অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
একটি বকের কাছ থেকে শিক্ষা – চিরঞ্জীব সরকার

   নেক রকম বক আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। এ বকেরা আবার খুবই মৎস্যপ্রিয় প্রানী। যে কোন স্রোতধারার কাছে এদের অবাধ আনাগোনা। ধানক্ষেতে যেখানে সাধারনত পানি থাকে সেখানেও তাঁদের সাবলীল বিচরন। উদ্দেশ্য একটাই। যদি ভাগ্যে জোটে লোভনীয় সে মৎস্য। আমরা এ গল্পটা মোটামুটি সবাই জানি। বাঘের  গলা থেকে বক  হাড় বের করে যখন প্রতিশ্রুতির পুরস্কার চাইতে গেল বেচারা বককে তখন বলশালী বাঘ পুরস্কারের বদলে তিরস্কার করে বলল তোর মত এ পুচকে বক আমার মুখে গলা ঢুকানোর পরও যে আমি ঘাড় মটকে দেইনি এর চেয়ে আর বড় কি পুরস্কার  তোর প্রাপ্য। গল্পের বাঘকে বক বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারলেও সে কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেই শিকারীর ফাঁদে পড়ে ছটফট করতে থাকে। সাদা ধবধবে বকগুলি যখন জলাশয়ের কাছে বা মাঠে বিচরন করতে থাকে তখন ওদেরকে দেখতে অপরূপ লাগে। ছোটকালে আমি খুব মাঠে মাঠে হাঁটতাম একাকী মনের আনন্দে আর কত বিচিত্র কিছু দেখতাম প্রকৃতির একেবারে কাছাকাছি থেকে। কাদা মাটিতে যখন ধানের চারা বপন করা হত বক তখন কোথা থেকে এসে যেন হাজির হত এবং কাদার ভিতর থেকে সন্ধান করত তাঁর আহার মিলে কিনা। বকগুলির কাছে গেলে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে গিয়ে বসত। সরে গেলে আবার কিছুক্ষন পর মাঠে নেমে আসত।
     বিভিন্ন রকমের বকের ভিতর এমন এক ধরনের বক আছে যা থেকে আমরা একটা মহান শিক্ষা পেতে পারি। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রকৃতিই মনে হয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। একটা বৃক্ষ কতখানি সহনশীলতা দেখায় তা যদি আমরা একটু গভীরভাবে ভেবে দেখি তাহলে এত সহজে আমরা উত্তেজিত হতাম না। আকাশের নীচে কতকিছু ঘটে যাচ্ছে, কত মেঘ এসে বৃষ্টি হয়ে মাটিকে সিক্ত করছে, সূর্য উদিত হয়ে পৃথিবীটাকে আলোকিত করছে আবার রাতের আকাশে চাঁদ এসে দুহাতে স্নিগ্ধতা বিলিয়ে দিচ্ছে। সবকিছুই আকাশ পর্যবেক্ষন করছে কিন্তু সে নিজে নির্বিকার। সে এ ঘটনাপ্রবাহের ভিতরে  থেকেও মনে হয় ঘটনা থেকে সম্পূর্ন পৃথক। আর আমরা একটু কিছু ঘটলেই বকবকানি শুরু করে দেই। এক সাগর বাতাসের ভিতর আমরা বসবাস করছি কিন্তু সে বাতাসকে আমরা খালি চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু এ বাতাস ছাড়াতো আমরা এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারি না। আসলে প্রকৃতির এ বিশাল পুস্তকের অনেক পৃষ্ঠাই এ খোলা চোখ দিয়ে পড়া যায় না সে পৃষ্ঠাগুলির মর্ম মন দিয়ে উপলদ্ধি করতে হয়, হৃদয় দিয়ে গ্রহন করতে হয়।
     বক ধ্যানী তপস্যীর মত এক পায়ে স্রোতধারার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কখন এখানে আসবে তাঁর ঈপ্সিত মৎস্যটি। সে অনেক ছোট মাছকে যেতে দেয় কিন্তু অপেক্ষায় থাকে তাঁর পছন্দের মাছটির জন্য। সে কিন্তু ধৈর্য্য হারায় না। গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করতে স্রোতধারায় চলমান মৎস্যদেরকে। বক যদি ছোট মাছগুলিকে ছোঁ মেরে ধরত তাহলে পানিতে সৃষ্ট শব্দে অপেক্ষাকৃত বড় মাছ আর ওপথ দিয়ে আর চলত না। এমন দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে যখনি বক বুঝতে পারে তাঁর লক্ষ্যের মাছটি এসে গেছে অমনি সে টুপ করে গলা নামিয়ে সে মাছটিকে ঠোটে ধরে গলাধঃকরন করে ফেলে। এক শিকারেই তার এক দিনের আহার নিবৃত্তি। দুমুঠো ঘাসের জন্য ভারবাহী গাধার মত সারাদিন তাঁর পিঠে করে মনিবের বোঝা বহন করতে হয় না বককে। বোকা গাধা বুঝতে পারে না যে মনিব তাঁকে দিয়ে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করিয়ে যে দুমুঠো ঘাস আহার্য হিসেবে দেয় সে এটা ইচ্ছে করলে যেকোন মাঠে গিয়ে যেকোন সময়ে অনায়াসে পেতে পারে।
     বকটির যেমন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে যে সে ওই বিশেষ ধরনের মাছটি ছাড়া অন্য মাছগুলিকে ধরবে না তেমনি আমাদেরও একটি লক্ষ্য ঠিক করা উচিত জীবনে আসলে আমরা কি করতে চাই। উচ্চতর কোন লক্ষ্য না থাকলে আমরা ছোটখাট বিষয়গুলি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে সময় ও শক্তির অপচয় করে মূল্যবান এ জীবনটিকে অবহেলায় অযত্নে কালের গর্ভে ঠেলে দিব। কিন্তু আমরা শুরুতেই যদি লক্ষ্য স্থির করে ফেলতে পারি তবে আমরা জীবনের চলার পথে সে লক্ষ্যকে অটল থেকে ছোট ছোট ঘটনায় প্রতিক্রিয়া না করে সময় ও শক্তির সঞ্চয় করতে পারি কারন তখন আমরা বুঝতে পারি জীবনের উচ্চতর লক্ষ্যে পৌঁছাই আমাদের সংকল্প। এ পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে যাঁরা অনেক কিছু দেখেও বুঝতে পেরেও কিছু বলে না কারন তাঁরা জানে এখন কিছু বলতে গেলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। তাঁরা জানে তাঁদের জীবনের একটা মহৎ উদ্দেশ্য আছে এবং সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য দরকার ধৈর্য্য, সহনশীলতা আর উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা। বকটি ছোট হতে পারে কিন্তু তাঁর শিক্ষাটি কিন্তু ছোট নয়। এ ছোট্ট জীবনের ফোটাটি টলমল করছে, যে কোন সময় তা উবে যেতে পারে। তাই সবকিছু করা এ জীবনে সম্ভব নহে। এটা করতে যাওয়াও বোকামী। তাঁর চেয়ে বরং যেগুলি সত্যি সত্যিই গুরুত্বপূর্ন সেগুলি বাস্তবায়নে আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত। বকটি যেমন ছোট মাঝের প্রভোলনে তাঁর বৃহত্তর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না তেমনি আমরাও লক্ষ্য একবার স্থির করতে পারলে আমাদের সামনে আসা অনেক প্রলোভনকে  অনায়াসেই উপেক্ষা করতে পারব।

চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা