চেতনার গতিপথ ও সমকালীন সাহিত্য - আলী রেজা
বাঙালির সাহিত্যচর্চা সব সময়ই একটি জাতীয় চেতনার গতিপথ ধরে এগিয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা, ভাষা আন্দোলনের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বৈরাচারবিরোধী চেতনাসহ সকল জাতীয় চেতনার পথ ধরেই নির্মিত হয়েছে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য। বাংলাসাহিত্য বাঙালির জাতীয় জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে- এ কথাটি শুধু ‘কথার কথা’ নয়। হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি যখন থেকে সংগঠিতভাবে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছে তখন থেকেই বাংলাসাহিত্য বাঙালি জাতির চেতনায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাসাহিত্য নান্দনিকতার যুগ পেরিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের যুগে প্রবেশ করে ব্রিটিশ শাসনামলে। এর আগেও সাহিত্যে প্রতিবাদ ছিল। কিন্তু তা রাজনৈতিক আন্দোলন তথা রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনামলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়’- বলে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার এই মহান বাণী উচ্চারণ করেন। বাঙালি জাতির চেতনায় স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়। তখন ছিল সিপাহি বিপ্লবের উত্তাল সময়। তারপর বিশ শতকের প্রথম দশকেই বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অসন্তোষ দেখা দেয়। স্বদেশী আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। স্বদেশী আন্দোলনকালে বাংলাসাহিত্য বাঙালি জাতির জীবনে অনুপ্রেরণা ও চেতনার উৎস হয়ে ওঠে। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরবিরোধী অবস্থান থাকলেও সে সময়ের সাহিত্য-সংস্কৃতি পরবর্তী সময়ে বাঙালির জাতীয় জাগরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি (বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত)’ কিংবা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল’সহ অসংখ্য স্বদেশী গান সেদিন জাতীয় চেতনার ধারক-বাহক হয়ে উঠেছিল। স্বদেশী আন্দোলনের চেতনায় রচিত হয়েছিল এক সমৃদ্ধ সাহিত্যের পরিমণ্ডল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাসাহিত্য আর এক নতুন চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। পরাধীনতার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠে সাহিত্য। শুধু পরাধীনতা নয়, শোষণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার কণ্ঠ হয়ে ওঠে সাহিত্য। রুশ বিপ্লবের সফলতা একদল কবি-সাহিত্যিককেও উজ্জীবিত করে তোলে। সাহিত্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে প্রবলভাবে। ধূমকেতু’র সম্পাদকীয়তে নজরুল সরাসরি বলেন, ‘ধূমকেতু সর্বপ্রথম ভারতের স্বাধীনতা চায়’। সর্বভারতীয় সকল নেতা যখন সায়ত্ত্বশাহনের দাবিতে ইংরেজ সরকারের সাথে নমনীয়ভাবে আবেদন-নিবেদনের পথে হাঁটছেন তখন একজন কবির এই স্বাধীনতার দাবি বিরাট গুরুত্ব বহন করে। নজরুলসাহিত্য বাঙালির চেতনায় আজো বহমান আছে। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী চেতনাকে লালন করেছে সাহিত্য। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে ও চার অধ্যায়, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী, নজরুলের মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকা বিপ্লবীদের উজ্জীবিত করেছে যুগে যুগে। সামাজিক প্রণয়োপাখ্যানের অমর স্রষ্টা হয়েও শরৎচন্দ্র জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে নীরব থাকেননি। সরাসরি কংগ্রেসের রাজনীতি করেছেন। তাঁর পথের দাবী উপন্যাস বিপ্লবীদের বাইবেল হয়ে উঠেছিল। বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যরা সাহিত্যকে শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তির হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। সেই অগ্নিযুগে যখন অধিকার আদায়ের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল শাসকগোষ্ঠী তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র, দীনেশ দাসসহ অনেকের সাহিত্যই মারণাস্ত্রের মতো শক্তিশালী ছিল। দীনেশ দাসের বিখ্যাত ‘কাস্তে’ কবিতার সাহসী উচ্চারণ ছিল ‘বেওনেট হোক যত ধারালো, কাস্তেটা শান দিয়ে বন্ধু’। তখন সাহিত্য ছিল জাতীয় মুক্তির চেতনায় সমৃদ্ধ।
সাতচল্লিশের দেশভাগ বাংলাসাহিত্যকেও বিভক্ত করে দেয়। এক শ্রেণির বুর্জোয়া সাহিত্যিক পাকিস্তানি ধর্মীয় আদর্শে লালিত হয়ে কিংবা লালিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্ত্বার আত্মপরিচয়ের মুলে আঘাত করে। বাঙালির ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) সে আঘাতকে মোকাবিলা করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন গতিপথ নির্মাণ করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় রচিত হয় এক সমৃদ্ধ সাহিত্য। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার একটি অপচেষ্টায় মেতে ওঠে শাসকগোষ্ঠী। এই অপচেষ্টাকে সমর্থন করে একদল মেরুদণ্ডহীন কবি-সাহিত্যিক। পুরো পাকিস্তান কালপর্বে বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনীতি, সাহিত্য, ও সংস্কৃতি একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে যায়। যার ফলে আমরা পাই কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা (১৯৭১)। পাকিস্তান কালপর্বে সাহিত্য ও সংস্কৃতি যেমন রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে তেমনি রাজনীতিও সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। ফলে পাকিস্তানপর্বেই আমরা খেলাঘর আসর, ছায়ানট ও উদীচী’র মতো প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হতে দেখি। যদিও রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির এই মেলবন্ধনের সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলেই।
একাত্তরপরবর্তী বাংলাসাহিত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ। পঁচাত্তরপরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদল মু্িক্তযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি। কারণ সাহিত্য ও সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মুলধারার রাজনীতিকে শক্তিশালী করার জ্বালানি হয়ে উঠেছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি। ফলে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে বিজয় অর্জিত হয়। নব্বইপূর্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু নব্বইপরবর্তী সাহিত্য-সংস্কৃতি কোন জাতীয় চেতনা ধারণ করতে পারেনি। এর একটি কারণ হলো নব্বইপরবর্তী সময়ে বাঙালির জাতীয় জীবনে সামগ্রিক অর্থে কোন সংকট দেখা দেয়নি। নব্বইপরবর্তী সংকটগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা দিয়েছে। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতি জাতীয় চেতনাবাহী কোন গতিপথ খুঁজে পায়নি। ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত, আত্মনির্মাণ, আত্মবিসর্জন, সামাজিক সংকট ও সামাজিক শাসনে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিনষ্টি এবং এর ফলে মানবাচরণের সামূহিক পরিবর্তন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের জগতকে করে তুলেছে বহুবর্ণিল। বাংলা সাহিত্য ক্রমশ হয়ে উঠেছে জীবনঘনিষ্ঠ । জীবনের জটিলতা, মনোজাগতিক দ্ব›দ্ব, প্রথাবিরোধী মনোভাব, ব্যক্তি ও সমাজের বিরুদ্ধ অবস্থানজনিত সংকট রবীন্দ্রযুগে শুরু হলেও রবীন্দ্রপরবর্তী যুগেও এই সংকট এসেছে প্রবলভাবে। রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম ব্যক্তিমানুষের কল্যাণে কাজ করে। মানুষও মানুষের কল্যাণে কাজ করে। এর অন্যথা হলে ব্যক্তিজীবনে নেমে আসে অশান্তি, অতৃপ্তি ও নানা সংকট। ব্যক্তিচিন্তায় যুক্ত হয় ক্ষোভ, হতাশা, দ্রোহ বা বিরুদ্ধবাদিতা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তির এই নানামাত্রিক নেতিবাচক প্রবণতাকে নিরীক্ষা করেন একজন সাহিত্যিক। চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতির বাঁকবদল ও অর্থনৈতিক স্তরবিন্যাসের প্রভাব নির্মোহভাবে নিরীক্ষা করলেই একজন সাহিত্যিক চলমান সময়ের বাস্তবতা খুঁজে পান।
যুগমানকে কেন্দ্র করে একটি বৃহত্তম ভাবের সন্ধান করেন সাহিত্যপাঠক। সাহিত্যকে সেই বৃহত্তম ভাবের অধিকারী করে তোলা সাহিত্যিকের প্রধান কাজ। সাহিত্যিকের দৃষ্টির সাথে সাহিত্যপাঠকের দৃষ্টির মিল হওয়াটা জরুরি। পাঠকেরও একটি নিজস্ব চিন্তার জগত আছে। সাহিত্যের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুকে পাঠক তার সেই নিজস্ব চিন্তার জগতের সাথে মেলাতে চান। তাই সাহিত্য যখন পাঠকের সেই চিন্তাকে আশ্রয় করে নির্মিত হয় তখনই সাহিত্য পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। সমকালীন সাহিত্য ব্যক্তির নানামাত্রিক প্রবণতা, নানামাত্রিক সংকট, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তি ও সমষ্টির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, পরিবেশ-প্রতিবেশ ইত্যাদি নিরীক্ষা করে নির্মিত হয়। এ কারণেই সাহিত্য এখন বহুমুখি ও বহুবিভক্ত। সাহিত্য এখন সামগ্রিক চেতনা ধারণ করতে ব্যর্থ। এটা সাহিত্যের সংকট নয়, এটা জাতীয় চেতনার সংকট। তাই একজন সাহিত্যিক এখন জাতীয় সংকটের বদলে ব্যক্তিসংকটকে নিরীক্ষা করেন। ব্যক্তিজীবনের সংকটগুলোকে তুলে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু সামগ্রিক সমাজনিরীক্ষণ ছাড়া সাহিত্য সকলের হয়ে ওঠে না। এই নিরীক্ষায় ঘাটতি থাকলে নান্দনিক সাহিত্য নির্মাণ করা সম্ভব হলেও জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
সাহিত্যের প্রথম বাঁকবদল বা গতিপথের পরিবর্তন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধপূর্ব সাহিত্য ছিল প্রধানত চিত্তবিলাসী ও নান্দনিক। চিত্তসুখ বা আনন্দ লাভ করাই ছিল তখনকার সাহিত্যপাঠের মূললক্ষ্য। সাহিত্যের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বাংলাসাহিত্যে ব্রিটিশবিরোধী চেতনা জোরদার হয়ে ওঠে। ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে এক নতুন ধারার প্রতিবাদী সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে। বিপ্লবীচেতনায় সমৃদ্ধ এই মানবতাবাদী সাহিত্য ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জাতীয়মুক্তির কথা বলে। শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশোষণ, ব্যক্তিসংকট, সামাজিক ক্ষয়-অবক্ষয় ব্যক্তিচিন্তাকে করে তোলে বিক্ষুব্ধ। এই বিক্ষুব্ধ চেতনাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দেয় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ত্বরান্বিত করে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানামাত্রিক সংকট, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও টিকে থাকার সংগ্রামকে উপজীব্য করে নির্মিত হয় সমকালীন সাহিত্য। মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, শোষণ-নির্যাতন, সামাজিক শোষণ, শিল্পায়নের প্রভাবে সামাজিক ভাঙন, যাপিত জীবনের বাঞ্চিত-অবাঞ্চিত পরিবর্তন, হতাশা-গ্লানি-অস্থিরতা ইত্যাদির চিত্রও উঠে আসে এই কালপর্বের সাহিত্যে।
সমকালীন সাহিত্য মূলত সমকালীন রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মনীতির সংকটকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে দেশত্যাগের মানবিক বিপর্যয়, দিখণ্ডিত বাংলার বিকলাঙ্গতা, বাংলাসাহিত্যের ইসলামিকরণ করার প্রচেষ্টা, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশকে থমকে দেওয়ার অপচেষ্টা ইত্যাদি জাতীয় সংকট থেকে জন্ম নেওয়া এক ভিন্ন সমাজমানস ধারণ করে বাংলাসাহিত্যে যে সমৃদ্ধ ধারা সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তী সময়ে সে ধারা টেকসই হয়নি। তৎকালীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নীতি-আদর্শিক বিচ্যুতি, অস্তিত্বের সংকট ও রক্ষণশীল মনোভাব দেশভাগপরবর্তী সাহিত্যে প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান- এ সব রাজনৈতিক আন্দোলনকেন্দ্রিক সাহিত্য ছিল জাতীয় চেতনাবাহী। বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থা, স্বৈরশাসন, অর্থনৈতিক শোষণ, মানবিক মর্যাদার বিনষ্টি এ কালপর্বের সাহিত্যকে করে তুলেছিল প্রতিবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ। একাত্তর পরবর্তী সাহিত্য আর এক নতুন বাঁকে চলে আসে। এই বাঁকবদলের ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য যে গতিপথ লাভ করে সে পথেই চলছে সমকালীন সাহিত্য। নতুন দেশ প্রাপ্তির স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নিয়ে শুরু হলেও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা যুগমানসকে পাল্টে দেয়। পাল্টে দেয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের চরিত্র। রাজনীতির নতুন বিন্যাসের ফলে সাহিত্যও ধারণ করে নতুন মেজাজ। নতুন নিরীক্ষায় সাহিত্য হয়ে ওঠে আর এক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ফলে নব্বইপরবর্তী সাহিত্য আবার গণমুখি হয়ে ওঠে। ব্যক্তিসংকট, ধর্মান্ধতা, যৌনচেতনা, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির মনোজাগতিক দহন ও নিঃসঙ্গতা এ সময়ের সাহিত্যকে করে তোলে বিপুল বৈচিত্র্যের অধিকারী। কিন্তু এই বৈচিত্র্য কোন জাতীয় চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি। আসলে নব্বইপরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্য কোন গতিপথ খুঁজে পায়নি। ধারণ করার মতো কোন জাতীয় চেতনা যুগমানসকে প্রভাবিত করতে পারেনি বলেই এ যুগের সাহিত্য ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে গেছে। তাই আজও ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিপ্লবীচেতনায় সমৃদ্ধ সাহিত্যই পাঠককে টানে। আজও দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনায় সমৃদ্ধ সাহিত্য পাঠককে আলোড়িত করে। আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ সাহিত্য পাঠককে নাড়িয়ে দেয়। আজও কোন সাহিত্যকর্মে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের গন্ধ থাকলে পাঠক নড়েচড়ে বসে। বিভিন্ন কালপর্বের সাহিত্যের দিকে পাঠকের এই মনোযোগই সমকালীন সাহিত্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সমকালীন সাহিত্যকে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে।
সমকালীন সাহিত্য কোন জাতীয় চেতনাকে ধারণ করতে পারছে না। কারণ এখন কোন জাতীয় চেতনায় বিক্ষুব্ধ হচ্ছে না মানুষ। মানুষ এখন বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিসংকট নিয়ে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী মনোভাব ব্যক্তিকে প্রবলভাবে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। ব্যক্তিচিন্তা বিশেষ বিশেষ গতিপথে চলছে। আবার সে গতিপথও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। চিন্তা-চেতনার ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে জাতীয় সংকট প্রয়োজন সে জাতীয় সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে না জাতি। জাতীয় সংকটের চেয়ে ব্যক্তিসংকটই এখন মানুষকে বেশি তাড়িত করছে। পুঁজিবাদের প্রভাব ও আনুকূল্য একটি শ্রেণিকে অতি বিত্তবান করে তুলছে। অন্যেরা পিছিয়ে পড়ছে ক্রমশ। ফলে এখন সংকট মানেই ব্যক্তিসংকট। জাতীয় সংকট বলে কিছু নেই। তাই জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ সাহিত্য এখন নির্মিত হচ্ছে না। সাহিত্যিক এখন নিজেকেই নির্মাণ করতে পারছেন না। নিজের মানসিক নির্মাণটা সঠিকভাবে না হলে সাহিত্য নির্মাণে পূর্ণতা আসবে কীভাবে?
পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবে ব্যক্তি এখন এতোটাই বিচ্ছিন্ন যে কোন সামষ্টিক চেতনা তাকে আর তাড়িত করে না। সংকটগুলো এখন একান্তই নিজস্ব। তাই সংকট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি আর সমষ্টির কাছে যায় না। ফলে সামষ্টিক চেতনা বলতে এখন তেমন কিছুই নেই। সামষ্টিক চেতনা ছাড়া সাহিত্য কোন গতিপথ খুঁজে পায় না। সামাজিক পরিবর্তন ব্যক্তিচেতনাকে নানামূখি করে তুলেছে বলেই একটি বিশেষ সাহিত্যকর্ম বা একটি বিশেষ সমাজচিত্র সাধারণ পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারছে না। ফলে পাঠক পড়ছে প্রচুর। ভুলেও যাচ্ছে একইভাবে।
সমকালীন সাহিত্য সবকিছুই ধারণ করে। অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ, অতি সুন্দর থেকে অতি কুৎসিত- সবকিছুই সাহিত্যের উপাদান হয়ে উঠেছে। একজন সাহিত্যিকের অনুসন্ধানের সীমা এখন ব্যক্তির মনোজগত থেকে মহাকাশ পর্যন্ত। কিন্তু শ্রেণিবিভাজিত সমাজে কোন সাহিত্যই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। আবার একটি শ্রেণিতে স্বার্থের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা দেখা দেয় স্বাভাবিকভাবেই। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে অভিন্ন চিন্তার অনুসারী একটি পাঠকমণ্ডলি তৈরি না হলে কোন সাহিত্যকর্মই পাঠকের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে না। চিন্তার ভিন্নতাকে পরিহার করে পাঠককে অভিন্ন চিন্তার আওতায় আনার জন্য যে জাতীয় সংকট বা জাতীয় সংকটপ্রসূত জাতীয় চেতনার প্রয়োজন সেই জাতীয় চেতনার অভাবেই যে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে না এ কথা অনেকাংশেই সত্য। এটা শুধু লেখক-পাঠকের সমস্যা নয়; এটা যুগমানসের সমস্যা।
একজন সৃষ্টিশীল লেখক বিক্ষুব্ধ হলেই তাঁর হৃদয়ে বুদবুদ সৃষ্টি হয়। প্রকাশ করার একটি ব্যাকুলতা পেয়ে বসে লেখককে। বিক্ষুব্ধ লেখক মানেই প্রকৃত লেখক। অন্যায়, অনিয়ম, অসঙ্গতি, শোষণ, নির্যাতন একজন প্রকৃত লেখককে বিক্ষুব্ধ করবেই। প্রথাগত লেখক কখনো বিক্ষুব্ধ হন না। তাঁরা কালস্রোতে গা ভাসিয়ে চলেন। প্রথাগত বিষয় নিয়ে নান্দনিক সাহিত্য নির্মাণ করেন। কিন্তু বর্তমানে সাহিত্য শুধু নান্দনিক মূল্য বহন করে না। মানবজীবনের তমসাবৃত দিকটিকে উন্মোচন করাও সাহিত্যের কাজ। ফলে লেখককে উভয় দিক সামলাতে হয়। যাপিত জীবনের কদর্য দিকগুলো সাধারণত প্রথাবিরোধী। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় এই প্রথাবিরোধী বিষয়গুলো নির্মোহভাবে সাহিত্যে তুলে আনা একজন লেখকের সামাজিক দায়িত্ব। তবে এই তুলে আনার কাজটি মার্জিত ও শিল্পিত হতে হবে। সমাজবাস্তবতার চিত্র যতই কদর্য হোক, সেটাকে শিল্পিত করেই উপস্থাপন করতে হবে সাহিত্যে। সমকালীন সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার চিত্র অতিশয় নগ্নভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতা যতটা প্রবল, সাহিত্যকে শিল্পিত করার প্রবণতা ততটা প্রবল নয়। ফলে সমকালীন সাহিত্য যতটা বক্তব্যধর্মী, ততটা হৃদয়গ্রাহী নয়।
ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধকে লালন করে। ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা মানুষের মনোজাগতিক দুরত্বকে বাড়িয়ে দেয়। চেতনার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না বলে লেখকরাও আজ পরস্পর বিচ্ছিন্ন। সম্মিলিতবোধের বিকাশ না হলে সাহিত্য বহুগামী হয়ে যায়। এই বহুগামিতা বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু কোন বোধের বিকাশ ঘটাতে পারে না বলে তা পাঠকমনে স্থায়ী আসন লাভে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার দায় শুধু লেখক-পাঠকের নয়। এর জন্য যুগমানসকেও দায়ী করা চলে। সমকালীন সমাজব্যবস্থা প্রধানত পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের কথা বলা হয় তা মূলত অবকাঠামোগত জাগতিক সমাজ। মনোজাগতিক চেতনাবাহী কোন সমাজ নয়। ফলে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি পুঁজিবাদের লেজুড় হয়ে টিকে থাকে। এই টিকে থাকা মানে চেতনাহীন হয়ে টিকে থাকা। এ কারণেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বাইরে যতটা সরব, ভেতরে ততটাই নীরব। উপাদানে-অবয়বে যতটা আকর্ষণীয়, ভেতরে ততটা প্রাণবন্ত নয়। জাতীয় চেতনার দীনতা থেকেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সাহিত্যকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পাঠকের মানসিক প্রস্তুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানসিক প্রস্তুতি না থাকলে সাহিত্যের মর্মমূলে ভেতরে ঢুকতে পারবেন না পাঠক। এখন প্রশ্ন হলো কে পাঠককে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবে? রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, ব্যক্তিসম্পর্কের নানামাত্রিক ঘাত-প্রতিঘাত ও সামূহিক সংকট একজন পাঠকের মানসগঠনে বা মানসিকভাবে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তির আর্থিক অবস্থানও তার আগ্রহের বিষয়টিকে নির্ধারণ করে। একজন সংকটাপন্ন ব্যক্তির আগ্রহের সাথে একজন স্বচ্ছল ও সংকটমুক্ত ব্যক্তির আগ্রহ কখনো মিলবে না। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ভিন্ন হলে ব্যক্তির মানসকাঠামোও ভিন্ন হয়ে যায়। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা ব্যক্তিচিন্তার প্রতিকূল হলে ব্যক্তি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ব্যক্তির আগ্রহ ও ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা পাঠককে এতোটাই স্বতন্ত্র করে তুলেছে যে একটি গল্প বা কবিতা সাধারণ আবেদন নিয়ে সাধারণ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন মানসকাঠামো কোন কালেই কোন সার্বিক চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি। একটি সাহিত্যকর্ম যে খণ্ডিত সমাজচিত্রকে তুলে ধরে কোন পাঠক সেই খণ্ডাংশের আওতায় পড়লেই কেবল সাহিত্যকর্মটিকে হৃদয়ে ধারণ করবে। অন্যেরা শুধু পড়ে যাবে, কিন্তু মনে রাখবে না। বলা যায়, মনে রাখতে পারবে না। এ জন্য পাঠককে দায়ী করা চলে না। দায়ী করা চলে না লেখককেও। একই পরিমণ্ডলে অবস্থান করে ভিন্ন ভিন্ন চেতনা লালন করার ফলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। সমাধানের জন্য প্রয়োজন চেতনার ঐক্য। এ সময়ের সাহিত্যে যে চেতনার দীনতা চলছে তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন চেতনার ঐক্য। চেতনার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলেই সাহিত্য সঠিক গতিপথ লাভ করবে।
আলী রেজা
কবি ও প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ
-
নিবন্ধ // মতামত
-
10-04-2021
-
-