অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
জীবন গাড়ির চাকাগুলি – চিরঞ্জীব সরকার

    কটি গাড়ি যেমন চারটি ব্যালাল্সড চাকায় ঘোরে জীবন গাড়ির চাকাও তেমনি ব্যালান্সড ওয়েতে সেট করে চালাতে হয়। তা না হলে গাড়ি যতই দামি হোক না কেন জার্নি কিন্তু সাবলিল হবে না। জীবনের এ চাকাগুলি হল প্রথমে ব্যাক্তি বা নিজের চাকা, দ্বিতীয় মা, বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, সন্তানদের নিয়ে পারিবারিক চাকা, তৃতীয় জীবিকার জন্য কর্মক্ষেত্রের চাকা এবং চতুর্থ হল সামাজিক চাকা। গাড়ির যেমন চারটি চাকাই সমান গুরুত্বপূর্ন তেমনি আমরা আমাদের জীবনের যাত্রাপথকে তখনই সাচ্ছন্দময় করতে পারব যদি আমরা নিজেকে, পরিবারকে, কাজকে ও আমাদের সমাজের প্রতি আমাদের যথাযথ দায়িত্বকে সমান গুরুত্ব দিয়ে জীবনের গাড়িটা চালানোর চেষ্টা করি। এক চাকায় বেশি হাওয়া বা কম হাওয়া যেমন গাড়ির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে তেমনি আমরা যদি উল্লেখিত চারটি জায়গার একটাতে মাত্রাতিরিক্ত প্রাধান্য বা অন্যটায় শৈথিল্য প্রদর্শন করি তাহলে কিন্তু জীবনের কোন একটা পর্যায়ে এসে এর জন্য অবশ্যই মাসুল গুনতে হবে।
     কিন্তু সমস্যা হল আমরা প্রায়শই জীবন চলার পথে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলে নিজেদের যাত্রাপথকে নিজেরাই বন্ধুর বা দূর্গম করে ফেলে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে এক অশান্ত জীবন যাপন করতে থাকি। যেখানে না আছে প্রকৃত শান্তি, না আছে এতটুকু স্বস্তি। প্রথমে যে ভুলটা করি সেটা হল নিজের চাকাটার দিকে খেয়াল না রাখা। আমি,আপনি পৃথিবীর প্রতিটা জীব ভিন্ন ভিন্ন স্বত্তা। এ পৃথিবীর সকলের ফিঙ্গার প্রিন্ট, আই রিফ্লেকশন,কন্ঠস্বর, গন্ধ আলাদা। আমাদের প্রত্যেকের কিছু ভাল লাগা না লাগার ব্যাপার থাকে। এ জনমানুষের ভিড়ে হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও নিজের জন্য প্রতিদিন একটু সময় বরাদ্দ রাখতে হবে। আমার গভিরে যে একান্ত আমি তাঁকে একটু সান্নিধ্য দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে আমি একা এসেছিলাম আবার একাই চলে যেতে হবে। তাই এ একান্ত আমিকে একটু ভালবাসতে হবে। তা না হলে আহত পাখির মত জীবনের গোধুলী বেলায় বা কোন এক বিশেষ ক্ষনে একদিন বেদনায় ছটফট করতে হবে।
     জীবনের দ্বিতীয় চাকা পরিবার। কর্পোরেট জগতের সদস্যরা কেরিয়ারের ওয়াইল্ড রেসে সামিল হয়ে চাকুরী জীবনে ল্যাডারের টপমোস্ট রাং-এ উঠে যখন তৃপ্তির ঠেকুর তুলবে তুলবে এমন একটা অবস্থা হয় তখন এদের অনেকেই আবিষ্কার করেন পরিবারের প্রিয় মানুষগুলি ইতোমধ্যে তাঁর থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কারন একটাই, সেটা হল সময়। কেরিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে উঠবার মানসে অধিকাংশ হাওয়া শুধু সেদিন জীবিকার চাকাটাতেই দেয়া হয়েছিল। আর সময় নামক সবচেয়ে মহামূল্যবান হাওয়া পরিবারের চাকাতে দেয়ার কার্পন্য থেকেই সেটি চুপসে গেছে কেরিয়ারের শীর্ষে উঠা এ সকল ব্যক্তিদের। সাফল্যের আনন্দ একান্তে শেয়ার করার মত পরিবারের তখন আর তেমন কেউ থাকে না। সময়কে তো আর ফিরিয়ে আনা যায় না। সময় থাকতে থাকতে যথাস্থানে সময়ের বরাদ্দ না রাখলে আখেরে পস্তাতেই হয়। এ সমস্যা শুধু কর্পোরেট জগতের নয়। এটি এখন সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত ও প্রকট।
     জীবন গাড়ির তৃতীয় চাকা হল আমাদের কর্মক্ষেত্র। কর্মজীবনের প্রতি অবহেলাও জীবনকে কঠিন করে তুলে। মনে রাখতে হবে আমাদের সেকেন্ড হোম আমাদের কর্মক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে কমিটমেন্টের অভাব কাংখিত নহে। কর্মই কর্মীকে ফল দান করে। হিসাব সহজ, ভাল কর্ম ভাল ফল দিবে, খারাপ কর্ম খারাপ ফল দিবে। বিভিন্ন বস বা সহকর্মী আসবে যাবে কর্মক্ষেত্রে সময়ের স্রোতধারায়। এটা নিয়ে বেশি চিন্তা না করে কিভাবে অর্পিত দায়িত্বটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায় সেদিকে মনোযোগ দিলে একটা ভাল ট্রাকরেকর্ড তৈরি হবে। তখন কাজ করতে গিয়ে কোন ভুল হলেও কর্তৃপক্ষ সেটা অবশ্যই বুঝবে যে ভুলটা ইচছাকৃত ছিল না।
     চতুর্থ চাকা হল আমাদের নিজস্ব বলয়ের বাইরের সমাজ। আজকে আপনি যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন তা কিন্তু আপনার একক প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হয়নি, এর পিছনে সন্মিলিত প্রয়াস ছিল। পরিবার আপনাকে স্নেহ, ভালবাসা, মমতায় বড় করেছে, সমাজ দিয়েছে সেবা, জীবিকা দিয়েছে জীবন চালানোর ইন্ধন।  তাই সবাকে নিয়েই জীবনের বৃত্ত পূর্ন করতে হয়।  কবির ভাষায়ঃ  “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”। সমাজকে সময় না দিলে আপনি আস্তে আস্তে অসামাজিক হয়ে যাবেন। আপনার বিপদে আপদে আপনার চারদিকের সমাজ কিন্তু সেদিন এগিয়ে আসবে না। আপনার তৈরি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আপনি বাস করতে পারেন তাতে আপাত সমস্যা নেই কিন্তু যেদিন দ্বীপের পৃষ্ঠে হ্যারিকেন বা সুনামি আঘাত করবে সেদিন কিন্তু সমাজ নামক মূল ভূখন্ডের উদ্ধারকর্মীরা আপনাকে উদ্ধার করতে আসবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
     জীবনের এ চারটি চাকার সুষম পরিচর্যার পরও আপনার রাইডিং স্মুথ হবে না যদি না আপনি গাড়ির ভিতরের স্টিয়ারিং হুইলটা ঠিক ভাবে না জানেন বা হ্যান্ডেল করতে না পারেন। এ স্টিয়ারিং হুইল হল স্পিরিচুয়ালিটি। জীবনের যাত্রাপথ কখনো কখনো মসৃন হলেও বেশির ভাগই অমসৃন,বন্ধুর। এটি আবার মাঝে মাঝে সুউচ্চ পাহাড়ের গা ঘেষে তৈরী।গতির একটু এদিক ওদিক হেরফের হলে গাড়িটা গড়িয়ে পড়বে গভির গিরিখাদে। স্পিরিচুয়ালিটি বলে দেয় কখন কোন গতিতে চলতে হবে, গন্তব্যের ঠিকানা। কখন ব্রেক কষতে হবে,সামনে কোন বাঁক আছে কিনা। অনন্তের যাত্রপথে পৃথিবী নামক হাইওয়েতে এটাই আসলে প্রকৃত ট্রাফিক গাইডবুক।

চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা