অনাবাদী মানবজমিন ও চিন্তাচাষীর মর্মপীড়া - আলী রেজা
মানুষকে অন্যন্য প্রাণি থেকে আলাদা করা হয় যে আবশ্যকীয় ও মৌলিক গুণটির কারণে সে গুণটি হলো বুদ্ধিবৃত্তি। বুদ্ধিবৃত্তির কল্যাণে মানুষ অন্যান্য প্রাণির ওপর প্রভাব বিস্তার করে আসছে সৃষ্টির শুরু থেকেই। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা মানেই জ্ঞানার্জন। গুণীজনের মতে, জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর। কিন্তু এই মহৎ কাজটি খুব কম মানুষই করে থাকেন। যাঁরা করেন তাঁরা মানবজাতির ইতিহাসে স্মরণীয় বরণীয় হন। তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিজীবনকে মানবজাতির কল্যাণে উৎসর্গ করেন। বিনিময়ে যা পান তাতে নিজের আত্মতুষ্টি ঘটে বটে। কিন্তু জীবন উপভোগ্য হয় না। জ্ঞানগুরু সক্রেটিসের ব্যক্তিজীবন সুখের ছিল না। জ্ঞানীরা ভোগবিলাসী নন এবং আত্মসুখের কথা চিন্তাও করেন না। মুর্খ ও আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিরা সুখ খুঁজে বেড়ান এবং নিজে সুখী হয়েই তুপ্ত হন। কারণ তারা অন্যের সুখ-সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করেন না। তারা নিজের জন্য অনেক কিছু করেন বলে অন্যের জন্য কিছু করতে পারেন না। সমাজে এ ধরণের ভোগবাদী ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। অন্যান্য প্রাণিরা ভোগবাদ না বুঝলেও ভোগ করাই তাদের একমাত্র কাজ। অবশ্য অন্যান্য প্রাণিদের ভোগ মানে খাদ্যগ্রহণ। খাদ্যগ্রহণ ও স্বাভাবিক যৌনক্রিয়া তথা জীববৃত্তি ছাড়া আর কোন চাহিদা নেই ওদের। কিন্তু মানুষের চাহিদার শেষ নেই। সবক্ষেত্রেই মানুষ ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। খাদ্যগ্রহণ, যৌনক্রিয়া, সম্পদ আহরণ- এ সবের একটি যৌক্তিক সীমা থাকলেও কেউ সীমাবদ্ধ থাকছে না। সবাই সীমা অতিক্রম করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। ধনার্জনের নেশায় মানুষ এখন সুচিন্তা ও সুপথ পরিত্যাগ করতেও কুণ্ঠিত নয়। কারণ ধনার্জন হলেই এখন সবকিছু অর্জিত হয়। পূঁজিবাদ মানুষকে এই অস্বাভাবিক শিক্ষাটা দিয়েছে। পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এটা খুব সহজ হিসাব। কিন্তু পুঁজিবাদ মানুষেকে যে শোষণের মন্ত্র শিখিয়েছে, কিছু মানুষকে যে সর্বগ্রাসী দৈত্যে পরিণত করেছে সে হিসাবটিও বুঝে নিতে হবে। সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রগতিশীল সমাজ প্রয়োজন।
বর্তমান সমাজ কতটা জ্ঞানভিত্তিক আর কতটা অর্থ ও পেশিশক্তিভিত্তিক সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি ভাবনার প্রয়োজন পড়ে না। চোখ-কান খুললেই দেখা যায় বোধবুদ্ধিহীনদের দৌরাত্ম, মূর্খদের আস্ফালন। কবি জীবনানন্দ দাশ এ কারণেই হয়তো বলেছিলেন- ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ / যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা/ যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই / পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ যে কালে জীবনানন্দ দাশ কথাটি বলেছিলেন সে কালের তুলনায় আজকের অবস্থা আরো খারাপ। এখন নেতৃত্ব চলে গেছে মূর্খদের দখলে। মূর্খ বলতে শুধু অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তি বোঝায় না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ বা ডিগ্রি নেওয়া ব্যক্তিও মূর্খ হতে পারে। অন্তরে সুচিন্তার চর্চা না থাকলে যে কেউ মূর্খ বলে গণ্য হতে পারে। সেকালে মূর্খরা জ্ঞানীদের কাছে যেতো। আজকাল জ্ঞানীরা মূর্খদের পেছনে ঘোরে। কারণ মূর্খের হাতে চলে গেছে শাসনক্ষমতা। মূর্খের শাসন বড় ভয়ানক। এ শাসনে পেশিশক্তি কাজে লাগে। পেশিশক্তি লালন করার জন্য এবং তা টেকসই করার জন্য প্রয়োজন