অটোয়া, শুক্রবার ১৮ অক্টোবর, ২০২৪
তিনটি চিলের গল্প – চিরঞ্জীব সরকার

     ল্পের প্রথম চিলটি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের। কবি তাঁর “হায় চিল” কবিতায় লিখেছেন, “হায় চিল, সোনালি ডানার চিল,/এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!/তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে;/পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চ’লে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;/আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?/কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!/হায় চিল, সোনালি ডানার চিল,/এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।“
     মেঘলা দুপুরের উদাসী চিল কবির হৃদয়ে রক্তক্ষরন ঘটাচ্ছে। চিলটি যেন তাঁর ঠোঁট দিয়ে কবির হৃদয়কে বিদ্ধ করে অতীতের বেদনারাশিকে টেনে বের করে আনছে। এ বেদনার জগতে আছে ফেলে আসা দিনের রূপবতী সেঐ রাজকন্যরা যারা একদিন কবির হৃদয়ে ভালবাসার জগত তৈরী করেছিল কিন্তু আজ তাঁরা মল্লিকাদের মত থাকে দূরের কোন নাম না জানা গাঁয়ে বা সাত সমূদ্র তের নদীর পারের কোন এক দূরদেশে। কবির এ বেদনা শুধু বেদনা নয়। এখানে আছে দূর অতীতের ভালবাসার এক গভীর অনুভূতি। কবির এ ভালবাসা হয়ত প্রকাশ পায়নি, কিন্তু স্থান পেয়েছে তাঁর হৃদয়ের প্রতি প্রকোষ্ঠে।হৃদয় খুড়ে বেদনা না জাগাতে চাইলেও যতদিন দূর থেকে ভেসে আসা রাখালের বাশীর সুর, বনের ডলপালার ভিতর লুকানো দুপুরের কোন ঘুঘু পাখির ডাক, শরতের কোন এক সকালের একটা কাশফুলের মৃদু দোলন আমাদের বাতায়নে কড়া নাড়বে ততদিন আমরাও হয়ত কবির মত নস্টালজিক হয়ে যাব। আসলে আমাদের সবারি জীবনে কফি হাউজের মত একটা আড্ডা বসেছিল যেটা আমাদের কাছে এখন অতীত। ডিসুজার মত আমাদেরও কত পরিচিত মুখ ঘুমিয়ে আছে আজ মাটির অন্ধকার ঘরে। সুজাতারা সুখে আছে কিনা জানিনা তবে হিরে আর জহরত অধিকারে থাকলেই সুখের প্রবাহ বয়ে যাবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই এ জগত সংসারে।
     গল্পের দ্বিতীয় চিলটি দত্তাত্রেয়র। গৃহত্যাগী অবধূত পরিব্রাজক সাধু দত্তাত্রেয় পৃথিবী পরিভ্রমন করে বেড়াতেন নিজের ইচ্ছেমত। সারা পৃথিবীটাই ছিল তাঁর পাঠশালা। তিনি জগত ও জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করতেন এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এক আনন্দময় জীবন কাটাতেন। মহারাজ যদু কর্তৃক সে যখন জিজ্ঞসিত হলেন তাঁর অপার এ আনন্দের প্রকৃত উৎসের ব্যাপারে তখন তিনি তাঁর জীবনের যে চব্বিশজন শিক্ষাগুরুর কথা উল্লেখ করেছিলেন তার একজন ছিলেন চিল। যখন তাঁর পরিব্রাজক জীবনে এক প্রভাতে কোন একটা দেশের এক সমৃ্দ্ধ নগরীতে প্রবেশ করলেন তখন তিনি দেখতে পেলেন একটা ছোট চিল এক টুকরো ছোট মাংস ঠোঁটে নিয়ে আকাশে উড়ছিল। হঠাৎ অনেকগুলি বড় চিল এসে ছোট চিলটাকে আক্রমন করল ঐমাংসের টুকরোটুকু ছিনিয়ে নিবার জন্য। ছোট চিলটিও আপ্রান চেষ্টা করছে তাঁর মাংসটুকু প্রানপনে ধরে রাখতে। আকাশে চলছিল ধস্তাধস্তি। অনেকগুলি বড় চিলের সাথে লড়াই করে সে হয়রান হয়ে যাচ্ছিল। এময় সময় ছোট চিলটি তাঁর ঠোটের মাংসের টুকরোটিকে ছেড়ে দিল আর বড় চিলগুলি আকাশ থেকে পড়তে থাকা সে মাংসখন্ডটির দিকে ধাবমান হল। ছোট চিলটি মুক্তির আনন্দে আকাশে আবার ডানা মেলে উড়তে লাগল। আর এদিকে আকাশ থেকে পড়ন্ত মাংসখন্ডটি যখন ভূমি স্পর্শ করল তখনি বড় চিলগুলি মাটিতে নেমে এসে ওটাকে কেন্দ্র করে নিজেদের ভিতর প্রচন্ড লড়াই শুরু করে দিল। একটু আগে যারা সংঘবদ্ধ হয়ে ছোট চিলটকে ক্রমাগত বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমন করছিল এখন তাঁরা আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু করল নিজেদেরকেই। অনেক ঠোকরাঠুকরির পর কেবলমাত্র তাদের ভিতর একটা চিলই মাংসখন্ডটিকে গলাধঃকরন করতে পারল। বাকীগুলি বিফল হয়ে একবুক হতাশা নিয়ে আবার আকাশে ডানা উড়াল।
     এ ঘটনাটি দেখে দত্তাত্রেয়র কয়েকটি গভীর জীবনবোধের উপলদ্ধি হল। জটিল পরিস্থিতিতে অনেকসময় দাবি ছেড়ে দিতে হয়, নিজের মুক্তি বা সুখের জন্যই। ছোট চিলটি যেন সেটাই করেছিল। ক্রমাগত ঠোকরে তাঁর জীবন যখন অসহ্য হয়ে উঠেছিল তখন সে তাঁর দুঃখের উৎস ছোট্ট সে মাংসটুকরোটিকে পরিত্যাগ করেছিল এবং দুঃখের উৎস ত্যাগের ফল সে সাথে সাথে প্রত্যক্ষ করল। তাঁর দিকে আর কেউ আক্রমন করতে আসছে না। মুক্ত বিহঙ্গের মত সে নীলকাশে বিচরন করতে লাগল। আমাদের জীবনেও ছোটখাট অনেক জিনিস পরিত্যাগ করা উচিত সেটা যদি ক্রমাগত দুঃখের কারন হয়ে দাঁড়ায়। তা নাহলে অশান্তির বড় বড় চিলগুলি আমাদের পিছু ছাড়বে না, জীবনকে জ্বালা দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলবে। মনে রাখতে হবে জীবন অনেক বড়। ছোটখাট বিষয় নিয়ে যদি সর্বদা জীবনকে ব্যাপৃত রাখি তবে আমাদের জীবন থেকে শান্তি চলে যেতে খুব একটা বেশী সময় লাগবে না। সময়ের সদা ঘূর্নয়মান চক্র কখনো অনুকূলে বা কখনো প্রতিকূলে থাকে। যখন পরিবেশ প্রতিকূলে থাকে তখন সামান্য একটু ছাড় শান্তির আবহ বয়ে আনে যেমনটি বয়ে এনেছিল ছোট চিলটির ক্ষেত্রে যখন সে তাঁর অধিকারে থাকা মাংসের টুকরোকে ঠোঁট থেকে ছেড়ে দিল। বিপরীত স্রোতে কতক্ষন সাঁতার কাটা যায়। আর এটি করতে গেলে পেশী দূর্বল হয়ে তলিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওই এক টুকরো মাংস হারাল বলেই ছোট চিলটির জীবন থেকে মাংস শেষ হয়ে যাবে না। এ বিরাট পৃথিবীর যে কোন জায়গায় সে আবার একটু খুঁজলেই ওরকম মাংসের টুকরা পেয়ে যাবে। ছোট চিলটি তো সাথে সাথেই বড় চিলগুলিকে দেখে তাঁর মাংসখন্ডটিকে ছেড়ে দেয়নি। যখন সে বুঝল এটার জন্যই এত কাড়াকাড়ি ও এত আঘাত তখনি সে এটা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়।
     এদিকে ছোট চিলগুলির কাছ থেকে মাংসের টুকরো কেড়ে নেবার আনন্দ কিন্তু বড় চিলগুলির জন্য স্থায়ী হল না। অচিরেই তাঁরা ছোট চিলটির কাছে যেটি দুঃখের উৎস ছিল সেটি তাঁদেরও দুঃখের উৎস হয়ে দাঁড়াল নিজেদের ভিতর পারস্পরিক লড়াইয়ে। এবং শুধুমাত্র একটি চিল ছাড়া এ লড়াইয়ের ফসল ঘরে তুলতে পারল না অন্য চিলগুলি। আসলে অন্যের জিনিস বা যেটি আমার প্রাপ্য নয় তা করায়ত্ত করার প্রয়াস আমাদের জীবনে অনেক দুঃখ বয়ে আনে এবং সেখানে চরম কল্যান নিহিত থাকে না। আমাদের যার জন্য যেটুকু বরাদ্দ সেটা নিয়ে এ ছোট জীবনটুকু অনায়াসে পার করে দেয়া যায়। অন্যের বরাদ্দে হাত বাড়ালে অসহনীয় দুঃখের বোঝা আমাদের জীবনকে বিষময় করে তুলবেই।
     এ গল্পের তৃতীয় চিলটি হল প্রবাদের চিল যে নাকি আকাশ থেকে নেমে ছোঁ মেরে কান নিয়ে যায় আর কান নিল কি নিল না এটা ভালমত পরখ না করেই কথিত সেই চিলের পিছনে অর্বাচীনের মত পশ্চাৎধাবন করা ছিন্ন কর্ন উদ্ধারের আশায়। এ চিলটি আসলে মনোজগতের কল্পনার আকাশেই উড়ে বেড়ায়। বাস্তবে আকাশ থেকে নেমে এসে ছোঁ মেরে আমাদের মাথার পাশের কান দুটিকে ছিড়ে নেয় না। এটাকে আতঙ্কের চিলও বলা যায়। অনাদিকাল থেকে আমাদের এই যে জীবন সংগ্রাম চলছে সেখানে সব সময় লুকিয়ে থাকে ভয়ের একটা আবহ। এ ভয়ই মানুষকে সদা সন্ত্রস্ত করে রাখে ওই বুঝি আমার জ্ঞান, মর্যাদা, সম্পদ, সস্পর্ক অন্য কেউ কেড়ে নিল। জীবন যুদ্ধের জয় পরাজয়ের এমন একটা দোলাচলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাই আমরা ভাবতে থাকি আমার মাথার উপর একটি চিল প্রদক্ষিনরত যে সুযোগ পেলেই আমাকে ছোঁ মারবে। এ আতঙ্কের চিল থেকে কি পরিত্রান নেই। না, এটা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারি অতি সহজেই। আমরা তো শূন্য হাতেই এখানে এসেছি, মাঝখানে কিছু জিনিস দিয়ে হাতটা অস্থায়ীভাবে একটু ভরি, আবার সময় হলে ওটুকুও ফেলে আবার শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। তাই এ হাত থেকে চিলের আর নেবার কি থাকে।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা