অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
নারীবাদ ও পুরুষতন্ত্র : একটি অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব - আলী রেজা

   শ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর নিজ সম্পদ থেকে কিছু ব্যক্তিকে মাসিক বৃত্তি প্রদান করতেন। নিজের মৃত্যুর পর সেই মাসিক বৃত্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিবেচনা করে বিদ্যাসাগর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর সম্পত্তির উপস্বত্ত্ব হতে কে কত মাসিক বৃত্তি পাবেন তা নির্দিষ্ট করে যান। প্রথম শ্রেণির নির্দিষ্ট বৃত্তিপ্রাপ্ত মোট ৩২ জনের মধ্যে ২৪ জনই ছিলেন নারী এবং ১৮ জন নারীর নামের সঙ্গে ‘দেবী’ বিশেষণটি যুক্ত ছিল। দ্বিতীয় শ্রেণির নির্দিষ্ট বৃত্তিপ্রাপ্ত মোট ১৩ জনের মধ্যে ৮ জন ছিল নারী এবং ৭ জনের নামের শেষে ‘দেবী’ বিশেষণটি যুক্ত ছিল [সূত্র : মো. মতিউর রহমান, বাঙালির দর্শন মানুষ ও সমাজ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০০]। সময়টা ছিল ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি ঐ সময়ে বিদ্যাসাগর নারীর সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের পূর্বে রামমোহন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নারীর বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। রামমোহনের পূর্বে ভারতবর্ষে নারীর অবস্থা যে অত্যন্ত করুণ ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। অথচ মুখে তাদেরকে দেবী নামেই ডাকার রেওয়াজ ছিল। যদিও এটা পুরুষতন্ত্রের আদুরে ডাক ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দেবীরা দাসীর মতোই ব্যবহৃত হতো।
     বিদ্যাসাগর যাদের মাসিক বৃত্তি দিতেন তারা সকলেই ছিলেন দরিদ্র। তাদের খুব একটা সামাজিক মর্যাদা ছিল না। বৃত্তি বলা হলেও আসলে এটা ছিল এক ধরণের আর্থিক সাহায্য। দান বা আর্থিক সাহায্যটা একটু সম্মানজনকভাবে প্রদান করার জন্য এটাকে বৃত্তি বলা হতো। এই বৃত্তিভোগী দুঃস্থ নারীদের নামের সাথে দেবী বিশেষণটি যুক্ত থাকার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে তৎকালে ভারতবর্ষে প্রায় সকল হিন্দু নারীর নামের শেষে দেবী বিশেষণটি যুক্ত থাকতো। অথচ এই দেবীদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। এই দেবীদের কোন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছিল না। ছিল না শিক্ষা গ্রহণের কোন অধিকার। ‘দেবী’ বিশেষণে ভূষিত এই নারীরা শুধু পুরুষের সেবা করতো। পুরুষের মনোরঞ্জন করতো আর পুরুষের মঙ্গল কামনা করে সারাজীবন কাটিয়ে দিতো। এই দেবীরা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতো। কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে থাকতো। থাকতো পুরুষের দাসী হয়ে। তবু পুরুষ সমাজ এই নারীদের দেবী বলেই সম্বোধন করতো। 
     পুরুষতন্ত্র নারীকে দেবী বানিয়েছে নিজের স্বার্থে। নারীকে তার মৃত স্বামীর সাথে চিতায় জ্বলতে হতো পুরুষের স্বার্থে। বিধবা নারী পুরুষের কাঙ্ক্ষিত নয় বলে পৃথিবীতে তার কোন প্রয়োজন নেই। যতদিন পুরুষ নারীকে আকাঙ্ক্ষা করে ততদিনই নারী দেবীর আসনে থাকে। নারী মা হলে তার প্রতি সকলের ভক্তি বেড়ে যায়। এই ভক্তিও নিঃস্বার্থ নয়। কারণ জননীর গর্ভে বেড়ে ওঠে পুরুষ। শিশুটি যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হয় তবে এ যুগেও সে মায়ের গৌরব বাড়ে না। অতীতেও কখনো মেয়ে সন্তান জন্মদানকারী মা গর্বিত ছিলেন না। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে নারী ছেলে ও মেয়ে- উভয়কেই জন্ম দিতে সক্ষম। সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তা নির্ভর করে পুরুষের ওপর। তবু পুরুষতন্ত্র নারীকেই মানসিকভাবে হেয় করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এক সময় সন্তান মেয়ে হলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। মেয়ে সন্তান কারো গৌরব বাড়াতো না। অথচ মেয়ে সন্তানের মাকে সসম্মানে জীবিত রাখা হতো। কারণ ছেলে সন্তানও জন্ম দিবেন ঐ মা-ই। কোন মায়ের গর্ভে ছেলে সন্তান জন্ম না হলে সে মায়ের মর্যাদা কমে যেতো সকলের কাছে। ভিন্ন কায়দায় এখনো মানুষ একই মনোভাব পোষণ করে।
     রক্ষণশীল সমাজ ও শাস্ত্রীয় পণ্ডিতগণ শাস্ত্রের দোহাই দিলেও রামমোহন রায় শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন যে, সতীদাহ কোন ধর্মীয় বিধান নয়। বিধবা নারী বিপথগামী হতে পারে এবং এতে বংশীয় লোকদের সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা বিবেচনা করে রক্ষণশীল সমাজ শাস্ত্রীয় পণ্ডিতগণের মাধ্যমে সতীদাহকে ধর্মীয় মর্যাদা দিয়েছিলেন। পুরুষতন্ত্র নারীর জীবনকে এতোটাই তুচ্ছ মনে করতো। সতীদাহ প্রথা আসলে ছিল পরিকল্পিতভাবে নারীহত্যার প্রথা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুরুষ বিপত্নীক হলে ঐ পুরুষের বিপথগমনের আশঙ্কা এবং এতে বংশীয় লোকদের সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার কথা বিবেচনা করে স্ত্রীর চিতায় স্বামীর সহমরণের বিধান দেননি কোন কালের কোন রক্ষণশীল সমাজ। এখানে একই অপরাধের আশঙ্কায় নারীর জন্য মৃত্যুদণ্ড আর পুরুষের জন্য কোন দণ্ডই নেই। তাই সহমরণ কালপর্বে মুখে নারীকে যতই দেবী বলা হোক না কেন- পুরুষতন্ত্রের কাছে নারী মানুষের মর্যাদাই পায়নি। পুরুষের মনোরঞ্জন আর পুরুষের সেবা করাকেই নারীর পরমধর্ম বলে প্রচার করা হয়েছে।
