অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
মুদ্রারাক্ষস - অনিরুদ্ধ আলি আকতার

’দিন হল সানির দুষ্টুমিটা আরো বেড়েছে। মুখে নানা করম মনগড়া কথা বলে আর সারা ঘর খেলে বেড়ায়। একটু পেট ভরা থাকলেই ওর আর কাউকে পাত্তা দেয় না। তবে মায়ের কান মলা বা বকাঝকা যে কম খায় তা নয়। এটা ভাঙছে, ওটা ফেলছে। সারা ঘর দৌড়াদৌড়ি করতে  করতে কাগজ-বই ছড়াচ্ছে। হাতের রঙ পেন্সিল দিয়ে দেওয়ালে দাগাচ্ছে আরো কতকি!

বিরাট দালান বাড়ি, দামি পাথরের মোজায়েক করা। দামি দামি ঝাড় লাগান। বিদেশী কাঁচের জানলা। আসবাবপত্রগুলো চোখ ধাঁধান কারুকার্য করা। বাড়ির বাইরে লাল পাথরের নকশা, আর ভেতরটা সাদা দামি কি একটা পাথর বসান। আলো পড়লে যে ঝকমক করে ওঠে। ঘরে ঢুকলে মনে হবে, ঘরতো নয় যেন একটা রাজপ্রাসাদ। একটা লোকই রয়েছে মেঝে, দেওয়াল আর আসবাবপত্র মোছার জন্য। বাড়ির একপাশে একটা বৈঠকখানা। সেটাও একেবারে নবাবী চালে তৈরি। সকাল সন্ধ্যে নানা লোকজন আসে, নানা দরকারে। সানির বাবা ধনজ্ঞয় সাধু এম.এল.এ হিসেবে বেশ দাপুটে। এলাকায় ওর কথায় বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। সরকার বদলের পর পাকপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে পার্টিতে। আগে একপ্রকার দাদাগিরি করত বলা চলা। আগের সরকারের আমলে ঠিকাদারিটা ছিল ওর পেশা আর নেশা ছিল রাজনীতি। ও যে চৌখস বুদ্ধির অধিকারী তা আর বলা লাগে না। আগের সরকারের আমলেও ও অনেক চেষ্টা করেছে পার্টিতে নিজের জায়গা করতে। কিন্তু হাতেগোণা কয়েকটা ছোট-বড়ো ঠিকাদারীর কাজ ছাড়া তেমন সুবিধা করতে পরিনি। পার্টি বদলের পর থেকে ওর পোয়া বারো। ছোট একটা ঠিকাদার থেকে সোজা এম.এল.এ।

ইদানিং পার্টিতেও কদর বেড়েছে। সকাল-সন্ধ্যে দামি গাড়ি নিয়ে ছুটছে এ মিটিং ও জনসভায়। আর বাড়ি থাকলে তো একের পর এক লোক আসতেই আছে। লোকলস্করের অভাব নেই। একটাই সমস্যা, ধনঞ্জয় লেখাপড়াটা তেমন জানে না। আর এটার কারণেই যাবতীয় কাগজ-পত্র দেখাশোনার করার জন্য রথিন বিশ্বাসকে রাখা হয়েছে। বিস্বস্ত। ডান হাত বললেও চলে। ধনঞ্জয় যেখানে যায় ওর সাথে রথিন সব সময়ই থাকে। লোকজন এলে আগে রথিনের সাথে কথা বলে। রথিনের সাথে সানির আবার খুবই ভাব। ও বাবার কোলে যতক্ষণ না থাকে তার থেকে রথিনের কাছেই থাকে বেশি। ওর যাবতীয় আবদার চলে রথিনের কাছেই। এম. এল. এর একমাত্র ছেলে বলে কথা। যখন যা চায় তখন তা চোখের নিমেষে চলে আসে বাড়িতে। এসবের ব্যবস্থা রথিনই করে। এমন কি এম. এল. এ হওয়ার পর ধনঞ্জয়ের পুরানো বাড়িটা ভেঙে যখন নতুন বাড়ি হয়েছে, তখন যাবতীয় দামি মার্বেল পাথর , ঝাড় সবই পছন্দ করে এনেছে রথিনই। বৈঠকখানায় ওর জন্য আলাদা একটা বসার ঘর। তার পাশেই আর একটা ঘরে বসে ধনঞ্জয়। সপ্তাহে কেবলমাত্র রবিবার  সকালে ঘন্টা দুই-তিন ঘন্টা সময় দেয় দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষদের সাথে কথা বলাতে।

ব্যস্ত মানুষ। পরিবারের সাথে তেমন সময়ই দিতে পারে না বললেও চলে। তবে যত রাতই হোক বাড়ি ফিরে ছেলেটাকে একবার কোলে নিয়ে আদর না করে ও ঘুমায় না। মাঝে মাঝে কাজ-কর্মে একটু ফুরসত হলে সারা দিনই প্রায় ছেলেটার সাথে খুনসুটি করেই কাটিয়ে দেয় ধনঞ্জয়। রথিনকে বলাই থাকে সব সামলে নেওয়ার জন্য। সানি কথা বলে বেশ টকটক করে, কিন্তু বাবার কাছে এলে অতটা নয়। আসলে বাচ্চাদের ধরণই এই রকম, যাকে ওরা বেশি দেখে, যে ওদের বেশি আদর করে তার কাছেই ওরা নিশ্চিন্ত বোধ করে। সানি ধনঞ্জয়কে তেমন পায় না বলেই বোধ হয় ওর কাছে এলে ও একটু চুপচাপ হয়ে যায়। তবে ইদানিং ধনঞ্জয়ের সাথে সানির বেশ ভাব হয়েছে। বাবা বাড়িতে এলেই ছুটে যায়। ও জানে, বাবা বাড়িতে এলেই ওর বেশ বড়োসড়ো একটা চকলেক পাওনা হয়। তাই উঠোনে গাড়ির আওয়াজ পেলেই ও ছুটে আসে বারান্দায়।

ওপরের ঘরে তেমন সানিকে উঠতে দেওয়া হয় না। ঘরটা নতুন। বাইরের ইঞ্জিনিয়ার এনে প্লান করে ঘরটা বানান হয়েছে। ভিতরের নকশাটা খানিকটা তাজমহলের মতো। ঘরের ভিতর থেকে একটা ঘুরন্ত বড়ো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর তলা পর্যন্ত। নিচের মার্বের পাথরের থেকে চর্তুগুণ দামি পাথর লাগান হয়েছে ওপরে। ওয়াশরুশটা দেখার মতো। স্নানের টাব, কমোট, ধোপদুরস্ত ব্যবস্থা। কমোটের সামনে পা রাখার জায়গাটায় কি  এক ধরণের টাইস লাগান, যাতে মুখ দেখা যায়। আশেপাশের সাদা টাইসগুলো সোনার মতো চমকাচ্ছে। ওপরে থাকে ধনঞ্জয়। সানি সারা দিনে যেভাবে নোংরা করে, দেওয়ালে দেওয়ালে রঙ পেন্সিল দিয়ে আঁক কাটে তাতে একবার ওপরে এলে ঘরটার বারোটা বেজে যাবে। তাই ধনঞ্জয়ের কড়া হুকুম, ছেলে যেন ওপরে না আসে। আর ওপরে যদি আসেও তবে সাথে যেন কেউ না কেউ থাকে।

কাজের বহর বেড়েছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আরো একটা দামি গাড়ি এসেছে বাড়ি। এলাকায় বেশ কিছু জমিও কিনেছে ধনঞ্জয়। মানুষের মুখ বলে কথা। কেউ কেউ তো বলতে শুরু করেছে—কাঙাল ধনা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে ক’দিনেই। পাড়ার চায়ের দোকানে কে যেন সেদিন বলল—ভোটে দাঁড়াও কেল্লা ফতে। প্রথমে টাকা দিয়ে ভোট কেন, তারপর দশগুণ টাকা ফেরত নাও। ভালো ব্যবসা। চায়ের দোকানে সারা দিন একশো কাপ চা বেঁচে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু’শো টাকা রোজগার। আর নেতা হতে পারলে দিন না ঘুরতেই একাউন্টে লাখ লাখ টাকা। আর যদি মাঝে মাঝে এক-অধটা বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড় আসে তাহলে তো চারতলা বাড়ি,গাড়ি হতে সময় লাগবে না। কথাগুলো যে ধনঞ্জয়ের কানে যায় না তা নয়। তবে ও এসব গায় মাখে না।

প্রত্যেক স্বাধীনতা দিবসে এ ক্লাবে ও  স্কুলে পতাকা উত্তোলন করতেই হয় ধনঞ্জয়কে। পার্টি অফিস তো আছেই। এ দিনটা আসলেই ওর বাড়ি থেকে দু’টো দামি গাড়ি বেরোয়। বেশ কয়েকজন সাথে থাকে ওর। এখানে ওখানে ঘুরে পতাকা উত্তোলন করে, দেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নানা কথা বর্তা বলে  প্রত্যেক বারই বেশ হাততালি পায়  ও। বিশেষ করে সানির স্কুলে  তো ওকে যেতেই হয়। সাদা ধোপদূরস্ত পোশাকে ছেলের স্কুলে গিয়ে পতাকা উত্তোলনের পর ও যখন মাইকে স্বাধীনতা সম্পর্কে গালভরা কথা বলে তখন সানিও কেমন যেন অবাক হয়। ওর বাবা কত্তো বড়ো মানুষ! কত্তলোক ওর বাবার কথা শুনছে হাঁ করে। বুকটা ফুলে ওঠে ওর।

সেদিন স্বাধীনতা দিবসের সারিতে দাঁড়িয়ে সানি দেখেছিল, ওর বাবা বুক ফুলিয়ে পতাকা উত্তোলন করছে। সানিও হাতের পতাকাটাও বেশ শক্ত করে ধরে বাবার সাথে গলা মিলিয়ে ছিল জাতীয় সংগীতে। ছুটে এসে ধনঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করেছিল—বাবা,এই পতাকাটা আমি বাড়ি নিয়ে যাব? ঘরে টাঙিয়ে রাখব। ধনঞ্জয় ছেলের কথা শুনে একবার হেসে ছিল।

দুপুর বেলা সানি অন্য দিনের মতো স্কুল থেকে ফিরে পতাকাটা কোনো রকমে মায়ের হাতে দিয়ে  রঙপেন্সিল দিয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে আঁক কাটছিল। কখন যে ও সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে  ওপরের ঘরে চুরি করে উঠে গেছিল তা কেউ দেখিনি। ঘুরতে ঘুরতে ও ওয়াশরুমের ভিতরে ঢুকে মনের সুখে সাদা পাথরের ওপর আঁক কেটেছে অনেকক্ষণ। মায়ের ডাক শুনে টুপ করে নিচে চলে গিয়ে আবার খেলতে শুরু করেছে রং নিয়ে। আঁকার মাস্টার এক দিন ধনঞ্জয়ের সামনেই বলেছিল—সানির আঁকার হাত ভালো। এই বয়সেই ও বেশ ভালো রঙ করতে শিখেছে। জাতীয় পতাকা, পয়সা-টাকা, মানুষের মাথা এসবই বেশ ভালো আঁকতে শিখেছে ও। ঠাট্টা করে রথিন বলেছিল—কার ছেলে দেখতে হবে না! আমাদের সানি বড়ো হয়ে লিয়নোদ্য দ্যা ভিন্চি হবে।

ঘুমভেঙেই ধনঞ্জয়ের প্রাতক্রিয়ার অভ্যেস। কিছু না হোক ওয়াশরুমটা ঝাঁচকচকে থাকা চাই। বাড়ির কাজের লোক তাই একবার করে ওয়াশরুমটা পরিস্কার করে যায় সকাল সকাল। আগের দিন পরিস্কার হয়েছে ওয়াশরুম। তারপর সানি এসেছিল ওয়াশরুমে। আজ বেরোবার তাড়াছিল ধনঞ্জয়ের। তাই ঘুম থেকে উঠেই  পড়িমরি করে ওয়াশরুমে ঢুকে প্রাতক্রিয়া সারছিল ও। দেওয়ালের গায়ে রঙিন আলো জ্বলছিল। আশেপাশের সাদা পাথরগুলোও চমকাচ্ছিল আগের মতোই। কমোটে বসেই ধনঞ্জয় ঠাণ্ডা সাদা পাথরে পা ঘষতে ঘষতে মনের সুখে সিলিংয়ের রঙিন আলোর দিকে তাকিয়ে হিসাব করছিল, গত ঝড়ে সরকারী গরহিসাবী কতটাকা ওর অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। হঠাৎই পায়ের নিচে একটা খসখসে কিছু অনুভব হওয়ায় ওর নজর পড়ে সেদিকে। তাকাতেই দেখে পায়ের নিচে মেঝেতে সানির আঁকা একটা ছবি, ওর পায়ের ঘষায় কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে।

অনিরুদ্ধ আলি আকতার
শিক্ষক, চন্দ্রকেতুগড় শহীদুল্লাহ্ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় (বাংলা বিভাগ)
উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত