অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
অবিভক্ত নজরুল ও প্রেম-দ্রোহের বহ্নিশিখা - আলী রেজা

‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’- ভারতবর্ষ যখন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক চেতনায় বিভক্ত তখন নজরুল এক মোহনায় দাঁড়িয়ে এক মিলনের বাঁশি বাঁজিয়েছেন। নানা বিভক্তির মাঝেও তাই নজরুল অবিভক্ত। অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই বলেছেন সে কথা। মানুষকে একটি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যেমন মিলনের গান গাওয়া প্রয়োজন তেমনি দ্রোহী হয়েও উঠতে হয় কখনো কখনো। মানব প্রকৃতির প্রধান দুটি অনুভূতি প্রেম ও দ্রোহ চেতনাকে বার বার আলোড়িত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন নজরুল। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ক্রোধ-ঘৃণা ইত্যাদি মনের অসংখ্য মৌলিক অনুভূতির মধ্যে প্রেম ও দ্রোহ বা বিদ্রোহ এতোটাই শক্তিশালী যে এই চেতনার দ্বারা মানুষ নিমিষে বদলে যেতে পারে, এমনকি জীবনকেও উৎসর্গ করতে পারে। মানব প্রকৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মানবমনে প্রেমের আবির্ভাব স্বতস্ফূর্ত। এই স্বতস্ফূর্ত প্রেম মূর্ত বিষয়ের প্রতিও হতে পারে আবার বিমূর্ত বিষয়ের প্রতিও হতে পারে। ইন্দ্রিয়গ্রাহৃ কিংবা অতীন্দ্রিয়, প্রাকৃতিক কিংবা অতিপ্রাকৃতিক, বাস্তব কিংবা পৌরাণিক, মানবিক কিংবা অতিমানবিক- প্রত্যেকটি বিষয়ই ক্ষেত্রবিশেষে মানবমনকে আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে। সুতরাং মানব প্রকৃতি সব সময় একরূপ নয়, এ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিভিন্নমুখি। কাব্য নির্মাণের অন্যতম প্রধান উপাদান প্রেম। এই প্রেম হতে পারে বিশেষ মানব-মানবীর জৈবিক প্রেষণাপ্রসূত, হতে সামগ্রিক মানবপ্রেমকেন্দ্রিক। দেশাত্ববোধ থেকেও মানবমনে দেশপ্রেম জেগে ওঠে। আবার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেকে প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে যান। বাবা-মা, ভাই-বোন ও সন্তানের প্রতি ভালবাসা প্রেমেরই নামান্তর। একজন কবি এই নানারূপ প্রেমের বহিপ্রকাশ ঘটান তার কাব্যে। কোন কবিই প্রেমকে পরিহার করে কাব্য নির্মাণের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারেন না। নজরুলও পারেননি।

প্রেমের মতো দ্রোহও হয়ে উঠতে পারে কাব্যের প্রধান উপাদান। তবে কাব্যে দ্রোহ চেতনার প্রতিফলন ঘটে বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে। প্রেম ও দ্রোহ পরস্পরবিরোধী হলেও পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ প্রেমের অনুপস্থিতি কিংবা প্রেমে ব্যর্থতা অনেক সময় দ্রোহ চেতনার জন্ম দেয়। প্রেমে ব্যর্থতা একজন কবিকেও দ্রোহী করে তুলতে পারে। তখন কবি তার দ্রোহের বহির্প্রকাশ ঘটান কাব্য নির্মাণ করে। কবির প্রেম, বিরহ, আবেগ, উচ্ছ্বাস বিনয়, বিদ্রোহ- এসব কিছু প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হলো কবিতা। তাই কবি কোন দুঃখ পেলে তা ছড়িয়ে দেন কবিতার অবয়বে। আবার সুখ পেলেও কবি আশ্রয় নেন কবিতার ভুবনে। দ্রোহী হলেও কবি তার দ্রোহ চেতনার প্রকাশ ঘটান কবিতায়। 