পড়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ফলে জ্ঞানচর্চা নয়, ছুটতে হয় অর্থের পেছনে। প্রকৃত জ্ঞানীরা এখন একাকিত্বে ভুগছেন। মূলধারায় চলে আসছে খারাপ লোকেরা। মূর্খেরা সংঘবদ্ধ। আর ভালো মানুষেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। আলোকিতজন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই পরিস্থিতি নিয়ে একটি সরস মন্তব্য করেছেন- ‘আজকাল আমাদের দেশে দেখবেন ভালো মানুষেরা বিচ্ছিন্ন। ভালো মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ নেই। তারা একা, পরস্পরকে খুঁজে পান না। কিন্তু যারা খারাপ, তারা খুবই সংঘবদ্ধ। এক শয়তান হুক্কাহুয়া দিলে মুহূর্তে হাজার শয়তান ক্যায়া হুয়া! ক্যায়া হুয়া! করতে করতে এগিয়ে আসে।’ মন্তব্যটি বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্রকেই উপস্থাপন করে। এ যুগে যাঁরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সমৃদ্ধ না করে স্বরস্বতীর ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে ব্যস্ত আমজনতা তাদেরকে ভুল পথের পথিক বলেই মনে করে। বিষয়টি নিয়ে ভাবনা নতুন নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর গীতিকবি রামপ্রসাদ সেন তাঁর কালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘মন রে কৃষি কাজ জানো না/ এমন মানব জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলতো সোনা।’ বোঝা যায়, তখনও মানবজমিন আবাদ করার লোক খুব বেশি ছিল না। এখন নেই বললেই চলে। তবু যাঁরা চিন্তাচর্চার মাধ্যমে মানবজমিন আবাদ করেন; তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য কোথায়? চিন্তাচাষীরা এখন মূল্যহীন। সবাই মানবজমিন অনাবাদি রেখে দিয়েছে। কোথায়ও প্রয়োজন পড়ে না চিন্তাচাষীদের সোনার ফসল। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- সবকিছুই চলছে মহৎচিন্তাকে বাইপাস করে। পরিবারের যে সদস্যটি অঢেল অর্থ উপার্জন করে তার পেছনে বাকি সদস্যরা ঘুর ঘুর করে। তার সিদ্ধান্ত মেনে নেয় অন্যেরা। আর যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা খরচ করার সাধ্য নেই; সে চিন্তায়, বুদ্ধি-বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ হলেও ক্ষমতায় ক্ষুদ্র। একই চিত্র সমাজ ও রাষ্ট্রেও বিরাজমান। বর্তমানে যারা সমাজ পরিচালনা করছে তাদের আছে অঢেল অর্থ আর পেশিশক্তি। শুধু অর্থ থাকলেই চলে। কারণ অর্থ থাকলেই পেশিশক্তি এসে যুক্ত হয়। অর্থ আর পেশিশক্তির যৌথ দাপটে জ্ঞানীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
অর্থ ও পেশিশক্তির অধিকারীরা সমাজপতি হয়। সমাজপতিরাই জনপ্রতিনিধি হয়। তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে যায়। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব মানেই ক্ষমতা হাতে পাওয়া। এই ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চায় না কেউ। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে অর্থ ও পেশিশক্তির। এটাও একটা দুষ্টচক্র। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য অর্থ ও পেশিশক্তি, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থ ও পেশিশক্তি, ক্ষমতা হাতছাড়া হলে সেটা ফিরে পাওয়ার জন্যও অর্থ ও পেশিশক্তি। এই দুষ্টচক্রে সুচিন্তা বা জ্ঞানের কোন ভূমিকা নেই। তাই মহৎ জ্ঞানের অধিকারীগণ এখন ক্ষমতার নাগাল পান না কিংবা স্বেচ্ছায় ক্ষমতার দুষ্টচক্র থেকে দূরে থাকেন। ক্ষমতার রাজনীতি এখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য যারা নির্বাচিত হয়ে আসেন তাদের এক শতাংশও শিক্ষাবিদ নন। কলেজের গভর্নিং বডি বা পরিচালনা পর্ষদে এমন অনেক ব্যক্তিকে দেখা যায় যারা কলেজ পর্যায়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে যারা আসেন তারা বেশিরভাগই ধর্মপ্রাণ নন। কিছু ধর্মান্ধ লোকও আসেন। এরা সব সময় রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে প্রভাব বিস্তার করে চলেন। প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ (প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, ইমাম) যেহেতু চাকরিজীবী তাই কমিটির লেজুড়বৃত্তি করেন চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য। কারণ চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য এখন যোগ্যতার চেয়ে লেজুড়বৃত্তির প্রয়োজন বেশি। চাকরি পাওয়ার জন্যও লেজুড়বৃত্তি করতে হয়। যাঁরা পারেন না তাঁরা পিছিয়ে পড়েন। যারা পারেন তারা এগিয়ে যান। অবশ্য জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই এগিয়ে যাওয়া প্রকৃত এগিয়ে যাওয়া নয়। বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একাধিকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বলতেন, ভিসি হওয়ার জন্য যতটা নিচে নামতে হয় ততটা নিচে নামার যোগ্যতা আমার নেই। অবশ্য এটা এ যুগের চিত্র। এককালে সুযোগ্যরাই প্রতিষ্ঠান প্রধান হতেন। অযোগ্যরা ওসব পদে যাওয়ার চেষ্টাও করতো না। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মহৎচিন্তার চর্চা হতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খ্যাতিমান পরমাণুবিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালামের একটি কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, ‘যোগতার চেয়ে বেশি কিছু পেয়ে গেলে মানুষের ব্যবহার পশুর মতো হয়ে যায়।’ আর পশুরা সব সময় পেশিশক্তি ব্যবহার করে। কারণ তাদের জ্ঞানশক্তি নেই । তারা মহৎচিন্তা করতে পারে না।
মহৎচিন্তার চর্চা ছাড়া মানবজমিন আগাছায় পূর্ণ হয়ে যায়। একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণে মহৎচিন্তার ভূমিকাই প্রধান। মহৎচিন্তা থেকেই জগতের সব মহৎ কাজের জন্ম হয়েছে। চিন্তার ভেতরে সততা না থাকলে সেই চিন্তাপ্রসূত কাজ কখনো মানবসমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। তাই সুচিন্তা বা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের কথা বলেন গুণিজনেরা। কিন্তু বিষয়সচেতন মানুষের নেই গুণিজনের কথা শোনার মানসিকতা। কারণ ঐ সময়টুকু অর্থের পেছনে ছুটলে কিছু অর্থযোগ ঘটতে পারে। জ্ঞান নয়, অর্থই এখন জীবন ধারণের মূল নিয়ামক শক্তি। সবাই অর্থ চায় । জ্ঞান না হলেও দিব্যি চলে। কিন্তু অর্থ না হলে একমুহূর্তও চলে না। তাই জ্ঞানীগণ মর্মপীড়ায় ভোগেন। চিন্তার চাষ যারা করেন তাঁদের অন্বিষ্ট হলো মানবকল্যাণ। মানবকল্যাণে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ নিজেকে নিয়ে বিব্রত থাকতে পারেন না। ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী ’পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’- কবি কামিনী রায়ের এই মহৎ বাণী মুখে যতটা উচ্চারিত হয়, ব্যবহারিক জীবনে ততটা প্রয়োগ হয় না। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ ও সাংগঠনিক তৎপরতা অনেক বেড়েছে। অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠছে। সংগঠনগুলোর মূল উদ্দেশ্য সংগঠিত থাকা ও সামাজিক কাজ করা। কিন্তু প্রদর্শনবাদিতার নির্লজ্জ মানসিকতার কারণে সংগঠনগুলো আত্মিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে গেছে। কানেক্টিভিটি বেড়েছে, কিন্তু সহমর্মিতা বাড়েনি। কাছের মানুষগুলোও এখন মনের দিক দিয়ে অনেক দূরের হয়ে গেছে। সবাই আত্মস্বার্থ রক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। কেউ অন্যের স্বার্থের দিকে তাকায় না। কারো প্রতি সহমর্মিতা ও বিপদে পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখন অনেকটা লোকদেখানো বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
পুঁজিবাদ মানুষকে এই শিক্ষাটা দিয়েছে নিখুঁতভাবে। ধনতান্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় ধনার্জন মানুষের প্রধান লক্ষ্য। টাকা দিয়ে টাকা উপার্জনের নানা কৌশল শিখেছে মানুষ ধনতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে। ধনতান্ত্রিক মানসিকতাকে ব্যক্তিচিন্তায় বদ্ধমূল করে দিয়েছে পুঁজিবাদ। ছোটবেলায় দেখেছি বিপদ-আপদে টাকা ধার দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এখন পারতপক্ষে কেউ কাউকে টাকা ধার দেয় না। অনেকক্ষেত্রে ধারের টাকা ফেরত পাওয়াও মুশকিল হয়ে পড়ে। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার ফলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমি আমার জন্য সবকিছু করবো। অন্যের কী হলো সেটা দেখার দায়িত্ব আমার নয়- এই মানসিকতা এতোটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, ক্ষুদ্র স্বার্থে এক ভাই আর এক ভাইকে খুন করছে। এককালে ভাইয়ের জন্য ভাই জীবন দিতো। মহৎচিন্তা বা সুচিন্তার অভাবেই এই সামাজিক পরিবর্তন বা সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। উত্তরণের জন্য প্রয়োজন চিন্তার পরিবর্তন। চিন্তার প্রসারণও জরুরি। সংকীর্ণ চিন্তা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক ও অমানবিক করে তোলে। মহৎচিন্তা মানুষকে মানবিক করে। কিন্তু মহৎচিন্তা সব সময় ধনার্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক হয় না। মহৎচিন্তা কখনো পেশিশক্তি ব্যবহারের পক্ষপাতী নয়। মহৎচিন্তার জন্য যে ধীশক্তির প্রয়োজন সে ধীশক্তির অর্জন করার বৌদ্ধিক সামর্থ নেই বেশিরভাগ মানুষের। যাদের আছে তারাও অনেকটা নিক্রিয়। কারণ সক্রিয় হলে সঙ্গীহীন হয়ে যান তারা। নেহাত বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় কেউ সঙ্গ দিতে আসেন না। চিন্তাচাষীর মর্মপীড়া এখানেই। নিজে নিজে মানবজমিনে চিন্তার চাষ করা যায়। কিন্তু সেই চিন্তার ফসল যদি মূল্যহীন হয় সেটা চিন্তাচাষীর জন্য পীড়াদায়ক।
চিন্তাচাষের একটি বড় ক্ষেত্র হলো সাহিত্য। কবি-সাহিত্যিকগণ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁদের চিন্তাকে প্রকাশ করেন। সাহিত্য একদিকে জীবনের প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নানা সঙ্গতি-অসঙ্গতিও প্রতিফলিত হয় সাহিত্যে। কিন্তু সাহিত্যচর্চার এই মহৎ কাজটি যাঁরা করেন বর্তমান সমাজে তাঁদের কদর কম। একজন দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারী, মজুদদার, ঘুষখোর, রাষ্ট্রের টাকা লোপাটকারী কিংবা পাচারকারী চিহ্নিত অপরাধী হলেও শুধু অর্থ ও ক্ষমতার জোরে সামাজিক সম্মান ও উচ্চাসন দখল করে নেয়। কিন্তু একজন কবি-সাহিত্যিক ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তবতা এবং চলমান সংকট তুলে ধরেন। পরিবেশ-প্রতিবেশের নান্দনিক সৌন্দর্য উপস্থাপন করেন। কিন্তু বিষয়সচেতন মানুষ এসবকে কাজ হিসেবেই মনে করেন না। তাই এখন সাহিত্যকর্মের তেমন কোন আর্থিক মূল্য নেই। অতীতেও ছিল না। তবে অতীতে রাজদরবার থেকে বটতলা পর্যন্ত কবি-লেখকগণ যে সম্মান পেতেন তাতে সম্মানী না পাওয়ার আক্ষেপ ঘুচে যেতো। কবি-সাহিত্যিকগণের সম্মান কমে যাওয়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ শিরোনামের একটি লেখায় [লেখাটি রবীন্দ্রনাথ ৭০তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবে সেনেট হলে পাঠ করেন] বলেছেন, ‘তখন দিনও এমন ছিল, ছড়া যারা বানাতে পারত তাদের দেখে লোক বিস্মিত হত। এখন যারা না পারে তারাই অসাধারণ বলে গণ্য।’ শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি যথার্থ বলেই মনে হয়। প্রায় একশ বছর আগের এই কথাটি এখন আরো অনেক বেশি সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন সাহিত্যচর্চাকে কোন কাজ হিসেবেই মনে করেন না সাধারণ মানুষ। মানুষ এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফল ভোগ করার জন্য অতিশয় ব্যস্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে এতোটাই আয়েশী ও আত্মকেন্দ্রিক জীবন উপহার দিয়েছে যে, মানুষের জীবনে এখন আর মানুষের প্রয়োজন খুব বেশি নেই। মানবজীবনে ডিভাইস এখন অত্যন্ত মূল্যবান। মানুষ ক্রমশ মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ডিভাইসে ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে মানুষ এখন নেট-দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে কোনো মানুষের সঙ্গ প্রয়োজন পড়ে না। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ মানুষকে অমানবিক করে তুলেছে।
বর্তমান বিশ্বে মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রচার ও প্রসার এ কথাই প্রমাণ করে যে, বিশ্ব খুব বেশি অমানবিক হয়ে উঠেছে। এই অমানবিকতা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন বৌদ্ধিক উন্নয়ন। বস্তুগত উন্নয়ন অনেক হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। কারণ মানুষ বস্তুগত উন্নয়নের পেছনে সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। কিন্তু বস্তুগত উন্নয়নের সমান্তরালে বৌদ্ধিক উন্নয়ন না হলে মানবসমাজে শান্তি আসবে না। বৌদ্ধিক উন্নয়ন মানে মানবতাবোধের উন্নয়ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবতাবোধের উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। মানবতাবোধের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মহৎচিন্তার চর্চা। মহৎচিন্তার দ্বারাই মানবজমিন ফুলে-ফসলে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। মানবতাবোধের উন্নয়ন হলেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়। অন্যথায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবী দেখেছে বিজ্ঞান কীভাবে মানবজাতির ধ্বংস ঘটাতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানবতাবোধের বিকাশ। এই মানবতাবোধের বিকাশ ঘটে মানবিক শিক্ষার মাধ্যমে। সৃজনশীল সাহিত্য, শিল্পকলা, সংগীত ও নীতিশিক্ষার পাঠ মানবতাবোধ বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলে ভেতর থেকে। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জীবনকে সুন্দর করে বাইরে থেকে। ভেতরটা সমৃদ্ধ ও সুন্দর না হলে বাইরের সৌন্দর্য টেকসই হয় না। মহৎচিন্তার প্রয়োগ না ঘটায় বর্তমান সময়ে বস্তুগত উন্নয়ন খুব কমই টেকসই হচ্ছে। তবু মহৎচিন্তার কদর বাড়ছে না। চিন্তাচাষীর মর্মপীড়া উপলব্ধি করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ অনেক আগেই। এই মহৎ কবিও বেঁচে থাকতে পাননি যথাযোগ্য সম্মান। অথচ কবির হৃদয়ে ছিল প্রেম-প্রীতি, করুণা ও মানুষের প্রতি গভীর আস্থা। তিনি হৃদয়হীন মানুষের আধিপত্য আর হৃদয়বান মানুষের হাহাকার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এ অবস্থা কবির কাছে যেন ‘অদ্ভুত আঁধার’। এই আঁধারে চিন্তাচাষীরা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য হয়েই বেঁচে থাকেন। কবির উপলব্ধি এ রকম-
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। [জীবনানন্দ দাশ: অদ্ভুত আঁধার এক]
আলী রেজা। প্রাবন্ধিক, সাহিত্যচিন্তক। টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
22-07-2021
-
-