     রামমোহনের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হলে বিধবা নারীরা জীবন ফিরে পায়। কিন্তু বিধবা নারীর জীবন আর অন্যান্য প্রাণির জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্যই থাকে না। গৃহপালিত প্রাণিরা গৃহস্থের মাধ্যমে যে সমাদর লাভ করে প্রকৃত বিচারে বিধবা নারীরা নিজ পরিবার ও সমাজে সেটুকু সমাদর থেকেও বঞ্চিত হয়। প্রতি পদক্ষেপে নিজেকেই বুঝে নিতে হয় কিংবা অন্যেরা বুঝিয়ে দেন যে সে বিধবা। পরিবার ও সমাজের সেবাদাসী হয়ে চলতে হয়। কোন শুভ বিষয়ে ডাক পড়ে না। কোন আনন্দের অংশীদার হতে পারেন না। সমাজ বিধবা নারীর জন্য যে পোশাক নির্ধারণ করে দেয় সে পোশাক একজন বিধবা নারীকে করে তুলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। কাফনের কাপড়ের মতো একটি সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে একজন বিধবা জীবিত থেকেও হয়ে যায় অর্ধমৃত। অথচ বিপত্নীক পুরুষ রঙিন পোশাকে সজ্জিত হতে পারে। সমাজ বিধবা নারীর জন্য যে বিধান দিয়েছে বিপত্নীক পুরুষের জন্য সে রকম কোন বিধানই দেয়নি। বিপত্নীক পুরুষ স্বাধীন হলেও বিধবা নারী সবক্ষেত্রেই হয় সমর্পিত। এই অর্পিত জীবন মেনে নিয়েই পথ চলেন বিধবা। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হলে সমাজে এই বিধবা নারীর সংখ্যা বেড়ে যায়। পুরুষ এদের সেবা গ্রহণ করে। যাপিত জীবনের সকল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখে বলে এরা প্রশংসিত হয় পুরুষের কাছে। পুরুষ মুখে এদের দেবী করে তোলে কাজে দাসী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
     সন্তান মেয়ে হলে বংশরক্ষা হয় না। তাই মেয়ে সন্তান কাঙ্ক্ষিত নয়। সন্তান মেয়ে হলে তার শিক্ষার পেছনে খরচ করা অপচয়। কারণ মেয়ে বিয়ে হয়ে গেলে অন্য সংসারে কাজে লাগবে। অনেকে এটাকে সাবেকী চিন্তা মনে করতে পারেন। কিন্তু এই মনোভাবের পরিবর্তন আজো খুব একটা হয়নি। বাঙালি সমাজ তো এ ব্যাপারে আরো রক্ষণশীল। শিক্ষার প্রসার ও সরকারি প্রচেষ্টায় সমাজের যে পরিবর্তন এসেছে তার বেশিরভাগই বাইরের। ভেতরের পরিবর্তন বা মানসজাগরণ তেমন ঘটেনি। মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। চাকরি পাচ্ছে সরকার নির্ধারিত বিশেষ কোটায়। শিক্ষায়, পদমর্যাদায় এগিয়ে যাওয়া এই মেয়েরা স্বামী হিসেবে বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে পিছিয়ে পড়া ছেলেদেরকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এটাকে স্বাভাবিক মনে করছে। ছেলের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো সে পুরুষ। আর মেয়ের সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হলো সে নারী। শিক্ষায়, পদমর্যাদায় এগিয়ে যাওয়া নারীরা সামাজিক সম্মানের দিক দিয়ে এগোয়নি। তার মানে হলো সমাজ এখনো পুরুষবান্ধব।
     পাঠশালার মাধ্যমে শুরু হয়ে টোল বা চতুষ্পাঠী এবং মাদরাসার মাধ্যমে শেষ হওয়ার যে শিক্ষাপদ্ধতি এ দেশে চালু ছিল ব্রিটিশের আগমনে সাবেকী সে শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে। কলিকাতা মাদরাসা (১৭৮১), সংস্কৃত কলেজ (১৭৯২), এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪), ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০) এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত বেশকিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি নির্মাণ করে। কলিকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সূচনা ও বোম্বাই মেডিকেল কলেজ (১৮৪৫) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে চিকিৎসা শিক্ষার প্রসার ঘটে। শিক্ষা বিস্তারের এই পথপরিক্রমায় নারী শিক্ষা নিয়ে তেমন কেউ ভাবেনি। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে নারীশিক্ষার জন্য কোন ভালো প্রতিষ্ঠান হয়নি। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু ফিমেল স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ২১ জন ছাত্রী নিয়ে ‘বেথুন স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা বেথুন (১৮০১-১৮৫১) ছিলেন ভারতপ্রেমী ব্রিটিশ রাজকর্মচারী। ভারতে নারী শিক্ষার পথিকৃত হিসেবে বেথুনকেই স্মরণ করা হয়। ইংরেজ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এই বেথুন স্কুলে সাড়ে চার দশক পরেও (১৮৯৪) ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১৩৮ জন। এদের মধ্যে ৭০ জন হিন্দু, ৫৫ জন ব্রাহ্ম ও ১৩ জন খ্রিস্টান। কোন মুসলমান ছাত্রী ছিল না। এই হলো ভারতে নারী শিক্ষার তৎকালীন চিত্র। ‘বেথুন স্কুল’ প্রতিষ্ঠার প্রায় আট দশক পরেও যে ভারতে নারী শিক্ষার অগ্রগতি হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে লেখা এক চিঠিতে। প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন দশক পরেও বেগম রোকেয়ার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১১৪ জন। এই ১১৪ জনের মধ্যে মাত্র দুজন ছিল বাঙালি [সূত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দ, বেগম রোকেয়া, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ১৯৮৩]।
     নারীশিক্ষার এই মন্থর গতির প্রধান কারণ হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাই স্বীকার করতো না। নারী শিক্ষার মানেই ছিল কিছু ধর্মীয় শিক্ষা। সেটাও সবার ভাগ্যে জুটতো না। কর্মমুখি শিক্ষার কথা নারীরা কল্পনাও করতে পারতো না। বিদ্যাসাগর-বেগম রোকেয়ার পথ ধরে পরবর্তী সময়ে যাঁরা নারী শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের সমবেত প্রচেষ্টায় ক্রমশ নারীরা এগিয়েছে অনেক। বর্তমানে নারী-পুরুষ সমান যোগ্যতায়, সমমর্যাদায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অবদান রাখছেন। নারীর এই অগ্রগতি সত্ত্বেও সমাজ নারীবান্ধব হয়নি। এখনো নারী নিরাপদ নয় পুরুষের কাছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছেও না। এখনো সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় পড়েনি নারী। নারীর জন্য চলাচলের পথ নিরাপদ নয়, গণপরিবহন নিরাপদ নয়, কর্মস্থল নিরাপদ নয়, এমনকি নিজের পরিবারও নিরাপদ নয়। নারী কেন এতো নিরাপত্তাহীন?  একদিকে নারীবাদী চেতনার বিকাশ ঘটছে অন্যদিকে নারী নিরাপত্তাহীন হচ্ছে। ফাঁকটা তাহলে কোথায়? নারীবাদ কি সঠিক পথে এগুচ্ছে না? পুরুষতন্ত্র কি নারীর ক্ষেত্রে ‘গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নেওয়া’র কাজটি করছে?
     নারী জন্মগতভাবেই পুরুষের প্রতিপক্ষ। জন্মের পর থেকেই প্রথাগত সমাজ নারীর জন্য কিছু বিশেষ বিধান জারি করে। ঐ বিশেষ বিধানের বলে নারী পুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হতে হতে প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। সমাজ তখন যে আপোষ মীমাংসা দেয় তার ফলে নারীর কাছে পুরুষ চায় সেবা। আর পুরুষের কাছে নারী চায় নিরাপত্তা। স্বভাবতই নিরাপত্তা বিধানকারী হিসেবে পুরুষ নিজেকে শক্তিমান মনে করে। নারীও তার নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনবোধ করে একজন পুরুষসঙ্গীর। সমাজ নারীকে এভাবে পুরুষনির্ভর করে তোলে। ফলে নারী হয়ে যায় অধীনস্ত, নারী হয়ে যায় পুরুষের সেবাদাসী। নারীর পেশাগত ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে নারীকে রক্ষা করতে পারে না। নারীর প্রকৃত রক্ষক পুরুষ। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এ বিধান লঙ্ঘন করতে পারে না কোন নারী। যারা করতে চায় তারা হয়ে যায় পুরুষের প্রবল প্রতিপক্ষ। শুধু পুরুষের নয়, রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মেরও প্রতিপক্ষ হয়ে যায় তারা।
     নারীর প্রতিপক্ষ শুধু পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র নয়। নারীদেহও নারীর আর এক প্রবল প্রতিপক্ষ। কেইট মিলেট তাঁর Sexual Politics (১৯৭০) গ্রন্থে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : ‘ যৌন সম্পর্কের মূলে রয়েছে নারীর পক্ষে দখল হওয়ার একটা ব্যাপার। সে পুরুষকে দখল করে না, পুরুষই তাকে দখল ও গ্রহণ করে থাকে। যৌন সম্পর্কের ধরণই নারীর স্বাধীনতাকে হত্যা করে। এর জন্য দায়ী নারীদেহ। নারীদেহই নারীর প্রধান শত্রু।’  ফলে শরীর নামক এই প্রতিপক্ষও নারীকে করে তোলে নিরাপত্তাহীন। সমাজ যেমন কিছু বিশেষ বিধান জারি করে পুরুষকে নারীর রক্ষাকর্তা বানিয়েছে তেমনি নারীর শরীরও নারীকে করেছে পুরুষের অধীন। রতিক্রিয়া সম্পন্ন করার যে আসনবিন্যাস সেখানে পুরুষ প্রবলভাবে আক্রমণকারী আর নারী আক্রান্ত। পুরুষ অতিমাত্রায় সক্রিয় আর নারী নিঃক্রিয়। পুরুষ উদ্ধত আর নারী অবনত। নারীর শরীরকাঠামো নারীকে সমর্পিত হতে বাধ্য করে। আর নারী সমর্পিত হলে পুরুষতন্ত্র নারীকে দেবী বলে প্রশংসিত করে। আবার এ দেবীবন্দনার মূল্যও আদায় করে নেয় পুরুষ সমর্পিত নারীর সেবা গ্রহণ করে। যে নারী সমর্পিত নয়, যে নারী পুরুষের সেবাদাসী নয়; সে নারীর প্রতিপক্ষ শুধু পুরুষ নয়, সমাজ ও ধর্মও তার প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। সমাজ এবং ধর্ম দুটোই পুরুষতন্ত্রের রক্ষাকর্তা। তাই শিক্ষায়, পদমর্যাদায় নারী যতই এগিয়ে যাক না কেন- যতই পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠুক না কেন- সমাজমানস নারীকে কখনো পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখেনি। নারীর অর্ধাঙ্গী অভিধাটি নারীর পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রবল অন্তরায়। ধর্ম বলেছে পুরুষের বাম পাশের বাকা হাড় দিয়ে তৈরি হয়েছে নারী। সে হিসেবে পুরুষ থেকেই নারীর সৃষ্টি। কিন্তু সৃষ্টি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে দেখা যায় নারী থেকেই পুরুষ ও নারী দুটোই সৃষ্টি হয়। নারীর এই সৃষ্টিক্ষমতাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবু নারী অর্ধাঙ্গী হিসেবে বিবেচিত পুরুষতন্ত্রের কাছে। পুরুষতন্ত্র নারীকে যেরূপে মূল্যায়ন করে সমাজে নারীর মূল্য সেরূপেই নির্ধারিত হয়। পুরুষ নিরাপত্তা দিলে নারী নিরাপদ হয়। তাই নারী আজও নিরাপদ নয় পুরুষের নিরাপত্তা ছাড়া। নারী আজও মুখে দেবী, কাজে দাসী।
     রাষ্ট্র নারীর যে অধিকার দিয়েছে, ধর্ম নারীর যে অধিকার দিয়েছে, সমাজ নারীর যে অধিকার দিয়েছে তার কোনটাই প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি নারী। নারী নিজের মেধা ও যোগ্যতায় শিক্ষা ও পদমর্যাদা পেয়েছে। এর পেছনে পুরুষের ভূমিকা সামান্যই। নিজের স্বার্থের অনুকূলে যেটুকু সেটুকুই দিয়েছে পুরুষ নারীকে। পুরুষতন্ত্রের অনুকূল না হলে পুরুষ কখনোই নারীর অগ্রযাত্রায় সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। পুরুষতন্ত্রের অনুকূল না হলে নারীর অগ্রযাত্রাকে নির্মমভাবে থামিয়ে দিয়েছে পুরুষ। নারীর অনুকূলে রাষ্ট্র অনেক আইন করেছে। আইন লঙ্ঘনকারীর জন্য যথার্থ শাস্তির বিধান করেছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নারীকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। পুরুষতন্ত্র নারীর প্রবল প্রতিপক্ষ না হলে নারীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, নারীকে নিরাপদ করার জন্য রাষ্ট্রীয় এসব আইনের কোন প্রয়োজনই হতো না। দুঃখজনক বিষয় হলো রাষ্ট্রীয় কোন আইন পুরুষের হাত থেকে নারীকে নিরাপদ করতে পারছে না। আসলে পুরুষের হাত থেকে নারীর নিরাপত্তার জন্য কোন আইনের প্রয়োজন নেই। এটা কোন আইনের বিষয়ই নয়। এটা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফল। এর জন্য রাষ্ট্রকেই আগে বের হয়ে আসতে হবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে। নারীনির্যাতনবিরোধী সকল আইন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সৃষ্টি। আইনগুলো পুরুষকে নির্যাতনকারী ও নারীকে নির্যাতিত হিসেবে মানসিকভাবে চিহ্নিত করে। এতে আরও প্রবলভাবে পরস্পর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে পুরুষ এবং নারী। তাহলে কি রাষ্ট্রীয় আইনের প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। তবে আইন আলাদাভাবে নারীর জন্য নয়। আইন হওয়া উচিত মানুষের জন্য। নারী ও পুরুষ উভয়েই উভয়ের মাধ্যমে নির্যাতিত হতে পারে। তাই নারীনির্যাতনবিরোধী আইন না হয়ে আইন হওয়া উচিত নির্যাতনবিরোধী। এতে পুরুষের আক্রমণাত্মক মানসিকতার পরিবর্তন যেমন ঘটবে তেমনি নারী শুধু আক্রান্ত হওয়ার দুর্বল মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।
     নারীকে সর্বক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। আর আইন হবে মানুষের জন্য। রাষ্ট্র পুরুষতান্ত্রিক কিংবা নারীতান্ত্রিক না হয়ে হবে মানবতান্ত্রিক। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে নারীর জন্য পৃথক আইনের প্রয়োজন হবে না। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছে সরকার। কিন্তু ধর্ষণ চলছে। এতে বোঝা যায় আইন করে নারীনির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। মানবকেন্দ্রিক মানসিকতা জাগ্রত করার মাধ্যমে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন দরকার। নারী শুধু নির্যাতিত হয় না, নারী শোষিতও হয়। পুরুষ শোষণ করে নারীকে। শ্রেণিশোষণের এটি একটি বড় ক্ষেত্র। পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর কাছ থেকে যে পরিমাণ সেবা পায়, নারী পুরুষের কাছ থেকে সে পরিমাণ সেবা পায় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে সেবিকা বানিয়েছে কিন্তু পুরুষকে নারীর সেবক বানায়নি। এটা শুধু সামাজিক বিধান নয়, ধর্মও যোগ হয়েছে এর সাথে। স্বামীসেবার মাধ্যমে নারী যত বেশি পূণ্য অর্জন করতে পারে স্ত্রীসেবার মাধ্যমে পুরুষ তা পারে না। ধর্মে স্বামীসেবার কথা যত ফলাও করে বলা হয়েছে, স্ত্রীসেবার কথা সেভাবে বলা হয়নি। স্ত্রীর জন্য স্বামীসেবা যতটা কর্তব্যকর্ম স্বামীর জন্য স্ত্রীসেবা ততটা কর্তব্যকর্ম নয়। স্ত্রীসেবার জন্য পুরুষ পরকালে কী পাবে ধর্ম সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। খুব একটা ফলাও করে বলেনি সে বিষয়ে। কিন্তু স্বামীসেবার ফলে স্ত্রী পরকালে বেহেস্ত বা স্বর্গলাভও করতে পারে বলে ফলাও করে বলা হয়েছে সকল ধর্মেই। মৃত্যুর পরে স্বর্গবাসী হয়ে পুরুষ যৌনসম্ভোগের জন্য পাবে সত্তরটি হুর আর শারীরিক সেবার জন্য পাবে অসংখ্য গেলমান। কিন্তু স্বর্গবাসী নারী এসবের কিছুই পাবে না। তাহলে কি রাষ্ট্র ও সমাজের ন্যায় ধর্মও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা লালন করে? পুরুষতন্ত্র নারীর সেবা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মকে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু নারী পুরুষের সেবা পাওয়ার জন্য কোন কর্তৃপক্ষকে কাজে লাগাতে পারেনি।
     নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার মানবিক মর্যাদার উন্নয়ন নিশ্চিত করে না। তাই সর্বযুগের ন্যায় আজও কর্মজীবী নারী যথাযোগ্য সামাজিক মর্যাদার অধিকারী নয়। একই পদমর্যাদার অধিকারী একজন পুরুষ যে সামাজিক মর্যাদা পায়, একজন নারী সে সামাজিক মর্যাদা পায় না। কারণ সমাজ চায় কর্মজীবী পুরুষ এবং পুরুষের অনুগত নারী। স্বাবলম্বী নারী পুরুষের কাম্য নয়। স্বাবলম্বী নারী পুরুষের একক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। তাই নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন পুরুষতন্ত্রের চোখে দৃষ্টিকটু। নারী অর্থ উপার্জনের জন্য কোন কাজে নিয়োজিত হলে অভিজাত সমাজ সেটা বাঁকাচোখেই দেখে। নারীর অর্থ উপার্জন আজও আভিজাত্যের প্রতীক নয়। আজও পুরুষতন্ত্রের মানসিকতা হলো নারী অর্থ উপার্জন করলে পুরুষের গৌরব ক্ষুণ্ন হয়। যে পুরুষ নারীকে অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত করে পুরুষতন্ত্রের চোখে সে পুরুষ অভিজাত নয়। নারীর গৃহিণী পরিচয়টাই পুরুষতন্ত্রের কাছে বড় এবং কাঙ্ক্ষিত পরিচয়। আজকাল নারীরা যে বিভিন্ন পেশায় ব্যাপকহারে  নিয়োজিত হচ্ছে তাতে পুরুষের চোখে নারীর মহিমা বাড়েনি। নারী তার কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা আজও পুরুষের মতের বাইরে যেতে পারে না। নারী যতই শিক্ষা ও পদমর্যাদায় এগিয়ে যাচ্ছে পুরুষ ততই তার কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষের সবচেয়ে আদিম ও অব্যর্থ অস্ত্র হলো যৌননির্যাতন বা ধর্ষণ। পুরুষ আক্রমণ করতে পারে নারীদেহের ওপর। এতে আক্রমণকারী পুরুষ নিন্দিত হলেও নষ্ট হয়ে যায় না। কিন্তু আক্রান্ত নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে হয়ে যায় নষ্টবস্তুর মতো অপাংক্তেয়।
     নারীর মূল্য নিয়ে দরদী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র লিখেছেন তাঁর ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে। নারীকে তিনি মহামূল্যবান করে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে নারী মহামূল্যবান এই কারণে যে নারীর সেবা ছাড়া পুরুষের একদণ্ডও চলে না। পুরুষের সকল প্রয়োজন মেটায় নারী। পুরুষের প্রয়োজনে না লাগলেই যেন নারী তুচ্ছ। শরৎচন্দ্র বোঝাতে চেয়েছেন যে জলের মূল্য নাই; কিন্তু জল ছাড়া জীবন বাঁচে না। জগতে জল যদি দুষ্প্রাপ্য হয় তবে প্রাণ বাঁচানোর জন্য তৃষ্ণার্ত রাজা একটু জলের বিনিময়ে তাঁর সিংহাসনও ছেড়ে যাবে। তার মানে জলের মূল্য তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির কাছে শুধু তৃষ্ণা নিবারণকালে। অন্য সময় জল মূল্যহীন। জলের মতো নারীরও নিজস্ব কোন মূল্য নেই। নারী কাছে থাকলে মূল্যহীন। দুষ্প্রাপ্য হলেই কেবল মূল্যবান। নারীর মূল্যের কথা বলতে গিয়ে দরদী শরৎচন্দ্রও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। অনেক মহৎ নারীকে বিপথগামী অসৎ পুরুষের সেবাদাসী করেই নারীর মহত্ত প্রচার করেছেন শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যে। নারী মহৎ হয়েছে পুরুষের সেবা করেই। শুরু শরৎসাহিত্য নয়, বঙ্কিম-রবীন্দ্র এবং বঙ্কিম-রবীন্দ্র প্রভাবিত সাহিত্যের ধারায় নারীর মহত্ত প্রকাশিত হয়েছে পুরুষের সেবার মাধ্যমে। যে নারী পুরুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, পুরুষের প্রতি গভীরভাবে অনুগত সে নারীই পেয়েছে সামাজিক মর্যাদা। নারী বিদ্রোহী হলে, অধিকার সচেতন  হলে নারীর কপালে কলঙ্কের দাগ লেগেছে। বিদ্রোহী নারীরা এক পর্যায়ে পুরুষের আধিপত্য মেনে নিয়ে, পুরুষের সেবাদাসী হয়ে সংসার ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। যারা পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয়নি তারা সমাজচ্যুত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র- কেউ শেষ পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।
     রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য- সবাই কমবেশি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা লালন করে। ফলে নারী কখনোই সমান অধিকার পায় না। নারী ব্যবহৃত হয়। পুরুষ ব্যবহার করে। সমকালে নারীবাদী আন্দোলন অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেক পুরুষও এখন নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নারী স্বাধীনতা ও নারীমুক্তির কথা বলছে উচ্চস্বরে। তার মানে নারী আজও স্বাধীন বা মুক্ত নয় পুরুষতন্ত্রের বিছানো জাল থেকে। পুরুষতন্ত্রের জালে আটকে আছে নারী। এই আটকে থাকাটা নারীর জন্য নিরাপদ। এই নিরাপত্তা দিয়েই পুরুষ শোষণ করছে নারীকে। আগের তুলনায় নারী এখন অনেক বেশি মাত্রায় পণ্যে পরিণত হয়েছে। পুরুষতন্ত্র নারীকে উপস্থাপন করছে অতি লোভনীয় পণ্য হিসেবে। মুক্তবাজার অর্থনীতি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে গিয়ে নারীকেই সবচেয়ে লোভনীয় পণ্যে পরিণত করেছে। পণ্যকে উপস্থাপন করতে গিয়ে নারী নিজেই উপস্থাপিত হচ্ছে। নারীর অঙ্গভঙ্গি, নারীর পোশাক, নারীর সংলাপ সবকিছু আজ পণ্য। নারী প্রদর্শিত হয়। পুরুষ নারীকে প্রদর্শন করে। প্রদর্শিত নারী পুরুষের বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়িয়ে দেয়। নারীও গর্বিত হয় প্রদর্শিত হতে পেরে। 
     পুরুষতন্ত্র নারীবাদকে লালন করে। কিন্তু নারীবাদকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয় না। নারীকে কাছে টানলেও নারীবাদী চেতনাকে দূরে ঠেলে রাখতে চায়। এটা পুরুষতন্ত্রের শ্রেণিস্বার্থ। এই শ্রেণিস্বার্থের জায়গা থেকে পুরুষতন্ত্র কখনোই সরে আসতে চায় না। সরে আসলেই কেবল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নারীবাদ। নারীবাদ কখনোই নারীর একক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ নারীর চেয়ে নারীর শরীর পুরুষতন্ত্রের কাছে বেশি কাঙ্ক্ষিত। তাই বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক গঠন ও সৌন্দর্য যেভাবে পরখ করা হয়, যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়; অন্য বিষয়গুলো সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এটা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফল। নারীর যোগ্যতা এখনো গৌণ বিষয়। দৈহিক সৌন্দর্যই মুখ্য বিষয়। সমাজ পুরুষের যোগ্যতা কামনা করে। আর নারীর যোগ্যতা মেনে নেয়। ছেলে সন্তান প্রতিষ্ঠিত হলে সে হয় ‘বাপের বেটা’। আর সন্তান চোর হলে ‘চোরের মার বড় গলা’ বলে মায়ের নামটাই সামনে আনা হয়। এভাবে সমাজমানস পুরুষের গৌরব রক্ষা করে আর নারীকে অধপতিত করে।
     নারী পুরুষকে তৃপ্ত করবে শরীর দিয়ে, সেবা দিয়ে, আনুগত্য আর নিষ্ঠা দিয়ে- চিরায়ত এই নারী ভাবমূর্তিই নারীকে করেছে চির অবনত। নারী যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলে সেটাকে বলা হয় দেহদান। নারীর দেহদান কোন গৌরবের বিষয় নয়। আবার নারীদেহই পুরুষের প্রধান কামনার বিষয়। নারীদেহের বন্দনায় মুখরিত হয় পুরুষ। আবার দেহব্যবসায়ী নারীদের অবজ্ঞা ও ঘৃণা করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নারী একবার পুরুষের ভোগ্য হলে সে হারায় তার সতীত্ব। পুরুষের কাছে সতীত্বের মূল্য অনেক। পুরুষ চায় অনাঘ্রাত নারী। নারী নিজেও তার সতীত্ব রক্ষা করে কোন পুরুষের কাছে সতীত্ব বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। আসলে নারী যা রক্ষা করে তাও পুরুষের জন্য। কিন্তু নারীর জন্য পুরুষের সতীত্ব জাতীয় কোন কিছু রক্ষা করতে হয় না। পুরুষের দেহদান বলতে কিছু নেই। বহু নারীর সাথে মিলিত হয়েও পুরুষ দেহব্যবসায়ী হয় না। সমাজ ও ধর্ম মিলেই পুরুষের বহুগামী হওয়ার বিধান দিয়েছে। পুরুষের একাধিক নারী গ্রহণ শুধু বিধিবদ্ধ নয়, এতে পুরুষের পৌরুষত্বও বাড়ে। কিন্তু নারীর একাধিক পুরুষ গ্রহণ করার কোন বিধানই নেই।
     যৌনভাবনার বিষয়টি বাদ দিলেও অন্যান্য বিষয়ে কি নারীর অবস্থান সম্মানজনক? এ নিয়ে যতই তর্ক চলুক- প্রকৃত অবস্থা হলো নারী আজও, এই বর্তমান মানবতাবাদী যুগেও ভালো নেই। আজও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার চিন্তার শেষ নেই। আজও বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের বলি হচ্ছে অসংখ্য নিরপরাধ নারী। বিবাহবিচ্ছেদের ফলে নারীই বেশি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। নারী তার মানবিক অধিকারগুলো থেকে আজও বঞ্চিত। তাহলে নারীমুক্তির আসল পথ কোনটি? নাকি নারী মুক্তির কোন পথই নেই? দৃশ্যত এখন নারীরা মুক্ত। এক কালের অবরোধবাসিনীগণ এখন বাইরের জগতে বিচরণ করছেন দুর্দান্ত দাপটে। এমন কোন পেশা আজকাল খুঁজেই পাওয়া যাবে না, যেখানে নারীরা নেই। তবু নারীবাদীরা নারীমুক্তির আন্দোলন করছে। এর কারণ দুটো। একটি হলো নারীদের এখনো মানসমুক্তি ঘটেনি। এর জন্য প্রধানত দায়ী নারীরাই। দ্বিতীয় কারণটি হলো পুরুষতন্ত্র এখনো নারীর ঘাড়ে চেপে আছে। পুরুষের চেয়ে পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য বিপদজনক।  
     রামমোহন-বিদ্যাসাগর বাঙালি নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। তৎকালে রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম নারীকে যে মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল সে মানবিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। এতে পুরুষাধিপত্য খর্ব হয়নি। নারী ঐ অধিকারটুকু পেয়ে পুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েছে। পুরুষের অনুগত হয়েছে আরও বেশি করে। নারী মনে করেছে প্রাপ্ত অধিকারটুকু পুরুষের দান। নারীর এ মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি খুব একটা। তাই নারী আজও তার অধিকার চায় পুরুষের কাছে। এতে পুরুষ হয় দাতা আর নারী হয় গ্রহীতা। পুরুষ ততটুকুই দিতে রাজি হয় যতটুকু দিলে তার আধিপত্য বজায় থাকে। এই বিষয়টি খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.)। তাই শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রোকেয়া নারীর মনস্তাত্তি¡ক জাগরণের কথা বলেছেন। এ জাগরণের মাধ্যমে নারী তার অধিকার চাইবে না; নারী নিজেই অধিকারী হবে। সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৮) তাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার চিত্র নয়; নারীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চিত্র। এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই পারে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ করতে। কিন্তু বেগম রোকেয়ার পর নারীর মানসিক জাগরণের কাজটি আর এগিয়ে যায়নি। নারী কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছে। হয়েছেও অনেকটা। কিন্তু আত্মজাগরণ বা মানসিক জাগরণ ঘটেনি। একটি ক্ষুদ্র অংশের মানসিক বিকাশ কিছুটা ঘটলেও মূলধারার নারী সমাজ আজও নিজেদেরকে মানসিকভাবে গুটিয়ে রেখেছে। এই গুটিয়ে থাকা নারীরাও এগিয়ে যাওয়া নারীদের আর এক প্রতিপক্ষ। পুরুষের সমান্তরালে নারীর এগিয়ে যাওয়াকে এখনো বাঁকা চোখে দেখে মানসিকভাবে অনগ্রসর এই বৃহৎ নারীসমাজ। তাই পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মই শুধু নয়; মানসিকভাবে অনগ্রসর নারীসমাজের একটি বৃহৎ অংশও নারীমুক্তির অন্তরায়।
     নারীর মিত্র কে? পুরুষ কখনো নারীর মিত্র নয়। পুরুষ নারীর মিত্র হতে চাইলেও পুরুষতন্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নারীর এগিয়ে যাওয়াকে ব্যক্তিপুরুষ সমর্থন করলেও পুরুষতন্ত্র তার সমর্থক হয় না কখনো। এই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা নারী প্রগতিকে ভেতর থেকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই নারীর মিত্র নারী নিজেই। নারীর শত্রুও নারী। যে নারী সমর্পিত হতে চায়, যে নারী পুরুষের সেবাদাসী হয়ে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সে নারীই পুরুষতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখে। নারীর এই সমর্পিত হওয়ার মানসিকতাই সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। নারীর এই সমর্পিত ভাবমূর্তিকে লালন করেছে পুরুষ যুগ যুগ ধরে। দীর্ঘদিনের এই লালিত ভাবমূর্তির পরিবর্তনের জন্য নারীর মানসজাগরণ জরুরি। জাগরণ ও ক্ষমতায়ন এক কথা নয়। জাগরণের সাথে মানসিক পরিবর্তনের একটা ইতিবাচক সম্পর্ক আছে। কিন্তু ক্ষমতায়নের সাথে থাকে এক ধরণের আধিপত্যবাদী মানসিকতা। তাই নারীর ক্ষমতায়ন নারী অধিকারের পক্ষে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু সমাধান নয়। নারীর ক্ষমতায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
     মেরি ওলস্টোনক্রাফট তাঁর A vindication of the rights of women গ্রন্থে নারীর সামাজিক ও মানসিক অধিকারগুলোর পক্ষে প্রথম সুসংবদ্ধ যুক্তিসঙ্গত মতামত উপস্থাপন করেন। কিন্তু নারী তাঁর অধিকারগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলে নারী আধিপত্য গ্রহণ করবে না। নারীর শরীরকাঠামো ও মানসকাঠামো এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এই বাধা অতিক্রম করা নারীর পক্ষে বিপদজনক। নারী এই বিপদজনক পথে পা বাড়াতে চায় না। পুরুষ চাইলেও না। এই সুযোগটাই পুরুষ ভোগ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। পুরুষ একদিকে নারীর বন্দনা করে। নারীকে দেবীর আসনে বসায়। অবশ্য পুরুষের কাছে নারীর বন্দনা মানে নারীর দেহবন্দনা, নারীর রূপবন্দনা। নারীর গুণের বন্দনা পারতপক্ষে করে না পুরুষ। এই দেবীরূপে বন্দনায় নারী মুগ্ধ হয়। বিনিময়ে পুরুষকে দেয় সেবা। এভাবে নারী নিজেই পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। পুরুষ সেবা গ্রহণ করে গর্বিত হয়। এই গৌরব ধরে রাখার জন্য নারীকে অনুগত রাখে। নারী অনুগত না হলে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম তার শাস্তি বিধান করে। 
     যুগে যুগে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে থেকেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম। রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম নারীকে দিয়েছে বিশেষ অধিকার। কিন্তু আধিপত্য দিয়েছে পুরুষের হাতে। পুরুষ নারীর অগ্রযাত্রাকে সমর্থন করে। কিন্তু নারীবাদী চেতনাকে প্রশ্রয় দেয় না। প্রকৃতপক্ষে বিরোধটা পুরুষ এবং নারীর নয়; বিরোধটা হলো পুরুষতন্ত্রের সাথে নারীবাদের। নারীবাদ একটি আধুনিক ধারণা। নারীবাদী চেতনা পুরুষতন্ত্রের একাধিপত্য খর্ব করতে চায়। তাই নারী নয়, নারীবাদী চেতনাই পুরুষতন্ত্রের প্রতিপক্ষ। আর এই প্রতিপক্ষ যতই প্রবল হতে চাচ্ছে পুরুষতন্ত্র ততই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ খুঁজতে হবে এখানে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে, শিক্ষা-সভ্যতায় অনেক এগিয়েছে বিশ্ব। রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মও অনেক মানবিক হয়েছে। যে কোন দুর্যোগে, যে কোন সংকটে এখন রাষ্ট্রের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়ায়, সমাজের পাশে সমাজ দাঁড়ায়, এমনকি ধর্মের পাশেও ধর্ম দাঁড়ায়। এই মানবিক বিশ্বটা নারীর পাশেও দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নারীবাদকে পুরুষতন্ত্রের সমউচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে না। নারীবাদ যেহেতু নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে তাই নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই।
     নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টিও গোলমেলে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এটাকে নারীর ক্ষমতায়ন বলা চলে না। সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে রাজনীতিতে নারীর প্রবেশাধিকার ঘটেছে। এটাকেও নারীর ক্ষমতায়ন বলা চলে না। প্রকৃতপক্ষে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটলে নারীর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হতো। নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি বলেই আজও নারীর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমানে নারী আরও বেশি নিরাপত্তাহীন। নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা সে কথাই প্রমাণ করে। আর এই সহিংসতা নারীবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতাও প্রমাণ করে। নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেই নারী নিরাপদ হবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বরং নারীবাদী চেতনা নারীকে আরও বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলতে পারে। নারীবাদ যদি পুরুষতন্ত্রের প্রবল প্রতিপক্ষ হয় তাহলে লড়াইটা হয়ে উঠবে আরও নির্মম। জীবন হয়ে উঠবে আরও বেশি নিরাপত্তাহীন। এ ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ- উভয়কেই শক্তিহীন করার মাধ্যমে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার একটি পথ বের করা যেতে পারে।
     শিক্ষা ও পদমর্যাদায় নারী আজ যতটা এগিয়েছে, নারীর যতটা আত্মজাগরণ ঘটেছে তাতে পুরুষতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেও ক্রমশ বের হয়ে আসছে রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম। এভাবে প্রগতিশীল মানবিক চেতনা বিকশিত হতে হতে একদিন পুরুষতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটবে। এই বিলুপ্তির পথে উগ্র নারীবাদ হতে পারে প্রধান বাধা। নারীবাদী চেতনা উগ্ররূপে দেখা দিলে তা পুরুষতন্ত্রকে উসকে দিবে। পুরুষতন্ত্রকে প্রতিপক্ষ করে নারীবাদী চেতনা প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো এই উভয় চেতনার বিনাশ সাধন করা। পুরুষ এগিয়ে যাবে পুরুষতান্ত্রিক চেতনাকে পরিহার করে। নারীও এগিয়ে যাবে নারীবাদী চেতনাকে পরিহার করে। তাহলেই শান্তিপূর্ণভাবে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে পুরুষতান্ত্রিক ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বদলে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। তাই পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদের দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য কোন আপোষ মীমাংসার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কোন আন্দোলন-সংগ্রামের। নারীর জন্য আলাদা আইনেরও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো এই দুটি চেতনার বিলুপ্তি ঘটানো। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য এভাবে দেখানো যায়-
পুরুষতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধি ও নারীবাদের শক্তিহ্রাস হলে অসমতা বাড়বে
পুরুষতন্ত্রের শক্তিহ্রাস ও নারীবাদের শক্তিবৃদ্ধি হলে অসমতা বাড়বে
পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ সমশক্তি অর্জন করলে দ্ব›দ্ব-সংঘাত বাড়বে 
পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ বিলুপ্ত হলে প্রকৃত সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
     পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ দুটোই মানবসমাজের জন্য ক্ষতিকর। পুরুষতন্ত্র বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বিলুপ্ত হলে একজন পুরুষ শুধু পুরুষ হওয়ার কারণেই নিজেকে সুপিরিয়র ভাবতে পারবে না। আর নারীবাদ বা নারীবাদী চেতনা বিলুপ্ত হলে একজন নারী শুধু নারী হওয়ার কারণেই নিজেকে পুরুষের প্রতিপক্ষ বা পুরুষের দ্বারা নিগৃহিত মনে করবে না। ব্যক্তিগত যোগ্যতার বিষয়টিই হবে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তখন সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য কোন আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না।

আলী রেজা
প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যচিন্তক
টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ।