অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
বৃক্ষকথা – চিরঞ্জীব সরকার

     কটি বৃক্ষ কি শুধু নিজের জন্য বাঁচে। না, তাঁর জীবদ্দশায় সে কত ছায়া দেয় অগনিত পথিককে, তাঁর পুস্পে কত প্রানী পুলকিত হয়, তাঁর ফলে কতজনে হয় পরিপুষ্ট, তাঁর ডালে আশ্রয় নেয় কত বিহঙ্গ। গ্রীস্মের তাপদাহে তাঁর শীতল বাতাসে কতজনের শরীর জুড়ায়। তাঁর ডালপালা দগ্ধ হয়ে শীতার্তদের শীতে দেয় উষ্ণতা, তৈরী হয় আমাদের আহার। এছাড়াও সে গোপনে নিঃসরন করে যাচ্ছে ধরনীর দেহে জীবনদায়ী অক্সিজেন একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। বৃক্ষ মরে গেলেও তাঁর কাঠ পরের তরে। বৃক্ষ শুধু দেখে, বলে না কিছু। কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠা গুনতে গুনতে একটা সময় নিজে কোন ইতিহাস না হয়ে ইতিহাসেরি অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। আমাদের জীবনটা পুরোপরি না হলেও কিছুটা হলেও ফলদায়ী বৃক্ষের আদর্শ অনুসরন করা দরকার। সেটা হচ্ছে না দেখেই সমাজে চারা গজিয়ে উঠছে ফলদায়ী বৃক্ষের বদলে বিষবৃক্ষের।
     একটি ভাল বৃক্ষের দরকার একটি শক্তিসালী মূল যা প্রোথিত থাকে মাটির অনেক গভীরে। মূলটি বাহির থেকে দেখা যায় না,  কিন্তু গাছটিকে টিকিয়ে রাখে এ মূলটিই। শিকড় শক্ত না হলে একটু ঝড়েই গাছটি পড়ে যাবে। আমাদেরও পোষাক পরিচ্ছদ, চেহারা,ধন সম্পদ এগুলো সমম্তই বাহ্যিক। কিন্তু আমাদের অন্তরে লালিত মানবিক চেতনাগুলি যা বাহির থেকে পরিলক্ষিত হয় না সেটাই আমাদের মূলত মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের শিকড় বা ভিত্তি।মানবিক চেতনায় আমরা যতটা শক্তিশালী হব ততই মানুষ হিসেবে আমাদের জন্মটা সার্থক হবে। তা না হলে জগতের অন্য প্রানী আর মানুষের পার্থক্যটা রইল কই। পৃথিবীর সমম্ত জীব অনাদিকাল থেকে চারটি কাজ করে যাচ্ছে। আহার,নিদ্রা,ভয় ও সন্তান উৎপাদন। এ চারটা জিনিস জীব প্রকৃতিগত ভাবে এমনি এমনি পায়। একটি পাখির বাচ্চা বা পিপিলিকা জানে কিভাবে আহার জুটাতে হয়, কিভাবে ভবিষৎ প্রজন্ম তৈরী করতে হয়, কিভাবে নিজেকে ভয় থেকে সুরক্ষিত রাখা যায়, কোথায় ঘুমাতে হয়। যে কোন পাখির দিকে ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায় সে সদা ভয়ে থাকে এই বুঝি তাকে কেউ ধরে ফেলল। সে খাদ্যকনা খাওয়ার সময়ও অজানা এক আশংকায় ক্রমাগত মাথা ঘোরাতে থাকে। সেও তার নিদ্রার জন্য লতাপাতা বা শুকনো একটু ডালপালা দিয়ে বাসা বানিয়ে নেয় এবং প্রয়োজনে নিজের সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করে ঠোঁট। বিপদ বুঝলে কুকুর তার তীক্ষ্ন দাঁতের ব্যবহার করে, তেড়ে আসে সাপ ভয়ানক ফনা তুলে। এ জ্ঞানগুলি অর্জনের জন্য তাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। কিভাবে ছোঁ মেরে মাছ ধরতে হবে এজন্য আকাশের চিলকে কোন পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে হয় না।
     আমরা মানুষেরাও আসলে এ চারটি কাজই করে যাচ্ছি। একটি পশু হয়ত রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়ে আর আমরা গগনচু্ম্বি অট্টালিকায় ঘুমাই। কিন্তু সত্যিকারের ঘুম আসলে আমাদের ভুলে যেতে হয় কোথায় আমরা ঘুমাচ্ছি, খোলা রাস্তায় না রঙ্গীন অট্টালিকায়। অন্য প্রানীর ঘুমে কষ্ট নেই বরং মানুষই ঘুমের জন্য কষ্ট পাচ্ছে বেশী। তাইতো তাকে সাহায্য নিতে হয় স্লিপিং পিলের। আমরা কত রকম বাহারী খানা তৈরী করি রসনা বিলাসের জন্য। কিন্তু জীবগতের অন্য প্রানীরা আমাদের মত বাহারী বা বহুমূখী খাবার হয়ত খাচ্ছে না কিন্তু তারাও তো মারা যাচ্ছে না। বরং মানুষ কোবরা, বেজী, বাদুরের মত বন্য প্রানী খেতে গিয়ে হয়ত করোনার মত ভাইরাসকে ডেকে এনে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছে। ভয় থেকে বাঁচার জন্য আমরা বন্দুক, পারমানবিক বোমা কত কিছুই তৈরী করেছি কিন্তু অন্যন্য প্রানীরাও তো তাদের সাধ্যমত আত্মরক্ষা করে। তাই এসব নিয়ে মানুষের অতটা বড়াই না করাই ভাল। একটা বাঘ জন্মগতভাবেই বাঘ, আস্তে আস্তে সে বাঘ হিসেবেই বড় হয়ে উঠবে এবং একটি হরিন দেখলে তাকে সে সোহাগে কোলে তুলে নিবে না। সে যেটা করবে সেটা হল প্রচন্ড বেগে হরিনটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাঁর লাঞ্চ বা ডিনার সেরে নিবে। তাঁর চরিত্র সংশোধন যোগ্য নহে।
     কিন্তু সৃষ্টিকুলে মানুষকেই মানুষ হতে হলে মানবতা অর্জন করতে হয়। তাইতো মানুষের জন্য এত ব্যাপক জ্ঞান বিজ্ঞানের আয়োজন। কিন্তু এত জ্ঞান আরোহনের পরও যদি আমাদের ভিতর মানবিক গুনাবলীর উন্মেষ না ঘটে তাহলে বুঝতে হবে আমরা আসলে শুধুমাত্র চেহারায় মানুষ, চরিত্রে নয়। মনুষ্যত্যের মূল যতক্ষন পর্যন্ত না আমাদের অন্তরে প্রোথিত না হয় ততক্ষন পর্যন্ত আমরা আমরা অন্য কোন এক সত্তা, আমাদেরকে যথার্থ মানুষ বলা চলবে না। এ মানবিক গুনাবলি হৃদয়ে বপন করতে হয়, মানবিকতার চারাগুলি যখন হৃদয়ে গজিয়ে উঠে সেগুলিকে সযত্নে লালন পালন করতে হয়, একটু একটু জলসিঞ্চনও করতে হয় মাঝে মাঝে । এ চারাগুলির যাতে কেউ ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য একটু বেড়া দিয়েও রাখতে হয়। এভাবেই মানবিকতার বীজ একদিন মহীরুহে পরিনত হয়। সে মানবিক বৃক্ষ তখন অসংখ্য মানুষকে ছায়া প্রদান করে,যার সান্নিধ্যে অন্য মানুষ নিরাপদ বোধ করে। প্রীতি, প্রেম, কল্যান যার পু্স্প,  আর জনমানুষের সেবা যার পরিপক্ক ফল। তখনি ধন্য হয় মানব জীবন।
     মানুষ পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়, প্রকৃতি, জনজীবন প্রভৃতি নানা উৎস থেকে এ মানবিকতার বীজ পেতে পারে। একটা শিশুর হৃদয়ে মানবিকতার এ বীজতলা সবচেয়ে ভাল তৈরী করে দিতে পারে পরিবার। তাইতো দেখা যায় যে সমস্ত পরিবার কিছু ভ্যালুজ মেনে চলে তাদের সন্তানেরা সাধারনত বিপথগামী হয় না। এ ভ্যালুজগুলোই হল দৃঢ় শিকড়। এটাকে উপড়ে ফেলা এত সহজ নহে। এ ঘরের সস্তানদের হাতে কেউ সহজে ইয়াবা ধরিয়ে দিতে পারবে না। একজন মা বাবা হয়ত তাঁর সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে পারে কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষক হাজার হাজার সস্তানকে যথার্থ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারে। তাইতো শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। যে সমাজে যত বেশী আদর্শ শিক্ষক থাকবে সে সমাজ তত বেশী পাবে ভবিষৎতের সুনাগরিক। একজন আদর্শ শিক্ষক একটি বিশাল বটবৃক্ষের মত যার শীতল ছায়ার পরশে তাপিত জীবন পায় কোমল আশ্রয়। প্রকৃত জ্ঞানের যাত্রীরা এসে তাঁর মূলে সমবেত হয়। বর্তমান সমাজে অস্থিরতার অন্যতম কারন সমাজে আদর্শ শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাওয়া। আদর্শ শিক্ষক একজন ফুলের বাগানের মালীর মত যার পরিচর্যায় আঙ্গিনা ছেয়ে যায় গোলাপের সৌরভে। সমাজে তখন সহজে বিষফোঁড়া গজিয়ে উঠতে পারে না কারন দক্ষ মালী বাগানের আগাছা অন্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে।
     বুঝতে হবে এ জীবনে আমরা কেহ অমর নহি। মানুষের দেহ পেলাম আর জীবনটা কাটিয়ে দিলাম শুধু আহার নিদ্রায় আর ধনসঞ্চয়ে যেটা নিয়ে আবার মৃত্যুর পর ভাগাভাগি শুরু হয়ে যাবে তাতো প্রকৃত জীবন নহে। জীবন জীবনের জন্য। অন্যের অশ্রু বা আর্তনাদ যদি আমাদের হৃদয়ে এতটুকু আলোড়ন সৃষ্টি না করতে পারে তবে বুঝতে হবে আমাদের দেহে রক্ত মাংস থাকলেও মন ইতোমধ্যে একখন্ড প্রস্তরে পরিনত হয়ে গেছে যেখান থেকে একটি দূর্বাঘাস গজিয়ে উঠাও প্রায় অসম্ভব। যার জীবনে শুধুই টাকা আছে সে সবচেয়ে গরীব। সে বুঝতে পারে না লোকজন তাঁকে ভালবাসেনা, ভালবাসে তাঁর টাকাকে। আর টাকা দিয়ে কেবলমাত্র পন্য ও সেবা কেনা যায় বাজার থেকে,শ্র্দ্ধা, ভালবাসা, স্নেহ নহে।  কারন এগুলো অমূল্য সম্পদ। আপনার চোঁখ থেকে যখন একফোটা অশ্রুবিন্দু গালে গড়িয়ে পড়বে তখন সেটা মুছে দেবার জন্য যদি অনেকগুলি হাত এগিয়ে আসে তখন বুঝতে হবে সত্যিই আপনি ধনী। একটি স্নেহভরা হাতও যদি এগিয়ে আসে তবেও বুঝতে হবে আপনি জীবনের প্রকৃত ধন অর্জন করেছেন। প্রকৃত ধন অর্জন করতে হয়। এটা মার্কেট থেকে কেনা যায় না। যে রিকশাওয়ালা কুড়িয়ে পাওয়া মানিব্যাগ থানায় গিয়ে জমা দেয় সে ধনী, আর যে তথাকথিত কোটিপতি কুড়িটাকার লাউশাক কিনার সময় কোন গরীব অসহায় বৃদ্ধার সাথে বহুসময় ধরে দরকষাকষিতে লিপ্ত হয় সে প্রকৃতক্ষে গরীব। তাঁর মানবিকতা এখনো মূল খুঁজে পায়নি, বৃক্ষ হওয়া তো হনুজ দূর অস্ত।

চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা