অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
বেলা সাঁঝের পাণ্ডুলিপি (চার) - দীপিকা ঘোষ

জীবনভর গড়ে তোলা অভ্যাস অনেকের পক্ষেই সহজে বদলে ফেলা সম্ভব হয় না।  কারণ অভ্যাসগুলো একদিন স্বভাবের অন্তর্গত হয়ে পড়ে।  জগদীশ ডি’কোস্তার জীবনেও বহুকালের তৈরি করা অভ্যাস চরিত্রের গভীরতায় এতটাই অন্তরঙ্গ হয়ে গিয়েছিল যে তা বদলে ফেলার প্রয়োজনের কথা কখনো মনেই হয়নি তাঁর।  অবশ্য অভ্যাস বদলে না ফেলার শারিরীক কারণও জগদীশের রয়েছে।  তিনি ডায়াবেটিসের রোগী।  সুতরাং এখনো রোজ ভোরসকালে বিছানা ছেড়ে যাবতীয় কাজ সেরে আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সারেন।  দুপুর একটায় লাঞ্চ।  রাত ন’টায় ডিনারের অভ্যাসও একইভাবে চলছে জীবনে।  আসলে পরিবার সেভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলেই কখনো বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।  কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হলো।  ব্রেকফাস্ট খেতে এসে দেখলেন, টেবিলে খাবার রাখা হয়নি।   বিরক্ত হলেও কাউকে ডেকে প্রশ্ন না করে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন জগদীশ।  কারণ সংসারে কারও ওপরেই জোর করার অধিকার যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত নেই, সে কথা ছোট ভাইয়ের স্ত্রীদের মুখে বারবার শুনে মানঅভিমানের ব্যাপারে তিনি অনেককাল হলো সচেতন হয়েছেন।    
     জগদীশ নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে সেদিনের সংবাদপত্রখানা আপাদমস্তক পাঠ করলেন।  অপেক্ষার মুহূর্ত দীর্ঘ হতে হতে সকাল সাড়ে ন’টা অতিক্রম করলো।  এবার তিনি ঘর ছেড়ে বেরোলেন।  অনুচ্চ গলায় ডাকলেন –
মৃণাল, বেকফাস্ট তৈরি হতে আজ কি দেরি হবে?
     কারুর সাড়া না পেয়ে এবার কণ্ঠস্বর উঁচুতে তুলতে পাশের ঘর থেকে বিরক্ত হয়ে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী শর্মিলা বেরিয়ে এলো।  সে একটি মেয়ে কলেজের অধ্যাপিকা।  দু’হাত কাঁধের কাছে রেখে আলস্য ভাঙতে ভাঙতে বললো –
আপনি এখন রিটায়ার্ড ম্যান বড়দা! এমন তো নয় যে সাতসকালে খেয়েদেয়ে আমাদের মতো অফিস যেতে হবে! এক আধদিন না হয় একটু দেরি হলোই! এত তাড়া কিসের? যাই হোক, আপনি হাঁটতে বেরিয়েছিলেন তাই জানেন না! মৃণালদি, কোথায় কী একটা দরকারে বেরিয়েছে! যাবার আগে জানিয়ে গেছে! তাকে বলেছিলাম, পরে যেতে! কী একটা বললো যেন, শুনিনি ভালো করে! আজ ছুটির দিন! ভাবছিলাম, ভালো করে ঘুমিয়ে দেরিতে উঠবো! কিন্তু তার তো আর …!বলতে বলতে শর্মিলা গ্লাশে জল ঢেলে রান্নাঘরের দিকে যেতেই 
জগদীশ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন –
তুমি কি এখন ব্রেকফাস্ট বানাতে যাচ্ছো নাকি?
     না না!  সেসব মৃণালদি করে রেখে গেছে! এ তো তারই কাজ! আসলে ছুটির দিন বলেই...! রোজ কাজে যেতে হয়! সপ্তাহে একটা  দিনই তো বিশ্রামের ব্যাপার! 
