অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আলেকজ্যান্ডারের অন্তিম উপলদ্ধি – চিরঞ্জীব সরকার

    গ্রীক বীর আলেকজ্যান্ডার বিশ্ব জয় করার আগে ডায়াযোনিস নামে একজন মান্ক বা সন্যাসীর আশীর্বাদ নিতে তাঁর কাছে যান। ডায়াযোনিস গৃহে থাকতেন না। তিনি এথেন্স শহরের রাস্তায় বৃত্তাকৃতির একটি স্লাবের মধ্যে বাস করতেন। আলেকজ্যান্ডার যখন ডায়াযোনিসকে বললেন তাঁকে আশীর্বাদ করতে সে যেন বিশ্বজয় করে আবার এথেন্সে ফিরে আসতে পারে তখন ডায়াযোনিস আলেকজ্যান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন,আপনি কে? উত্তরে আলেকজ্যান্ডার বললেন, আমি বীর আলেকজ্যান্ডার, দ্য গ্রেট। ডায়াযোনিস মৃদু হেসে বললেন আপনি দি গ্রেট নন, কারন প্রকৃত গ্রেটরা কখনো নিজেকে গ্রেট বলে প্রচার করে না। যে নিজের ড্রাম নিজেই বাজায় সে যথার্থ বীরও নহে। আর আমি আপনাকে বলছি আপনার আশা পুরন হবে না। আপনি বিশ্বজয়ে বের হতে পারেন কিন্তু এথেন্সে ফিরে আসতে পারবেন না। আলেকজ্যা্ডার ডয়াযোনিসের কাছ কাছ থেকে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে এলেন।
     ডায়াযোনিসের কৃপা না পেলেও আলেকজ্যান্ডারের রক্তে রাজ্য জয়ের এক দূর্বার নেশা। এরপর আলেকজ্যান্ডার রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে চললো। একটা সময় যখন ভারতবর্ষ পর্যন্ত পৌঁছল তখন আলেকজ্যান্ডারের বাহিনী অনেক ক্লান্ত। সেনাদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। গুপ্তচর মারফত খোঁজ নিয়ে আলেকজ্যান্ডার পরিস্থিতি অনুধাবন করে গৃহে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। যাবার আগে তিনি ঠিক করলেন ভারতবর্ষ থেকে তিনি একজন যোগী সাথে নিয়ে তিনি গ্রীসে ফিরবেন। কারন আলেকজ্যান্ডার লোকমুখে শুনেছে যোগীদের রয়েছে অলৌকিক সব ক্ষমতা আর আধ্যাত্মিক শক্তি। যেরকম কথা সেরকম কাজ। আলকজ্যান্ডারের লোকজন দন্ডামিস নামক একজন যোগীর কাছে গেলেন এবং জানালেন তাঁদের রাজা আলেকজ্যান্ডার তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান। বিনিময়ে তিনি যত স্বর্নমূদ্রা চান রাজা তাঁকে তা দিতে প্রস্তুত। সব শুনে দন্ডামিস বললেন সে যাবে না এমনকি পৃথিবীর সমস্ত স্বর্নমূদ্রাও যদি তাঁকে দেয়া হয়। আলেকজ্যান্ডার এর প্রেরিত লোকেরা কোনভাবেই দন্ডামিসকে রাজী করাতে সক্ষম হল না। বিফল মনোরথ হয়ে অবশেষে তারা ফিরে গেল এবং আলেকজ্যান্ডারকে সবকথা খুলে বলল।
     আলেকজ্যান্ডার ইতোমধ্যে পৃথিবীর বহু সাম্রাজ্য জয় করা এক বিশ্বজয়ী বীর। তৎকালীন রাজারা না শব্দটি শুনতে অভ্যস্ত ছিল না আর সে যদি হয় আলেকজ্যান্ডারের মত মহাবিক্রমশালী রাজা। রাগে ছটফট করছিল আলেকজ্যান্ডার। নিজেই ছুটে গেলেন দন্ডামিসের কাছে। দন্ডামিসের কাছে গিয়ে আলেকজ্যা্ন্ডার বললেন আমি আপনাকে আমার সাথে নিয়ে যাবার জন্য এসেছি। দন্ডামিসও ডায়াযোনিসের মত আলেকজ্যান্ডারকে জিজ্ঞেস করল আপনি কে? উত্তরে আলেকজ্যান্ডার বলল আমি বিশ্বজয়ী রাজা আলেকজ্যান্ডার দ্য গ্রেট। চলুন দেরি না করে আমার সাথে উঠুন। দন্ডামিস খুব শান্তভাবে বললেন আমি যাব না আপনার সাথে তা আপনি পৃথিবীর বুকে যত বড়ই রাজা হন না কেন। দন্ডামিসের এহেন বাক্যবানে আগুনে ঘি ঢাললে সেটা যেমন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে সেভাবে আলেকজ্যন্ডার ক্রোধাগ্নিতে জ্বলে উঠল। দন্ডামিসকে বলল আলেকজ্যন্ডারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে যায় তাঁকে আর পৃথিবীতে থাকতে হয় না। আমার কথার অবাধ্য হলে আপনার পরিনতি কি হতে পারে সেটা মনে হয় আপনি পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারছেন না। আর একটু অবাধ্য হলে এ তরবারি দিয়ে আপনার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলব। কিন্তু আলেকজ্যান্ডার লক্ষ করল তাঁর কথায় দন্ডামিস একটুমাত্র বিচলিত নহে বরং সে যেন হিমালয়ের মত নির্বিকার। আলেকজ্যান্ডার খাপ থেকে তরবারি বের করবে করবে এমন সময় তাঁর মনে হল দন্ডামিসের এত বড় মানসিক শক্তির উৎস কি যা কিনা কাউকে মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করতে শেখায়। আলেকজ্যান্ডার তাই দন্ডামিসকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কে? দন্ডামিস বলল আমি কে তা আমি জানি কিন্তু আপনি কে তা আপনি জানেন না।
