অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
নজরুলের কবিতায় নারী - সৌম্য ঘোষ

জরুলের ব্যক্তি জীবনের মতো তাঁর কবি মানসেও নারী বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা বিকাশে নারীদের অবদান যে বেশ অর্থবহ তা কবিও সরলচিত্তে স্বীকার করেছেন। ১৯৩৭ সালের ১ আগস্ট কবি তাঁর প্রথমা স্ত্রী নার্গিসকে  চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত; কি অসীম বেদনা। ...তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না— আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।’ এখানে সুস্পষ্টত কবি নার্গিস বিচ্ছেদকে সঙ্গী করে অগ্নিবীণা’য় পৌঁছেছেন। নজরুলকে কবি নজরুল হিসেবে গড়ে তুলতে নারীর প্রেম, বিরহ যে বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীর বিরহ দহনে জ্বলে-পুড়ে পুরুষ যেন নতুন করে সৃষ্টি হয়। আবার নারীর প্রেম-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পুরুষ লাভ করে নবজন্ম- এটাই জগতের নিয়ম। তাই কবির উক্তি : ‘নারীর বিরহে নারীর মিলনে নর পেলো কবি প্রাণ/ যত কথা তার হইল কবিতা শব্দ হইল গান।’

পুরুষদের সৃজনশীলতা, বীরত্ব, শৌর্য-বীর্য এ সবই নারীর বিরহে সিক্ত। পৃথিবীতে যেসব গৌরবময় সৌন্দর্যমণ্ডিত সৃষ্টি রয়েছে তাতে নারী-পুরুষের অবদান সমান সমান। পৃথিবীতে রক্তপাত, হানাহানি, বেদনা, দুঃখ, কষ্টের যে স্রোত বহমান- তাতেও নারী-পুরুষ সমানভাবেই দায়ী। সুজলা-সুফলা, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার পৃথিবী গড়তে নারী-পুরুষের অবদানকে সমান চোখে দেখেছেন নজরুল। তৎকালীন সমাজে নারীদের অবদান স্বীকৃত ছিলো না। পুরুষই সর্বেসর্বা। নারীদের দেখা হতো পরনির্ভরশীল দুর্বল হিসেবে। কিন্তু কবি নজরুল পুরুষদের সর্বেসর্বা মনোভাবকে দলিত করে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন অমোঘ সত্য; দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সাম্যের বাণী— ‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’ (নারী, সাম্যবাদী)।
নজরুলের নারীবিষয়ক যেসব কবিতা রয়েছে তার মধ্যে সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ‘নারী’ কবিতাটি বেশ আলোচিত ও প্রণিধানযোগ্য। তৎকালীন সময়ে এই কবিতাটি রক্ষণশীল পুরুষ মহলে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলো। কবিতায় কবি চেয়েছেন নারীরা জেগে উঠুক। ভাঙুক তাদের কয়েকশ’ বছরের দীর্ঘ ঘুম। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে শিকল বয়ে চলছে নারী, তা ছুড়ে ফেলা হোক বহুদূরে। কবির মতে, নারীদের বন্দিশালায় থেকে দাসী থাকার দিন শেষ হয়েছে। নতুন সূর্যের আলোয় জনরব উঠেছে, এই পৃথিবীতে কারো অধীনে কেউ বন্দি নয়। যদি পুরুষরা নারীদের গৃহে আটকে রাখতে চায়, ক্ষুণ্ন করতে চায় তাদের অধিকার, তবে এক সময় আসবে যখন নিজের তৈরি কারাগারে পুরুষরাই হবে বন্দি। কবি মনে করেছেন, ‘বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,/ কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।’
নারীদের সমান অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাদেরকেই বেশি এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অধিকার সম্পর্কে তাদেরই আগে সচেতন হতে হবে। কবির মনে হয়েছিল- নারীরা সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারেনি। তাদের নিজস্ব অধিকার আদায়ে তাদের আগ্রহ-অধিরতার ঘাটতি রয়েছে। তারা আজ ভয়ে জড়সড়। তারা অন্দরবাসিনী। তারা নেপথ্যে কথা বলে। কবি ‘নারী’ কবিতায় সেই সব নারীদের দাসত্ব, ভীতি ঘোচাতে আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে— ‘আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা/ আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!/ চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায়ে মল,/ মাথায় ঘোমটা, ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল!/ যে-ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ!/ দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যতো আবরণ।’

নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় কবি নজরুল যে কতটা উন্মুখ অধীর ছিলেন তার চিত্র ফুঁটে উঠেছে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায়। কবি দাবি তুলেছেন, অসৎ মাতার সন্তান যদি জারজ হয়, তবে যারা অসৎ পিতা, তাদের সন্তানও জারজ হবে। অনৈতিকতার শাস্তি কেবল নারীরা পাবে, পুরুষরা তার ধারও ধারবে না— নজরুল ছিলেন তার ঘোর বিরোধী। তাই কবির ঘোষণা— ‘শুন ধর্মের চাঁই/ জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো প্রভেদ নাই!/ অসত্য মাতার পুত্র যদি জারজ পুত্র হয়,/ অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।’ কবি উপলব্ধি করেছেন নারীর অবদান স্বীকৃত হয় না। গণনা হয় না। ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না নারীর অনুপ্রেরণা, অবদান, চিরায়ত মহিমা। বড় আড়ম্বরে ঢাকঢোল, কাসা, বাদ্য বাজিয়ে ইতিহাসে কেবলই পুরুষদের ত্যাগ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অভিযানের কথা লেখা হয়েছে। অথচ ‘কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারি,/ প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়া লক্ষ্মী নারী।’
বর্তমানে নারীদের সমানাধিকার ও নারী ক্ষমতায়নের জন্য বেশ  সভা, সেমিনার, লেখালেখি চলছে। কিন্তু নজরুল আরো কয়েক দশক আগেই নারীদের সমানাধিকারের কথা বলে গেছেন এবং এখানেই তাঁর চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মহত্ব। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘সাম্য’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মনুষ্যে মনুষ্যে সমানাধিকার বিশিষ্ট, স্ত্রীগণও মনুষ্য জাতি, অতএব স্ত্রীগণও পুরুষের তুল্য অধিকারশালী, যে যে কার্যে পুরুষের অধিকার আছে, স্ত্রীগণেরও সেই সেই কার্যে অধিকার থাকা ন্যায় সঙ্গত।’ সাহিত্য সম্রাট যেমন তাঁর প্রবন্ধে নারীদের সমান অধিকারের কথা তুলেছেন তেমনি করে নজরুলও তাঁর কবিতায় সেই একই উত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। এজন্য সেই সময়ে পুরুষরা তাঁকে ভাবতো নারীবাদী, নারীঘেঁষা কবি হিসেবে। কবি নিজেই তার কবিতায় এমন চিত্র তুলে ধরেছেন— ‘নর-ভাবে আমি বড় নারী ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী!’ (আমার কৈফিয়ত; সর্বহারা।)
অগ্নিবীণার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো নজরুলের নারীবিষয়ক কবিতায়ও সেই বিদ্রোহের ঢামাঢোল বাজিয়েছেন। তৎকালীন মৌলবাদী সমাজে নজরুল নারীদের অধিকারের পক্ষে যেভাবে দ্বিধাহীন, শঙ্কামুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিতে পেরেছেন, তা সেই সময়ের কোনো কবিই পারেননি।
নজরুল নারীদের সবক’টি রূপই সচেতনভাবে তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় যেমন নারীর সমানাধিকারের দাবি এসেছে তেমনি সেই একই কলমে তিনি এঁকেছেন মাতৃরূপী নারীর মমতাময়ী স্নেহ, প্রেমময়ী নারীর প্রেমমূর্তি, বিরহের রূদ্রপ্রতাপের প্রতিচ্ছবি। নারীর বধুরূপ, কন্যারূপ, নারীর অসহায়ত্ব, গ্লানি, বঞ্চনা, নারীর উল্লাস, আনন্দ সবকিছুই তিনি দক্ষ হাতে তুলে ধরেছেন। কখনো কখনো ইতিহাসের জমি খুঁড়ে তিনি এনেছেন ঐতিহাসিক তাবৎ নারী চরিত্রদের। ‘নওরোজ’ কবিতায় ইতিহাসখ্যাত নারীদের প্রেমময় জীবন তুলে ধরেছেন এভাবে : ‘শিরী লায়লীরে খোঁজে ফরহাদ খোঁজে কায়েস/ ...খুঁজে ফেরে হেথা যুবা সেলিম!/ নূরজাহানের দূর সাকিম,/...চাঁদ বাজারে এ নওরোজের/ দোকান ব'সেছে মোমতাজের,/ সওদা করিতে এসেছে ফের/ শা'জাহান হেথা-রূপ পাগল!’

নজরুলের সর্বাপেক্ষা অমূল্য সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও এসেছে নারীর উদাহরণ- নারীর উপমা। নারীর বৈশিষ্ট্যে সিক্ত হয়েছেন কবি। তাঁর বিদ্রোহ : ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,/ আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/ আমি উন্মন মন উদাসীর,/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশির। (বিদ্রোহী, অগ্নি-বীণা)।’

নজরুলের কবিতায় বিশেষ করে ‘নতুন চাঁদ’ এবং ‘আমার কবিতা তুমি’ কবিতায় নারী সৌন্দর্যের সাথে স্রষ্টা, সৃষ্টি, প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নজরুলের কবি জীবনের পরিপূর্ণতা আনতে নারীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য তা পূর্বেই বলেছি। বিশেষ করে নার্গিস আসার খানম, ফজিলাতুননেছা, জাহানারা চৌধুরীর প্রেমিক হৃদয়ের সংস্পর্শে এসে নজরুল নামের গোলাপ বাংলা সাহিত্যে বেঁচে থাকার জল পেল। কবি তাঁর বহু কবিতায় তাঁর প্রিয়ার অবদান জানিয়েছেন। কবি বিদ্রোহী হলেও প্রেমিক হৃদয়, কবি প্রেমের কাঙাল। কবির প্রিয়াকে কবি সম্বোধন করেন : ‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।/ আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।/ ...আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,/ বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে’। (বিজয়িনী; ছায়ানট)। কবির বিদ্রোহ, বিজয়, প্রেম- সবই প্রিয়ার কাছে জমা রেখেছেন তিনি। তাঁর অস্তিত্বটুকু, কবি মানসের পরম ভক্তিগুলো, নৈবদ্যগুলো স্থান পেয়েছে প্রেয়সীর পদতলে। কবি মনে করেন, তাঁর জীবনে প্রিয় নামক নারীটি না থাকলে তিনি কবি হতে পারতেন না। কবির উক্তি— ‘...আমার বাণী জয়মাল্য, রাণী! তোমার সবি।/ তুমি আমায় ভালোবাসো, তাইতো আমি কবি।/ আমার এ রূপ,— সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।’ (কবি-রাণী, দোলন-চাঁপা)। প্রিয়া কবির জীবনে এসেছিলো মরুতৃষ্ণার পানি হয়ে। কবি ভেবেছেন— ‘প্রিয় রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,/ আঁখির পলকে মরুভূমি যেনো হয়ে গেলো বনভূমি।’

নজরুলের কবিতায় উঠে এসেছে সহজ-সরল নারীদের জীবন বর্ণনাও। ‘বেলা গেলো বধূ’ ভাসে ননদী,/ ‘চলে জল নিতে যাবি লো যদি।’ এভাবেই বধূ, ননদীর দৈনন্দিন জীবনচারিতা ‘বসিয়া বিজনে একা মনে’ কবিতায় নজরুলের মাতৃভক্তির বর্ণনা, জীবনদর্শনও উল্লেখ করার মতো। কবির দৃঢ় বিশ্বাস, ‘সর্বসহা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা!/ শূন্য নাহি রহে কভূ মাতা ও বিধাতা!’ (মা, সর্বহারা)। কবি ব্যক্তি জীবনে অনেক নারীর সান্নিধ্যই পেয়েছেন, যারা ছিলেন তাঁর মাতৃসম। কবি তাঁদের মা বলে জ্ঞান করতেন। তাঁদের স্নেহ-মমতায় পূর্ণ হয়েছে কবি হৃদয়। কবি মাতৃহৃদয়ের আলোকেই বিশ্বকে চিনেছেন— ‘তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু/ ...মাতা তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্ব-জননী।/ তোমার আঁচল পাতা নিখিল দুঃখী-নিপীড়িত তবে,/ বিষ শুধু তোমা দহে যথা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণীর ভার বহে।’ কবি মাতৃস্নেহের জন্য ব্যাকুল হয়েছেন। তেমনি অসহায়, দুস্থ নারীদের জন্য কবি হয়েছেন শোকাতুর, সহমর্মী। এজন্য কবি স্পর্ধা করতেও ছাড়েননি। দুই নারীর নিদারুণ কষ্টে, অসহায়ত্বে ‘ফণি-মনসা’ কাব্যের ‘সত্য কবি’ কবিতায় কবির স্পর্ধা— ‘ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দুটি নারীর পানে?/ জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে যদি ওরা অভিশাপ হানে!’

নজরুলের এমন স্পর্ধা যেমন হৃদয়গ্রাহী, পুরোধা, কোমল সুরে বজ্রকণ্ঠ তেমনি এমনটা সেই সমাজের থেকে বলাটাও দুঃসাহসিক। নজরুল নারীদের সমানাধিকার, নারীর প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ, প্রেয়সীর প্রেমের অনিবার্যতা ও মাতৃভক্তির পদতলে যে পরিপূর্ণতা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন তা-ই নজরুলকে নজরুল করেছে।

অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ
চুঁচুড়া, পশ্চিমবঙ্গ