     জগদীশ কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে টেবিলে এসে বসলেন। বুঝলেন, একটা সকাল মৃণাল বাড়ির বাইরে থাকায় প্রথমবারেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে।  আরও বুঝলেন, সবকিছু গুছিয়ে রেখে শর্মিলাকে যাওয়ার আগে পরিবেশনের দায়িত্বটুকুই শুধু দিয়ে গিয়েছিলেন মৃণাল, তার বেশি কিছু নয়! মৃণাল তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের স্ত্রী। অল্প লেখাপড়া জানা গাঁয়ের মেয়ে।  বিয়ের পরে সংসারের মামুলি কাজ ছাড়া আর কিছুই শেখা হয়নি।  তার স্বামীও তারই মতো। আয়রোজগার বলতে ছিল কিছু মাঠান জমি। কিন্তু তার অকাল মৃত্যু হতে শ্বশুরবাড়ির নিজের সংসার থেকে ভেসে গিয়েছিলেন মৃণাল।  জগদীশ সেদিন বাড়িতে এনে পঁচিশ বছরের তরুণী ভ্রাতৃবধূকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।  সঙ্গে তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে।  তাঁর এই সিদ্ধান্ত সংসারের সবাই মেনে নেয়নি।  যদিও মৃণাল সপরিবারে এদের সংসারেই আশ্রয় পেয়েছিলেন যদযাবতীয় খাটাখাটনির দায়িত্ব বহন করে।  তবে জগদীশ যে সেদিন ভাশুর হয়ে নয়, নিজের দাদার মতেই সম্পূর্ণ দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছেন, সেটা উপলব্ধি করার বিবেচনাবোধ অসহায় তরুণীর ছিল।  সেই থেকে মৃণাল একটা দিনের জন্যও জগদীশের অটুট স্নেহ এবং বিরাট ত্যাগকে কখনো বিস্মৃত হননি।  মেয়ের বিয়ে হয়েছে।  দুই ছেলে পড়াশুনো শেষে চাকরি পেয়ে বিয়ের পরে পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে।  কিন্তু দাদাকে ছেড়ে মৃণাল একটা দিনও অন্যকোথাও গিয়ে থাকেননি।  কোনোদিন অবহেলা দিয়ে আঘাত করেননি তাঁকে।  যেটা সহোদর ভাইদের পরিবার থেকে জগদীশকে নিয়মিত পেতে হয়। 
     দশটার পরেই ফিরে এলেন মৃণাল।  এসে দাদাকে তখনও খেতে দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই শর্মিলা বললো –
তুমি যেমন বলে গিয়েছিলে, আমি সেভাবেই সব দিয়েছি। 
     মৃণাল সে কথার উত্তর না দিয়ে দাদার মুখে তাকালেন।  তাঁর মুখ ম্লান।  মুখের ওপর অভিমান আর বেদনার আভাস স্পষ্ট হয়ে গাম্ভীর্য দিয়েছে।  জগদীশ অবশ্য চোখ তুলে তাকালেন না।  মৃণাল বুঝলেন তার স্নেহময় দাদা বড় আঘাত হজম করেই নীরব হয়ে রয়েছেন।  নইলে তার অনুপস্থিতির কারণ নিয়ে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করতেন –
মৃণাল, সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? কোথায় গিয়েছিলে সাতসকালে?
     মৃণাল হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন।  চকিতে দৃষ্টি ফেললেন জগদীশের মুখে।  শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলেন - খেতে এত দেরি করলেন যে?
     দাদাকে নিরুত্তর দেখে একটু থেমে থেকে ফের বললেন –
আসলে খুব জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছিলাম! আপনার খাবার টেবিলে দিতে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনি কলিংবেল বাজছে।  খুলতেই দেখি ভুবন।  বললো, ও বাড়িতে পশশু আপনার মেয়ের শাশুড়ি এসেছেন মাসিমা! খুব অসুস্থ! ঠিকমতো চলতে ফিরতে পারেন না! আজই সকাল ন’টার গাড়িতে চলে যাচ্ছেন।  মউবৌদিমণি একটু আগেই ফোন করে বললো, ভুবনদা মাকে এক্ষুনি নিয়ে এসে আমার শাশুড়িমায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও! আমি আর দেরি করতে পারিনি! কোনোমতে কাপড়খানা পাল্টেই…!
     এতক্ষণে জগদীশ মুখ তুললেন –
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি অসুস্থ দেহে চলে যাওয়ার কারণ?
     ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন দাদা! ওঁদের ওখানে কয়েকজনকে দেখিয়ে কোনো কাজ হয়নি! চেহারা ভীষণ ভেঙে গিয়েছে! চেনাই যায় না!
     কী আশ্চর্য! মউয়ের তো আসার আগেই উচিৎ ছিল ফোন করে জানানো! ব্যাপারটা কী রকম হলো? একবার দেখা পর্যন্ত হলো না! ওর কি আর কোনোকালে বুদ্ধিবিবেচনা হবে না?
     আর হয়েছে! আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতাম! কিন্তু ন’টার সময় গাড়ি আসবে! তাই আর অপেক্ষা করতে পারিনি!
     নাঃ, ঠিকই করেছো! আমার নিজেরই খারাপ লাগছে! এতটা অসুস্থতা নিয়ে মেয়ের বাড়িতে দুদিন রইলেন! অথচ আমরা কেউ…! মাত্রই তো দু’ আড়াই মাইলের পথ! কিন্তু শরীর খারাপ কেন? কী হয়েছে?
     ফুসফুসের ক্যান্সার! খুব ভয় পেয়েছেন! আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিলেন! আহা! কী ই বা বয়স! পঞ্চান্ন হয়েছে শুনলাম! আমাদের মউই তো ওঁর বড় ছেলের বউ!
     তুমি বেয়ানকে বলেছো, আমরা কিছু জানতাম না?
     হ্যাঁ দাদা! তখনই বললেন, সবারই মন খারাপ! তাই মউ আর আপনাদের জানাতে চায়নি দিদি!
     জগদীশ বাকী খাবার না খেয়েই উঠে পড়লেন।  মৃণাল এবার ব্যাকুল হলেন –
     সবই তো পড়ে রইলো দাদা! বেশি দেরি হয়ে গেল বলে কি …!
     না না ঠিক আছে।  দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি না হয় খেয়ে নেব! আমি একজনকে ফোন করতে যাচ্ছি! এক ছাত্রের সংগে যোগাযোগ করতে হবে! দেখি পাই কিনা! ও ক্যান্সার স্পেশালিস্ট! খুব ভালো সার্জনও!
     সেসব করে বোধহয় আর লাভ নেই দাদা!
     কেন?
     মউয়ের ননদ দোদুলের সঙ্গে কথা হলো।  সেও তার মায়ের সঙ্গে গেলো।  বললো – মাকে বলিনি মাসিমা! ডাক্তার বলে দিয়েছেন, খুব বড় জোর দু’তিন সপ্তাহ টিকতে পারেন! এখন ট্রিটমেন্ট নিয়ে চাপাচাপি করতে গেলে কষ্টটাই বাড়বে! লাভ কিছু হবে না! শেষ কটা দিন আমি তাই মায়ের সঙ্গেই থাকবো!
     তাহলে চলো, আমরাও যাই! মউদের বাড়ি গিয়ে বেয়ানকে দেখে আসি!
     যাবেন দাদা? তাহলে বড় ভালো হয়! মৃণাল গভীর কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকাতেই তার দু’চোখ জলে ভরে উঠলো।
     জগদীশ চেয়ার ছেড়ে উঠতে-উঠতে বললেন –
সামনের সপ্তাহেই চলো তাহলে! বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়তো …!
     মৃণাল কথা না বাড়িয়ে টেবিল পরিষ্কার করে তাড়াতাড়ি রান্নার কাজে ব্যস্ত হচ্ছিলেন।  সকালে ঠিকমতো জগদীশের খাওয়া হয়নি। অন্তত দুপুরবেলা যাতে নিয়মের ব্যতিক্রম না হয়, সেটা মাথায় রেখে দ্রুত গুছিয়ে নিচ্ছিলেন সবকিছু!  হঠাৎ শর্মিলা নিজের ঘর থেকে একগাদা জামাকাপড় বাথরুমের সামনে ফেলে দিয়ে ক্ষোভ নিয়ে বললো –
সামনের সপ্তায় তোমরা কি কোথাও যাওয়ার কথা বলছিলে মৃণালদি?
     হ্যাঁ ভাই! মউদের বাড়িতে!
     হঠাৎ সেখানে কেন?
     বেয়ান খুব অসুস্থ! ডাক্তার জবাব দিয়েছেন! দাদা তাই বললেন,  আমাদের একবার দেখতে যাওয়া উচিৎ!
     কিন্তু উচিৎ বললেই তো আর সবার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় মৃণালদি! সামনের সপ্তাহ থেকে আমার কলেজে পরীক্ষা শুরু হচ্ছে! আমার ছেলেমেয়েদেরও বিস্তর পড়াশুনোর চাপ!
     না না তোমাদের যেতে হবে না ভাই! আমি আর দাদা গিয়ে …!
     হ্যাঁ, সেই ভালো! তবে যাবার আগে নিজের সব কাজগুলো করে যেতে ভুলো না যেন! কদিন থাকবে?
     থাকবো না!  সেখানে তো আর আনন্দ করতে যাওয়া নয়!
     জানি! কর্তব্য করতে যাওয়া! যাই হোক, রান্নার আগে এইসব জামাকাপড়গুলো সাবানকাচা করে আগে তাড়াতাড়ি শুকোতে দাও! দেরি হয়ে গেলে শুকোতে চাইবে না! দুর্গন্ধ ছড়াবে!
     রান্নাটা আগে সেরে নিই! দাদার আজ সকালে খাওয়া হয়নি তো! তাই একটু তাড়াতাড়ি খাবেন আজ! আমি এগুলো এক ঘন্টার মধ্যেই কেচে দেবো! ঠিক শুকিয়ে যাবে!
     কথা না বাড়িয়ে মৃণাল গরম কড়াইতে মাছ ঢেলে দিচ্ছিলেন।  শর্মিলা সহসা ঝাঁঝালো গলায় উত্তেজনা ছড়ালো –
তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি মৃণালদি! এক আধদিন নিয়মের ব্যতিক্রম হলে কী এত মহাভারত অশুদ্ধ হয়, আমি তো বুঝিনে বাপু! তোমার দাদার সবকিছুতেই এই রাজাউজির ভাবখানা আর আহ্লাদ করে বাড়িয়ো না বাপু! বাড়িতে অন্য সদস্যরাও রয়েছে! তাদের দিকটাও তোমায় সমঝে চলতে হবে! এ বাড়িতে তোমার থাকা খাওয়া শুধু একজনের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য নয়, সেটা মাথায় রেখো!
     মৃণাল জবাব দিলেন না।  জবাবে তার চোখ দুটি শুধু জলে ভরে উঠলো।  এ বাড়িতে তার অবস্থান কোথায়, এ বাড়ির ছোট বউ সেটা মাঝে মাঝেই তাকে মনে করিয়ে দিতে ভোলে না।  শর্মিলা অবশ্য উত্তরের প্রত্যাশা করলো না।  কেবল হিংস্র আনন্দে মুখখানা উজ্বল করে দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। চলবে...

দীপিকা ঘোষ। যুক্তরাষ্ট্র