     আলেককজ্যান্ডার নিজেকে সংযত করে দন্ডামিসকে বললেন ঠিক আছে তাহলে আপনিই বলুন আমি কে? মৃদু হেসে দন্ডামিস বললেন আপনি হলেন আমার চাকরের চাকর। অন্য কেউ হলে দন্ডামিসকে তৎক্ষনাৎ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হত। কিন্তু একজন সাধারন রাজা আর আলেক্যান্ডারের পার্থক্য এখানে। আমরা যদি একটু গভীরভাবে খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাব যারা এ পৃথিবীর বুকে মহান হয়েছেন তাঁরা সাধারনের মত আচরন করেনি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। আলেকজ্যান্ডার বললেন আপনার কথার অর্থ আমাকে বুঝিয়ে বলুন। আমি ক্রোধকে জয় করেছি তাই ক্রোধ আমার চাকর। অন্যদিকে আপনি ক্রোধ যে কিনা আমার চাকর তাঁর দ্বারা পরিচালিত হন তাই আসলে আপনি আমার চাকরের চাকর। আপনার কথা যখন আমি অমান্য করি তখন মনে হচ্ছিল আপনি ক্রোধের আগুনে সম্পূর্ন প্রজ্বলিত। আপনি বিশ্ব জয় করলেও আমার কাছে আপনি সামান্য ক্রোধ দ্বারা পরাজিত একজন সামান্য ব্যাক্তিরূপেই প্রতিভাত। দন্ডামিসের কাছ থেকে আলকজ্যান্ডার চলে আসলেন।
     আলেকজ্যান্ডার চিন্তা করতে লাগলেন, না পারলেন তিনি ডায়াযোনিসের কৃপা আরোহন করতে আর আবারো পারলেন না দন্ডামিসকে রাজী করাতে। তাঁর এরকম একটা উপলদ্ধি জন্মাল দৈহিক বা সামরিক শক্তির চেয়ে আধ্যাত্মিক শক্তি অনেক অনেক শক্তিশালী। যা হোক শেষ পর্যন্ত ক্যালিনস নামে একজন যোগীকে তাঁর সঙ্গে ফেরত যাত্রায় আলেকজ্যান্ডার সাথী করতে পেরেছিলেন। কালিনসের সান্নিধ্যে আলেকজ্যান্ডার সম্ভবত জাগতিক জীবনের নন্বরতা বুঝতে পেরেছিলেন। তাইতো প্রত্যাবর্তন যাত্রায় আলেকজ্যান্ডার যখন অসু্স্থ হয়ে পড়েছিলেন তখন তাঁর মৃত্যুর পর জগতকে শিক্ষা দিবার জন্য তাঁর প্রধান প্রধান সেনাপতিদের ডেকে অনুরোধ করেন মৃত্যুর পর অন্তিম শবযাত্রায় কফিন থেকে তাঁর দুটি হাত যেন বের করে রাখা হয় যাতে জগতবাসী দেখতে পারে যে তথাকথিত বীর আলেকজ্যান্ডার যার ধন সম্পদের শুচুমাত্র চাবির বস্তা বহন করতে অনেকগুলি উটের দরকার ছিল তাঁকে শূন্য হাতেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। যে ভূখন্ডের জন্য আলেজ্যান্ডারকে কত রক্ত ঝড়াতে হয়েছে সে ভূখন্ড তাঁর জায়গাতে পড়ে রয়েছে, তা আলেকজ্যান্ডারকে অনুগমন করছে না। ক্ষমতা,সম্পদ, রাজ্য কোনটাই আলকজ্যান্ডারের মৃত্যুকে ঠেকাতে পারেনি। জগত দেখুক আলকজান্ডারের সমস্ত শ্রম মৃত্যু নামক এক মহাশক্তি এসে কিভাবে পন্ডশ্রমে পরিনত করে দিল। যে সস্ম্পদ ও ঐষর্য মৃত্যুর অনুগামী হতে পারে না সেটা আসলে পচনশীল দেহের মত কেবলমাত্র পচনশীল সম্পদ মাত্র। আলেকজ্যান্ডার তবুও ভাগ্যবান যে মৃ্ত্যুর আগ পর্যন্ত অনন্ত ডায়াযোনিস, দন্ডামিস ও ক্যালিওসের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন যারা জানত জীবনের প্রকৃত সম্পদ কি। সে সম্পদে ধনী হতে পররাজ্য জয় করতে হয় না, জয় করতে হয় নিজের মনরাজ্য। দুদিনের জন্য আমরা পৃথিবীতে এসে দুদিন পর চলে যাই,মাঝখানে কত কিছুর মিথ্যা মালিক হবার চেষ্টা করি। সবার অগোচরে মৃত্যু এসে নির্মমভাবে আমাদের তথাকথিত মালিকানা কেড়ে নেয়। তবুও আমাদের বু্দ্ধি আমাদেরকে এমনভাবে বুঝায় যে আমাদের পরিকল্পনগুলো দেখলে মনে হয় আমরা বুঝি এখানে চিরকাল থাকতে পারব। তিনজন দার্শনিক যেমন আলকজ্যান্ডারকে নতুন উপলদ্ধি দিয়েছিল বহু বছর আগে আজ মহামারী করোনাও মানুষের জীবনকে এক নতুন উপলদ্ধির সামনে মুখোমুখি করে দিয়েছে।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা