অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
এসো মানুষের জয়গান গাই – চিরঞ্জীব সরকার

০২০ সাল থেকে সারা পৃথিবী এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শতবর্ষ পরে পৃথিবীর বুকে মহামারী যে নেমে আসে প্রকৃতির এ অলিখিত নিয়মটি থেকে ধরনীমাতা এ একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। মহামারী বা অতিমারী যে নামেই ডাকিনা কেন এটা নাকি দুবছর তার তাণ্ডব লীলা চালিয়ে তারপর আস্তে আস্তে বিদায় নেয়। করোনা মহামারীর আক্রমনাত্মক প্রবনতা লক্ষ্য করে এটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে যে এটাকে সহনশীল পর্যায়ে আনতে ২০২১ লেগে যাবে কিন্তু বিশ্ব থেকে এটিকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে আরও দুবছর বা তারও বেশী সময় লাগতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশের অনেক বিজ্ঞানীরা এর বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে কার্যকর কিছু টিকা আবিষ্কারের ফলে করোনাকে পরাজয়ের প্রাথমিক সাফল্য এসেছে। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ যতক্ষন পর্যন্ত না টিকা পাচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত কিন্তু বলা যাবে না যে করোনা চলে গেছে।তবে সবকিছুই নির্ভর করছে করোনার গতি প্রকৃতির উপর। সে মানুষের দেহে গিয়ে মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে আবার নতুন ভাবে ঝাপিয়ে পড়ছে মানব জাতির উপর। করোনারও মনে হয় একটা গুপ্ত লক্ষ্য আছে।এ লক্ষ্য মনে হয় সে যতদিন বাস্তবায়ন না করতে পারবে ততদিন  সে মানবজাতিকে এত সহজে ছাড়বে না। লক্ষ্য বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে মানবজাতিকে সে হয়ত কিছু একটা শিক্ষা দিতে চাচ্ছে যে শিক্ষাটা মানুষ কোন এক অজ্ঞাত কারনে এখনো বুঝতে পারছে না।

মানুষও আসলে খুব বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছিল। প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের পরিবর্তে প্রকৃতিকে সে ক্রমাগত শোষন করে গেছে। গাছপালা কেটে, অরন্য উজাড় করে তথাকথিত উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে একটা বিপদজনক জায়গায় ঠেলে দিয়েছে মানুষ। জলে, স্থলে, অন্তঃরীক্ষে সে দামামা বাজিয়ে দিয়েছে। অতি বেগুনী রশ্মি শোষন করে যে ওজন স্তর ধরনীকে রক্ষা করছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরন করে সে ওজোন স্তরে বিশাল ফাটল তৈরী হয়েছিল। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উত্তর মেরু, অ্যান্টার্টিকার বড় বড় বরফ খণ্ডগুলি ক্রমাগত গলে যাচ্ছিল। আর জীব-জন্তুদেরতো মানুষ তাদের প্রাকৃতিক আবাসে থাকতে দিচ্ছিল না। নীরব প্রকৃতি তাই হয়ত করোনা নামক এ অস্ত্রটি দিয়ে মানুষের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু এ লড়াইয়ে প্রান দিতে হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কত মানুষের প্রতিদিন। জীবনের নশ্বরতা ও ক্ষনস্থায়ীতা মানুষ এখন উপলদ্ধি করতে পারছে। যে বাতাসের ভিতর অক্সিজেনের সমুদ্রে থেকে আমরা এর গুরুত্ত্ব কখনো অনুধাবন করতে পারতাম না করোনা এখন চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রাকৃতিক দানের গুরুত্ত্ব কতটুকু। লালনের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়,’লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা’।

বিজ্ঞানীরা বলছে আকাশে উড়তে থাকা আকাশযান বা উড়োজাহাজের সংখ্যা কমে যাবার কারনে ইতোমধ্যেই ওজোন স্তরের ছিদ্র অনেকটা কমে গেছে। গাড়ি ও জাহাজ চলাচল কম হওয়ায় বাতাস ও সমুদ্র এখন অনেক বেশী পরিস্কার। যে মানুষেরা সুখের সন্ধানে ঘরকে উপেক্ষা করত এখন করোনার কারনে তারা ঘরেই থাকতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছেন তাঁদের  শোকে এখন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেছে। কত নিদারুন কষ্টের গল্প তৈরী হয়েছে যা চোখের জলের কালি দিয়ে লেখা। মানুষ মানুষের ভয়াবহ বিপদে যেমন এগিয়ে এসেছে আবার মানুষ মানুষকে নিদারুন উপেক্ষাও করেছে মানবতার এ ক্রান্তিকালে। তবে  এত কিছুর পরও শুভ মানুষের মানবিকতা ও ভ্রাতৃত্ব বোধই নেতিবাচক দিকগুলিকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। আবারো প্রমানিত হয়েছে পৃথিবীতে এখনো ভাল মানুষের সংখ্যাটা বেশী এবং এ কারনেই পৃথিবী আজো টিকে আছে। কোনদিন যদি এ চিত্রটা উল্টে যায় সেদিন হয়তপৃথিবী বাস্তবেই ধ্বংস হয়ে যাবে। মানবতার পরাজয়ই হল মানুষের প্রকৃত বিনাশ।

আরো একটা জিনিস এখানে প্রনিধানযোগ্য। করোনার এ সময়ে পৃথিবীতে অন্যান্য ব্যাবসা বানিজ্যের প্রভূত ক্ষতি হলেও অস্ত্র কেনা বেচার ব্যাবসা কিন্তু কোন অংশে কমেনি বরং তা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কিছু ছোটখাট যুদ্ধও এর মাঝে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক বিদ্বেষও মনে হয় একটুও কমেনি। পৃথিবীটাকে আমরা কেবলমাত্র নামেই গ্লোবাল ভিলেজ বলছি কিন্তু এ ভিলেজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে রাখতে যে নমনীয়তা, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা আবশ্যক সেটার অভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন কারনে কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অনিশ্চিয়তার দিগন্তে হাঁটছে। সুকান্তের রানারের মত এদের হাঁটা কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারে না।

করোনা হয়ত তাই মানুষকে বলতে চাচ্ছে, ‘হে অমৃতপুত্র মানব জাতি, তোমরা একটু থাম, ভাব ও তারপর তোমাদের কর্ম নির্ধারন কর। তোমাকে যেমন শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে তেমনি তোমার উপর দায়িত্বতো অনেক। তোমার যেমন বাঁচার অধিকার আছে তেমনি গাছপালা, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ, জল, মাটি, আকাশ সবারি তেমন বাঁচার অধিকার আছে। তুমি যদি শুধু তোমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাক তবে আমিও তোমাকে তাড়িয়ে ব্যস্ত রাখব’।

এ পৃথিবীতে আমরা কদিনের জন্য এসে কদিন পর চলে যাই। আমার আমার বলে সবকিছু নিজের অধিকারে নিতে গিয়ে কত অশান্তি তৈরী করি। কিন্তু একবারও যদি ভাবি দুদিনের জন্য পৃথিবী নামক আমরা একটা হোটেলে এসেছি, দুদিন পর এ হোটেল ছেড়ে যেতে হবে। হোটেলের বিছানা, চাদর, গ্লাস, টিভি, টাওয়েল সবি হোটেল মালিকের। হোটেল ত্যাগ করার সময় এগুলি ব্যাগে ভরে নিয়ে যেতে পারব না। মানবজাতির একটা বড় অংশকে  হয়ত  এ  শিক্ষাটাই দিতে চাচ্ছে করোনা মৃত্যুরূপে  ঘরে ঘরে এসে টোকা দিয়ে। আর এত কিছুর পরও মানুষ যদি বেপরোয়া হয়ে কোন শিক্ষা গ্রহন না করে তার সামনে আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। আমাদেরকে যে ভাবেই হোক না মানুষকে সবচেয়ে উপরে রেখে মানবতার জয়গান গেতেই হবে।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা