অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
মুহাম্মদ সামাদ: সমুদ্রের দিকে হাঁটতে-থাকা এক কবি - ড. ফজলুল হক সৈকত

কবি মুহাম্মদ সামাদ (জন্ম: জামালপুর, ১৯৫৬) বাংলাদেশের কবিতাভুবনে একটি পরিচিত নাম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও ছড়িয়ে গেছে তাঁর কল্পনা ও পরিকল্পনার বিভা। কেননা, কবিতাকে তিনি যেমন চর্চায় নিবেদন করেন অঞ্জলি, তেমনই পাশাপাশি কবিতাকে দাঁড় করিয়েছেন সাংগঠনিক ফ্রেমে। জাতীয় কবিতা পরিষদে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে দেশে এবং প্রবাসে বাংলা কবিতা-সাধনার পথ ও মতকে দেখার চেষ্টা করে চলেছেন। মঞ্চে কবিদের কবিতা পাঠের ভেতর দিয়ে কবিতার নতুন অভিধা খুঁজবার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদান রয়েছে। বহির্বিশ্বে বিভিন্ন কবির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের মধ্য দিয়েও তিনি বাংলা কবিতার ধারা ও শোভাকে নিয়ে গেছেন নানান রঙের মানুষের কাছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে বাংলা ভাষায় রচিত কবিতার প্রতি মুহাম্মদ সামাদের বিশেষ অভিনিবেশ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আবার, নিজের কবিতার একটি ভূগোল তৈরির সাথে সাথে তিনি অনুবাদ করেছেন পৃথিবীর বেশ কিছু অবশ্যবিবেচ্য কবির কবিতা। অন্যদিকে তাঁর কবিতারও ভাষান্তর হয়েছে- যার মধ্য দিয়ে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন বিশ্ব-কাব্য-পরিমণ্ডলে।

মুহাম্মদ সামাদের ‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো‘ একটি বোধ-জাগানিয়া কবিতা। বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি, মানুষের প্রতিবাদী চেতনা আর কবির কল্পনা মিশে এখানে নির্মিতি পেয়েছে এক অনন্য শিল্পসভা। নীতির সাথে ‘রাজ‘ শব্দটিই যে এই পথের রাজকীয়তাকে নির্দেশ করে, তা বেশিরভাগ লোকেই বোঝে না। তাই, দায়িত্বকে তারা মনে করে বসে ক্ষমতা। আর তখনই রাষ্ট্রে সেবার পরিবর্তে চেপে বসে অত্যাচারের বিচিত্র রূপ। বিশ শতকের আশির দশকে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যখন জনক্ষোভ জমা হচ্ছিল, তখন কবিতাকে আশ্রয় করে কবির কল্পনাকে প্রকাশের ভার থেকে নামিয়ে দিয়েছেন- রাস্তায়, কবি মুহাম্মদ সামাদ। সেনাশাসকের রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে, ২৭ বছরের সম্ভাবনাময় যুবক, কলমের কালির ওপর ভরসা রাখলেন। রাজনীতির মাঠ মাত্র তৈরি হতে শুরু করেছে স্বৈরাচারকে প্রতিরোধের। শিল্প-সাহিত্য তখনো জিম্মি। সামাদ তাঁর কবিতা ফেরি করতে শুরু করলেন তখন। তার আগে অবশ্য তাঁকে পাওয়া গেছে জল-পূর্ণিমা-আকাশ-বৃষ্টি প্রভৃতি কোমলতার ভেতর। কিন্তু তিনি কোমল থাকতে পারলেন না- অন্তত কবিতায়। এভাবে বলছি এজন্য যে, আজও সেই ১৯৮৩-র প্রায় ৩৮ বছর পরেও, তিনি মানুষ হিসেবে রয়ে গেছেন শৈশবের মতো কোমল-স্বভাব। কী করে তিনি ধারণ করলেন সেই কঠিনকে! - তা করতে পেরেছিলেন বোধকরি সময়ের প্রয়োজনে। চলমান সময় ও তার যাবতীয় গতিবিধি মানুষকে কখনো কখনো বদলে দেয়। সেই সময়ের তাপ ও হাওয়ায় পাল্টে-যাওয়া কবি মুহাম্মদ সামাদ লিখলেন: ‘কালনাগিনীরা বিষাক্ত ফণা তুলে উঠে আসুক রাজনৈতিক মঞ্চে‘; ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব হোক রাজনীতির নাম‘; ‘দক্ষ জনশক্তি দেদার চালান হোক বিদেশে‘; ‘প্রচারমাধ্যমগুলো ক্ষমতাসীনদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হোক‘; ‘সাহসী সাংবাদিকের বুক ঝাঁজরা হোক আততায়ীর ব্রাশ ফায়ারে/ বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধির মাথা খেয়ে নির্বোধ হোক/ আতঙ্কে থেমে যাক লেখকের প্রতিবাদী কলম‘। হ্যাঁ, কলমের সাহসের সমাচারের সাথে তিনি যোগ করেছেন, বলা যায় করতে পেরেছেন, কল্পনার বিভোরতাও। বলেছেন: ‘আধুনিক ছ্যাঁচড়া কবি গাঁজায় টান দিয়ে/ রঙিন স্বপ্নে বিভোর হোক‘। বাংলাদেশে তখন চলছে সামাজিক নিপীড়ন, দুর্নীতি জেঁকে বসেছে সর্বত্র। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিরা হয়ে গেছে দালাল। সেই বিভীষিকাময় সময়ে কবি সামাদ তাঁর আশৈশব লালিত প্রতিবাদী প্রবণতাকে সম্বল করে জনসভায়-মিছিলে-আন্দোলনে-বক্তৃতায় কাঁপিয়ে দিতে চাইলেন পরিচিত আকাশ-বাতাস। আওয়াজে আওয়াজে বদলে দিতে চাইলেন বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজনীতি। একটি ভীষণ হতাশাঘেরা আকুলতায় তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর অনুভূতি: ‘দেশ ও জাতির এই দুর্যোগময় মুহূর্তে/ আমি আপনাদের শুধু মিষ্টি কথার জোর আশ্বাসের ফুলঝুরি/ এবং/ জ্বালাময়ী বক্তৃতার ফেনায়িত সমুদ্র উপহার দিতে পারি।' 

শ্রম-শিল্প-বিপ্লব এবং মানুষের সম্ভাবনাকে লালন করেছেন তিনি কবিতার ক্যানভাসে। বিভিন্ন তন্ত্র আর মন্ত্রে মানুষ যখন বিপন্ন, মত ও পথ যখন মানুষকে দিতে পারছে না প্রত্যাশিত মুক্তি, স্বপ্নগুলো যখন সত্যিই অধরা, তখন শিল্পকে এবং বিশেষভাবে বললে কবিতাকে আশ্রয় জেনেছেন, মেনেছেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেছেন তাঁর অভিব্যক্তির কথা: ‘হাড্ডিসার শ্রমিকের বিক্ষুদ্ধ সমাবেশ কেমন গন্‌গনে জ্বলন্ত উনুন-/ বস্তুত সকলেই উতকর্ণ ভীষণ!/ এখানে আমাকে কবিতা পড়তে হবে-/ কবিতা আমাকে পড়তেই হবে:‘।

জাতীয় চেতনাকে কবি মুহাম্মদ সামাদ ধারণ করেন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তা ও অর্জনের ভেতর দিয়ে। অসীম কল্পনা ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে একজন রাজনৈতিক দার্শনিক তাঁর সমকালের মানুষকে নিয়ে যেতে পারেন মানবিকতার উন্নত স্তরে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে দেওয়া যায় অনন্য মুক্তি ও নিরাপত্তা। এইসব বোধ কবিকে সত্যিই কোনো-না-কোনো মানুষের প্রতি নিমগ্ন ও শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। সামাদ লিখেছেন তাঁর ভাবনা: ‘মুজিব আমার স্বাধীনতা/ অমর কাব্যের কবি/ মুজিব আমার হৃদয়পটে/ চিরসবুজ ছবি‘। রাজনীতি সামাদের কবিতায় প্রবেশ করেছে স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে। তিনি বিশ্বরাজনীতির পাঠশালায় নতুন কোনো শিক্ষার্থী যেন- দেখছেন আর শিখছেন। জার্মানির ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গও তাই তাঁকে কাঁদায়-হাসায়। 

কবিতার এই কারিগর মাঝে মাঝে দর্পণে দেখেন নিজের মুখ। খুঁজে ফেরেন ফেলে-আসা দিনের কথা ও কাহিনি। তখন দেখতে পান নিজেকে এক আশাবাদী কিশোরের চরিত্রে, যে-কিনা ভাবতে ভালোবাসে, খোঁজ করে দুনিয়াজোড়া সমাজ-বিপ্লবীদের, চোখ রাখে কোনো প্রেমিক পুরুষের প্রতি। সেই কিশোরকে লালন করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। জীবনের দুপুরবেলায় এসে ভোরকে, সকালকে মনে করার ভেতর দিয়ে তিনি মূলত জীবনের আনন্দ ও অভিজ্ঞানকেই স্পর্শ করেন। আর পাঠক পেয়ে যান কোনো এক চেনা অথবা অচেনা কল্পবালককে। কবির স্মৃতির বিবরণ-পাতা থেকে খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে: ‘কেউ কেউ ভাবেন/ ছেলেটা গরীব হয়েও ছোটায় টাট্টু ঘোড়া/ আদার বেপারী হয়ে রাখে জাহাজের খোঁজ/ বোকাটা নিজের খেয়ে সারাদিন তাড়ায় বনের মোষ/ নিজের বেলায় কারা থাকে এমন বেহুঁশ?‘ হয়তো কবির বর্ণিত বালকটি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেনি। কিন্তু পরিণত কবি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন- একদা হুঁশ-না-থাকা ছেলেটির ভেতরে ছিল কবির সকল প্রাপ্তির আশা। জীবনের সেই প্রথম প্রহর থেকেই তিনি ডুবে আছেন কবিতার ছলা ও কলায়। আর তাঁর এই কবিত্বের নিবিড়তা পাঠক টের পান ‘পোড়াবে চন্দন কাঠ‘ নামক গ্রন্থের শুরুতেই। উত্তীর্ণ কবি লেখেন শিল্পের বারতা: ‘আমার তালুতে দেখো- গেঁথে আছে/ কালের পেরেক।' - আর এই পেরেকের যন্ত্রণা থেকে কোনোদিন মুক্তি পেলেন না তিনি, ধরা খেয়ে গেলেন পেরেকের ছোঁয়ায় ও মায়ায়। কবি মুহাম্মদ সামাদকে, তাই দেখা যায়, কবিতার ক্রম-উন্নতির দিকে, এমনকি সমুদ্রের দিকে ধাবিত হতে। সমুদ্র অনেক বড়; তিনি সেই বড়ত্ব অর্জন করতে চান জীবনের শিল্পকলা দিয়ে। কবিতার শরীরে তাই প্রবেশ করাতে থাকেন অনুভবের বিপুল পেরেক। এর নাম হয়তো তারকাঁটা। সেই তারকাঁটায় গেছে চলেছেন তিনি শব্দের সীমানা-প্রাচীর। আর তখন তাঁর কল্পনায় এসে ধরা দেয় অকল্পনীয় সব ইমেজ। যেমন তাঁর বর্ণনায়: ‘আমার সবুজ পত্রালিতে নাচবে/ সূর্যের আগুন।'; ‘তুমি এসে দাঁড়ালে বৃক্ষের পাশে/ হেলানো ছায়ায়।'

মুহাম্মদ সামাদ কবিতায় ধারণ করেন আবহমান বাংলাকে। হাজার হাজার বছর ধরে নির্মিত হয়েছে যে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, তার সুতোয় সাজানো আছে সামাদের কল্পনার ও পরিকল্পনার কাঁথা। তাই তিনি ভুলতে পারেন না- ‘বৃষ্টি ভিজে খুশির গোসল/ কাদাজলে গড়াগড়ি' কিংবা ‘বনের জলে ডানকিনে মাছ/ পিছলে পড়ে আছাড় খাওয়া'। ভোলেননি লোকচিকিতসার মোহময়তাও, লিখেছেন সে-কথা: 'ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-কাশি/ গরম তেলে বুক মালিশ'। কবি সামাদ বাংলার ঐতিহ্য আর অহংকারকে এক করে মিলিয়ে দেখতে শিখেছেন যেন। একটি বিবরণ থেকে কিছু উদ্ধৃত করলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে: ‘বিলের পাঁজর ঘেঁষে বীজক্ষেত/ চারাধান তোমাকে বলতে ডেকে-/ চারুমুখী মেয়ে/ খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে এতো দূর এসেছো যখন/ কাদার আলতা পরো পায়/ বাহারী খোঁপায় গোঁজো কলমির ফুল/ কনিষ্ঠায় তুলে নাও মাটির তিলক।' - এই মাটির দেশের প্রতীক; এই মাটি মানুষের আদি সভ্যতার বিকাশের প্রতীক; এই মাটি মানুষের মর্যাদার প্রতীক। কবি মুহাম্মদ সামাদ চেতনায় মাটি নিয়ে, বুকে নীল-শাদা কষ্ট গেঁথে, হাতে প্রতিবাদের মশাল নিয়ে এগিয়ে চলেছেন অনন্ত ইতিবাচকতার দিকে। ঐতিহ্য তাঁর চলার পথের আলো। কল্পনা তাঁর পরিকল্পনার পরিপক্ক ভিত। চিন্তা তাঁর দুশ্চিন্তা দূরীকরণে মহৌষধ। কিন্তু কে এই চারুমুখী মেয়ে? সে কি কোনো বাঙালি শ্যামল কিশোরী? তার অন্য নাম কি অরুণা?  

নারীভাবনা সামাদের কবিতায় অনায়াসে জুড়ে দিয়েছে বিপুল বিভা। তিনি নারীর স্নিগ্ধ-সুন্দর-স্বপ্নময় রূপ কল্পনা করেছেন। বাস্তবেও হয়তো তিনি নারীর সেই রূপের সাথে পরিচিত হয়েছেন। দেশে-বিদেশে নারীর সাথে আলাপ-পরিচয়ের ভেতর দিয়ে তিনি খুঁজেছেন নারীর বিশ্ববৈশিষ্ট্য। প্রণয় কিংবা স্রেফ ভালোলাগা অথবা শ্রদ্ধায় নিমগ্নতা- সবকিছু মিলিয়ে নারীর এক ‘ধন-ধান্যে শস্যেভরা নদীমাতৃক বাংলাদেশ‘ শোভা আবিষ্কার করেছেন যেন তিনি। একবার বলছেন: ‘একজন নারী/ একটি রাত্রির মতো শুভ্র অন্ধকার/ ভয়ংকর সুন্দর পবিত্র/ আর/ পাথরের আছড়েপড়া ঝর্ণার মতোন আনন্দিত।' অন্যত্র জানাচ্ছেন তাঁর ভিন্নতর এক অনুভবের কথা: ‘মেয়েটির পুষ্পিত হৃদয় ছিল মোরগ ফুলের মতো টকটকে লাল/ ভরপুর রক্ত আর আবেগের উষ্ণ প্রস্রবন/ কাপ্তাই হ্রদের মতো লহমায় উজ্জ্বল করতো অন্ধকার!‘ কবি সম্ভবত নারীর মধ্যে খুঁজেছেন নিশ্চিত আশ্রয়।

মুহাম্মদ সামাদের কবিতায় ‘মিছিল‘, ‘অস্পষ্ট রঙের খেলা‘, ‘সোনালি আক্রোশ‘, ‘ন্যুজ ক্ষুদ্ধ অমল মানুষ‘, কিংবা নতুন-গজিয়ে-ওঠা ‘শাখা কান্ড কুঁড়ি পল্লব‘ অথবা ‘শৃংখলিত দহন যন্ত্রণা আর পাপ‘ সারবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। কবি তখন ‘তুমুল বুষ্টিতে‘ ভিজে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেন ইতিহাসের মাথা-মুণ্ড। ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনরায় নিমগ্ন হন ‘বৃষ্টি ও নারীর প্রার্থনায়‘। তিনি হয়তো শান্তি ও সম্ভাবনা দেখতে পান বৃক্ষছায়ায় কিংবা ‘রাতভর বৃষ্টি‘তে। মাঝে মধ্যে মনে হয় কবি সামাদ যেন আমাদের সমকালের এক বিদ্রোহী বৃক্ষ- যে তাঁর শাখা ও প্রশাখা নিয়ে হাজির হতে চেষ্টা করছেন উত্তরকালের জীবন ও শিল্পসভায়। শুধু প্রতিবাদ নয়- জেগেওঠার শক্তি নিয়ে আটপ্রহর জাগ্রত যেন। ঐতিহ্য থেকে, স্মৃতি থেকে আলো ধার করে তিনি হাতে নিয়েছেন কুপি ও সলতে। তাঁর একটি খুব সরল ও দারুণ কবিতা ‘দাদিমার শুয়োর পেটানো লাঠি‘। কবিতাটির কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলো: ‘আজ দাদিমার কথা খুউব মনে পড়ছে আমার/ আমাদের ছোট বাড়িটার ভেতরে বাইরে চতুর্দিকে ঘোঁত ঘোঁত করছে/ দাঁতাল শুয়োরের ঝাঁক.../ আমি এই শুয়োরের পিঠগুলো পিটিয়ে গুঁড়িয়ে/ বুকের সাহস ফিরে পেতে চাই!‘ এই প্রতীকি কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি ‘সব জল খেয়ে ফেলি‘ প্রবণতা উপড়ে ফেলতে চান; দেখতে চান ‘এমন তৃষ্ণা কেন পায়‘ মানুষের।

কবি মুহাম্মদ সামাদ সমাজ-পরিব্রাজক। কবিতাকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন সমাজের স্বচ্ছ আয়নায় রেখে। তিনি দেখতে পান সমাজের চকচকে স্বভাবে কারা যেন লাগিয়ে দিচ্ছে কালো কালির দাগ। তিনি চারিদিকে ভয়ংকর বিষাক্ত সাপের ছোবলের আশংকা করেন সবসময়। বাস্তবকে তিনি কল্পনায় অনুভব করতে চেষ্টা করেন কখনো কখনো। একবার লিখেছেন: ‘আজ এই দিনদুপুরেই/ আমি তাকিয়ে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখলাম:/ একটা কালো সাপ তোমাকে তাড়া করছে/ তুমি কেবল ছুটছো আর ছুটছো।‘

কখনো কখনো তাঁর কাব্যকলায় একজন পিতাকে দেখা যায়: ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন শীতের কোনো সবজিতলায়- শিশুকন্যার জন্য, নন্দিতার জন্য, সোনালি আঙুলের আভা তৈরি করার ইচ্ছা বুকে নিয়ে। হয়তো কোনো ধর্ষিতা বালিকার ছবিতে ভেসে উঠতে দেখেন নিজের কন্যার ছবি। কিংবা কোনো কোনো কবিতা-অবসরে তিনি হয়ে ওঠেন নিবিষ্ট অভিভাবক। প্রদান করেন তাঁর সঞ্চিত নির্দেশনা: ‘কমলকোমল লাজনতমুখে কেউ তাকাবে না।‘ মাঝে মধ্যে তিনি অবগাহন করেন কোনো নাম-না-বলা কিশোরীর স্বপ্নপ্রহরের উজ্জ্বল কল্পনায় ও পরিকল্পনায়। 

রাজনীতির রূপান্তরের স্বপ্ন কবি সামাদ চিন্তায় লালন করেছেন সবসময়। ঘুরে-দাঁড়ানোর প্রত্যয় তাঁর এই ভাবনার প্রধান অবলম্বন। দেশকে মা ভেবে তিনি লিখেছেন সেইসব অমর কথামালা: ‘হে মা আমার/ সন্ত্রস্ত শোকের দেহে তুমি জ্বেলে দাও/ শক্তির আগুন'। মুহাম্মদ সামাদ চেয়েছেন দায়ভারমুক্ত ‘ভোরের সূর্যের দিকে' ‘সমুদ্রের দিকে' স্থিরচক্ষু অভিযাত্রার ভেতর দিয়ে চিরচেনা ফসলের মাঠকে ‘মেঘ আর সবুজ বৃষ্টিতে' ভরে দিতে, যেখানে ‘সারারাত শরতের ভরাচাঁদ' ;জ্যোতস্নার প্লাবন' বইয়ে দিতে পারে; যেখানে ‘ভয়ঙ্কর হিরোশিমা পাড়ি দিয়ে/ মানুষের প্রেম ফিরে যায় মানুষের দিকে'। মুহাম্মদ সামাদ মূলত অনন্ত প্রেম আর কাব্যপ্রভায় স্বপ্নবাজ- সমুদ্রের দিকে হাঁটতে-থাকা এক কবি- শুধু কবি।

ড. ফজলুল হক সৈকত। বাংলাদেশ