অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
বৃহন্নলা - ডাঃ শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়


কুমুর মনটা কাল থেকে ভালো নেই। থেকে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। কাজে ভুল হয়ে যাচ্ছে। কেউ ডাকলে সাড়া দিতে দেরি হচ্ছে। বৌদির চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়েছে। সকালে তো বৌদি বলেই বসলো, " কি ব্যাপার বলতো কুমু? তোর কি কিছু হয়েছে?"
     ভোর থেকে কুমুর অনেক কাজ থাকে। সে আর বৌদি দুজনে মিলে মিষ্টিকে ঠেলাঠেলি করে ঘুম থেকে তোলে। বৌদি স্কুলের ব্যাগ গোছায়, তো কুমু টিফিন তৈরি করে। তারপর মিষ্টিকে খাওয়ানোর পালা শুরু হয়। খাওয়ানো তো নয়, যেন একটা ছোটোখাটো যুদ্ধ। ঘুমচোখে মিষ্টি একবার বাঁয়ে হেলে পড়ে তো একবার ডাইনে। বেশির ভাগ দিনই মাখন-ভাত আর ডিমসেদ্ধ।  প্রতি গ্রাস মুখে নিয়ে সে অন্তত পাঁচ মিনিট বসে থাকে, এক এক গ্রাস গলাদ্ধকরণ করলে বৌদি আর কুমুর মুখে দিগ্বিজয়ীর হাসি ফুটে ওঠে তারই মধ্যে পুল কারের ড্রাইভার সুকুমারদার প্যাঁক প্যাঁক হর্ন বাজানোর আওয়াজ শোনা যায়। বৌদির খাওয়ানোর স্পিড বেড়ে যায়। কুমু তারই মধ্যে কোনোরকমে মিষ্টির চুল আঁচড়ে মোজা-জুতো পরিয়ে দেয়। সুকুমারদা হাঁক পড়ে, " কি হলো ? রোজ রোজ এতো দেরি করলে হবে?" কুমু একটু আদুরে গলায় বলে, "একটু দাঁড়াও না সুকুমারদা, প্লিজ।" কুমু জানে এতে কাজ হবে। তারপর তিনজনের দৌড় শুরু হয়ে যায়। মিষ্টিকে গাড়িতে চড়িয়ে বৌদি আর কুমু একটু দাঁড়ায়, যতক্ষণ না গাড়িটা রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
     কুমুর পোশাকী নাম কুমুদিনী। বয়স বাইশ বছর। দাদা-বৌদির সংসারে সে আজ চার বছর আছে। আঠারো বছর বয়সে এসেছিলো। গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। তারপর বাবা মারা গেলো। কুমুর দুটো ছোট ভাই। ওরা ওখানেই স্কুলে পড়ে। পাশের বাড়ির কাকিমা মাকে বললো, " কি আর করবে বলো ? সবই কপাল। আমি কলকাতায় যেখানে কাজ করি, ওপাড়ায় একজন কাজের মেয়ে খুঁজছিলো। ভালো ঘর। কিন্তু তুমি তো আর বাচ্চাদুটোকে ফেলে যেতে পারবে না। আমি বলি কি কুমুকে পাঠিয়ে দাও। সংসারে সাশ্রয় হবে, ওর জীবনটাও দাঁড়িয়ে যাবে।" মা প্রথমে রাজি হয় নি। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠেছিল, " কি যে বলো ? বাবা নেই বলে মেয়েটা কি জলে পড়ে গেছে ? ও যাবে পরের বাড়ি কাজ করতে ? " তারপর মাইনের অঙ্কটা শুনে মা একটু নরম হলো। তাই কুমু আজ এবাড়িতে।
     মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে কুমু এবাড়িতে এসেছিলো। পড়াশোনায় বিরাট ভালো না হলেও খুব খারাপ ছিল না। সংসারের অনটনের জন্য সেটা অকালেই বন্ধ হয়ে গেলো, তার ওপর অচেনা পরিবেশে থাকা, লোকের বাড়ি কাজ করে খাওয়া ! পান থেকে চুন খসলেই নিঃশ্চই অনেক কথা শুনতে হবে। এবাড়িতে এসে বৌদির স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে, মিষ্টির মিষ্টি মুখ দেখে আর দাদার উদার মনের পরিচয় পেয়ে কুমু সব দুঃখ ভুলে গেলো। কুমুর পড়াশোনায় উৎসাহ দেখে বৌদি  তাকে পাড়ার স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি করে দিলো। ঘরের কাজ সামলে পড়াশোনা করে কুমু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো। বাংলা অনার্স নিয়ে রবীন্দ্র ভারতী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো। বাড়ি থেকে হাঁটা পথে কলেজ। তাই ঘরের কাজ সামলে ক্লাস করতে খুব অসুবিধা হয় না।  অফ পিরিয়ডে কুমু বাড়িও চলে আসতে পারে। সব কিছু এখন যেন কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয় কুমুর।  তার ভাগ্য ভালো যে সে এবাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলো।
     মিষ্টির ব্যাপারে বৌদি বড় স্পর্শকাতর। মেয়ের আদর-যত্নে কোনো ত্রুটি বৌদি কখনো মেনে নিতে পারে না | কুমু এটা প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলো। মিষ্টিকে সে সবসময় আগলে আগলে রাখে প্রাণপণে। তাই বৌদির মন পেতে কুমুর বেশি দেরি হয় নি। যেমন বৌদির মনে হয় পুল কারে ঘুরে ঘুরে আসতে হয় বলে মিষ্টির বাড়ি ফিরতে দেরি হয়, দুপুরের খাবার খেতে দেরি হয়, এতে মিষ্টির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে।  তাই কুমুর দুপুরে অফ পিরিয়ড থাকলে বৌদি অফিস পৌঁছে গাড়ি ফেরত পাঠায়, যাতে কুমু স্কুল থেকে মিষ্টিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারে। কুমু জানে এটা বৌদির বাড়াবাড়ি, কিন্তু সে হাসিমুখে এই দায়িত্ব পালন করে। মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র এই তিনদিন তাই কুমুকে বাড়ির গাড়ি নিয়ে মিষ্টির স্কুলে যেতে হয় ওকে বাড়ি আনার জন্য।
     কালও প্রতি মঙ্গলবারের রুটিন মতো কুমু মিষ্টিকে আনতে স্কুলে গিয়েছিলো। ফেরার পথেই ঘটনাটা ঘটলো।  সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে ফিরছিলো কুমু মিষ্টিকে নিয়ে।  গোবিন্দকাকা গাড়ির কাঁচ তুলে এসি চালিয়ে  মিষ্টির সঙ্গে গল্প করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছিল। মিষ্টি সাধারণত গাড়িতে সারাক্ষণ বকবক করতে আসে। স্কুলে কি কি ঘটনা ঘটলো, কোন বন্ধু কি বললো, মিস কেমন করে কথা বলে সব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া চাই। বিবেকানন্দ রোডের মুখে আসতেই মিষ্টির সতস্ফুর্ত কথায় ছেদ পড়লো। গাড়ির কাঁচের ওপর একটা টকটক আওয়াজ। কুমু ফিরে দেখলোএকটা হিজড়ে জানালায় টোকা মেরে ভিক্ষা চাইছে। এই রাস্তাটাতে এটা একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রোজকারের মতো কুমু হিজড়েটাকে উপেক্ষা করে কুমুর গল্প শোনায় মন দিলো। কিন্তু আজকের হিজড়েটা যেন নাছোড়বান্দা। অন্যদিন মুখ ফিরিয়ে নিলে ওরা বুঝে যায়, বিরক্ত না করে অন্য গাড়ির দিকে এগোয়, কখনো কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না। এই হিজড়েটা সমানে জানালায় ধাক্কা মারতে লাগলো। বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, " তোমরা কেমন লোক গো বাবা? তোমাদের প্রাণে কি দয়ামায়া নেই? এতো বড় গাড়ি নিয়ে ঘুরছো আর দুটো পয়সা উপুড়হস্ত করতে পারো না?"
     কুমু তাও চুপ করে ছিল। কিন্তু বাদ সাধলো মিষ্টি। পুরুষালি চেহারা, কর্কশ গলার সঙ্গে পাউডার লিপ্ত মুখ, কাজল খচিত চোখ, কানে ঝোলা দুলের বাহারের যে অস্বাভাবিক মিশ্রণ তা তার শিশু মনে ভীতির সঞ্চার করলো। মিষ্টি কুমুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো, "ওকে যেতে বলো না কুমু মাসি, আমার ভয় করছে।" কুমু এমনিতে খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে, কিন্তু কি যে হলো তার সেদিন! মিষ্টির  ভীত সন্ত্রস্ত মুখখানা দেখে হঠাৎ মাথায় আগুন চড়ে গেলো।  রুক্ষ স্বরে হিজড়েটাকে ধমকে উঠলো সে, " এই, যাও শিগগিরই, লজ্জা করে না গাড়িতে টোকা মেরে ভিক্ষে করতে, খেটে খেতে পারো না?" কথাটা বলা মাত্র সামনে দাঁড়ানো মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে তার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো।  সেই চোখে এক সঙ্গে অনেকগুলো অনুভূতি খেলে গেলো- রাগ, দুঃখ, অভিমান, হতাশা! বা এমন হতে পারে সবটাই কুমুর মনের ভুল। কুমুর নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হতে লাগলো। মন খারাপের রেশটা বাড়ি আসা অবধি রয়ে গেলো। 

 ২
রতন যখন কলকাতায় আসে তখন ওর বয়স দশ বছর। মাকে রতনের ভালো করে মনে পড়ে না। ও যখন বছর পাঁচেকের আর ওর বোন রানু যখন দু বছরের তখন হঠাৎ একদিন মা যেন কোথায় উধাও হয়ে গেলো। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে বাবা চুপ করে থাকতো, বেশি জোর করলে রেগে গিয়ে বলতো "মরে গেছে।" একদিন রতন জোর করেছিল বাবাকে, "না, তোমায় বলতেই হবে।" বাবা সপাটে এক চড় মেরেছিলো রতনের গালে। তার পার থেকে আর কখনো রতন মায়ের নাম মুখে আনেনি। শুধু যখন খুব মন খারাপ হতো, তখন ভাসা ভাসা মনে পড়তো মায়ের মুখটা- শ্যামলা রং, দীঘল চোখ, নিটোল হাতদুটো। একটু বড়ো হতে পাড়ার লোকের কাছে কানাঘুষোয় শুনেছিলো মা নাকি যে ঠিকেদারের কাছে কাজ করতো তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে। ঝাপসা মনে পড়ে মায়ের হাতের ছোঁয়াটা। দিনমজুরি করে হাতে কড়া পড়ে গিয়েছিলো, তাও যখন মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতো, মনে হতো কি নরম হাত। মা যখন চলে গেলো মায়ের কি একবারও তার আর বোনের কথা মনে পড়ে নি? তাই জিতুকাকু যখন তাকে কলকাতায় নিয়ে আসার কথা বাবাকে বললো তখন তার খুব খারাপ লাগে নি। মা চলে যাবার পর বোনকে বাবা মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো। রতন সারাদিন একা একা গ্রাম চষে বেড়াতো। বন্ধুবান্ধব তার খুব বেশি ছিল না। কোথায় যেন একটা সংকোচ বোধ ছিল তার। গ্রামের আর পাঁচটা পরিবারের থেকে তাদের পরিবার কেমন যেন আলাদা। তার বয়সী ছেলেদের অনেকের বাপ্ মাকে ছেড়ে আবার ঘর বেঁধেছে এমনটা সে দেখেছে, কিন্তু মা থেকেও মা নেই এমন কোনো ছেলে ছিল না তার গাঁয়ে। রতন তাই আগাছার মতোই বড়ো হতে লাগলো। কোনো অপরাধ না করেও সে যেন অপরাধী হয়ে গেলো ভাগ্যের দোষে। গাছের ছায়াকেই তার মনে হতো সব থেকে নিরাপদ আশ্রয়, পুকুরের শীতল জলে গা জুড়িয়ে মনে মনে ভাবতো এমনি বুঝি ছিল মায়ের হাতের ছোঁয়া।  তাই জিতুকাকুর প্রস্তাবে সে খুশিই হলো। শহর যেন হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকতে লাগলো। অনেক দূরের কলকাতা শহর, যেখানে কেউ জানবে  না তার মা থেকেও নেই, যেখানে সে নতুন জীবন শুরু করবে।
     মানবাজার থেকে কলকাতার বাস ধরলো তারা। এই প্রথম রতন গ্রামের বাইরে পা রাখলো। ক্রমে ক্রমে সবুজ মাঠ, ধানক্ষেত, খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর মিলিয়ে গেলো, ধুলো-ধোঁয়া ভরা ইটের জঙ্গলে পা রাখলো রতন। জিতুকাকু কলকাতার কোন ক্যাটারিংএ রান্নার কাজ করতো। কলকাতায় শ্যামবাজারের কাছে কাছে ওদের ঠেক ছিল। রতনকে সে সোজা নিয়ে এলো বাবলুদার চায়ের দোকানে। দশ বছরের রতনকে দেখে বাবলুদা খুশিই হলো; বললো, " খাওয়া পরা পাবি, রাতে দোকানেই শুয়ে যাবি।" ভয়ে ভয়ে রতন জিজ্ঞাসা করলো, " আর মাইনা?" বাবলুদা যেন আকাশ থেকে পড়লো, "এখন মাইনে কি রে ব্যাটা? সবে এলি, আগে দেখি ক’টা চায়ের গেলাস ভাঙিস। যদি ঠিকঠাক কাজ করিস, পরে ভাববো" না বলার কোনো সুযোগ রতনের ছিল না, তাই সে সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে এক দিকে মাথা হেলাল।
     প্রথম প্রথম রতনের কথায় পুরুলিয়ার টান শুনে হাসতো সবাই। দোকানের বাঁধা খদ্দেররা নতুন মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করতো, " নাম কি রে?"  রতন লাজুক মুখে চোখ নামিয়ে উত্তর দিতো, " রতন বটে। " একচোট হাসির পরে কেউ প্রশ্ন করতো, " চা বানাতে পারিস?"  তৎক্ষণাৎ রতন জবাব দিতো, "লাই পারি।" হাসিখুশি সরল প্রকৃতির রতনের কথার ভঙ্গিমা আর মুখের অভিব্যক্তি খদ্দেরদের আমোদের কারণ হয়ে উঠলো। আড্ডা-প্রেমিকরা দোকানে বসে আড্ডা দিতো, রতনকে নিয়ে মজা করতো, আর রতনও তাদের কাপের পর কাপ চা সাপ্লাই করতো। এমনি করে দিন কাটতে লাগলো, দিনের পরে মাস গড়ালো, মাসের পরে বছর। রতন মন দিয়ে কাজ করে, খাওয়া-পরা পায়, সকাল সন্ধে নানারকম লোক দেখে, তারপর সারাদিনের পর দোকান বন্ধ হলে খেয়ে দেয়ে এক ঘুমে সকাল। জিতুকাকু আজকাল আর বড় একটা আসে না। বাবলুদাকে জিজ্ঞাসা করতে বললো ওরা না কি অন্য পাড়ায় উঠে গেছে। রতন তাও নাছোড়বান্দা। বলে, "বাবলুদা, একবারটি ফোন লাগিয়ে দাও না গো !" তার কথায় এখন শহরের প্রলেপ পড়েছে। বাবলুদা সত্যি ফোনে জিতুকাকুকে ধরালো।" " জিতুকাকু, বাড়ি যাবো লাই ?", রতনের গলায় অভিমানের সুর। কিন্তু যা শুনলো, তাতে তার উৎসাহে ভাঁটা পড়লো। বাবা না কি আবার বিয়ে করে সংসারী হয়েছে।  রতনের সেখানে না যাওয়াই ভালো। সেই লালমাটির দেশটা চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। সেই গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ মাঠ, সেই হাড়-কাঁপানো শীত, সেই কৃপণ বাদল-মেঘ। তার মা পর হলো, বোন পর হলো, এখন বাবাও আর আপন রইলো না। সব বাঁধন আলগা হতে সে প্রাণপণে শিকড় গাড়ল এই ছোট্ট চায়ের দোকানটাতেই। ধীরে ধীরে মরীচিকার মতো মন থেকে মিলিয়ে গেলো বাপের ঠেঙানি, মায়ের আদর, বোনের একঘেয়ে কান্নার সুর। সকাল-সন্ধে খালি চায়ের গেলাসের টুং-টাং শব্দ আর খদ্দেরদের আবদার, 'রতনা, চা দে তো এক কাপ "- এই হয়ে উঠলো তার জীবন। এর বাইরেও কোনো জগৎ থাকতে পারে এটা ভাবাও তার পক্ষে হয়ে উঠলো  বিলাসিতা।


সপ্তাহে তিন দিন দুপুর বেলা সুকুমার তক্কে তক্কে থাকে। সে জানে মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র- এই তিন দিন স্কুলের সামনে দুপুর বেলা কুমুদিনীর দেখা মিলবে। মেয়ে তো নয়, যেন বড়লাটের কন্যে- দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। কবে থেকে সুকুমার লাইন মারছে, গরবিনীর সে দিকে হুঁশই নেই । সকাল বেলা মেয়ে রেডি করতে দেরি হলে কি মিষ্টি মিষ্টি কথা, আর দুপুরে  কি না স্কুলের সামনে আর চিনতেই পারে না! সুকুমার জানে সে অতি সাধারণ। কোনোরকমে মাধ্যমিক পাশ। নেহাত গাড়ি চালানোটা শিখেছিল বলে পুল কারের ড্রাইভারের কাজ করে পেট চালাচ্ছে। বাড়িতে থাকার জায়গা নেই। দুই দাদা পরিবার নিয়ে দুটো ঘরে, মা খাটিয়া পেতে বারান্দায়। কুমু তাকে পাত্তা দেবে না এটাই তো স্বাভাবিক। বাড়িতে শোয়ার জায়গা নেই বলে রাতের বেলা সে পাড়ার ক্লাবে ঘুমোতে যায়। বিয়ে করে বৌকে ঘরে নিয়ে গিয়ে তোলবার জায়গা তার নেই। কুমুর ওপর বৌদির সুনজর পড়েছে, বৌদি তাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। কুমুকে পেতে চাওয়া তার কাছে বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার সমান। তবুও অবুঝ মন তো স্বপ্ন দেখা ছাড়ে না। সুকুমার ক্লাবের ছাদে রাত্রে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে সে মালিকের গাড়ি চালানো ছেড়ে দিয়েছে, নিজেই একটা বড়ো গাড়ি কিনে পুল কারের ব্যবসা চালাচ্ছে। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে- দুটো ছোট ঘর, এক চিলতে বারান্দা, বারান্দায় কুমু স্নান করে এসে কাপড় শুকাতে দিচ্ছে, কুমুর সিঁথিতে সিঁদুর। আচমকা দমকা হাওয়ায় স্বপ্নটা ভেঙে যায়। কুমুর মুখটা  ভাবতে ভাবতে কখন চোখে ঘুম এসে যায়।  আবার সকাল হয়, ক্লাবঘরেই প্রাতঃকৃত্য সেরে কোনোরকমে দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে সুকুমার ছোটে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করতে।  তারপর একের পার এক বাচ্চা তুলতে তুলতে এগিয়ে চলে গাড়ি নিয়ে। শিশুদের কলকাকলিতে ভোরে ওঠে গাড়ি। সে তখন সুকুমার নয়, সুকুমার কাকু - একগুচ্ছ তাজা ভোরের ফুলের মালী, এক ঝাঁক শিশুর গর্বিত অভিভাবক।   


রতন যে কি ভাবে বড়ো হয়ে গেলো কেউ যেন টেরই পেলো না। বাবলুদার ধমক, আড্ডাবাজদের হাসি-মস্করা, চায়ের কেটলির গরম ধোঁয়া আর গেলাসের টুং-টাং এর মধ্যে কখন যেন ছোট্ট রতনের কোমল শরীর তাগড়াই হয়ে উঠলো। দুবেলা দু-মুঠো ভাত পেটে পড়েই প্রথম যৌবনের পদক্ষেপে তার কাঁধ দুটো চওড়া হলো, বাহুর মাংসপেশী সবল হলো, কিন্তু মুখে শিশুসুলভ সরল হাসিটা আর চোখের উদাসী দৃষ্টিটা রয়ে গেলো। আর একটা পরিবর্তন হলো। আগে ধমক খেলে, টিটকিরি শুনলে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বের করে দিতো, এখন তার অল্পেতেই বড় রাগ হয়। আর এই রাগই তার কাল হলো। রতন এখন উনিশ বছরের ছেলে। নয় বছর হলো বাবলুদার চায়ের দোকানে কাজ করছে। আগে তো খাওয়া-পরা ছাড়া আর কিছু পেতো না সে, দু-চার বছর হলো বাবলুদা নামমাত্র টাকা হাতে ধরায়। রতন জানে তাকে ঠকানো হচ্ছে, তার পরিশ্রমের মূল্য সে পাচ্ছে না। তাও সে চুপ করে থাকে; কি করবে আর কোনো কাজ তো সে জানে না। নানা ধরণের মিস্ত্রিরা এসে চায়ের দোকানে ভিড় করে। মাঝে মাঝে রতনের মনে হয় ওদের জিজ্ঞাসা করে ওদের হাতে কোনো কাজ আছে কি না কিন্তু লাজুক প্রকৃতির রতনের আর শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলায় না। তা ছাড়া তার ওপর সব সময় বাবলুদার কড়া নজর। 
     সেদিন সারা দিনের খাটাখাটনির পর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করার সময় রতন বলেই ফেললো বাবলুদাকে, " বাবলুদা, আমার টাকা বাড়াও, আমার বয়স বেড়েছে, খরচাপাতি আছে, ওই টাকায় আর চলছে না।" শান্তশিষ্ট রতনের মুখে এমনভাবে নিজের চাহিদার কথা বাবলুদা আগে শোনে নি। সে অবাক হলো, রাগও হলো। বিরক্তির সুরে সে বললো, " কেন? তোর আবার খরচা কিসের ? একলা মানুষ! নেশাভাং করছিস না কি?" রতনের মাথায় ঠিক তখনই সেই দানবিক রাগটা চড়ে গেলো।  সে চিৎকার করে উঠলো, " একলা মানুষ বলে বিনি মাইনেতে খাটাবে সারা জীবন?  আমি টাকা নিয়ে কি করবো তাতে তোমার কি?” বাবলুদা প্রথমটায় হতবাক হয়ে গেলো। এ কোন রতনকে দেখছে সে?  সম্বিৎ ফিরতে চিৎকার করে বললো, " এতো বড় সাহস? বেরো  শিগগিরই আমার দোকান থেকে। যত বড় মুখ নয় ততো বড় কথা। তোর হাফ বয়সের একটা ছেলেকে তোর হাফ মাইনে আর হাফ ভাত খাইয়ে তোর ডবল কাজ করবো আমি। দেখি তুই কি করে পেটের ভাত জোটাস!”
     রতন হতভম্ব হয়ে প্রথমে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপার আর বাক্যব্যয় না করে টিনের সুইটকেসটা হাতে নিয়ে পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে গেলো দোকান ছেড়ে। রাগে অপমানে তার কানদুটো গরম হয়ে উঠেছিল। একবার পিছন ফিরে আর তাকালো না সে, পাচ্ছে ফিরতে মন চায়। যে দশ বছর বয়সে নিজের গ্রাম, নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে স্বেচ্ছায় পা বাড়িয়েছে তার আবার পিছুটান কিসের?  দোকানের ছেলেরাও কেউ তাকে ডাকলো না। চাকরি হারাবার ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদও করলো না। অনেক দিন বাদে সে আবার নতুন করে বুঝলো তার  কেউ কোথাও নেই। এই বিশাল পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা।
     হাঁটতে হাঁটতে শোভাবাজারের কাছে এসে একটা পুরোনো বাড়ির রোয়াকে রতন একটু বসলো। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে সে একটু হাঁফিয়ে গিয়েছিলো । তাছাড়া এর পর সে কি করবে, কোথায় যাবে তা  নিয়ে একটু ভাবনা-চিন্তারও প্রয়োজন ছিল । সেই সময় হঠাৎ দেখা হলো ললিতা-বিশাখার সাথে, খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই । রতনকে দেখে ওরা চিনতে পারলো । বাবলুদার চায়ের দোকানে ওরা বহুবার এসেছে। রতন তাই ওদের কাছে পরিচিত মুখ। রতনকে এতো রাত্রে সুটকেস নিয়ে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে তারাও কম অবাক হলো না। 
     উপায়ান্তর না দেখে রতন ওদের প্রশ্নের জবাবে সত্যি কথাই বললো। কাউকে না কাউকে তো বলতে হবে নিজের দুঃখের কাহিনী! ললিতা আগ বাড়িয়ে বললো, " তাহলে তো তোমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই গো! চলো আমাদের ডেরায়।" " তার মানে?"- রতন আঁতকে উঠলো। যাওয়ার জায়গা নেইবলে সে হিজড়েদের বাসায় থাকবে? এও কখনো সম্ভব? জোরে জোরে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে রতন তার অসম্মতি জানালো। বিশাখা অভিমান করে বললো," কেন রে? হিজড়ে বলে কি আমরা মানুষ নই? ঠিক আছে, বরাবর থাকতে না চাস, আজ রাতটুকুর মতো থাক, পেটে দুটো দানাপানি পড়ুক, তার পর যেখানে হোক চলে যাস।" হঠাৎ রতনের মনে হলো তার মালিক যার জন্য সে এতো দিন প্রাণপাত করে পরিশ্রম করেছে আজ তাকে তাড়িয়ে দিলো, দোকানের ছেলেরা কেউ তার দিকে ফিরেও তাকালো না, আর এই দুজন, যাদের সমাজ হেয় করে রেখেছে, আজ স্বল্প পরিচয় সত্ত্বেও তার অসময়ে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।  রতনের হঠাৎ ললিতা-বিশাখাকে ঈশ্বরের দূত মনে হলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে সুটকেস হাতে নিয়ে তাদের পিছন পিছন চললো তাদের আস্তানায়।


আজও গাড়িটা বিবেকানন্দ রোডের মুখে সিগনালে দাঁড়িয়েছিল। রোজকার মতো আজও কুমু মিষ্টির বকবকানি শুনছিলো। হঠাৎ মিষ্টি চিৎকার করে উঠলো "দেখো পিসি, সেই লোকটা যাকে তুমি বকেছিলে; দেখো দেখো ভয়ে আর এদিকে আসছে না।"  বলেই মিষ্টি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। কুমু গাড়ির জানালার বাইরে তাকালো। সত্যিই তো, সেই হিজড়েটা, এ গাড়ি সে গাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। কুমুর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই অন্যদিকে মুখ ফেরালো। হঠাৎ কুমু একটা অভাবনীয় কান্ড করে বসলো। হাত বাড়িয়ে ডাকলো ওকে, " এই শোনো, এদিকে এসো।" হিজড়েটা ভয়ে পালাচ্ছিল। কুমু আবার ডাকলো। এবার ভীত সন্ত্রস্ত মুখ নিয়ে সে কাছে এলো। কুমু লক্ষ্য করলো এ যেন অন্যদের থেকে একটু আলাদা। পুরুষালি চেহারা, কিন্তু মুখে মেয়েলি কোমলতা, আর চোখ দুটো কেমন উদাস। কুমু বললো, " সেদিন তোমার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি, তুমি কিছু মনে কোরো না, কেমন? " বলার সঙ্গে সঙ্গে কুমুর মনটা পালকের মতো হালকা হয়ে গেলো। বুকের ভিতর চেপে বসা পাথরটা নেমে গেলো। হিজড়েটা তাকালো, " কি আবার মনে করবো? হিজড়েদের আবার কেউ মানুষ মনে করে না কি?" কুমু যেন একটু লজ্জা পেলো, বললো, " তুমি হিজড়ে বলে তো তোমাকে বকিনি, তুমি ভিক্ষা করছিলে বলে বকেছি, খেটে খেতে পারো না?" উদাস চোখের কোনদুটো যেন একটু চিকচিক করে উঠলো, " কে দেবে কাজ? কাজ চাইলেই কাজ পাওয়া যায় বুঝি?" কুমু মাথা ঠান্ডা করে ভাবলো, সত্যি তো, সবার ভাগ্যে কি তার মতো দাদা বৌদি জোটে? কে দেবে কাজ রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো হিজড়েকে? এদের কি সব এসোসিয়েশন আছে না! বৌদিকে জিজ্ঞাসা করবে, বৌদি নিশ্চয় একটা উপায় বার করবে। ভাবতে ভাবতে গাড়ির বাইরে তাকিয়ে কুমুর সম্বিৎ ফিরলো। সিগনাল খুলে গেছে, গাড়ি এগিয়ে এসেছে। পরদিন কুমু স্কুলের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই পিছন থেকে সুকুমারের ডাক শুনতে পেলো। অন্যদিন কুমু সাড়া দেয় না, ভাব করে যেন শুনতে পায় নি। আজ তার মনটা ভালো ছিল, তাই পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলো, " কি বলছো?" এমন অপ্রত্যাশিত আচরণে সুকুমার একটু ঘাবড়ে গেলো। একটু থতমত খেয়ে বললো, " না, জিজ্ঞাসা করছিলাম, তুমি এসেছো? অনন্যা আমার গাড়িতে যাবে না?"  কুমু একটু হাসলো, "কেন তুমি জানো না সপ্তাহে কোন কোন দিন অনন্যা বাড়ির গাড়িতে যায়?" সুকুমার কি বলবে ভেবে না পেয়ে বললো, " জানি, কিন্তু মাঝে মাঝে ভুলে যাই।" কুমু এবার মন খুলে হাসলো, " আমার আসা মানেই তোমার ছুটি।" আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল সুকুমার? মনে পড়লো ক্লাবে বেসিনের আয়নায় নিজের মুখটাই প্রথম দেখেছিলো। নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে হতে লাগলো তার।

৬ 
সুকুমারের সঙ্গে আজকাল কুমুর অনেক কথা হয়। একপক্ষে ভালোই হয়েছে, স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার সময়টা কথা বলতে বলতে কখন কেটে যায় বোঝা যায় না। অন্যান্য বাচ্চাদের মায়েরাও দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সঙ্গে গল্প জুড়তে কুমুর একটু বাধো বাধো থেকে, হাজার হলেও সে তো তাদের সমগোত্রীয় নয়। কদিন মেলামেশা করে কুমু বুঝতে পারে সুকুমার ছেলেটা ভালো, উচ্চাকাঙ্খী কিন্তু সৎ আর পরিশ্রমী। পুঁথিগত বিদ্যা হয়তো খুব বেশি নেই, কিন্তু ছেলেটা বেশ ভদ্র আর বিনয়ী।
     প্রায় দু সপ্তাহ বাদে মিষ্টিকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় কুমু একটা অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করলো। অল্পবয়সী হিজড়েটা ফের এ গাড়ি থেকে ও গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু ভিক্ষা করছে না। হাতে রকমারি জিনিস- সস্তার লজেন্স, চিউইং গাম, হজমি গুলি, আমলকি, পান মশলা, আরো কত কি! কুমুদের লাল মারুতি গাড়িটা ও চিনে গিয়েছিলো, ছুটে এলো সেদিকে। কুমুকে বললো, " লজেন্স নেবে খুকির জন্য?"  কুমু প্রমাদ গুনলো, " এই রাস্তায় কেনা লজেন্স মিষ্টিকে খাওয়ালে আর দেখতে হবে না, বৌদি নির্ঘাত হার্ট ফেল করবে। কুমু কথা ঘোরাবার জন্য বললো, " তোমার নামটা সেদিন জানা হয় নি।" হিজড়েটা একটু হাসলো, তাকে বোধ হয় গাড়ির ভিতর বসে এই প্রথম কেউ নাম জিজ্ঞাসা করলো। একটু হেসে বললো, "আমার নাম রত্না। তুমি লজেন্স নেবে না? হজমিও নিতে পারো। তোমার কথায় আমি ভিক্ষা ছেড়ে ফেরিওয়ালার কাজ করছি।" কুমুর মনটা অজানা খুশিতে ভরে উঠলো। নিজেকে হঠাৎ খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করলো। সে সামান্য একটা মেয়ে, তার কথা একজনের মনে এতো গভীর ছাপ ফেলতে পারে?  আগে তো কখনো এমন করে ভাবেনি সে! কুমু গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা হাজমোলার প্যাকেট কিনলো, তার নিজের টাকা থেকে। জানালার ওপাশে কাজল-পরা চোখদুটো যেন কথা কয়ে উঠলো- সে চোখে কৃতজ্ঞতার ছবি।
     বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। কুমুর  যেন আজকাল সবসময় কেমন খুশি খুশি ভাব। কাজ করতে করতে গুনগুন করে গান করে, কখনো আবার অন্যমনস্ক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। বৌদির নজর এড়ায় না, কিন্তু সে মুখে কিছু বলে না; ভাবে বয়সের ধৰ্ম। কুমুর পরীক্ষা এসে গেছে, এখন আগের মতো আর অতো ঘন ঘন মিষ্টিকে আনতে স্কুলে যাওয়া হয় না। সকালবেলা মিষ্টিকে গাড়িতে তোলার সময় আজকাল মনে হয় সুকুমার যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, সে বোধহয় কিছু বলতে চায় কুমুকে। কিন্তু বৌদি চলে আসে বলে ফুরসৎ পায় না। আজ বৌদি ভিতরে ছিল, কুমুকে দেখে সুকুমার গলা নামিয়ে বললো, " স্কুলে যাওনা কেন? তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।" কুমু নিজের বুকের ধুকপুক শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো। কোনোরকমে বললো, " কাল যাবো।"
     কুমুর সারারাত ঘুম হলো না। সে জানে সুকুমার তাকে কি বলবে। কিন্তু সে তাকে কি উত্তর দেবে? মা চোখের জাল গোপন করে তাকে পরের বাড়ি কাজ করতে পাঠিয়েছে, বৌদি  নিজের বোনের মতো ভালোবেসে তাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। চালচুলোহীন অর্ধশিক্ষিত ড্রাইভারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলে এদের কাছে সে মুখ দেখাতে পারবে তো?  মা বলবে, "তুই আমাদের মান-ইজ্জতের কথা একবারও ভাবলি না কুমু?" বৌদি বলবে, " এই জন্য তোকে লেখাপড়া শেখালাম?" কিন্তু এইসব ছাপিয়ে সুকুমারের মুখটা কেবলই মনে পড়তে লাগলো। সেখানে কোথাও কোনো মিথ্যাচার নেই, সে জানে সুকুমারের তার প্রতি ভালোবাসা খাদহীন। কি করবে সে? অযোগ্য বলে সে সুকুমারের ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করবে? এতো কঠিন ধর্মসঙ্কটে বোধহয় কুমু আগে কোনো দিন পড়ে নি।


আজ কুমু তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বই নিয়ে বসেছিল। কিন্তু পড়ার মতো মানসিক অবস্থা আজ তার ছিল না। স্নান করে সে আজ তার প্রিয় সালোয়ার কামিজটা পড়লো, মুখে হালকা প্রসাধন করলো। যাবার সময় যত এগিয়ে আসতে  লাগলো, তার বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগলো। বেলা দেড়টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে কুমু বেরোলো। যাবার পথে বিবেকানন্দ রোডে রাস্তার অন্য পারে সেই কাজালনয়ানাকে দেখতে পেলো যে ভিখারিনী থেকে বিক্রেতা হয়েছে কুমুরই অনুপ্রেরণায়। ওপারে থাকায় কুমুর সঙ্গে তার কথা হলো না।  অন্যদিন হলে কুমু হয়তো জিজ্ঞাসা করতো তার ব্যবসা কেমন চলছে?  কোনটা বেশি লাভজনক? ভিক্ষা না লজেন্স বিক্রি? কিন্তু আজ তার আর অন্য কোনো দিকে মাথা কাজ করছিলো না। সুকুমার আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো। কুমু এসে দাঁড়ালো তার সামনে। বুকের মধ্যে তোলপাড়, তাও মুখ যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বললো, " বলো, কি বলব?" সুকুমার হেসে বললো, " তুমি জানো না কি বলবো?" কুমু মাথা নিচু করলো, তারপর নীরবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো। সুকুমার জিজ্ঞাসা করলো, "তোমার উত্তরটা জানতে পারি?" কুমু উত্তর দিলো না, শুধু গাড়ির ওপর রাখা সুকুমারের হাতের উপর হাত রাখলো। হৃদয় নিঙড়ানো অনুভূতির কাছে মস্তিস্ক প্রসূত সব যুক্তি হার মানলো। কুমুর হাতটা ঠান্ডা, কিন্তু ঘামে ভিজে। সুকুমার তার হাতের উপর অন্য হাতটা রাখলো, তারপর বুক ভরে নিঃস্বাস নিলো, তার মনে হলো সে আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ।
     স্কুলের ঘন্টা পড়তে আজ যেন কুমু বাঁচলো। অন্যদিন কত কথা, আজ কুমুর মুখে কোনো কথাই ফুটছিল না। মিষ্টিকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেও মনটা পড়ে রইলো অন্য কোথাও। ফেরার পথে দেখা হলো রত্নার সাথে।  রত্না এগিয়ে এসে বললো, " তোমাকে অনেকদিন দেখিনি। আজ আমার চকলেট নেবে তো?" কুমু হাসলো, " নিশ্চয়ই, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। আজ যাবার সময় তোমার মুখ দেখেছি, তাই আমার দিন ভালো গেছে।" রত্না একটা কিটক্যাটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো, "তাই না কি? আজ লটারী জিতেছ বুঝি?" এবার কুমু জোরে হেসে উঠলো, "ঠিক তাই। আজ আমি একজন বন্ধু পেয়েছি যে আমার সঙ্গে সারা জীবন একসাথে থাকবে কথা দিয়েছে।" রত্না বললো, " এ তো সত্যি খুব আনন্দের খবর, আজ আমি তোমার থেকে আজ কোনো পয়সা নেবো না।" কুমু ইতস্তত করলো,  "না, না, তা কি করে হয়, তোমার লোকসান হবে।" রত্না কোনো কথা শুনলো না, জোর করে কিটক্যাটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
     রত্না তার ঝুপড়িতে ফিরলো। এখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার হাসি কান্নার কোনো কৈফিয়ত এখানে তাকে দিতে হয় না। ঝাঁপিটা নামিয়ে রেখে সে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। চোখের কোল বেয়ে কখন জল এসে কাজল দিয়েছে গলিয়ে। বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকার পর রত্না উঠে গিয়ে বেসিনে মুখ ধুলো, সব প্রসাধন ঘষে ঘষে তুললো। শাড়ি, ডিজাইন করা ব্লাঊজ,পেটিকোট একে একে খুললো, এখন সে আর রত্না নয়, এখন সে একজন পূর্ণ যুবক রতন। গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরে ক্লান্ত রতন সতরঞ্চিতে  পিঠ ঠেকালো। বাবলুদার দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পর তার না ছিল খাবার পয়সা, না ছিল থাকার জায়গা। লালিত-বিশাখা সেদিন বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এক রাত তাদের আস্তানায় থেকে রতন বুঝতে পারে হিজড়েদের ভিক্ষা করে যা রোজগার হয়, তাতে তাদের পেট চলে যায়। দিশাহারা রতন শেষ পর্যন্ত নিজের ভেক বদলালো, এলাকাও বদলালো। নিজের এলাকায় থাকলে লোক চিনে ফেলার ভয় ছিল। বেশ চলছিল সবকিছু, ওই মেয়েটা কোথা থেকে এসে তার সব ওলটপালট করে দিলো। ওর ঘৃণা ভরা তিরস্কার, স্নেহ মাখা কথা রতনকে যে কি যাদু করলো! ওর জীবনে তো আগে কেউ কখনো এমন ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব নিয়ে আসেনি। রতন যেন কতদিন ধরে ওই মেয়েটাকে চেনে, তার মায়ের চোখ দুটো কি এমনি ছিল? রতন ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়লো, জিনিস বেচা শুরু করলো, কিন্তু হিজড়ের বেশটা ছাড়তে পারলো না। তাহলে যে ওই মেয়েটা তাকে আর চিনতে পারবে না, তার সাথে আর কথা বলবে না। রতনের খুব ইচ্ছে হতো সে রত্না থেকে রতন হয়ে একবার তার সামনে দাঁড়ায়, কিন্তু সাহসে কুলায় নি। আজ সে মুক্ত, আজ আর তার ওই খোলসের দরকার নেই। কুমু চলে গেছে তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে, শুধু যাবার আগে রতনকে তার সোনার কাঠির ছোঁয়া দিয়ে একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ করে দিয়ে গেছে, যে গরিব হলেও এখন থেকে  আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচবে ঠিক।  
     কুমু ভালোভাবে বি.এ পাশ করলো। সুকুমারের সঙ্গে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হলো। বৌদি খুশি হলো, মা-ও আপত্তি করলো না। দুজনে মিলে একটা ছোট ফ্ল্যাট  ভাড়া করে ঘর-সংসার করতে লাগলো। বছরগুলো ঘুরে চললো রেলগাড়ির চাকার মতো। কুমু এখন একটা ফুটফুটে ছেলের মা। সুকুমারের অবস্থা আগের থেকে ভালো। এখন সে নিজেই পুল কারের ব্যবসা করে। কুমু বাড়িতে বাচ্চাদের টিউশন ক্লাস নেয়। এখন অবশ্য কুমু গাড়ি চড়ে না। বাসে চড়ে কোনো কারণে সেন্ট্রাল এভেন্যুয়ের দিকে এলে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে নিজের অজান্তেই খোঁজে এক বৃহন্নলাকে, কিন্তু দেখা পায় না তার। কাঁচা বয়সের পাগলামির কথা মনে পড়ে যায়। দীর্ঘাকৃতি, বৃষস্কন্ধ রত্নার মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হতো এ নিশ্চয়ই ছদ্মবেশী অর্জুন, বৃহন্নলার বেশে এসেছে তাকে সাহচর্য দিতে। একথা ভাবলেই তার মন উড়তে উড়তে চলে যেত সেই দ্বাপরযুগে। ভাগ্যিস সুকুমার এসে  কল্পলোক থেকে তাকে হাত ধরে টেনে এনে নতুন স্বপ্নের জোয়ারে ভাসালো। নিজের ছেলেমানুষির কথা ভেবে মৃদু হাসে কুমুদিনী- সে আজ জানে কলিযুগের বৃহন্নলারা কখনো অর্জুন হতে পারে না। 

ডাঃ শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা, ভারত