অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
মানুষের ধর্ম - অমল রায়

প্রাক-কথন
আমরা একবিংশ-শতাব্দীর আধুনিক মানুষ। আজ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটিমাত্র মানব-প্রজাতি বিদ্যমান। এই মানব-প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম  Homo sapiens  (কোন কোন নৃতাত্ত্বিকদের মতে বর্তমানের মানুষ, Homo sapiens প্রজাতির অন্তর্গত একটি উপ-প্রজাতি (sub-specis) Homo sapiens sapiens, অন্য উপ-প্রজাতিটি হল Homo sapiens idaltu, যার বিলুপ্তি ঘটেছে আজ  থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর  পূর্বে)। এই দুটি ল্যাটিন শব্দের অর্থ "জ্ঞানী মানুষ"। প্রাণী-বিজ্ঞানের ভাষায় এই মানুষ-প্রজাতি হোমিনিডি (Hominidae) পরিবারের অন্তর্গত। এই পরিবারের অন্যান্য সদস্য-প্রাণীদের তুলনায় মানুষের বিশেষ পার্থক্য তাঁর দুই-পায়ের উপর ভর করে সোজা হয়ে হাঁটার ক্ষমতা, আর তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা! যদিও অদ্যাবধি মানুষের ইতিহাস সম্পূর্ণ উন্মোচিত নয়, তবু  মানুষ এখন পর্যন্ত তার নিজের সম্বন্ধে যতটুকু আবিষ্কার করতে পেরেছে তাও কোনো বিবেচনাতেই একেবারে নগন্য নয়,  আর এই আবিষ্কারের সবটুকুই বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবদান। বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার বিশ্বাসযোগ্য, কারণ কোন বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তাদের সূক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং একটি সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের উপর নির্ভরশীল। সেখানে স্বপ্নাশ্রিত, কল্পনাশ্রিত, বা অতি-প্রাকৃত কোন মনগড়া কাহিনীর উপস্হাপনা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক এবং ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হয় এবং তা আধুনিক মননশীল মানুষের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

মানুষ এই বিশ্ব-প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের ইতিহাস লক্ষ-লক্ষ বৎসরের বিবর্তনের ইতিহাস। বিবর্তনের এক মহাদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আজকের এই আধুনিক মানুষের উৎপত্তি আজ থেকে মাত্র প্রায় দুই লক্ষ বছর পূর্বে। মহাকালের মহা-আবর্তনের হিসাবে এই আধুনিক মানুষের উদ্ভব আর বিকাশের সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত।  তবুও মানুষ এর মধেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে  তাঁর দেশ-সভ্যতা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই গ্রহের এত সকল  প্রাণীর মধ্যে একমাত্র মানুষ নামক প্রাণীই এই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। আর মানুষের এই বিশেষ ক্ষমতার উৎস অন্য সকল প্রাণীর তুলনায় তাঁর অতি উন্নত-বৈশিষ্ট্য-মন্ডিত মস্তিষ্ক।  আধুনিক মানুষের এই উন্নত মস্তিষ্কও এক দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল। মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ এক প্রকার বানর-জাতীয় প্রাণীদের (genus Australopithecus) মস্তিষ্কের ওজন ছিল মাত্র প্রায় এক পাউন্ড। তারপর দীর্ঘ ৪০ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল স্বরূপ বর্তমানের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের গড় ওজন এখন  তিন পাউন্ড। এই অতি উন্নত  মস্তিষ্কের কারণে মানুষ একদিকে যেমন সৃষ্টি করে চলছে  তাদের  ধরা-ছোঁয়ার tangible)অসংখ্য জিনিস, তেমনি  অন্যদিকে তারা রচনা করতে পারে বিমূর্ত (abstract) ধারণা! এই অতি উন্নত মস্তিষ্কের কারণে  মানুষ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে তাঁর ভাব প্রকাশের নিমিত্তে উন্নত ভাষা। মানুষের অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য  ইত্যাদিI মানুষ তাঁর বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন জঠিল মস্তিষ্কের দ্বারা জটিল সব সমস্যার সমাধান করতে পারদর্শী। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে আগুন আবিষ্কার করেছে এবং তাঁর খাবার রান্না করে খেতে পারে। মানুষই কেবল পারে তাঁর নগ্ন দেহকে মনোরম পোশাকে আবৃত করতে। মানুষই এক মাত্র প্রাণী যে ক্রমাগত আবিষ্কার করে চলছে অতি উন্নত সব প্রযুক্তি। মানুষের মস্তিষ্কের সকল বিশেষ ক্ষমতার  মধ্যেও আরো একটি  বিশেষ বৈশিষ্ট্য  হল তাঁর  কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার অসাধারণ পারঙ্গমতা! মানুষ  বিমূর্ত কার্য-কারণ-সম্পর্ক (abtract reasoning) বিষয়ে চিন্তা করতে সক্ষমI মানুষ তাঁর যুক্তি আর কার্য-কারণ সম্পর্কের দৃষ্টিতে কোনো ক্রিয়াকলাপকে অনুপঙ্খ-বিশ্লেষণ করার অনন্য-সাধারণ ক্ষমতার কারণে আজ সে এই ভূপৃষ্ঠের প্রাণী জগতের মধ্যে এক বিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত।

মানুষের বিগত তিনশত বৎসরের ইতিহাসে তাদের জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই  ঘটেছে বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। আর এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র সমূহ হল কৃষি বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি, প্রকৌশল বিজ্ঞান,পদার্থ বিজ্ঞান, কম্পিউটিং বিজ্ঞান এবং মহাকাশ গবেষণা।  বিজ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির কারণে বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। বন থেকে আহরণ নয়, মানুষ এখন উন্নত কৃষিকার্যের মাধ্যমে উৎপাদন করতে সক্ষম সবার জন্য খাদ্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের  অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে মানুষের আয়ুষ্কাল  বেড়েছে অনেকখানি। মানুষের সাথে মানুষের দ্রুত যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটেছে বিস্ময়কর সাফল্য। এই মহা-মহাবিশ্বের মহাকাশ সম্বন্ধেও  নিরন্তর গবেষণা করে মানুষ আবিষ্কার করছে নতুন নতুন সব বিস্ময়কর তথ্য। আজ থেকে ৫২ বৎসর পূর্বে বিজ্ঞানীরা চন্দ্র জয় করেছে, এবং এখন মানুষ চেষ্টা করছে মঙ্গলগ্রহে বসতি স্হাপন করতে। মানুষের এত সকল আবিষ্কারের পিছনে যে প্রণিধানযোগ্য  বিষয়টি কাজ করেছে তা হলো অন্ধ-বিশ্বাসে নির্ভরতার পরিবর্তে যুক্তি আর বুদ্ধির প্রয়োগে বিজ্ঞান চর্চা!

এই বিশ্বজগতের রহস্য উন্মোচনের নিমিত্তে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলশ্রুতিতে আজ মানুষের অনেক প্রাচীন ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে  মানুষ এক সময় মনে করত মানুষে মানুষে মূলগত ভাবে বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান - কোন কোন মানুষ অন্য  সকল মানুষ থেকে  উন্নত বা অবনত।  কিন্তু আজ বৈজ্ঞানিক গবেষনার দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে মানুষের সেই ধারণা ছিল নিতান্তই অলিক কল্পনা - আসলে প্রতিটি মানুষ কৌলিক এবং মৌলিক  ভাবে এক এবং অভিন্ন, আমরা সকলে মিলিত ভাবে এক প্রজাতি, এবং  দৃশ্যত আমাদের মধ্যে যা পার্থক্য তা নিতান্তই বাহ্যিক! আজ উন্নত দেশ সমূহে উন্নত চিকিৎসা সেবার ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েই চলছে ক্রমাগত! মানুষ এক সময় কল্পনা করত ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-খরা এই সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগ মানুষের পাপ-পূণ্যের  সাথে সম্পর্কিত! কিন্তু আধুনিক মানুষরা এখন জানে এইগুলি এই চলমান প্রকৃতির নানা  উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফল, মানুষের পাপ-পূণ্যের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং মানুষ এখন বিজ্ঞানের অনেক প্রায়োগিক নকশার মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই হিসাব নিকাশ করে আবহাওয়া সম্বন্ধে  খুব সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিতেও বিশেষ ভাবে সক্ষম। বিজ্ঞানের এই সকল আবিষ্কার মানুষের চিন্তার জগতে এনেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন - মানুষ এখন আর কেবল অন্ধ বিশ্বাসের উপর ভর করে জীবন-যাত্রা নির্বাহ করে না।  আধুনিক মানুষ তাঁর  উন্নত মস্তিষ্কের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মুক্তবুদ্ধির আলোকে যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে তাঁর নিজেকে এবং তাঁর চারিপাশের জগতকে। সেই মুক্তবুদ্ধির তাড়নায় এই আধুনিক মানবগুষ্ঠির মনে  প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, তাহলে, কি এই মানব প্রজাতির সত্যিকার বৈশিষ্ট্য?? - অন্য কথায়  বলা যেতে পারে, কি হওয়া উচিত এই মানুষের ধর্ম??

মানুষের মানবিক ধর্ম
বিশ্ব-প্রকৃতির সাথে একাত্মতা: এই বিশ্ব-প্রকৃতি থেকে মানুষ সহ সকল জীব এবং জড় পদার্থ উদ্ভূত। আমাদের চারিপাশের প্রাকৃতিক জগতের সাথে আমরা এক জটিল ও নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের পরিবেশ সুস্হ আর সজীব থাকলে প্রকৃতি থেকে আমরা পাব আমাদের বাঁচার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ বায়ু, বিশুদ্ধ জল আর পুষ্টিকর খাদ্য! মানুষের অনেক অবিবেচক কার্য্যাবলীর কারণে প্রকৃতি আজ নানা ভাবে বিপন্ন। এক সময় এই পৃথিবীতে মানুষের সম গোত্রীয় বা প্রায়-মানুষ জাতীয় (Homo neanderthalensis, Homo erectus, Homo idaltu, Homo habilis  ইত্যাদি) অনেক প্রাণী ছিল। প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে তারা সকলে এক সময় হয়েছে বিলুপ্ত। মানুষ (Homo sapiens)  ছাড়া এখন আর  হোমো-গণের (genus Homo) অন্য কোন প্রজাতির অস্তিত্ব নেই - কালের গর্ভে তারা সকলে হয়েছে বিলীন। মানুষের কর্মকান্ড তার চারিপাশের পরিবেশ-প্রকৃতির পক্ষে অনুকূল না হলে পরিবেশ হবে দূষিত, যার ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হবে চরমভাবে বিপদগ্রস্ত, আর এর পরিণতিতে মানবপ্রজাতিও হয়তবা একসময় হতে পারে বিলুপ্ত। তাই মানুষের ধর্ম হওয়া  উচিত তাদের প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া, তাকে মমতা দিয়ে লালন পালন করা তাদের নিজেদের সুস্হ ও সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার জন্য এবং তাদের ভবিষ্যৎ-বংশধরদের জন্য একটি বাসোপযোগী সুন্দর পৃথিবী রেখে যাবার জন্য। 

সকল মানুষকে সমান জ্ঞানে সম্মান করা: যেহেতু এটি আজ বৈজ্ঞানিক সত্য যে দৈহিক এবং মানসিক গঠনগত ভাবে এই পৃথিবীর সকল মানুষ মৌলিক ভাবে একটি অভিন্ন প্রজাতি; কাজেই স্থান আর পরিবেশগত ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষে মানুষে যে ভিন্নতা তা নিতান্তই স্থুল। দৈহিক কর্মতৎপরতার  দ্বারা যেমন দেহকে বলশালী করা সম্ভব তেমনি সুস্থ জ্ঞান চর্চার দ্বারা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করাও সম্ভব। সাধারণ ভাবে এই মানবগুষ্ঠির সকলেই বুদ্ধিদীপ্ত। তবে সুযোগের অভাবে অনেকে তাদের নিজেদের বিকশিত করতে অপারগ। সুযোগের অভাবে অথবা ব্যক্তিগত  ও সামাজিক ভাবে অবহেলা, অবজ্ঞা, বা বৈষম্যের কারণে  অনেক মানুষ নিপীড়িত এবং দরিদ্র। বুদ্ধিমান মানুষ হিসাবে প্রতিটি মানুষের ধর্ম এটি মনে রাখা যে আমরা প্রতিটি মানুষের উৎস এক। আমরা জানি প্রতিটি মানুষের উৎপত্তি দুই জন মানুষ থেকে, সেই দুইজন মানুষের উৎপত্তি আবার চারজন মানুষ থেকে, এমনিভাবে ক্রমাগত পিছনের দিকে যেতে থাকলে এই হিসাবের ফলটি আমাকে বলে দিবে আমি জন্মগত ভাবে আমার পূর্ববর্তী সকল মানুষের সাথে সংযুক্ত, এবং এই হিসাবটি  বর্তমানের সকল মানুষের  ক্ষেত্রে  প্রয়োগ করলে দেখা যাবে এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের আত্মীয়। কাজেই প্রতিটি মানুষকে আমার সমকক্ষ রূপে বিবেচনা করে তাকে সম্মান করা প্রতিটি  মানুষের  মৌলিক মানবিক ধর্ম।

সকল জীবের প্রতি দয়াশীল হওয়া: আমরা মানুষ হিসাবে যদি নিজেদেরকে কখনো এই প্রশ্ন করি যে "এই পৃথিবী কি  কেবল মানুষের জন্য?? নিঃসন্দেহে এর উত্তরটি হবে "না "। মানুষের উৎপত্তির বহু বহু পূর্বে এই পৃথিবীতে উদ্ভিদের জন্ম হয়েছে। এই পৃথিবীর প্রায় সকল  প্রাণীজগতের উৎপত্তি মানুষের আগে। বিবর্তনের ধারায় তাদের উৎপত্তি আর প্রসার মানব উৎপত্তির পথকে সুগম করেছে, এবং বর্তমান সময়েও এই পৃথিবীর প্রতিটি জীব একে অন্যের উপর নানা ভাবে নির্ভরশীল। মানবিক বিবেচনায় দুঃখজনক  হলেও এটা এক  নির্মম সত্য যে এই পৃথিবীতে এক জীব অন্য আর এক জীবের খাদ্য, আর তাই  এক প্রাণী আর এক জীবকে হত্যা করে চলে প্রতিনিয়ত। তবে খাদ্য-খাদকের এই সম্পর্কের বিষয়টির বাহিরে সাধারণ ভাবে সমস্ত জীবজগতের প্রতি দয়াশীল হওয়া এবং অকারণে কোন জীবের প্রতি হিংসা প্রদর্শন না করা মানুষের ধর্ম, কারণ এই পৃথিবীটা কেবল আমার একার নয় তাদেরও  জন্য। 

মানবধিকার প্রতিষ্ঠা করা: আজ থেকে প্রায় আড়াইশত বৎসর পূর্বে দার্শনিক জিন রশু  (Jean Rousseau) বলেছিলেন, "মানুষ জন্মগ্রহণ করে মুক্ত কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত"!  আজ এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে এই পৃথিবীতে  সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকা, বেড়ে উঠা এবং  মুক্তভাবে চিন্তা করার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু যুগে যুগে মানুষ কিছু অন্ধ-বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বা নিজেদের অশুভ ইচ্ছা চরিতার্থ করতে অন্য মানুষকে তাদের সেই জন্মাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা নানা ভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্চিত হয়ে চলছে বহুকাল ধরেI নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের অধিকার এই পৃথিবীর আলো-বাতাস সমভাবে ভোগ করার।  প্রতিটি মানুষের কর্তব্য তাঁর নিজের এই জন্মগত অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এবং অন্য সকলের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং কোনভাবেই তাঁর সেই মৌলিক অধিকারে বাঁধা সৃষ্টি না করা। বর্তমানের জাতিসংঘ (United Nations)-এর  Universal Declaration of Human Rights - মুখবন্ধের প্রথম বাক্যটি হলো "মানব পরিবারের সকল সদস্যের অন্তর্নিহিত মর্যাদা এবং সমান ও অবিচ্ছেদ্য মানবধিকারের  স্বীকৃতি প্রদান করা  হল এই পৃথিবীতে মানুষের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার আর শান্তি  প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি"। কাজেই এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের তাঁর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা এবং অন্য সকলের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সমর্থন আর সহায়তা প্রদান করা তাঁর মানব-ধর্ম।

ন্যায়-নীতি ও আদর্শবান হওয়া: যে সকল নিয়ম-নীতি পালনে ব্যক্তি জীবন শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুস্থ থাকে ও সমাজজীবনে বৈষম্য দূর হয়ে সাম্যতা ও শান্তি  আনয়নে সহায়তা করে সাধারনভাবে তাই ন্যায়-নীতি হিসাবে গণ্য হয়। যদিও স্থান, কাল ভেদে ন্যায়-নীতির কিছুটা হের-ফের হতে পারে তবে মানব-ইতিহাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা  আর যুক্তি-বুদ্ধির সহায়তায় বিশ্ব-ব্যাপিই ন্যায় নীতি সম্বন্ধে বর্তমান যুগের আধুনিক মানুষের একটা মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এই নীতি-আদর্শগুলো আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবেI এই নীতি-আদর্শগুলোর ভিত্তি মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত চেতনা আর যৌক্তিক বিবেচনা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় এক সময় ধর্ম রক্ষার নামে মানুষ অসহায় বিধবা  নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারত। এক সময় আরব দেশে মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিতI বর্তমানের  যেকোন মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে এই কাজগুলি বিবেচিত হবে নিছক বর্বরতা রূপে। তাই কোন অন্ধ বিশ্বাসের উপর রচিত কোন নীতি নয়, মানুষের যুক্তির কঠিন কষ্টি পাথরে পরীক্ষিত নীতি-আদর্শ পালনই হোক আধুনিক মানুষের ধর্ম। আবার, কোন অন্ধ-বিশ্বাসের পরিবর্তে ন্যায়- নীতির ভিত্তি হওয়া উচিৎ বিজ্ঞান। যেমন বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে প্রতিটি ক্রিয়ারই আছে একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া। মানুষের ন্যায়-নীতির ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগযোগ্যI যেমন কাউকে অকারণে আঘাত করলে সে পাল্টা আঘাত করবে বা করতে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। অপরদিকে কোন মানুষকে, এমনকি  অন্য কোন প্রাণী, বা তরু-লতাকেও সত্যিকার ভালবাসা প্রদর্শন করতে পারলে তার প্রতিদানে সে ঘৃনা প্রদর্শন করবে সেটা একেবারেই প্রাকৃতিক নিয়ম-বিরুদ্ধ। অতএব যুক্তি, বুদ্ধি, আর বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ন্যায়--নীতির অনুসরণই হোক মানুষের প্রকৃত ধর্ম।

উন্নত মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে যুক্তিবাদী হওয়া: বুদ্ধি, যুক্তি, আর বিশ্লেষণ ক্ষমতা আধুনিক মুক্তবুদ্ধির মানুষদের জীবন যাত্রা নির্বাহের প্রধান সহায়ক। তাই অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারকে দূরে সরিয়ে রেখে নিরন্তর জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিকে আরো শানিত করা, যুক্তিবাদী মনকে আরো ক্ষুরধার করা, মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে আরো তীক্ষ্ণ করা হোক আধুনিক মানুষের ধর্ম। একটি যুক্তিবাদী মন তাঁর যুক্তি ও বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে অনায়াসেই সকল মানুষের জন্য হিতকর সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই মত কর্মে নিয়োজিত হতে পারে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক -- একজন যুক্তিবাদী সুশিক্ষিত মানুষ বুঝতে পারবে এই পৃথিবীর সম্পদ সীমিত, তাই অন্য সকলের অধিকারের কথা চিন্তা করলে সে সহজেই বুঝতে পারবে সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমিত বোধ এবং সর্ব ক্ষেত্রে অপচয় রোধ করা তাঁর কর্তব্য, বা অন্য কথায়  বলা যেতে পারে এটি হওয়া উচিৎ তাঁর ধর্ম। এই বিষয়ে  মহাত্মা গান্ধীর মহা-মূল্যবান উক্তি "এই পৃথিবীতে প্রত্যেকের প্রয়োজনের অন্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু প্রত্যেকের লোভ নিবৃত্তির জন্য যথেষ্ট নাই” (There is enough on Earth for everybody's need, but not enough for everybody's greed") 

সকলের হিতার্থে ইহজাগতিকতা (Secularism)-র  চর্চা:  মানব ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই কিছু কিছু মানুষের উদার এবং মুক্তদৃষ্টির কারণে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা অব্যাহত ভাবে এগিয়ে  চলছে। আজ এটি বিজ্ঞানের সত্য যে আমাদের এই দৃষ্টিগ্রাহ্য জগতের সমস্ত ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম (Physical laws)-এর মাধ্যমে। কিছু ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যায়: আকাশের দিকে ঢিল ছুড়লে তা মাটিতে ফিরে আসে, ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় কেবল খাদ্যের দ্বারা, বা একটি পেশীবহুল মানবদেহ ঘটন সম্ভব কেবল ব্যায়ামের দ্বারা। অনন্ত প্রহর ধরে চেষ্টা করলেও  আকাশের দিকে ছোড়া  ঢিল মাটির দিকে ফিরে আসা রোধ করা যাবে না। এক কঠিন কার্য-কারণ (cause and effect) সম্পর্কের নিয়মে বাঁধা এই জগৎ ও জীবন। আমার জন্ম গ্রহণে আমার কোন ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভূমিকা ছিল না। কিন্তু আমার জন্মের পর আমার বাঁচার  জন্য, আমার একটি সুস্থ-সুন্দর দেহ-মন গঠনের জন্য, এই পৃথিবীতে একটু সুন্দর জীবন-যাত্রা নির্বাহের জন্য প্রয়োজন এই জাগতিক নিয়মের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে গঠন করা এবং কর্ম করা। এই পৃথিবীর সকল জীব-জগৎ এই নিয়মের অধীনI এই প্রাকৃতিক নিয়মকে সম্মান করে যুক্তি আর বুদ্ধি খাটিয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করার মধ্যে নিহিত এই মানব সমাজের জন্য এক উন্নত জীবন। এর বিপরীতে কোন মনগড়া কল্প কাহিনীর উপর নির্ভর  করে জীবন চালিত করলে এই পৃথিবীতে ঠিকে থাকাই যে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় এটা আজ প্রমাণিত সত্য। তাই মানুষ তাঁর নিজের এবং সমস্ত মানব সমাজের উন্নতির স্বার্থে প্রয়োজন ইহজাগতিকতার চর্চা করা।

বিজ্ঞানমনস্কতা  ও বিজ্ঞানচর্চা: যদিও এটা  সত্যি  মানুষ এখনো সব সত্য আবিষ্কার করতে পারেনি - বিজ্ঞান এখনো সব প্রাকৃতিক রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয় নি, তবু একথাও  সত্যি, সত্যকে উম্মোচিত করার জন্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা -নিরীক্ষার কোন  বিকল্প নেই। বিজ্ঞান  ও অন্ধ-বিশ্বাস একে অপরের বিপরীত। বিজ্ঞানের কাজ সত্যকে উন্মোচিত করা আর অন্ধ-বিশ্বাস করে তার ঠিক উল্টোটা। মন-গড়া অতি-প্রাকৃত কল্প-কাহিনীর রচনা দ্বারা অন্ধ-বিশ্বাস সত্যকে আড়াল করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যৌক্তিক কোন পরিণতির দিকে মানুষের চেতনাকে পরিচালিত করার পরিবর্তে তাকে অযৌক্তিক ফ্যান্টাসিময় এক জগতে নিক্ষেপ করে। ফলে মানুষ তার প্রভাবে বাস্তবতার পরিবর্তে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে। এর  পরিণতিতে দেহের বল আর মস্তিষ্কের বুদ্ধি খাটিয়ে জীবন আর জগতের উন্নতি সাধন করার পরিবর্তে মানুষ কেবল তার ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে অনায়াসে কোন কর্ম না করেই ফল লাভ করতে চায়। কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা আর যুক্তি দ্বারা আমরা জানি এটা এখন নিছক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। মানুষের এই ধরনের মানসিকতা তার নিজেকে ও সমাজকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে পশ্চাতমুখী করে  তোলে। মানুষের অগ্রগতি ব্যাহত হয় পদে পদে। তাই  প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বার্থে এবং সমষ্টিগত ভাবে সমস্ত মানব সমাজের স্বার্থে হওয়া উচিত বিজ্ঞান মনস্ক, এবং বিজ্ঞান  চর্চা  করা হোক তাঁর ধর্ম। এই যুগের প্রতিটি শিশুর জন্য এখন বিজ্ঞান শিক্ষা আর কোন ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং সকল শিশুর জন্য এটি একটি অবশ্য পঠনীয় বাধ্যতামূলক বিষয় হওয়া মানব ধর্মের অন্তর্গত।

মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম 
যেহেতু আমার এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় "মানুষের ধর্ম", তাই এখানে মানবসমাজে বিদ্যমান অধিকাংশ মানুষের জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সম্বন্ধে কিছু কথা না লিখলেই নয়। মানুষের বিবর্তনেরধারায় আজ থেকে প্রায় ৭০ হাজার বছর পূর্বে মানুষের মধ্যে যখন বোধশক্তির বিপ্লব (Cognitive  Revolution) ঘটলো, অর্থাৎ মানুষের মনে যখন বোধের উদয় হলো, সে যখন চোখ মেলে, তার মনের জানালা খোলে, তার চারিপাশের অসীম মহাবিশ্বের দিকে অশেষ বিস্ময়ে তাকালো - তখন তার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উদয় হলো - কে সে, আর কোথা থেকেই বা এলো সে, কে সৃষ্টি করলো তাকে আর তার চারিপাশে বিরাজমান এই বিস্ময়কর সুন্দর ভুবনকে? মানুষের এই আত্মজিজ্ঞাসার পথধরেই মানুষ ধীরে ধীরে তার কল্পনায়, তার ধ্যানে আর জ্ঞানে সৃষ্টিকরলো এক বা একাধিক অলৌকিকসত্ত্বার, এবং এই ক্রম-বিবর্তনেরধারায় সেই সকল অলৌকিকসত্ত্বার প্রতি তাদের জন্মালো বিশ্বাসI ক্রমে ক্রমে তাদের সেই বিশ্বাসকে ঘিরে তৈরী হতে থাকলো নানাহ আচার-অনুষ্ঠান এবং সেই সাথে তাদের সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা নির্বাহের নিমিত্তে যুক্ত হলো কিছু ন্যায়-নীতির চর্চা। তারপর বর্তমানের আধুনিক মানুষ যখন তার উৎপত্তিস্থল পূর্ব-আফ্রিকা থেকে ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো, তখন ধীরে ধীরে স্থান আর কালের ব্যবধানে তৈরী হলো ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ এবং ক্রমে ক্রমে ভিন্নতা দেখা দিল তাদের বিশ্বাসে এবং তার প্রভাবে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে এবং সেই সাথে কিছু পরিমানে তাদের ন্যায়-নীতিবোধে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে জন্মনিলো পৃথিবীর নানা প্রান্তে হরেক রকমের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। মানবজাতির ইতিহাসের ভাঙাগড়ার ধারায় অনেক ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে আবার একসময় বিলুপ্তিও ঘটেছে, তার সঠিক ইতিহাস মানুষের অজানা। তবে বর্তমানে পৃথিবীতে প্রচলিত আছে অনেক কয়েকটি ধর্ম, যেমন খ্রীষ্টধর্ম, ইসলামধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, ইহুদিধর্ম, পার্সিধর্ম, জৈনধর্ম, শিখধর্ম, শিন্টোধর্ম, বাহাইধর্ম, কনফুসিয়াসধর্ম ও তাওধর্ম সহ আরো অনেক নাম-না-জানা ধর্ম। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই সকল ধর্মের অন্তর্ভুক্ত অনুসারীদের ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ আর সচেতন-চিন্তার ফলে প্রায় প্রত্যেক ধর্মেই জন্মনিয়েছে অনেক শাখা-উপশাখা, যেমন, খ্রীষ্টধর্মের মধ্যে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্ট সহ নানা সম্প্রদায় আর উপ-সম্প্রদায়, ইসলামধর্মের মধ্যে সুন্নি, শিয়া, সুফী সহ আরো অনেক মতবাদ, হিন্দুধর্মের মধ্যে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, ব্রাহ্ম সহ নানাহ সম্প্রদায়। বৌদ্ধধর্মের মধ্যে মহাযান, হীনযান ইত্যাদি, ইহুদিধর্মের মধ্যে আদি ইহুদি(Orthodox Jews), গোঁড়া ইহুদি(Conservative Jews), পরিবর্তিত ইহুদি (Reform Jews) এবং পুনর্ঘটিত ইহুদি (Reconstructioned Jews) ইত্যাদি। এই সকল বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে, এই বিশ্বজগৎ তথা রহস্যময় জন্ম, জীবন আর মৃত্যুর বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণে অনেক মিল বিদ্যমান, যেমন প্রায় সব ধর্মেই মানুষের জীবন-মৃত্যুর খেলায় এক অবিনশ্বর জীবনের কথা বলে, অর্থাৎ প্রায় সব ধর্মেই বলে মানুষের মৃত্যুই জীবনের সবশেষ নয়, মৃত্যুর পর আছে আর এক জীবন। কোন ধর্ম বলে এই ইহজীবনের কর্মফলের ভিত্তিতে আবার ঘটে পুনর্জন্ম এবং পুনর্জন্মের এই ঘূর্ণায়মানচক্রের ধারায় একসময় কর্মফলের পূর্ণ-নিবৃত্তিতে মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ ঘটে, আবার কোন কোন ধর্মমতে মৃত্যুর পর মোকাবিলা করতে হবে সৃষ্টিকর্তার শেষবিচার এবং সেই শেষবিচারে পাপ-পুণ্যের হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে একসময় অনন্তকালের জন্য স্বর্গ/বেহেস্ত বা নরকে/দোজকে গমন। প্রায় সব ধর্মেই মানুষের এই নশ্বরদেহে এক অবিনশ্বর "আত্মা"-এর অবস্থানের কথা বলে এবং মানুষের মৃত্যুতে শুধু এই নশ্বরদেহটারই বিনাশ হয় কিন্তু "আত্মা" থাকে চির-অক্ষয়, চির-অম্লান ও চির-জীবিত। আবার সব ধর্মেই আছে এই জগতে মানুষের বিরহ-বেদনা-মৃত্যু-শোক-দুঃখে জর্জরিত জাগতিক জীবনের সকল তাপ থেকে মুক্তির জন্য নানাবিধ আধ্যাত্বিক দর্শন ও বিধি-বিধানI ন্যায়-নীতির বিষয়েও এক ধর্মের সাথে আর এক ধর্মের অনেক মিল বিদ্যমান - যেমন সততা, সত্যতা, দয়া, দান, মায়া, করুণা, প্রেম, ভালোবাসা প্রায় সকল ধর্মেরই মূল উপাদান।

এক ধর্মের সাথে অন্য আর এক ধর্মের অনেক মিলের মধ্যেও ধর্মে ধর্মে আছে অনেক অমিলও। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে বিভিন্ন ধর্মে সৃষ্টিকর্তার যে স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে তা কিন্তু সব ধর্মে এক নয়, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে বিরোধপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে হিন্দুধর্মের অনুসারীদের ভগবান যুগে যুগে মানুষরূপে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন যখন পৃথিবীতে ধর্মের ক্ষয়ে অধর্মের উত্থান হয়, আবার দেব-দেবীর মৃন্ময়-মূর্তি গড়ে হিন্দুরা তাঁর পূজা-অর্চ্চনা করে।  অপরদিকে ইসলামধর্মের অনুসারীদের নিকট মাটির দেবতাকে পূজা করা তো বহু দূরের কথা, এমনকি সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার কোন আকার বা রূপ কল্পনাকরাও এক ভয়ংকর পাপ। আবার খ্রীষ্টধর্মের অনুসারীদের কাছে যীশুখ্রীষ্ট ঈশ্বরের সন্তান আর বৌদ্ধধর্মালম্বীদের কাছে গৌতমবুদ্ধ স্বয়ং ভগবান।  

তবে একথা অতীব দুঃখের সাথে বলতেই হয় যে এক ধর্মের সাথে আর এক ধর্মের আধ্যাত্বিক বিষয়ে অনেক মিল থাকলেও কিছু কিছু বিষয়ে অমিলের কারণেই হোক বা কিছু মানুষের প্রচন্ড অহংবোধ  -- যেমন "আমার বিশ্বাসটাই একমাত্র সত্য বিশ্বাস" বা নিজের ধর্মের প্রতি আত্যন্তিক অন্ধ-মোহের কারণে বা অন্য কোন কারণে অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধার ফলশ্রুতিতে এ পৃথিবীতে এযাবৎকাল অবধি একই ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বা এক ধর্মের মানুষের সাথে আর এক ধর্মের মানুষের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।  কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক -- ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে খ্রীষ্টধর্মের ঐশতত্ব (Theology) নিয়ে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিবাদের কারণে শত-সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে।  ১৫৭২ সালে ২৬শে আগস্ট ফ্রান্সে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে সংঘর্ষে ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে পাঁচ থেকে দশহাজার প্রোটেস্ট্যানের মৃত্যু হয়েছে ক্যাথলিকদের হাতে।আর এটাতো বলাই বাহুল্য যে আমাদের এই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশে কেবলমাত্র ধর্মের কারণে দেশান্তরিত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ, আর ভয়াল হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উভয় ধর্মেরই লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তাদের নিজের দেশের এবং তার প্রতিবেশী ভাইয়ের হাতে কেবলমাত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মটি তার প্রতিবেশী বা স্বদেশী ভাইয়ের ধর্ম থেকে একটু ভিন্ন হওয়ার কারণে।  

আমার চিন্তা ও আমার অনুধ্যান 
আমি মনে করি শোক-তাপ-বেদনা-বিরহ-মৃত্যু জর্জরিত এবং অনিশ্চয়তা-ভরা এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনে মানসিক শান্তি, মানসিক উদ্দীপনা এবং মানুষের জীবনকে শোভন-সুন্দর-কল্যাণময় করার জন্য প্রতিটি ধর্মেই আছে নানাবিধ ইতিবাচক ও কল্যাণধর্মী উপাদান। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ইসলাম ধর্মে আছে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের সর্বময় কর্তা এক নিরাকার আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য আর আত্মসমর্পণ এবং তাঁর প্রেরিত মহানবীর প্রতি নিখাদ বিশ্বাস (ঈমান) স্থাপনের কথা; এই ধর্মেই আছে প্রতিদিন পাঁচবার নামাজপড়ার আর বৎসরে একবার একমাসব্যাপী রোজা (উপবাস)পালনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও করুণা প্রার্থনা করার এবং আত্মোপলব্ধি এবং আত্মশুদ্ধি লাভ করার কথা।এই ধর্মেই আরো আছে যাকাত, অর্থাৎ নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সমাজে সমতা আনয়নের কথা এবং এই ধর্মেই আরো বলা আছে সাম্যের অর্থাৎ মানুষের বিচারে আমির আর ফকিরে কোন ভেদাভেদ থাকবে না এমন মহৎ মানবতাবাদের কথা। খ্রীষ্টধর্মে আছে এক ঈশ্বরের কাছ থেকে আগত সকল মানুষের প্রতি আত্যন্তিক ভালবাসা প্রদর্শনের কথা: সেখানে আছে প্রত্যেক মানুষ তাঁর প্রতিবেশীকে নিজেরমতো করে ভালোবাসার মতো মহান উপদেশ বাণী। সেখানে আছে, যীশুখ্রীষ্ট মানুষের বেশে এই পৃথিবীতে জন্মেছেন মানুষকে স্বর্গীয় ভালোবাসার স্বরূপ শিক্ষা দেবার জন্য এবং তিনি পীড়িত, নিপীড়িত, দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, শৃঙ্খলিত মানুষের জন্য বহে এনেছিলেন আশার আলো। এই ধর্মে আরো আছে যীশুর স্বেচ্ছায় ক্রুশে আত্মহুতির মাধ্যমে সকল মানুষের পাপ বহন করার মধ্য দিয়ে সকল মানুষের জন্য ঈশ্বরের কাছে অনন্ত-জীবনের পথ উন্মুক্ত করার কথা। সেখানে আরো আছে ঈশ্বর-পিতারূপে এই বিশ্বসৃষ্টির কথা,  ঈশ্বর-পুত্ররূপে(যীশুখ্রীষ্ট)এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর মৃত্যু আর পুনরুত্থানের মাধ্যমে মানুষের পাপ নিজে গ্রহণ করে মানুষকে পাপ থেকে পরিত্রান করার কথা, এবং ঈশ্বর-পবিত্র-আত্মা (Holy Spirit)-রূপে এই পৃথিবীকে পবিত্রকরণের মতো মহান দার্শনিক তত্ত্বের কথা। হিন্দুধর্মের উপনিষদ (বেদান্ত)-এ আছে সর্বভূতে বিরাজমান এক স্বয়ম্ভু-পরমাত্মার কথা এবং তাঁর সাথে সকল জীবাত্মার একাত্মতার কথা অর্থাৎ এই বিশ্বচরাচরে ব্যাপ্ত এক পরমাত্মাই এই বিশ্বের সবকিছু সৃষ্টির মূল কারণ এবং এই মহাবিশ্বের সবকিছুর মধ্যে এই পরমাত্মা বিরাজমান, এবং সেই বিচারে এই বিশ্বের প্রতিটি জীব এক পরমসত্ত্বার অংশ অর্থাৎ জীব এবং পরমেশ্বর এক এবং একীভূত। এই উপনিষদেই আরো আছে এমন উচ্চমার্গের দর্শনের কথা যে "আমি আমার "দেহ" নই এবং "আমি" আমার মনও নই, আমি আমার দেহ-মনের খাঁচায় আবদ্ধ পরমাত্মার অংশবিশেষ এক জীবাত্মা - আর জীবের জাগতিক বাসনার নিবৃত্তিতে জীবাত্মা বিলীন হতে পারে পরমাত্মায় - যার আর এক নাম মোক্ষলাভ।" এই ধর্মেরই যোগশাস্ত্রে আছে সর্ববিধ ধ্যানের কথা অর্থাৎ যার অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ নিজের চেতনাকে জাগ্রত করে আত্মজ্ঞান লাভের নানাবিধ পন্থার কথা।আবার এই ধর্মেরই শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় আছে কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ আর ধ্যানযোগের কথা - যার চর্চার মাধ্যমে মানুষ লাভ করতে পারে আত্মজ্ঞান এবং তার বাসনার নিবৃত্তি ঘটিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারে জাগতিক সুখ-দুঃখের অতীত আধ্যাত্বিক জগতে জীবনের অন্য এক মাত্রায়। বৌদ্ধধর্মে আছে এই মহাজগতের অসীম প্রজ্ঞার আলোকে নানাবিধ ধ্যানানুশীলনের মাধ্যমে মানুষের আলোকিত অবস্থায় (enlightened  state) উত্তীর্ণ হওয়ার উপায়ের কথা। এই আলোকিত অবস্থা হলো অসীম প্রজ্ঞাপূর্ণ পূর্ণ সচেতন অবস্থা যার মাধ্যমে সেই আলোকিত মানুষ কার্য-কারণ সম্পর্কের জটিল অতীন্দ্রিয় নিয়ম (mystical  law)-এ আবর্তিত এই জগৎ ও জীবনের পূর্ণ বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হবে। এই ধর্মে আছে এই জগতে স্থান আর কালের অসীম সীমানায় অবস্থিত সবকিছু এক অবিনাশী এককসত্বা, যাহা জীবন্ত, সংযুক্ত এবং অবিভাজিত। মানুষ যখন এই আলোকিত অবস্থায় উত্তীর্ণ হয় তখন সে বুঝতে পারবে এই জীবনে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জন্ম-মৃত্যু এক সূত্রে গাঁথা আর জীবনের এই পরম সত্য উপলব্ধিতে যে প্রজ্ঞাবান হয় তখন সেই মানুষ জন্ম-মৃত্যুতে এবং সুখে-শোকে থাকে অবিচলিত। এই ধর্মেই উপায় বর্ণনা আছ্ কি করে জীবনের এই পরম সত্যে উপনীত হয়ে আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক অনিশ্চয়তা সত্বেও মানুষ জীবনের অসীম আনন্দকে অনুভব করতে সমর্থ হবে। এই ধর্মেই বলা আছে জীবন একটি অবিরামধারা এবং এই ধারায় গ্রহ-তারকা থেকে শুরু করে সবকিছুই জন্ম(birth)-বৃদ্ধি(growth)-জরা(aging )-মৃত্যু(death) চক্রে আবর্তিতI এই ধর্মেই আরো আছে করুণা(সর্ব-জীবের প্রতি ভালোবাসা), সাম্য(সকল মানুষকে সমান জ্ঞান করা), মৈত্রী(সকলের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন)এবং অহিংসার কথাI এই ধর্মেই আছে জীবন নির্বাহে আটটি মহৎ পন্থা (সম্যক দৃষ্টি, সম্যক চিন্তা, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক উদ্যোগ, সম্যক মনোযোগ ও সম্যক একাগ্রতা) অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য নির্বাণ লাভের কথাI তেমনি জৈনধর্মে আছে এই জগতের সকল জীবের প্রতি অহিংসা প্রদর্শনসহ যেকোনো প্রকার আঘাত(শারীরিক বা মানসিক)করা থেকে বিরত থাকা বা অন্যকথায় সকল জীবের প্রতি গভীর ভালবাসা প্রদর্শন করার কথাI বাহাইধর্মে আছে সকল মানুষ এক ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং ঈশ্বর এই পৃথিবীতে বিভিন্ন পয়গম্বর যেমন বুদ্ধ, মুহাম্মদ, ঈশা ও কৃষ্ণের মাধ্যমে তাঁর বার্তা মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেনI জাপানের শিন্তোধর্মে(Shinto) আছে প্রকৃতি পবিত্র এবং এই পবিত্র প্রকৃতিকে পবিত্র আত্মারূপে পূজা করার কথা এবং সেই সাথে এই পৃথিবীর সকল জীব এবং সকল জড় পদার্থকে সম্মান প্রদর্শন করার কথা।  চীনের তাওধর্ম(Taoism) বা তাও-দর্শন জীবনের দুই বিপরীতমুখী কিন্তু পরিপূরক মূল-নীতি Yin ও Yan আর কথা বলেI Yin হলো পৃথিবী, অন্ধকার, স্ত্রীলিঙ্গ, অক্রিয়(passive) আর Yan হলো স্বর্গ, আলো, পুংলিঙ্গ, এবং সক্রিয়(active) এবং এই Yin এবং Yan যৌথভাবে এই জগতের সকল বৈপরীত্যের পরস্পরের উপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঐকতান(harmony)- এর কথা বলে। তেমনিভাবে পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মের অন্তর্গত ইরানের পার্শীধর্ম (Zoroastrianism)-ও আরো অনেক আধুনিক ধর্মের মতোই মানুষের ত্রি-মার্গ পথ: সৎচিন্তা, সৎবাক্য ও সৎকর্মের কথা বলে।    

পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মেই মানুষের জীবনকে উদ্দীপ্ত ও মহিমান্বিত করার লক্ষ্যে জীবন-সম্পৃক্ত অনেক ভালো ভালো উপাদান আছে বলেই দেখা যায় যে সকল ধর্মেই অসংখ্য সব মানুষ মহান-মানুষ হিসাবে পৃথিবীর আর সকল মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। উদাহরণ হিসাবে আমি প্রধান কয়েকটি ধর্মের কিছ মহৎ মানুষের নাম এখানে উল্লেখ করতে চাই, যেমন - সেইন্ট অগাস্টিন, মার্টিন লুথার, উইলিয়াম ক্যারি, মাদার তেরেসা, শ্রীচৈতন্য দেব, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, রামকৃষ্ণ পরমহংস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী, শ্রীঅরবিন্দ, জালালাদ্দিন রুমি, সাদি সিরাজী, হযরত শাহজালাল, সম্রাট আকবর, আবুল কালাম আজাদ (মৌলানা আজাদ), কাজী নজরুল ইসলাম, নাগার্জুন, সম্রাট অশোক, অতীশ দীপংকর, দালাইলামা (১৪তম), ডাইসাকো ইকেডা প্রমুখ।

শেষে আমার আর একটা অনুভূতির কথা: সব ধর্মেই যেমন মানুষের জীবনকে সুন্দর ও শোভন করার জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর উপাদান আছে, আবার এমন অনেক উপাদান আছে যা সুন্দর-সুস্থ-যৌক্তিক বিচারে কোন কোন ক্ষেত্রে স্ববিরোধী এবং অনেক ক্ষেত্রে আপাতঃ-মানবতা-বিরোধী বলেও মনে হয়। এই ভালো আর মন্দের মিশেল বলেই মনে হয় বর্তমান কালের সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। এই প্রসঙ্গে আমি এখানে একটি উপমার উল্লেখ করতে চাই: একটা বাগানে হরেক রকমেরই ফুল থাকে, যেমন, গোলাপ, গন্ধরাজ, হাস্নাহেনা, শিউলি, কামিনী, মালতী, জুঁই, করবী এমনি আরো কত কি। তারা সকলেই সুন্দর, সকলেই মনোহর - এতদসত্বেও তাদের সকলেরই সৌন্দর্যের স্বরূপে আছে ভিন্নতা - কেহ গোলাপি, কেহ সাদা, কেহ লাল, আবার কেহবা হলুদ সহ কত বিচিত্র বর্ণের - তাদের গন্ধের মধ্যেও আবার কত বৈচিত্র!আমরা কি পারি এক ফুলের সৌন্দর্য আর সৌকর্ষের সাথে আর এক ফুলের তুলনা করতে? প্রতিটি ফুলই সে তাঁর নিজস্ব বিশেষ সৌন্দর্যে ও বৈশিষ্ঠে মহিমান্বিত। আমরা সবাই ফুল ভালবাসি - আমাদের এক এক জনের কাছে এক এক ফুলের সৌন্দর্যের স্বরূপ আলাদা। আমাদের প্রত্যেকের প্রাকৃতিক গড়নের উপর নির্ভরকরে এক এক জনের এক এক ফুলের প্রতি আছে একটু বেশি ভালবাসা বা একটু বেশি আবিষ্টতা! তেমনি ফুলের প্রতি আবিষ্টতার ভিন্নতার মতোই, আমাদের গড়ন, আমাদের প্রকৃতি অনুযায়ী আমরা এক এক জন এক এক ধর্মের প্রতি একটু বেশি অনুরক্ত বা আবিষ্ট। আর একটা কথা - ফুলের সৌন্দর্য আছে একথা যেমন সত্য, তেমনি কোন কোন ফুলে কাঁটাও থাকে, আবার সব ফুলেই পোকাও থাকতে পারে, এটাও তেমনি সত্য। তবে আমরা কি ফুলের সেই কাঁটাকে উপেক্ষা করে, ফুলের মধ্যে আশ্রিত পোকাকে দূরে সরিয়ে রেখে ফুলের সৌন্দর্যকে, ফুলের সৌরভকে আমাদের জীবনের অঙ্গ করি না? স্থান আর কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন ধর্মের প্রবাহমানতায় সকল ধর্মেই হয়তো তাদের মহিমাময় সব উপাদানের সাথে কোনভাবে কিছুপরিমানে অনাকাঙ্খিত উপাদান সংযুক্ত হয়েছে! তবে সেই কিছু পরিমান অনাকাঙ্খিত উপাদানকে ফুলের পোকার মতোই দূরে সরিয়ে রেখে আমরা কি পারি না তাদের সৌন্দর্যটুকু ফুলের মতোই আমাদের জীবনে গ্রহণ করতে? দুঃখ-শোকে জর্জরিত আর জীবন-মৃত্যুর খেলায় আবর্তিত এই মহারহস্যময় জীবনে মানুষ যদি পারে ধর্মের আধ্যাত্বিক সৌন্দর্যের নির্যাসটুকু গ্রহণ করে তার সাথে বিজ্ঞানের পার্থিব-বস্তুগত সত্যকে যুক্ত করে সকল মানুষকে এক জ্ঞান করে মানুষ তাঁর অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বের শিখাকে প্রজ্জ্বলিত করতে, তবেই হয়তো সকল মানুষের মন থেকেই ঘুচে যাবে এক ধর্মের মানুষ আর এক ধর্মের মানুষকে ছোট করে দেখার হীন মানসিকতা।

শেষ কথা 
আমরা যে, যে ধর্মেরই অনুসারী হই না কেন সেই ধর্মের প্রতি মোহগ্রস্ত না হয়ে বরং সচেতনভাবে সেই ধর্মের মূল মানবিক ও আধ্যাত্বিক স্বরূপটি অন্তরে ধারণ করে, সেই সাথে বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত শুদ্ধ ও যৌক্তিক জাগতিক আদর্শটি অন্তরে লালন করে, অথবা আমাদের কেহ যদি কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী না হয়েও কোন একটি মানবতাবাদী আদর্শকে অন্তরে ধারণ করে এবং সেই সাথে বিজ্ঞানের সত্যকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় প্রয়োগ করে এবং সেই সাথে অন্য আর একজনকে তাঁর  বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিরপেক্ষভাবে তাকে কেবল মানুষ ভেবেই সম্মান জানাতে পারি তবেই বোধ হয় আমরা বলতে পারবো যে মানুষ হিসাবে সেই মানুষের ভিতর মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়েছে এবং সেই মানুষ সত্যিকার "মানুষের ধর্ম"-এর অনুসারী হতে পেরেছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রা নির্বাহে "মানব ধর্ম'-ই হোক এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ধর্ম - যেখানে আমরা সকলেই এক প্রজাতি এবং আমাদের সকলের আদর্শিক ধর্ম হোক এক। বাহ্যিক জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণ হয়, মঙ্গল হয়, এমন নীতি-আদর্শ যদি আমরা আমাদের জীবনে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণকরে তা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে পালন করতে পারি তবেই এই পৃথিবী হয়ে উঠবে সকলের জন্য বাসযোগ্য কল্যাণময় আর শান্তিময় এক আবাসস্থল। সবশেষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "আত্ম-পরিচয়" প্রবন্ধ থেকে একটি ছোট্ট উদ্ধৃতি দিয়ে আমার এই লেখার সমাপ্তি টানছি "মানুষের আর একটা প্রাণ আছে, সেটা শরীর-প্রাণের চেয়ে বড়ো - সেটা তার মনুষ্যত্ব।"

মার্চ ২৬, ২০২১ সাল 
অমল রায়
ইকালুইট, নুনাভুট