প্রেম ও দ্রোহ হলো কাজী নজরুলের কাব্য নির্মাণের প্রধান দুটি উপাদান। নজরুল-কাব্যের জগত মন্থন করলে যে সারবস্তু পাওয়া যায় তাহলো প্রেম ও দ্রোহ। এই প্রেম ও দ্রোহ সকল কবির কাব্যেই পাওয়া যায়। তবে মাত্রাগত ব্যবধানেই প্রকাশ পায় কোন একজন কবির স্বাতন্ত্র্য। তাই কাল পরিক্রমায় একেক জন কবি একেক অভিধায় ভূষিত হন। এই অভিধা কবি নজরুলের ক্ষেত্রে একটি নয়, বহু। নজরুল প্রেমের কবি, নজরুল বিদ্রোহের কবি, নজরুল সাম্যের কবি, নজরুল মানবতার কবি। অর্থাৎ কবি নজরুল তার কাব্যে বহুমাত্রিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। একজন বহুমাত্রিক কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম তাই সর্বত্রগামী। ফলে নজরুল অবিভক্ত। নজরুল যেমন তাঁর সাহিত্যে অবিভক্ত, ব্যক্তিজীবনেও অবিভক্ত। ধর্মভেদ, জাতিভেদ কিংবা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নজরুলকে বিভক্ত করতে পারেনি।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ভারতীয় জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতবাসীর মনে রোপণ করে রাজনৈতিক চেতনা। কংগ্রেস গঠনের অনেক আগেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়েছিল মহাবিদ্রোহ নামে অভিহিত সিপাহী বিদ্রোহ। সুতরাং বিদ্রোহের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দেই। আর রাজনৈতিক চেতনার জন্ম হলো ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস গঠনের মাধ্যমে। এই রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের যুগে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। কোন শহরে নয়; পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে। কোন বিত্তবান পরিবারে নয়; মাজারের খাদেম ও মাজার নিয়ন্ত্রিত মসজিদের ইমাম কাজী ফকির আহমেদের দরিদ্র পরিবারে। আট বছর বয়সে কবি নজরুল তার পিতাকে হারান। ফলে দরিদ্র পরিবারটি আরো বেশি দারিদ্রের মধ্যে পতিত হয়। জীবিকার তাগিদে দশ বছর বয়সে গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাইমারি পরীক্ষায় পাশ করে ঐ মক্তবেই এক বছর শিক্ষকতা করেন। তারপর জীবিকার তাগিদেই লেটোর গানের দলে যোগ দেন। দুরন্ত স্বভাবের কারণে এ সময় বালক নজরুলকে গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর মিলে রাণীগঞ্জের কাছে শিয়ারশোল সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ডানপিটে নজরুল স্কুল ত্যাগ করে বাড়ি থেকে পলায়ন করেন এবং আসানসোলের এক রুটির দোকানে পাঁচ টাকা বেতনে চাকরি নেন। রুটির দোকানে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নজরুল গান গাইতেন এবং উপস্থিত সবাই সে গান শুনতো। এভাবে এক সময় আসানসোলের দারোগা কাজী রফিজউদ্দিন বালক নজরুলের কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হন এবং নিজের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার সিমলায় নিয়ে গিয়ে ত্রিশাল বাজারের নিকটবর্তী দরিরামপুর স্কুলে কাজীকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে কাউকে কিছু না বলে কাজী সিমলা ত্যাগ করে আবার রাণীগঞ্জে চলে আসেন এবং পুনরায় শিয়ারশোল সরকারি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণির প্রিটেস্ট পরীক্ষা চলছে। এ সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষে শক্তি বৃদ্ধির জন্য ভারতীয়দের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন কাজী নজরুল। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

সৈনিক নজরুল কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করে হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং এখানেই তার সৈনিক জীবনেরও সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কবি নজরুল আজীবন ছিলেন কলম সৈনিক, ছিলেন সুর সৈনিক। প্রেম ও দ্রোহের বাণী প্রচার করে তিনি মানুষের চেতনায় জাগিয়ে তুলেছিলেন এক অদম্য উদ্দীপনা। নজরুলের নিজেরও দাবী হলো- তিনি কোন বিশেষ কালের কিংবা কোন বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের নন। সত্যিই নজরুল বিশেষ নন; নজরুল সামগ্রিক। নজরুল মানুষের কবি, নজরুল মানবতার কবি। তাই বহু ধর্ম-সম্প্রদায় ও জাতি-গোষ্ঠীর ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেও নজরুল কোন বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হননি। ইসলামি গান রচনা কিংবা ইসলামের গৌরব ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে কবিতা লিখে নজরুল যেমন মুসলমানদের চেতনাকে শাণিত করেছেন তেমনি হিন্দু পুরাণ ও দেব দেবীকে নিয়ে এসেছেন তার কাব্য-গানে। লিখেছেন অসংখ্য কাওয়ালি ও শ্যামা সঙ্গীত। সুতরাং নজরুল ভাগ হননি। নজরুলের মূল পরিচয়, তিনি বাঙালি। এই অবিভক্ত ও অসাম্প্রদায়িক নজরুল তার কাব্য ও গানে মানবপ্রেমের জয়গান গেয়েছেন অকুণ্ঠচিত্তে। নিজের প্রেমিকসত্তাকে অবারিত করেছেন নিজেকেই নানা উপমায় উপস্থাপন করে। 

কাজী নজরুলের কাব্যসৃষ্টিতে পাওয়া যায় মহা আনন্দের বার্তা, ‘প্রাণখোলা হাসি উল্লাস’। প্রকৃতি যেমন আপনমনে সৃষ্টি করে চলে বৈচিত্র্যেভরা প্রতিটি উপাদান; খেয়ালি প্রকৃতির যেমন অনন্তকালেও বিশ্রাম নেই, শুধু বয়ে চলা, শুধু ছুটে চলা, শুধু ভেঙ্গে চুরমার করা; আবার নিপুণ হাতে গড়ে তোলা। প্রকৃতির এই গতি ও পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নজরুলকাব্যের অসাধারণ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ নজরুল মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিকেও দেখেছেন গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। নজরুলকাব্য গতিশীল ও পরিবর্তনবাদী। কখনো প্রেম, কখনো বিরহ, কখনো বিদ্রোহের পংক্তিতে দেদীপ্যমান নজরুলের কাব্যের জগত। নজরুলকাব্যের এই নানামাত্রিকতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্ন্তগত চিন্তাপ্রসূত নয়। তাই তার চিন্তার জগত নির্মাণের ক্ষেত্রে বর্হিভাবনাই প্রধান। তার চিন্তার জগতে বাঁক পরিবর্তন ঘটেছে যেভাবে, যেভাবে তিনি দ্রোহ চেতনায় বলিষ্ঠতা অর্জন করেছেন তার মূল নিহিত আছে ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি’- এই উক্তিতে। অর্থাৎ নজরুল তার সমকালের সমাজনীতি, রাজনীতি ও ব্যক্তি মানুষের অর্ন্তগত নৈতিক অবস্থানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, অনুসন্ধান করেছেন ও বিদ্যমান অসঙ্গতির সঙ্গে আপোষ করতে না পেরে দ্রোহী হয়ে উঠেছেন। এখানেই তার বিদ্রোহী সত্তার শেকড় নিহিত। মোটকথা নজরুল তার কাব্যসৃষ্টির প্রধান উপাদান সংগ্রহ করেছেন মানুষের কাছ থেকে। নজরুলের নিজের উক্তিতে তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় :  ‘ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের/ আমার চোখে জল  আসে /আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।’

কবি নজরুল মানুষকে চিনেছেন মানুষের মনোজগতের অন্তর্গত প্রবনতাগুলোকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে। এই নিরীক্ষণ মানুষের কোন বিশেষ দিক নিরীক্ষণ নয়; মানুষের সামগ্রিক সত্তাকেই নিরীক্ষণ। কাজী নজরুলের চিন্তা, তার দৃষ্টি মানুষের অন্তরালকে স্পর্শ করে। তিনি পুরুষকে চিনে নেন, জেনে নেন তার অন্তরালের প্রকৃতি থেকে। আবার নারীকেও চিনে নেন, জেনে নেন নারীর অন্তরালের প্রকৃতি থেকে। অন্তরাল অনুসন্ধানী এই বীক্ষণ শক্তি কবি নজরুলকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছে। এই বীক্ষণ প্রক্রিয়ায় কোন ফাঁক নেই, কোন ফাঁকি নেই; নেই কোন আপোষ। সত্যকে আবরণমুক্ত করে উপস্থাপন করতে সিদ্ধহস্ত কবি নজরুল। তাই কবি মানুষের মহত্তকে যেমন উচ্চ আসন দিয়েছেন, তেমনি মানুষের হীনতা, নীচতা ও স্বার্থপরতাকে পদদলিত করেছেন নির্মমভাবে। প্রেমের পুজারী নজরুল মানুষের ভেতরের প্রেমহীনতা প্রত্যক্ষ করে দ্রোহী হয়ে ওঠেছেন বার। সূতরাং কোমলে কঠোরে আত্মপ্রকাশ করেছেন কবি। কবি তার এই অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন কাব্যভাষায় : ‘আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য/ মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।’

