগোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট একটি শ্রেণির ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষাই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়। উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিতদের অনেকেই ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন। উচ্চশিক্ষার মাধ্যমও ছিল ইংরেজি ভাষা, যার প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাঙালি জাতি। 

প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। প্রায় দুই যুগের পাকিস্তান আমলেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ভাষা বাংলাকে কোণঠাসা করে রাখার নানা অপকৌশল হাতে নেয়। মুসলিম লীগের মাধ্যমে এই অপকৌশলের শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির এক দশক পূর্বে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব করেন। ঐ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন বাংলার নেতা এ কে ফজলুল হক। ১৯৪৭ সালের ১৮ মে হায়দারাবাদের ‘উর্দু সম্মেলন’ এ উত্তর ভারতের মুসলিম লীগ নেতারা ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দেন। একই বছর জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হকসহ পূর্ববাংলার বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু এই বিরোধিতাকে আমলে না নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার মুদ্রা, পোস্টকার্ড, চিঠির খাম প্রভৃতিতে ইংরেজি ও উর্দু ভাষা চালু করেন। অফিস-আদালতের ভাষাও ইংরেজি ও উর্দু করা হয়। পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বাংলা ভাষা যথাযোগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়।

নিজেদের ভাষার প্রতি এই অমর্যাদা বাঙালি জাতি এবার আর নীরবে সয়ে যায়নি। ব্রিটিশ শাসনামলেই বাঙালি জাতির মনে জাতীয়তাবাদী চেতনা দানা বেধেছিল। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে সেই চেতনা আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। এই সমৃদ্ধ চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষ রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করলো। শাসকগোষ্ঠীর সকল অপকৌশলকে ধূলিস্মাৎ করে বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিকে করে তুললো জাতিসত্ত্বার আত্মপরিচয়ের প্রথম মাইলফলক। বাঙালির ভাষা বাংলা পেল রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। 

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল খুবই স্বাভাবিক ও যৌক্তিকভাবে। পাকিস্তানের ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা ছিল ৫৬.৪০%। এই ৫৬.৪০% মানুষের ভাষা বাংলার পরিবর্তে ৩.২৭% মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার করার পরিকল্পনা ছিল অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও উদ্দেশ্যমূলক। তাই হয়তো সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে যুগে যুগে যারা বাঙালিকে শাসন করেছে, শাসনের নামে শোষণ করেছে তারা কেউ বাঙালির ভাষা বাংলাকে মর্যাদা দেয়নি। বাংলা কখনো শাসক শ্রেণির আনুকূল্য পায়নি। কারণ একটাই, একাত্তরের পূর্বে বাঙালি কখনো শাসক ছিল না। তাই শাসক শ্রেণি বাঙালির ভাষাকে কখনো রাজভাষার মর্যাদা দিতে চায়নি। শাসক শ্রেণি সব সময় চায় শাসিত শ্রেণি থেকে দূরে থাকতে। এই দুরত্ব দূরে গিয়ে সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয় না। এক সাথে থেকেই বোঝাতে হয় আমরা শাসক আর তোমরা শাসিত। আমরা রাজা আর তোমরা প্রজা। তাই রাজভাষা কখনো আমজনতার ভাষা হয় না। আমজনতা যেমন রাজাকে সমীহ করে তেমনি রাজভাষাকেও সমীহ করে। এই সমীহ করার বিষয়টা আমজনতার মগজে এমনভাবে স্থিত হয়ে গেছে যে তারা আর সেটা মুছে ফেলতে পারছে না।

একাত্তরে বাঙালির বিজয় হয়েছে। বাংলাদেশ বাঙালির হয়েছে। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। যদিও অফিসিয়ালি বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে পাকিস্তান আমলেই। তবে স্বাধীন বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা পেল জাতীয় ভাষার সম্মান। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিলেন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু এ সম্মানও শেষমেশ টেকসই হলো না। পঁচাত্তরের মধ্যআগস্টে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। নতুন করে শাসকশ্রেণি হিসেবে যারা আবির্ভূত হলেন তারা শাসিত জনগণ থেকে মানসিক দুরত্ব রক্ষা করে চলা শুরু করলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে উৎসারিত ‘বাংলাদেশ বেতার’কে করলেন ‘রেডিও বাংলাদেশ’। যুগে যুগে শাসক শ্রেণির আলাদা ভাষা ছিল। তুর্কিরা তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, আফগানরা তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, মোগলরা তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, ইংরেজরাও তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, পাকিস্তানিরাও শাসন করার জন্য চাপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজি ও উর্দু। প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠীই আলাদা ভাষা দিয়ে তাঁদের রাজসম্মান প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু বাঙালিই যখন বাঙালির শাসক হলো তখন সে আলাদা ভাষা কোথায় পাবে। শাসক ও শাসিতের ভাষা এক হবেই বা কি করে। তাই ‘বেতার’ থেকে ‘রেডিও’তে এলেন। ভাষা আন্দোলনের ভ্রুণ থেকে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে তো উর্দু চালাতে সম্ভব নয়। তাই অগত্যা ইংরেজির আশ্রয় নেওয়া হলো। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও রাজসম্মান থেকে বঞ্চিত হয়ে সাধারণ মানুষের ভাষাই হয়ে রইল। উচ্চ আদালতে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, উচ্চতর দাপ্তরিক কাজে আবার ইংরেজির কদর বাড়তে থাকলো। তারই ধারাবাহিকতায় এখনও অনেকে ইংরেজিতে দু’কথা বলে নিজের আভিজাত্য প্রদর্শন করতে চায়।

বাংলা ভাষার স্মৃতি বিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। বাংলায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষা এখন বিশ্বঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জাতিসংঘে প্রদত্ত বাংলায় ভাষণ আজ বিশ্বইতিহাসের অংশ। তারও অনেক আগে (১৯১৩) বাঙালি কবি, বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার অর্জন  বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তারপরও আবহমান বাংলার দুঃখিনী মায়ের মতো হাজার বছর ধরে বাঙালির ভাষা অনাদরে, অবহেলায়, অমর্যাদায়। নিবিড় পল্লীতে মায়ের আদরে, মায়ের শাসনে লালিত সন্তানটিই মাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। মায়ের কোল ছেড়ে যাওয়া শহুরে সন্তানটি উচুঁতে উঠতে উঠতে মাকে ভুলেই যায়। একই কথা খাটে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে। আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, বাঙালি দু’শ বছর ইংরেজের অধীনে ছিল, আর ইংরেজি ভাষার অধীনে থাকতে হবে অনন্তকাল। এটা বাঙালির মানসিক দীনতা। এক শ্রেণির বাঙালি মানসিক দীনতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে নিজে যেমন পূর্ববর্তী শাসক শ্রেণির ভাষার প্রতি অতিভক্তি প্রদর্শন করে তেমনি নিজের সন্তানদেরও শাসক শ্রেণির মতো করে গড়ে তুলতে চায়। ঔপনিবেশিক শিক্ষা বাঙালির সেই মনোভাবকেই ধারণ করে প্রণীত হয়েছিল। সাথে যোগ হয়েছিল পুঁজিবাদী চিন্তা-চেতনা। তাই ঔপনিবেশিক শিক্ষায় বাঙালি মহৎ হয়নি, বৃহৎ হওয়ার দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। আমাদের সন্তানরা শিখেছে ‘লেখাপড়া করে যে/ গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে’। বাবা-মা, দাদা-দাদির কাছে এই বাক্যটি শুনতে শুনতে বড় হয়েছে আমাদের সন্তানরা। তাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া। গাড়ি-ঘোড়ায় চড়তে হলে টাকা রোজগার করতে হবে। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে টাকা রোজগার করা। বৈধ কিংবা অবৈধ- যে কোন উপায়েই হোক। এই শিক্ষা আমাদের যতটা উপরে তুলেছে ততটা নিচেও নামিয়েছে। আমরা শেকড়কে দুর্বল করেছি। তাই শিখরে উঠতে পারিনি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করে শাসক হতে চেয়েছি। শাসক হয়েছিও। কিন্তু শাসনের হাতিয়ার আনতে হয়েছে বাইরে থেকে। নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি যে শোষিত শ্রেণির ভাষা-সংস্কৃতি তা আমরা কখনো ভুলতে পারিনি। তাই মনে করেছি এই ভাষা দিয়ে শাসন চলে না। বাংলার কবি মধুসূদন দত্ত ফ্রান্সে বসেও বাংলা ভাষায়ই লিখেছেন। তারও আগে কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার শত্রুদের বিদেশে চলে যেতে বলেছেন (দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে ন যায়’- আবদুল হাকিম, বঙ্গবাণী)। রবীন্দ্রনাথও তাঁর মেঝদাদার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি। তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার ছেলেবেলা)। কিন্তু এ সবকে কোন কাজের মনে করেনি জাতে ওঠার জন্য মরিয়া বাঙালি সমাজ। বাংলা ভাষাকে দূরে রেখেই বাঙালি অভিজাত হতে চেয়েছে।  

বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়; বাংলা একটি ভূখণ্ড, বাঙালি একটি জাতিসত্ত্বা। একটি ভাষা একটি জাতিসত্ত্বার আত্মপরিচয়ের সঙ্গে এমন অবিচ্ছিন্নভাবে মিশে থাকার নজির মানবজাতির ইতিহাসে খুব একটা নেই। তাই বাংলা ভাষার সাথে বাঙালির সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের মতোই দৃঢ়। তবে বাঙালির রক্তও তো মিশ্র। তাই সম্পর্কের অবনতি ঘটতেও সময় লাগে না। তাই বাঙালির ভাষাপ্রীতির ইতিহাস যেমন আছে তেমনি ভাষার প্রতি অবজ্ঞার ইতিহাসও আছে। বাংলা ভাষার শত্রু শুধু বাইরে নয়, ভেতরেও ছিল। আজও আছে। ভেতরের শত্রুই বেশি ক্ষতিকর। ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ কথাটি বাঙালি সমাজে এমনিতেই এতো জনপ্রিয় হয়নি। আরবি হরফে বাংলা লেখার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের সাথে কিছু ঘরের লোকও জড়িত ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এটা জেনেও শাসকগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের (১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত হয়) সাথে একমত পোষণ করে বিবৃতি দেন একদল বাঙালি বুদ্ধিজীবী। এরাও বাংলা ভাষার ঘরের শত্রু।

বিশ্বায়নের এই যুগে ভাষা ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানের প্রয়োজনীয়তা আমি দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করি। স্বীকার করি আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে হবে। তাই বলে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে নয়। শেকড় দুর্বল হলে বৃক্ষ খুব বড় হওয়ার আগেই উপড়ে পড়ে। আমাদের ভাষাপ্রীতি এখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একুশের আনুষ্ঠানিকতার অলঙ্কার হয়ে উঠছে বাংলা ভাষা। সারা বছরের দায়বদ্ধতা এড়ানোর জন্য ফেব্রুয়ারিকে আমরা বানিয়েছি ভাষার মাস। তাই শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও সচেতন মহল জেগে ওঠেন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা বলেন। আমরা বিশুদ্ধ বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। বাংলা বর্ণমালা খচিত পোশাক পড়ি। আমাদের সন্তানদের বাঙালি বানানোর উৎসবে মেতে উঠি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই আমরা বাঙালিয়ানার সেই খোলস ছুড়ে ফেলে দেই। রক্ত দিয়ে কেনা ভাষার প্রতি এমন অনাদর প্রকৃত বাঙালিকে ব্যথিত করবেই।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা বেড়েছে কি?  আজও আমরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি না। আজও আমরা ভুল বানান ব্যবহার করে বা ব্যবহৃত হতে দেখে বিচলিত হই না। ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট হলে আমরা কষ্ট পাই না। একটি আদরে লালিত ভাষা ঐ ভাষাভাষীদের মধ্যে যেমন আত্মার বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে তেমনি একটি অবহেলিত ভাষা ঐ ভাষাভাষীদের মধ্যে কোন আত্মিক বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না। হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা ছিল শাসক শ্রেণির কাছে অবহেলিত। অতীতে বাঙালি জাতির শাসকগোষ্ঠীরা বাঙালি ছিল না। কিন্তু এখন বাঙালি জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন করেছে। এখনও বাংলা ভাষা আদরে লালিত হচ্ছে না কেন? 

আলী রেজা 
কবি ও প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