অটোয়া, শুক্রবার ১৮ অক্টোবর, ২০২৪
শোষণের সংস্কৃতি ও সম্পদের নির্গমন - আলী রেজা

বাঙালি জাতির একটি শোষণের ইতিহাস আছে। অতীতে বিভিন্ন সময় বাঙালি শোষিত হয়েছে বহিরাগত শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে। এখন বহিরাগত শাসক নেই। তবু শোষিত হচ্ছে। শোষিত হচ্ছে নিজেদের দ্বারাই। নিজেদের মধ্যেই এখন সৃষ্টি হয়েছে একটি শোষকগোষ্ঠী। শোষণ করছে নিজেদেরকেই। তাই বাঙালি এখন একই সাথে শোষক ও শোষিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই বিভাজন তৈরি হয়েছে এবং ক্রমশ বেড়েছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এই বিভাজন ছিল না। কারণ তখন সবাই ছিল শোষিত। শোষিতদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটি ঐক্য থাকে। শোষণের অবসান ঘটলে সেই ঐক্য আর থাকে না। তখন মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী চেতনা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। বিচ্ছিন্ন মানুষ সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিজের স্বার্থে অন্যের স্বার্থ নষ্ট করে। নিজের সাথে অন্যের একটি বিভাজন সৃষ্টি করে। এভাবে সে হয় শোষক হয়ে ওঠে নয়তো শোষিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ কিংবা ঔপনিবেশিক শোষণের সাথে জাতির অভ্যন্তরীণ শ্রেণিশোষণের একটি পার্থক্য আছে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ হলো দখলদার কর্তৃক শোষণ। অন্যের দখলে থাকলে শোষিত হতে হয়। সে শোষণ মেনে না নিয়ে উপায় থাকে না। তখন শোষিত জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে শোষিত হয়। ঔপনিবেশিক শোষণের চিত্রও অনেকটা একই। দখলকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য দখলদাররাই উপনিবেশ তৈরি করে। ঔপনিবেশিক শক্তি সব সময় শোষণের একটি রূপরেখা তৈরি করে নেয়। সে রূপরেখায় শাসক ও শাসিতের মধ্যে একটি আইনগত বিষয় থাকে বটে। কিন্তু শোষণের পথও উন্মুক্ত থাকে। শাসকশক্তি উপনিবেশকে নানাভাবে শোষণ করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করে। ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল তখন ব্রিটিশ শাসক ভারতবর্ষে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও কিছু আচরণিক উন্নয়নের ফলে ভারতবাসীর  জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছিল বলে অনেকে ইংরেজ শাসকের প্রশংসা করেন। ভারতবাসীকে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ইংরেজ। আবার ভারতকে শোষণও করেছে সবচেয়ে বেশি। দেশভাগের সাথে বৃহৎ বাংলাও বিভক্ত হয়েছিল। বাংলার পূর্ব অংশ মুসলিম প্রধান হওয়ায় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ করেছে দেশের এই পূর্ব অংশটি। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এই বৈষম্য ও শোষণ এতোটাই উন্মুক্ত হয়েছিল যে তার সমাপ্তি ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে। বাঙালি জাতির এই ধারাবাহিক শোষণ ও সম্পদ নির্গমনের বিষয় তুলে ধরাই বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য।

পালযুগ, সেনযুগ ও সুলতানি আমলে বাঙালি জাতির সমাজজীবনে খুব বেশি পরিবর্তন সাধিত হয়নি। সে সময় শাসকগোষ্ঠী ধর্ম, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভাষা ও ধর্মের পৃষ্টপোষকতা দিতেন বলে অন্যান্য ধর্ম, ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সমৃদ্ধ হতে পারতো না। এটাকে সাংস্কৃতিক শোষণ বলা যেতে পারে। তখন এই সাংষ্কৃতিক শোষণ যতটা ছিল অর্থনৈতিক শোষণ ততটা ছিল না। মোগল আমল থেকে অর্থনৈতিক শোষণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে থাকে। এ সময় বাংলায় স্বাধীন নবাবি আমলের সূচনা হলেও দিল্লির সম্রাটকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েই নবাবি শাসন পরিচালনা করতে হতো। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অধিকার করে নতুন রাজস্বব্যবস্থা চালু করেন। তার আগে বারো ভূঁইয়ারা স্বাধীনভাবেই নিজ নিজ জমিদারি পরিচালনা করতেন। বারো ভূঁইয়াদের হাত থেকে বাংলা অধিকার করে সম্রাট আকবর রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন (১৫৯৪)। তখন থেকে সুবা বাংলার রাজস্ব দিয়ে বাংলার উন্নয়ন হোক বা না হোক দিল্লির দরবারে নিয়মিত রাজস্ব দিতেই হয়েছে। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলা থেকে বছরে ১০ লক্ষ টাকা নিতেন। সুবাদার শায়েস্তা খানের দৈনিক আয় ছিল দুই লক্ষ টাকা যা তৎকালীন বিশ্বে ছিল বিরল ঘটনা। তাঁর সময় খাদ্য-দ্রব্যের মূল্য কম ছিল। এই কম থাকার একটি মন্দ দিকও ছিল। টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেতো বলে যে ইতিহাস পাওয়া যায় সে ইতিহাসের উল্টোপিঠও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। তখন বাংলার বেশিরভাগ লোক কৃষক ছিল। ফসল বিক্রি করেই তারা অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতো। তাই শস্যের দাম কম হওয়াতে তাদের খুব একটা লাভ হয়নি। বরং কম দামে শস্য বিক্রি করে খাজনা পরিশোধ করা তাদের জন্য কষ্টকর হয়েছে। মোগল সম্রাটদের মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা আর ব্যয়বহুল স্থাপত্যের পেছনে ব্যয়িত বিপুল পরিমাণ অর্থের একটি বড় অংশের যোগান দিতে হয়েছে বাংলার দরিদ্র কৃষকদের। মোগল হেরেম আর দৃষ্টিনন্দন দিল্লি শহর নির্মাণের পেছনে যে বাংলার কত হতদরিদ্র কৃষকের চোখের জলও যুক্ত আছে সে খবর কে রেখেছে? কিছুটা পাওয়া যায় সাহিত্যে। এ বিষয়ে বহুল প্রচলিত লোকছড়াটি হলো : ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/ বর্গী এলো দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে / খাজনা দিব কিসে। ধান ফুরালো পান ফুরালো / খাজনার উপায় কী। আর কটা দিন সবুর কর/ রসুন বুনেছি।’ শান্তিপ্রিয় আর অসহায় কৃষকদের কষ্টার্জিত শস্য বর্গিরা লুট করে নিলে, বুলবুলি পাখি বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল খোয়া গেলে, এমনকি ধান ও পান ফুরিয়ে গেলেও সামনে যে শস্য ঘরে আসছে (রসুন) সেই শস্য বিক্রি করে খাজনা দেওয়ার কথা চিন্তা করতে হতো কৃষকদের। বোঝাই যায়, শতকষ্টেও বাংলার কৃষকদের খাজনা দিতে হতো শাসকগোষ্ঠীর বিলাসিতার ব্যয় মেটানোর জন্য।

সুবাদার ইসলাম খাঁ সমগ্র বাংলায় মোগল শাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ঢাকায় অবস্থান করতেন এবং রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি গভীর আনুগত্য দেখিয়ে নতুন রাজধানী ঢাকার নামকরণ করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর (১৬১২)। মোগল আমলে বাংলার আর একজন প্রভাবশালী সুবাদার ছিলেন শাহজাদা সুজা (সম্রাট শাহজাহানের পুত্র)। তিনি প্রায় ২১ বছর বাংলার শাসক ছিলেন। বাংলায় ইংরেজ বেনিয়াদের বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন তিনি। জেব্রাইল ব্রাউটন নামক এক ইংরেজ ড়াক্তারের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি মাত্র তিন হাজার টাকা নযরানার বিনিময়ে সারা বাংলায় ইংরেজ বণিকদের বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এতে বাংলার ব্যবসায়ীরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং বাংলার সম্পদ ইংল্যান্ডের ডান্ডি, ম্যানচেস্টারে পাচার হওয়ার পথ সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলায় ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও তারা আগের মতোই তিন হাজার টাকাই নযরানা দিয়ে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতো। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে সুবাদার শায়েস্তা খান ইংরেজ বণিকদের এই বিশেষ সুবিধা বাতিল করার চেষ্টা করলে ইংরেজদের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষ দিকেই মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। এ সময় মোগল রাজপরিবার প্রধানত বাংলার রাজস্ব দিয়েই চলতো। ফলে তৎকালীন বাংলার সুবাদার মুর্শিদকুলী খানকে সম্রাট রাজস্ব ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এই স্বাধীনতার সুযোগে সুবাদার মুর্শিদকুলী খান নিজেকে নবাব হিসেবে ঘোষণা করে নবাবি আমলের সূত্রপাত করেন। কিন্তু তখনও বাংলা থেকে দিল্লির দরবারে রাজস্ব পাঠানো হতো। ‘নবাবি আমলে বাংলা থেকে দিল্লিতে (মোগল স¤্রাটের দরবারে) এক কোটি পাঁচ লক্ষ টাকা থেকে এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রাজস্ব নযরানাস্বরূপ পাঠানো হতো’ [ ড. এস এম হাসান, বাংলার ইতিহাস, পৃ.৩৩৭]।

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। বাংলায় নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে ইংরেজ বণিকদের প্রভাব অনেক বেড়ে যায়। আলীবর্দী খান মারাঠা দস্যু বা বর্গীদের দমন করার জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করেন এবং সময় সময় এই অর্থ ইংরেজদের নিকট থেকেও আদায় করতেন। নবাবকে সাহায্য করার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিজয়ী হয়ে শাসন ও শোষণ ক্ষমতা লাভের পথ নির্মাণ করে। বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪) মীর কাসিমকে পরাজিত করে বাংলার আধিপত্য লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের এক ফরমান বলে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে এবং একই সাথে বাংলায় নবাবের রাজত্ব শেষ হয় ও কোম্পানির শাসন শুরু হয়। শুরুতেই কোম্পানি দিল্লির সম্রাটের বৃত্তি বন্ধ করে দেয় এবং বাংলার নবাবের বৃত্তি ৫৩ লক্ষ টাকা থেকে কমিয়ে প্রথমে ৪১ লক্ষ ও পরে তা ৩২ লক্ষ নির্ধারণ করে। অন্যদিকে রাজস্ব আদায় মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি করে। এ সম্পর্কে রেজা খান অভিযোগ করেন যে, নবাব আলীবর্দী খানের আমলে পূর্ণিয়া জেলায় বাৎসরিক রাজস্ব যেখানে মাত্র ৪ লক্ষ টাকা ছিল সেখানে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে তা বৃদ্ধি করে ২৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয়। অন্যান্য জেলাতেও একইভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব বৃদ্ধি পেলেও তা দিয়ে বাংলার উন্নয়ন হয়নি। বেশিরভাগ অর্থই চলে গেছে ইংল্যান্ডে। এর ফলেই বাংলায় দেখা দিয়েছিল ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) নামক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসে এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিয়েছেন।  কোম্পানির শাসনামলে বাংলাকে যেভাবে শোষণ করা হয়েছিল তা শোষণের ইতিহাসের এক বড় অধ্যায়।  ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিপ্লবের মাধ্যমে একশ বছরের কোম্পানি শাসনের অবসান হলে যে প্রকৃত ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় সে শাসনেও বাংলার সম্পদ নির্গমনের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে। বাংলা দুইভাবে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান অংশে পড়ে মুসলিম প্রধান পূর্ববাংলা। শুরু হয় শোষণের আর এক ইতিহাস। এবার শুধু অর্থনৈতিক শোষণ নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণের কবলে পড়ে বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র শুরু করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। প্রথমে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়। তারপর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বাতিঘর রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে। মূলত সেখানেও ব্যর্থ হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক শোষণ চালায় খুব সফলভাবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হলেও রাজধানী স্থাপন করে পশ্চিম পাকিস্তানে। রাজনৈতিক তাৎপর্যমণ্ডিত শহর লাহোরকে বাদ দিয়ে করাচিতে রাজধানী স্থাপন করা হয় এবং রাজধানী উন্নয়নের নামে ২০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়। পরবর্তীতে আইয়ুব খান ইসলামাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করে এর উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেন ২০ কোটি টাকা। এ সময় ঢাকার উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয় মাত্র ২ কোটি টাকা। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদর দফতর এবং সকল অস্ত্রকারখানা স্থাপিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। সামরিক বাহিনীর চাকরিগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় একচেটিয়া। ফলে সামরিক খাতে ব্যয়িত অর্থের (বার্ষিক আয়ের ৭৫% এবং পরে ৬০%) সুবিধাভোগী ছিল সম্পূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। ১৯৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় ৩২% বেশি। দশ বছর পর (১৯৬৯-৭০) এ পার্থক্যের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৬১%। কেন্দ্রীয় সরকারের সকল হেড অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে অবাধে অর্থ চলে যেতো পশ্চিম পাকিস্তানে। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত অর্থ দিয়েই হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬%  ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করতো ২০% (পরে ৩০% করা হয়েছিল)। পাকিস্তান সৃষ্টির ১৫ বছরের মাথায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেয় ৬০ কোটি টাকা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে উদ্বৃত্ত হয় ৩৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সীমাহীন শোষণের ফলেই বাঙালি জাতি মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে এবং ১৯৭১- এর ১৬ ডিসেম্বর অর্জন করে হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশ কি শোষণমুক্ত হতে পেরেছে?  মোগল আমলে দিল্লির অধীনস্ত হওয়ার পূর্বে প্রায় চার শতাব্দী পর্যন্ত অধিকাংশ সময় বাংলা স্বাধীন ছিল। সে সময় বাংলার ধন-সম্পদ বাংলায়ই থাকতো। ফলে মোগলপূর্ব বাংলা খুবই সমৃদ্ধ ছিল। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর বর্ণনা থেকেও বাংলার সেই সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। মূলত মোগল আমল থেকেই শুরু হয় শোষণের সংস্কৃতি। মোগল আমলে বাংলার অর্থ চলে গেছে দিল্লিতে, ইংরেজ আমলে বাংলার অর্থ চলে গেছে ইংল্যাণ্ডে আর পাকিস্তান আমলে বাংলার অর্থ চলে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানে। একাত্তর পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থ কোথাও যাবে না; বাংলাদেশেই ব্যয় হবে, বাংলাদেশ হবে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা- এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ শোষণমুক্ত হয়নি। বাংলাদেশের অর্থ বিদেশে পাচার হওয়াও বন্ধ হয়নি। এখন মোগল নেই, ইংরেজ নেই, পাকিস্তানি শোষকরাও নেই। তাহলে কে শোষক? শোষক নিজেদের মধ্যেই। এখন বাঙালি নিজেদের দ্বারাই নিজেরা শোষিত। বাংলাদেশের অর্থ এখন আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয় দেশের এক শ্রেণির নীতিহীন রাজনীতিক, দুর্নীতিবাজ আমলা ও অসাধু ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দ্বারা। যে দেশপ্রেমের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সে চেতনা এখন বিলুপ্তির পথে। দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বড় দুঃখ করে বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে ঐ চোরদের দমন করা সম্ভব হয়নি। এখন ঐ চোরদেরই বংশবিস্তার ঘটেছে। এরা দেশের টাকা চুরি করে বিদেশে পালিয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে সামারিক-বেসামরিক অনেক আমলা টাকার কুমির হয়েছিল। তাদের পরিবার-পরিজন বিলাসী জীবন যাপন করতে করতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। বিষয়টিকে উপজীব্য করে কবি ও সাংবাদিক আব্দুল গণি হাজারী লিখেছিলেন ‘আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী’ নামক একটি প্রতীকী কবিতা। কবিতাটি ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেছিল। বর্তমানে বাংলাদেশেও সামরিক-বেসামরিক অনেক আমলা সীমাহীন সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে। অসাধু রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরাও সম্পদের পাহাড় গড়ছে। বিদেশেও পাচার করছে। কানাডায় বেগম পাড়া আর মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম এই বাংলাদেশের অর্থেই গড়ে উঠেছে। 

প্রাচীন বাংলা ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। বাংলার কৃষকের ‘গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ’ ছিল- এ কথাটি শুধু কথার কথা নয়। ইবনে বতুতা বাংলাকে ‘দোযখপুর নিয়ামত’ বা ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ নরক বলেছিলেন। কারণ বাংলার ধন-সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে বহির্শক্তি বাংলা আক্রমণ করে ধন-সম্পদ লুট করে নিতো। লুণ্ঠনের এই ধারাবাহিকতা বর্তমানেও চলছে। তবে এখন বাইরের শক্তি নয়; ভেতরের শক্তিই লুণ্ঠন করছে। তারাই সম্পদ পাচার করছে। সম্পদ পাচারের সাথে এখন যোগ হয়েছে মেধা পাচার। মেধাবীরা এখন দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। ধরে রাখার চেষ্টাও নেই খুব একটা। প্রবাসে গিয়ে প্রায় সবাই স্থায়ী হতে চায়। যারা পিছিয়ে পড়ে তারাই ফিরে আসে। ভালো কিছু করতে পারলে স্থায়ী হয়ে যায় প্রবাসেই। এটা দেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। তবে সুশাসন ব্যতিত শুধু অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না। দুর্নীতি ক্রমশ বাড়ছে। ফলে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হলে সম্পদ ও মেধা দুটোই পাচার হয়ে যাবে। যেখানে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত নয়, মানুষ সেখান থেকে মাইগ্রেট হয়ে যাবেই। তবে বাঙালির মাইগ্রেশন ঘটেছে দুইভাবে। কেউ শোষিত হয়ে দেশ ছেড়েছে। আবার কেউ শোষণ করে দেশ ছেড়েছে। যারা শোষণ করে দেশ ছেড়েছে তারা একা যায়নি, সম্পদ নিয়ে গেছে। এখনো যাচ্ছে। 

আলী রেজা। প্রাবন্ধিক, সাহিত্যচিন্তক, জন্মস্থান :  টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ। পেশা : অধ্যাপনা, প্রকাশিত গ্রন্থ : ৭টি   e-mail: alirezaphilo@gmail.com