কবিতার শরীর নির্মাণ করতে গিয়ে কবি নজরুল যেমন নিজেকে প্রকাশ করেছেন উত্তমপুরুষে, তেমনি কবি তার মানসপ্রতিমা বা প্রেমাস্পদকে উপস্থাপন করেছেন মধ্যমপুরুষ ও নামপুরুষে। তাই ‘তুমি’ কিংবা ‘সে’ হয়ে ওঠেছে কবিতার কেন্দ্রিয় চরিত্র। একজন পুরুষ যখন কবিতায় নিজের অর্ন্তগত অনুভূতিগুলো মানবীয় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশ করে তখন সেই ‘তুমি’ কিংবা ‘সে’ সাধারণত একজন নারীকেই নির্দেশ করে। এই নারী সকল কবির কবিতাতেই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত হয়। প্রেমের কবিতার শরীর নির্মাণের ক্ষেত্রে নারী একটি প্রধান উপাদান। ক্ষেত্রবিশেষে একমাত্র উপাদানও হয়ে ওঠে। কবি নজরুলের কবিতায় নারীর উপস্থিতি, নারী প্রকৃতির বর্ণনা নানামাত্রিক। কবি নজরুলের কবিতায় একদিকে যেমন নারী পেয়েছে অতি উচ্চ আসন অন্যদিকে আবার নারীই পেয়েছে কঠিন ও নির্মম অপবাদ। নারীকে কখনো কবি দেবী করে তুলেছেন আবার কখনো লোভী বলেও নিন্দা করেছেন। তাহলে কী কবি নারী প্রকৃতির স্বরূপ উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? নারী প্রকৃতির বর্ণনায় কবির এই দ্বৈত অবস্থান পাঠককে দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। নিম্নের উদ্ধৃতি দুটিতে কবির এই দ্বৈত অবস্থানের প্রমাণ মেলে:

ক. বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
------
কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়-লক্ষ্মী-নারী।  [নারী, সাম্যবাদী] 

খ.এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীরু বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি।
নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো। 
ইহাদের অতি লোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহু জন।....
যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে! [পূজারিণী, দোলন-চাঁপা]

নারী প্রকৃতি ও নারী প্রেমবিষয়ক উদ্ধৃতি দুটোতে কবি নজরুলের পরস্পরবিরোধী চিন্তা কিংবা চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

নজরুল মূলত প্রেমের কবি। নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বার শেকড় নিহিত তার প্রেমিক সত্ত্বার মধ্যেই। কবি নজরুলের প্রথম আরাধনা প্রেমের জন্য। কিন্তু মানুষের অর্ন্তজগতের প্রেমহীনতা প্রত্যক্ষ করে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। সমাজনীতিতে, রাষ্ট্রনীতিতে যদি শোষণ-নির্যাতন না থাকতো, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝে যদি স্বার্থপরতা, প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ না থাকতো, সাম্যের সুর যদি ধ্বনিত হতো সমাজে, রাষ্ট্রে- তাহলে হয়তো নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বার প্রকাশ ঘটতো না। একজন প্রেমপূজারী কবি হিসেবেই হয়তো আমরা নজরুলকে দেখতে পেতাম। তাই নজরুল প্রথমত প্রেমের কবি; দ্বিতীয়ত দ্রোহের কবি।

নজরুলকাব্যে প্রেম ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে ধাবমান। ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মচর্চায় নজরুলের শৈশব অতিবাহিত হয়েছে। পিতা ছিলেন মসজিদের ইমাম। নজরুল নিজেও কিছুদিন পড়িয়েছেন মক্তবে। শৈশবের এই ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ পরবর্তী পর্যায়ে আমরা কবির কবিতা ও গানে লক্ষ্য করি। ইসলামি কবিতা ও ইসলামি গানে কবির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে। যে সময় মুসলমান সমাজে গানের কোন কদর ছিল না, গানকে যে সময় অনৈসলামিক আখ্যা দিয়েছিল মুসলমান সমাজের কর্তাব্যক্তিগণ; নজরুল সে সময় ইসলামি ভাবধারাকে উপজীব্য করে সঙ্গীত রচনা করলেন এবং সেই সঙ্গীত মুসলমান সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করলো। গানের মাধ্যমেও যে আল্লার দরবারে প্রার্থনা করা যায় তার প্রমাণ মিললো নজরুলের গানে। তাই নজরুল কাব্যে প্রেম শুধু মানবীয় নয়, অসীম আল্লাহর প্রতি প্রেম নিবেদনও নজরুলকাব্যে প্রতিফলিত। সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম নজরুল মানসের ধর্মীয় অনুভূতিজাত।      

নজরুলকাব্যে দেশপ্রেম একটি প্রধান উপাদান। এই দেশপ্রেম সকল কবির কাব্যেই কমবেশি প্রতিফলিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধর্মান্তরিত হয়েও, দেশত্যাগী হয়েও দেশের ভাষা ও মাটি-মানুষকে ভুলতে পারেন নি। বহু দেশ ভ্রমন করেও কবি তার জন্মভূমির সেই ছোট্ট কপোতাক্ষ নদকে ভুলতে পারেন নি। কবিগুরুর বিশ্বখ্যাতি দেশপ্রেমকে গৌণ করতে পারে নি। তাই তো ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’ বলে দেশপ্রেমের পুজারী হয়েছেন। কবিদের দেশপ্রেম নিখাদ ও নিঃস্বার্থ। রাজনীতিকের দেশপ্রেমের সাথে তার রাষ্ট্র পরিচালনার গৌরব, সম্মান ও ক্ষমতার মোহ জড়িত। কিন্তু কবিরা ভিন্ন জাতের। নজরুল নিজেই বলেছেন- বনের পাখির মতো গান গাওয়ার স্বভাব আমার, কারো ভালো লাগলেও গাই, না লাগলেও গাই। সব কবির মনেই দেশপ্রেমের ঝর্ণাধারা নীরবে প্রবাহিত। কিন্তু নজরুল দেশপ্রেমের বাঁধভাঙা জোঁয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে নজরুল নিজেও যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন দুর্দান্ত কলম সৈনিক। সাহিত্য রচনা করে কারাবরণ করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনকে অকার্যকর মনে করে যারা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন সেই বিপ্লবীদের প্লাটফর্ম ছিল যুগান্তর দল ও অনুশীলন সমিতি। এই উভয় সংগঠনের সঙ্গে কবি নজরুলের ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ ও অকুণ্ঠ সমর্থন। নজরুলের গান ও কবিতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও ভারতবর্ষের রাজনীতিকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলতেন- ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তার গান গাইবো’। সত্যি, কারাগারের রাজবন্দীদের উজ্জীবিত করার যে কাব্য-গান নজরুল সাহিত্যে দেদীপ্যমান তা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিরল বলেই মনে হয়। অন্তর্গত চেতনায় শাণিত দেশপ্রেম না থাকলে পরাধীনতার বিরুদ্ধে দ্রোহী, অবিনাশী ও প্রেরণাদায়ী কাব্য-গান রচনা করা সম্ভব নয়। পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের দেশপ্রেম তাই নিরেট, খাঁটি ও মেদহীন।

ব্রিটিশ ভারতের একমাত্র কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে  উচ্চারণ করেছিলেন ‘ভারত হবে ভারতবাসীর’। এ রকম দুঃসাহসী উচ্চারণ তার পক্ষেই করা সম্ভব যিনি বলতে পারেন ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ’। ‘ধুমকেতু’র পুচ্ছটি উচ্চে তুলে ধরে নজরুল পরাধীনতার লৌহশৃঙ্খল ভেঙ্গেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি বিদ্রোহী। কবি নজরুলের বিদ্রোহ অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে; কবি নজরুলের বিদ্রোহ অসাম্যের বিরুদ্ধে। এই দ্রোহ চেতনা নজরুলকে তুলে ধরেছে খ্যাতির উচ্চ শিখরে এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে দিয়েছে জাতীয় কবির আসন।

দেশপ্রেমের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ মানবপ্রেম। মানবপ্রেম থেকেই দেশপ্রেম অঙ্কুরিত হয়। যে ব্যক্তি দেশের মানুষকে ভালবাসে সে দেশদ্রোহী হতে পারে না। নজরুল দেশকে ভালবেসেছিলেন বলেই দেশের মানুষকে ভালবেসেছিলেন। অর্থাৎ নজরুলকাব্যে গভীর দেশপ্রেমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে গভীর মানবপ্রেম। তবে নজরুলের দেশপ্রেম দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকলেও তার মানবপ্রেম গণ্ডিবদ্ধ নয়। বিশ্বের সকল মানুষকে নজরুল একই মিলনসুরে বাঁধতে চেয়েছিলেন। তাই তার আহবান: ‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/ এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশী।’                                                                              

নজরুলকাব্যে আমরা দেখি মানবপ্রেমের এক সামগ্রিক রূপ। মানুষে মানুষে ব্যবধান বা বিভেদের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। প্রতিবাদের ভাষাও শাণিত, মেদহীন ও প্রত্যক্ষ। ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’- বলে নজরুল মানুষ ও মানবতার যে জয়গান গেয়েছেন তা কবি চণ্ডীদাসের ‘শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’- এ কথারই প্রতিধ্বনি। তবে প্রতিধ্বনি বা পুনরুক্তি বলে বিষয়টিকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। কারণ চণ্ডীদাসের প্রায় ছয় শ বছর পরে এসে মানবতাবাদের এই বাণী নজরুল যেভাবে উচ্চারণ করলেন, দীর্ঘ ছয় শ বছরে অন্য কোন কবি তেমন বলিষ্ঠভাবে তা উচ্চারণ করেননি। তাই কাজী নজরুল ইসলামের মানবতাবাদী চেতনা স্বতন্ত্র উচ্চতায় অভিষিক্ত।

কাজী নজরুল ইসলামের মানবভাবনার সার্থক প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় তার সাহিত্যকর্মের সামগ্রিকতার ভেতর। কবি নজরুলের বিশেষ থেকে নির্বিশেষ যাত্রার যে ভাবালুতা, যে ধ্যানমগ্নতা সেটাও ইহজাগতিক। ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই/ এ হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই’- বলে কবি মানব হৃদয়ের যে মহিমান্বিত রূপ সে রূপের আরাধনা করেছেন। মানুষের হৃদয়বৃত্তিকে সর্বোচ্চ আসন দিয়েছেন কবি। কবির এই মানবতাবোধের বিকাশও ঘটেছে তার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। কবি যে বিশেষ কালে জন্মেছিলেন সেই কালটি ছিল ধর্মান্ধতা বা অতীন্দ্রিয় অন্ধবিশ্বাস থেকে বেড়িয়ে আসার কাল। সেই কালপর্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরও অগ্রযাত্রার সুচনা হয়েছিল। পাশাপাশি ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাও দানা বাধতে শুরু করেছিল সে সময়। বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৯০৫ ও ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল যা পরবর্তী সময়ে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নিয়েছিল। ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন কবি নজরুল মানতে পারেননি।

তিনি নিজেকে কোন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করেননি। তাকেও কেউ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ভূক্ত করেনি। তিনি বিয়ে করেছেন হিন্দু পরিবারে। কিন্তু স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করেননি। সন্তানকে শুধু নিজের ধর্মে আবদ্ধ না রেখে নাম রেখেছেন কৃষ্ণ মুহাম্মদ। নজরুলের ঘরে একদিকে যেমন পূজা অর্চনা হতো অন্যদিকে তেমনি নামাজ আদায় হতো। এমন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা তৎকালে খুব একটা দেখা যায় না। কাজী নজরুল দেশ, কাল ও ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠে বিশ্বের সম্পদ হয়েছিলেন। মুসলমানরা তাকে নিয়ে গর্ব করতো দুটি কারণে; এক. কাজী নজরুল ছিলেন জন্মসূত্রে মুসলমান এবং দুই. ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে কাজী নজরুল অসংখ্য গান ও কবিতা রচনা করেছিলেন এবং সে সব গান ও কবিতা মুসলমানদের উজ্জীবিত করেছিল। কাব্য-গানে হিন্দু পুরাণ ও দেবদেবীর নাম ব্যবহার করে কাজী নজরুল হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রীতিধন্য হয়েছিলেন। মোটকথা নজরুল কারো একার নয়, নজরুল সবার। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুল সকল জাতি-ধর্মের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। 

এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাই নজরুলকাব্যের শেষ কথা নয়। নজরুল কাব্যের আর একটি বলিষ্ঠ দিক হলো সাম্যবাদী চেতনা। সাম্প্রদায়িকতার মূলে কাজ করে ধর্ম ও সামাজিক আচার। আর অসাম্য সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক শোষণ ও অসম বণ্টন ব্যবস্থা থেকে। নজরুল ছিলেন সকল প্রকার অসাম্যের বিরুদ্ধে। সমাজের পথহারা, দিশেহারা, বঞ্চিত, শোষিত মানুষগুলো চিরকালই অসাম্যের শিকার। আর এদের কথাই নজরুল বলেছেন তার কাব্য- গানে। নিম্নবর্গের ব্রাত্যজনের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করেই নজরুল একটি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নজরুল নিজেও ছিলেন জন্মসূত্রে নিম্নবর্গের দলে। তাই নিম্নবর্গের প্রতি নজরুলের দরদ তার নিজের সহজাত প্রবণতা থেকেই নিঃসৃত। নজরুল বিত্তহীন চিত্তবান, চিত্তহীন বিত্তবান নন। চিত্তনামা কাব্যে তিনি সে প্রমাণ রেখেছেন। মানবচিত্তের জয়গান গেয়ে নজরুল প্রকারান্তরে মানবতাবাদেরই জয়গান গেয়েছেন। তাই মানবপ্রেম নজরুলকাব্যের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কবি নজরুলের দ্রোহচেতনা প্রেমহীনতা থেকে উৎসারিত। তাই মানবপ্রেম যেখানে পদদলিত নজরুল সেখানে বিদ্রোহী সত্ত্বায় দেদীপ্যমান। নজরুলের বিদ্রোহ ছিল তৎকালীন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে। শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সর্বাগ্রে কবিরাই এগিয়ে আসেন। তাই সবশেষে কবিরাই নায়ক হন। হোমার, চসার, শেক্সপিয়র, গোর্কি, টলস্টয়, গ্যেটে, মিল্টন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল- এরা ইতিহাসের মহানায়ক। যুগে যুগে আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক মানবজাতির হৃদয়ে অম্লান।

শোষিত মানুষের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়েই নজরুল বিদ্রোহী হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন পর্বে কবি সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ (১৯২০ খ্রি.), অর্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতু (১৯২২ খ্রি.) ও সাপ্তাহিক লাঙল (১৯২৫ খ্রি.) পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মান্ধতা, রাষ্ট্রীয় শোষণ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে এক গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। নবযুগ ধর্মান্ধ, কূপমণ্ডুক ও ‘মৌ লোভী যত মৌলবী’দের মুখোশ উন্মোচন করেছিল। ধূমকেতু সেদিন ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবীদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল এবং ব্রিটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে তুলেছিল। আর লাঙল কৃষক, শ্রমিক, কুলিমজুর তথা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার গান গেয়ে সর্বস্তরের মানুষের প্রাণে সাম্যবাদী চেতনা জাগিয়ে তুলেছিল। নজরুল সম্পাদিত এ সব পত্রিকা সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়েছিল নিঃসন্দেহে। তাই নজরুল জেগে ওঠার কবি; মানুষকে জাগিয়ে তোলার কবি। ‘ভোর হলো দোর খোলো/ খুকুমনি ওঠরে’ কবিতার মাধ্যমে কবি শিশুদের জাগিয়েছেন। ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখবো এবার জগতটাকে’- দিয়ে কবি কিশোরদের জাগিয়ে তুলেছেন। ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান/ আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান’- বলে বিপ্লবীদের উজ্জীবিত করেছেন। ‘আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/ আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ’- বলে তারুণ্যকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাই কবি নজরুল প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি। প্রেম ও দ্রোহের মাধ্যমে নজরুল গণমানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বলে তিনি আমাদের জাতীয় জাগরণের কবি হিসেবেও নমস্য।  

আলী রেজা
প্রাবন্ধিক, সাহিত্যচিন্তক
ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল।