অটোয়া, মঙ্গলবার ২২ জুলাই, ২০২৫
কপাল - জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

    সে বসে চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল অনিলবাবুর। সেই ঘুমটাই কাল হলো। চন্দননগর থেকে সকাল আটটা দশের লোকালটার চার নম্বর বগিতে চড়েই আজ অনিলবাবুর মনটা একটু কু ডেকেছিল। বন্ধু সুনীল, মেয়ের বিয়ের জন্য দশ দিন ছুটি নিয়েছে বলে আজ থেকে ও আসবে না। রোজ সুনীলই ওনার জন্য নিজের পাশে একটা সিট রেখে দেয়। সেই সুনীল আজ আসেনি , তবে অবাঙালীদের কি একটা অনুষ্ঠানের জন্য ট্রেন আজ প্রায় ফাঁকা। অনিলবাবু জানালার পাশে একটা সিট খালি দেখে  প্রথমে বসতে ইতস্তত করছিলেন। অফিস টাইমে জানালার ধরে সিট পাওয়া আর লটারি পাওয়া এক ব্যাপার। অবশ্য আজকের দিনটা অন্যদিনের মতো নয়। কামরায় প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। তবুও বসার আগে সিটটা দেখে নিলেন নোংরা কিনা। ছেলে-ছোকরাদের ব্যাপার বলে কথা। অনেকে দুস্টুমি করে সিটটা নোংরা করে উঠে যায় পরের অসুবিধা করার জন্য। পরের অসুবিধায় তারা আনন্দ পায়।
     হাতব্যাগটাতে মোবাইল এবং চশমাটা ঢুকিয়ে, চেনটা টেনে ,ওটা কোলের ওপর রেখে অনিলবাবু একটু আরামে পিঠটা সিটে হেলিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিনের মতো আজ ভিড়ের ঠেলাঠেলি, হকারের উৎপাত কম।কম বয়সীরা মোবাইল দেখতে ব্যস্ত, বাকিরা খবরের কাগজ দেখছে অথবা বাইরে চেয়ে আছে। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া জানালা দিয়ে ঢুকে অনিলবাবুর মুখ, চুল,গাল প্রেমিকার মতো আদর করে দিচ্ছে। সেই আদর খেতে খেতেই চোখ নিজে থেকেই কখন যেন বুজে এসেছিল।
     উনি অফিসের টেবিলে রাখা কম্পিউটারের মনিটরে চোখ রেখে গতকালের মাঝরাত্র পর্য্যন্ত কতগুলো ই টেন্ডার জমা পড়েছে তার হিসেব নিতে থাকলেন। আজ টেন্ডার খোলার দিন। সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অজস্র অনুরোধ, আবদার, প্রলোভন টেলিফোনের মাধ্যমে যে আসবে তা তিনি ভালোই জানেন। তবে সেগুলো কি করে কাটাতে হয় সেটা তিনি এতদিনে রপ্ত করেছেন। মোবাইল ফোনে একটা নম্বর থেকে বার বার ফোন আসছে দেখে ফোনটা ধরতে গিয়ে উনি কেমন যেন একটা ঝটকা খেলেন। ভয়ে অনিলবাবু যেন জেগে উঠলেন। উনি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝতেই পারেননি। লিলুয়া স্টেশনে ট্রেনতা একটু জোরে ব্রেক কষে থামতে ওনার ঘুম ভেঙে গেল। এরপর ট্রেন সোজা হাওড়া গিয়ে থামবে। পাশে দুই মহিলা বসে নিজেদের মধ্যে গল্পে মত্ত। হটাৎ ব্যাগটার দিকে নজর পড়তেই অনিলবাবুর বুকটা ধড়াস করে উঠলো। ব্যাগটা প্রায় পাঁচ ইঞ্চিখানেক ব্লেডে চেরা। তড়িঘড়ি ব্যাগের চেন খুলে দেখেন মোবাইলটা আর চারটে একশো টাকার নোট গায়েব। মেজাজটা সকালেই খিঁচড়ে গেল। এই অফিসে যাবার সময়টাতেই  চুরিটা হতে হলো। চাকরিতে যাতায়াতের পথে ওনার প্রথম মোবাইল চুরি হলো। অবশ্য মোবাইল বছর পনেরো এসেছে। কিন্তু রীতিমতো ব্যাগ কেটে চুরি যাওয়া এই প্রথম। মনটা একটা অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল। আজ অফিসে ঢুকতে দেরি হবে।
     গত বাইশ বছরের চাকরি জীবনে দুদিন উনি দেরিতে অফিসে ঢুকেছিলেন। মায়ের মৃত্যুদিনের পরের দিন প্রায় আধঘন্টা দেরিতে এসেছিলেন। কাছাপরা অনিলবাবুকে দেখে সেদিন  অফিসের লোকজন ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল। অফিসের  বড়বাবু শ্রীকান্ত, যিনি কিনা এত বছর অনিলবাবুর প্রতিটি কাজে সমালোচনা করে এসেছেন উনি পর্যন্ত অবাক হয়েছিলেন। ডেস্প্যাচের সুন্দরী মিনতি তো নিজের কাজলপরা চোখের জল আটকাতে পারেনি।
     দ্বিতীয়বার অফিসের কাজে দিল্লি থেকে ভোরবেলায় হাওড়া ফিরেই উনি আবার চন্দননগর ফিরে গিয়েছিলেন। কোনরকমে জলখাবার খেয়েই লোকালে চড়ে অফিসে আসতে প্রায় ঘন্টাখানেক দেরি হয়েছিল। সেদিন অফিসে না আসলেও চলতো। ওনার সাথে ফেরা ফিরদৌস তো প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিল যে ও সেদিন আর অফিসে আসবে না। দিল্লি থেকে ফিরে ক্লান্ত।অফিসের সাহেবরা কেউ কিছু বলতোও না। এটা ধরে নেওয়া হয় যে এতটা জার্নির পর একদিন রেস্ট নেওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু অনিলবাবু সেসব কোনদিনই মানেন না। 'আরাম হারাম হায়' এটাই উনি মনকে সব সময় বলে চলেন। অফিসে আসার ব্যাপারে উনি খাঁটি ইংরেজ। সময়ের নড়চড় হয় না। অফিস টাইমের পাঁচ মিনিট আগেই ওনাকে ডেস্কে পাওয়া যায়। দারোয়ান রামাবতার অনিলবাবুর আসার সময় নিজের হাতঘড়ি মেলায়।
     হাওড়াতে নেমে অনিলবাবুকে লঞ্চঘাটে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে মোবাইল চুরিটা পুলিশে একটা ডাইরি করা দরকার। চুরি যাওয়া মোবাইলে কেউ কোনো অপরাধ করলে ওনারই মুশকিল। তাছাড়া মোবাইল কোম্পানিকে জানিয়ে সিমটাকে লক করা দরকার। এ সব গুলোর জন্য প্রায় একঘন্টা সময় গেল। উনি তড়িঘড়ি লঞ্চঘাটে দৌড়লেন। টিকিট কেটে জেটিতে পৌঁছে দেখলেন বাবুঘাটের লঞ্চটা চোখের সামনে জল কেটে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। পরেরটা আবার পনেরো মিনিট পরে। অনিলবাবুর মনটা আরো দমে গেল। উনি চিন্তা করতে লাগলেন বড়বাবু শ্রীকান্ত বাঁকা চোখে ওনার অফিসে ঢোকা দেখছেন। পাশের সিটে শীতল ফাইল থেকে মুখ তুলে মুচকি হেসে ওনার দিকে তাকাচ্ছেন। মিনতি ডিস্প্যাচ থেকে হাত নেড়ে জিজ্ঞাসা করছে  "দাদা, বাড়ির খবর সব ভালো তো?"
     হাঁপাতে হাঁপাতে অনিলবাবু যখন অফিসে ঢুকছেন তখন এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। নিজের সিটে বসে দেখলেন বাসুসাহেব কোনো ফাইল পাঠিয়েছেন কিনা। অফিসের টেন্ডারের ফাইলের মূলদায়িত্ব অনিলবাবুর ওপরে। এটা উনি গত সাত বছর ধরে করছেন। বাসুসাহেব নিশ্চিন্ত যে কোনো রকম গড়বড় হবে না। মাঝে অফিসে কম্পিউটার আসাতে ই-টেন্ডার এর কাজ শিখতেই অনিলবাবু দিল্লি গিয়েছিলেন। কম্পিউটারে পুরোপুরি সড়গড় এখনও হতে না পারলেও উনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েই টেন্ডারের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন। একটি কমবয়সী সহযোগীও পেয়েছেন উনি। বড়োবাবুর পর উনিই অফিসের দ্বিতীয় ব্যক্তি  যিনি নিজস্ব কম্পিউটার পেয়েছেন। সাহেবদের ঘরে ঘরে সব কম্পিউটার থাকলেও কমবয়সী দু একজন সাহেব ছাড়া বাকিদের সহযোগীরা সেই কম্পিউটার চালায়, ডিক্টেশন নেয়, ডি টি পি তে প্রিন্ট বার করে। অনিলবাবু এসব কাজ ভালোই জানেন।
     আঙুলের ছাপ দিয়ে কম্পিউটার খুলে উনি দেখলেন নতুন মেশিনের টেন্ডারটা আজ শেষ দিনে সবাই দিয়েছে কিনা। সবে মেইলগুলো চেক করছেন ঠিক তখনই শ্রীকান্ত বললেন
"আজ বাসুসাহেব ঠিক দশটায় আপনার খোঁজ করছিলেন। আপনার সিটের কাছে পর্য্যন্ত চলে এসেছিলেন। যান, গিয়ে দেখা করে নিন। আজ ঝাড় আছে মনে হয় আপনার কপালে।"
     বাসুসাহেব, একাউন্টস বিভাগের সর্বময় কর্তা সাধারণতঃ সকালের দিকে ওনার খোঁজ করেন না। দুপুর তিনটে বা চারটেতে ওনার খোঁজ করেন। তাও রোজ নয়। ওনার অনিলবাবুর ওপর অগাধ বিশ্বাস। কিছু প্রয়োজন হলে অনিলবাবু নিজেই সাহেবের কক্ষে যান। অফিসের আরো তিন চারজন অনিলবাবুর কুশল জিজ্ঞাসা করে বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন 
"স্যার, আপনাকে সাতসকালেই খুঁজছিলেন।"
     মিনতি ওর মোহময়ী হাসি ছড়িয়ে বললো
"অনিলদা, কি হলো দেরি করলেন যে? রোজ সবার আগে আসেন, স্যার খোঁজ করেন না। আজই আপনি দেরি করে এলেন আর আজই সকাল সকাল আপনাকে দরকার পড়লো। আমাদের বলে গেছেন আসামাত্র পাঠিয়ে দিতে।"
     অনিলবাবু মোবাইল হারানোর ঘটনাটা বলতে গিয়েও বললেন না। দেরিতে আসার অজুহাত দেওয়াকে উনি ঘৃণা করেন। মনে মনে বিলক্ষণ জানেন আজ যদি উনি সাহেবের থেকে তির্যক বাক্যবান শোনেন তো এরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। যবে থেকে উনি নিজস্ব কম্পিউটার পেয়েছেন অফিসের বাকিরা কেমন যেন ওনার শত্রু হয়ে গেছে। আরে, উনি কি নিজে থেকে চেয়ে কম্পিউটার নিয়েছেন নাকি? গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ওনাকে দেওয়া হয়েছে এবং সেটা বাসুসাহেবের নির্দেশেই।
     অনিলবাবু নিজের চেয়ারেই চুপ করে বসে রইলেন। মাথার ওপর ফ্যানটা আজ কেমন কোঁচ কোঁচ আওয়াজ করছে। বেয়ারিংটায় বহুদিন গ্রীস দেওয়া হয়নি। মোবাইল হারানোর ঘটনাটা কাউকে না বলা অব্দি মনটা কেমন যেন হালকা হচ্ছে না। এমন সময় অফিসের গেটের চা ওয়ালা ডান হাতে কেটলিভর্তি চা আর বাঁ হাতে একটার ওপর আরেকটা সাজানো মাটির ভাঁড় নিয়ে ঢুকলো। ওর থেকে চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিয়ে প্রথম চুমুক দিয়ে সবে সকালের ঘটনাটা পাশে বসা শীতলকে বলতে শুরু করবেন এমন সময় আরদালি এসে জানালো যে বাসুসাহেব ওনাকে জরুরি তলব করেছেন। অনিলবাবু লক্ষ্য করলেন বড়বাবু শ্রীকান্ত হাতে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে  চুপি চুপি সাহেবের কামরার দিকে কোনো আছিলায় এগিয়ে যাচ্ছেন। যাবার সময় আরো দুজনকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আসলে ওনারা সবাই নিজের চোখের সামনে অনিলবাবুর অপমানিত হওয়া দেখতে চান। অনিলবাবু অপদস্ত হলে ওনাদের কেমন যেন একটা আনন্দ হয়। কোনো ফাঁকিবাজই সৎ ও নিয়মনিষ্ঠ সহকর্মীকে পছন্দ করে না। উপায়ান্তর না দেখে মোবাইল চুরির গল্পটা সাহেবকে কিভাবে উপস্থাপিত করবেন সেটা ভাবতে ভাবতে অনিলবাবু সাহেবের ঘরের দিকে এগোলেন।
     ঘরে ঢুকে দেখেন সেখানে বড়বাবু, শেখর, স্বস্তিক ছাড়াও দুজন অন্য বিভাগের সাহেবও বসে আছেন। বাসুসাহেব ও অন্য দুজন সাহেব চিনামাটির কাপে দুধ-চিনি ছাড়া গ্রীন টিতে চুমুক দিচ্ছেন।
"আরে অনিলবাবু যে, আসুন আসুন। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন। ওই সামনের সিটে মিস্টার মেহতার পাশে বসুন।" সাহেবের কথায় একটু ইতস্তত করে অনিলবাবু পার্সোনাল সেকশনের কর্তা মিস্টার মেহতার পাশের খালি চেয়ারটাতে বসলেন।
"আচ্ছা বড়বাবু, আমার পাশে একটা ঘর অনেকদিন তালাবন্ধ আছে দেখেছি। ওটাতে পুরোনো আসবাব ঢোকানো ছিল। আজই ওটা লোককে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দিন তো। আর ওই ঘরে একটা দেড় টনের এ সি লাগানোর বন্দোবস্ত করুন।" বাসুসাহেব বড়বাবু শ্রীকান্তকে আদেশ দিলেন।
"কেন স্যার, নতুন কোনো সাহেব বদলি হয়ে আমাদের অফিসে আসছেন?" 
"হাঁ। নতুন সাহেবই বটে। আজই ঘরটা টিপটপ করে দিন। কম্পিউটার বসবে। ইলেক্ট্রিক লাইনটাও চেক করতে বলবেন।"
"ওকে স্যার।" বড়বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। বড়োবাবুর যে সব সঙ্গীরা ওনার সাথে ঘরে ঢুকেছিলো তারাও বড়বাবুর দেখাদেখি চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে এগোলেন। অনিলবাবুর হেনস্থা হওয়াটা ওনাদের সামনে না হওয়ায় ওনাদের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।
"দাঁড়ান, দাঁড়ান। কোন সাহেব আসছেন জানতে চাইলেন না তো।" সাহেব হেঁয়ালি করে ওনাদের বেরিয়ে যাওয়া আটকালেন।
বাসুসাহেবের, মেহতাসাহেব এনাদের মুখে রহস্যময় হাসি। অনিলবাবু নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছেন।
"কোন সাহেব স্যার?" দাঁড়ানো অবস্থায় তিনজন একসাথে জিজ্ঞাসা করলেন।
"কোম্পানির ডিরেক্টর ও আমাদের সবাইয়ের সম্মতিতে আজ থেকে সততা ও নিয়মানুবর্তিতার জন্য অনিলবাবুকে অফিসার পদে নিয়োগ করা হলো। আমরাই ওনার নামটা রেকমেন্ড করেছিলাম। উনিই আমার পাশের ঘরে বসবেন। কাল থেকে মিস্টার অনিল চক্রবর্তী সাহেবকেই আপনারা রিপোর্ট করবেন।"
     অনিলবাবু হাঁ হয়ে রইলেন। মোবাইল চুরির ঘটনাটা আর ওনার মাথায় রইলো না।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা