আশার পাত্র – চিরঞ্জীব সরকার
আশা এমন একটি পাত্র যার কোন তলা নেই। এ আশা নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে আমৃত্যু। যতক্ষন পর্যন্ত আশার ক্ষীনধারা প্রবাহমান থাকে ততক্ষন পর্যন্ত মানুষ জীবন যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আশা ছেড়ে দেয়া মানে জীবিত অবস্থাতেই দ্বিতীয় মৃত্যুকে বরন করা। সে কারনে হয়ত বলা হয় যে বীরেরা একবারি মরে, দুবার নয়। বীরেরা কখনো আশা পরিত্যাগ করে না। জন্মের পর একটা শিশুর আশা নতুন নতুন খেলনার। তারপর সে যখন একটু বড় হয় তখন সে আশা করে একটা সাইকেল। সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে দক্ষ হয়ে সে যখন আরও একটু বড় হয় তখন তার চাই একটা মটরসাইকেল। মটরসাইকেল চালাতে চালাতে সে চিন্তা করে পিছনের সিটটা তো খালি। এখানে মনের মত একজন মানুষ বসলে এটা চালাতে কতই না রোমাঞ্চকর হত। সত্যিই একদিন এরকম মনের সাথীকে নিয়ে মটরসাইকেলে রাস্তা চষে বেড়াতে বেড়াতে সে খেয়াল করে রাস্তার চলমান গাড়ির পিছনের সিটের স্বামী-স্ত্রী নামক দুজন আরোহী কি সুন্দর করে কফির মগ হাতে নিয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। তারও মনে তখন আশা জাগে মনের সাথীর সাথে এবার ঘর বেধে চার চাকার শকটে চড়ে পঞ্চগরের চা বাগানে গিয়ে ইচ্ছেমত ঘুরবে, হারিয়ে যাবে আনমনে এবং দূর থেকে কাঞ্চনজংঘার শীর্ষে ভোরের প্রতিফলিত সূর্যকিরনের মায়াবী রূপ নয়ন ভরে দুজনে একসাথে দেখবে। ঘর তো বাধা হল কিন্তু ‘অপুত্রস্য গৃহম শূন্যম’-অর্থাৎ সন্তানহীন গৃহতো শূন্যতার দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নহে। এল সন্তান।তাকে বড় কর এবং এর সাথে নতুন আশা যুক্ত হল ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। দিনে দিনে সন্তান বড় হয়। সন্তানেরও নিজস্ব জগত তৈরী হয়। সেও মুক্ত আকাশে স্বাধীন পাখির মত ডানা মেলে উড়তে চায়। শুধু উড়তে চায় না,সে চায় ডানা মেলে হারিয়ে যেতে দিগন্তে। অতঃপর সে সন্তানও জীবনের নতুন সঙ্গী নিয়ে নতুন একটি গৃহ নির্মান করে। মা-বাবার পুরানো গৃহ তখন অনেকাংশেই সেকেলে হয়ে যায়। শুরু হয় স্বার্থের অনিবার্য সংঘাত। এখন সে আশা করে একদিন এ সংঘাত মিটে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হল ‘আমার না মিটিল সাধ, না পুরিল আশা’।
আশার আবর্তে জীবনের ঘূর্নিপাক। এ আশা বিচিত্র,বহুমুখী ও বর্নময়। কিন্তু জীবন সীমিত।সীমিত জীবনে এ অসীম আশাপূরন সম্ভবপর নহে। আর এটা ভালভাবে বুঝতে না পারার ফলেই আমরা কখনো কখনো হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হই। কখনো কখনো কেউ আত্মহত্যা করে বসে,কেউ কেউ পাগল হয়ে যায়। আশার ধর্ম হল একটা আশা পূর্ন হতেই নতুন আশার উদ্ভব হয়। সেটা পূরন হলে আবার নতুন আশার চারা গজিয়ে উঠে। এদিকে একটা দিন অতিবাহিত হওয়া মানে হল জীবনের পরমায়ু থেকে একটা দিন সবার অগোচরে মহাকালের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া। আমরা কিন্তু সেদিকে খেয়াল করি না। অথচ জীবনের ঘড়ি কিন্তু ঠিকই সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে। কথায় বলে চল্লিশ অতিক্রমে চোখে ঝাপসা দেখা শুরু হয়। সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে চশমা। খাবার চিবাতে গেলেও কেমন যেন কষ্ট হয়। চিবিয়ে হাড্ডি পাউডার করে ফেলা যে দাঁতের জন্য ছিল যৌবনে নস্যি, সে হাড্ডিই এখন উল্টো দাঁতকে ভেঙ্গে ফেলছে। চুলের আস্তরনেও আসে ভাটির টান। কালো কেশ আস্তে আস্তে সাদা হয়ে যায়। পেশীও ক্রমে ক্রমে দূর্বল হয়। দেহের এ পরিবর্তন আমাদেরকে মনে করে দেয় জীবনের বেলা অবেলার কথা। মধ্য বয়স মানে জীবনের দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলের দিকে এগিয়ে চলা। আয়ুকে যদি একটা ট্রাফিক সিগন্যালের সাথে তুলনা করা হয় তখন পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত মোটামুটি জীবনের সবুজ বাতি জ্বলে, চলতে তেমন একটা কোন বাধা নেই। যেমন খুশি তেমন চল। এরপর জীবনের হলুদ বাতি জ্বলে উঠে। মানে হল তুমি প্রস্তুতি নাও। সামনে লাল বাতিটি জ্বলে উঠবে। তখন তুমি আর এখানে চলতে পারবে না। এখানে উল্লেখ্য যে হলুদ বাতি কিন্তু বেশী সময় ধরে জ্বলতে থাকে না।
আগুনে ঘি ঢেলে যেমন আগুন নিভানো যায় না তেমনি আশা পূরনের মাধ্যমে আশার নিরন্তর প্রবাহ থামানো যায় না। কারন ফুটবল খেলার মত আমরা তো জীবনের মাঠে খেলতে পারব মাত্র নব্বই মিনিট যদি না এর মাঝে রেড কার্ড পেয়ে মাঠ থেকে মাঝপথে বের হয়ে আসতে না হয়। বলের পিছনে সব সময় ছুটলে ক্লান্ত হতে খুব একটা বেশী সময় লাগবে না। খেলার মাঠে প্রত্যেক খেলোয়ারের একটা নির্দিষ্ট পজিশন আছে। সে পজিশনকে ভিত্তি করে তাকে খেলতে হবে। তা না হলে সেটা খেলা না হয়ে হবে বিশৃঙ্খলা। হিগুইতা নামে কলম্বিয়ার একজন গোলরক্ষক ছিলেন। তিনি কারনে অকারনে গোলপোস্ট ছেড়ে মাঝমাঠে খেলতে আসতেন। বিশ্বকাপে এরকম করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ন খেলায় অনেকগুলি গোল হজম করে কলম্বিয়াকে বিদায় নিতে হয়। আমাদেরও তেমনি সাধ্য অনুযায়ী প্রায়োরিটি নির্ধারন করা জরুরী। কোনটা আসলেই আমাদের করা দরকার আর কোনটা দরকার নয়। অনেক সময় আমরা অন্যকে দেখে তাকে অনুসরন না করে অন্ধভাবে অনুকরনের চেষ্টা করি পরিনামের কথা না ভেবেই। শেষে অবলোকন করি আশার গুড়ে বালির মিশ্রন।
একবার একটা কাকের মনে দুঃখের উদ্রেক হল তার রূপ কেন এত কালো। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সে যখন নীল আকাশে উড়তে লাগল তখন সে দেখতে পেল নীচে সুন্দর একটা সরোবর এবং সেখানে একঝাক শ্বেতশুভ্র হংস জলকেলীতে মত্ত। কাকটি সরোবরের কাছে নেমে এসে একটি হংসকে কাছে পেয়ে তাকে বলল, আহারে তোমরা কত সুখী। কি সুন্দর তোমাদের শ্বেতবর্ন, তোমরাই সবচেয়ে ভাগ্যবান। হংস বলে না, আমাদের চেয়েও ভাগ্যবান টিয়ে পাখি। এ সরোবরের তীরে ওই যে গাছগুলো দেখছ, ওখানে ওরা মাঝেমাঝে ঝাঁকবেধে আসে। কি সুন্দর ওদের লাল ঠোট ও সবুজ পালক। ওদের সুখের কোন সীমা নেই। কাকটি কালবিলম্ব না করে সরোবরের নিকটের বৃক্ষরাজির দিকে ডানা উড়াল। সেখানে গিয়ে একটা টিয়েকে বলল পাখিকুলে তুমি কত ভাগ্যবান, কি সুন্দর তোমার রঙ্গীন ঠোট, কচি কলাপাতার মত তোমার গাত্রবর্ন। একথা শুনে টিয়েটি কাককে বলল, তুমি ঠিক বলছ না ভাই। এই যে কাছে একটা চিড়িয়াখানা আছে ওখানে গিয়ে বহুবর্নের মায়াবী ময়ূরকে দেখ। ওদের শরীরে রঙ্গের ঝলক বইছে। তুমি ময়ূরের রূপে বিমোহিত হতে বাধ্য। কাক তখন ময়ূর দর্শনে ব্যাকুল হয়ে উঠল। টিয়েকে ধন্যবাদ দিয়ে খুঁজতে লাগল নিকটস্থ চিড়িয়াখানা। এখানে এসে বিলম্ব না করে সরাসরি উপস্থিত হল খাঁচাবন্দী ময়ূরের কাছে। কাক ময়ূরের রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ময়র কাকমুখে নিজ বন্দনা শুনে শেষে বলল,হে বোকা বায়স, তোমার বুদ্ধি অপরিপক্ক, আমার এ রূপের জন্যই আজকে আমার এ বন্দীদশা। বন থেকে আমাকে ধরে এনে চিড়িয়াখানা নামক এ কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে লোকরঞ্জনের নিমিত্তে। তোমার রূপহীনতা তোমার জন্য আশীর্বাদ। কাকের দিব্যজ্ঞান হল। সে বুঝতে পারল নিজের যা আছে তার গুরুত্বের কথা,না জেনে অন্যের জিনিস প্রাপ্তির আশাতে ভয়াবহ বিপদের কথা।
তবে কি আশার পাত্র অপূর্নই থেকে যাবে। না, ছোট্ট একটি তলা বা ঢাকনা যদি জুড়ে দেয়া যায় আশা নামক এ পাত্রটির নীচে তাহলে এটি শুধু দ্রুত পূর্নই হবে না এটি তখন উথলে পড়বে যে আশা আমরা অন্যকে বিতরন করতে পারব অকাতরে। গ্রহীতা থেকে আমরা তখন হয়ে যাব দাতা। নেই নেই দর্শন থেকে আমরা বেড়িয়ে এসে অনুধাবন করতে সক্ষম হব জগত ও জীবন আমাদের কত কিছু দিয়েছে। জীবনের নদীকে চলতে দিতে হবে,তাহলেই সেটি সমুদ্রে মিশবে। হতাশায় যদি সেটা থামিয়ে দেই তবে সেটা নদীর চরিত্র হারিয়ে বদ্ধ জলাভূমিতে পরিনত হবে, আশ্রয়স্থল হবে মশা, মাছি, কীট-পতঙ্গদের যেটা থেকে ভয় শুধু দংশনের। আর জীবন নদীটা যদি সাবলীল থাকে তবে সেখানে থাকবে জোয়ার ভাটা, চাঁদ সওদাগর তখন বাহারী পণ্য নিয়ে তরী ভাসাতে পারবে অনেক বন্দরে, অনেক জনপদে মহা আনন্দে। বেহুলাও প্রান ফিরে পাবে এ আশায় লক্ষীন্দরকে নিয়ে ভাসবে নতুন এক ভেলায় প্রবাহমান এ জীবনের স্রোতধারায়।
চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
09-07-2021
-
-