চিন্তাশক্তির পণ্যায়ন ও বুদ্ধিজীবীর দায় - আলী রেজা
মানুষ একমাত্র চিন্তাশীল প্রাণি- মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় বর্তমানে এ কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ইতর প্রাণিদের নিয়ে গবেষণা করে, তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে ইতর প্রাণিদের চিন্তাশক্তি কোন অংশেই কম নয়। সার্কাসের প্রাণিরা যেসব খেলা দেখায় সে সব খেলা দেখে আমরা তাদের বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি অস্বীকার করতে পারি না। মানুষ অন্যান্য প্রাণিদের চিন্তাশক্তিকে বিশেষ উদ্দেশ্যে কাজে লাগায়। বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী করে তাদের চিন্তাকে বাণিজ্যিক করে তোলে। চিন্তা তখন হয়ে যায় পণ্য। যে বানর বিশেষ কৌশলে খেলা দেখাতে পারে না তাকে দেখে কেউ টাকা দেয় না। বানরের মালিকও তাকে দেখিয়ে টাকা দাবি করতে পারে না। কিন্তু যে বানর বিশেষ কৌশলে খেলা দেখায় সে টাকা পায়। কারণ সে সেখানে চিন্তার প্রয়োগ ঘটায়। এখানে বানরের চিন্তাশক্তিকে পণ্য বলতে বাধা নেই। কারণ তা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়। মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় কি? নাকি মানুষের চিন্তাশক্তি ইতরপ্রাণির চিন্তাশক্তির মতোই পণ্য। বিষয়টি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ। মানুষের চিন্তাশক্তি তার অমূল্য সম্পদ। এই শক্তির সঠিক ব্যবহার মানবজাতির জন্য কল্যাণকর। কিন্তু অপব্যবহার মানবজাতির জন্য শুধু অকল্যাণকর নয়, ধ্বংসের কারণও হয়। এই অমূল্য চিন্তাশক্তির মূল্যায়ন করে আসছে যুগে যুগে মানবসমাজ। ব্যক্তিচিন্তার উৎকর্ষ ঘটিয়ে অনেক মানুষ উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছেছে। অনেকে শুধু চিন্তাকেই কাজে লাগান। শারীরিক পরিশ্রম করেন না। তবু তাঁদের উপার্জন কম নয়। চিন্তাশক্তি কাজে লাগানোকে মানসিক শ্রম বলা যায়। কিন্তু চিন্তা বা মানসিক শ্রমকে কি পণ্য বলা যায়?
চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে মানুষ সাধারণত তাঁর বৌদ্ধিক উন্নয়ন ঘটান। একটি নীতি-আদর্শিক সফল জীবন প্রতিষ্ঠা করেন। যাঁদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৌদ্ধিক উন্নয়ন ঘটে তাঁরা সাধারণ মানুষের নীতি-আদর্শিক উন্নয়নের নির্দেশনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বস্তুগত উন্নয়নের পথও বাতলে দেন। এঁদেরকে বুদ্ধিচর্চাকারী বলাই সঙ্গত। যুগে যুগে কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিকগণ বুদ্ধি বা চিন্তাচর্চাকারী হিসেবেই গণ্য ছিলেন। জীবিকার উপায় হিসেবে তাঁদের অন্য কোন পেশা ছিল। এখনো যারা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন তাদেরও জীবিকা অর্জিত হয় অন্য কাজ করে। এই অন্য কাজে যে চিন্তার প্রয়োগ হয় তা ব্যক্তিগত চিন্তাচর্চার আওতায় পড়ে না। ব্যক্তিচিন্তা একটি স্বাধীন মনোজাগতিক বিষয় এবং তা জীবিকার সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই বুদ্ধিজীবী কথাটি শাব্দিক অর্থে সন্তোষজনক নয়। তবু আমি ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটিই ব্যবহার করবো। কারণ শব্দটি এখন এতো বেশি প্রচলিত যে, অন্য কোন শব্দের প্রয়োগে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন। আলোচনাটিও দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে পারে।
বুদ্ধির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে হলে, মানে বুদ্ধিজীবী হতে হলে চিন্তাশক্তিকে জীবিকার উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু জীবিকার উপায় হিসেবে যারা চিন্তাশক্তির প্রয়োগ করেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবী নয়, পেশাজীবী বলা হয় এবং সেটা বলাই সঙ্গত। তাহলে বুদ্ধিজীবী কারা? প্রকৃত অর্থে বুদ্ধিজীবী কেউ না। যাঁদেরকে সাধারণত বুদ্ধিজীবী বলা হয় তাঁরা আসলে বুদ্ধিচর্চাকারী। একজন বুদ্ধিচর্চাকারী তাঁর চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগান মানবজাতির কল্যাণে। চিন্তাশক্তি কোন পণ্য নয়। চিন্তাশক্তি ব্যক্তির শুদ্ধতম চেতনা। এই চেতনা স্বরূপে কাজ করলেই মানবজাতির কল্যাণ হয়। কিন্তু ব্যক্তি যখন তার এই শুদ্ধতম চেতনা বা চিন্তাশক্তিকে ভিন্নরূপে কাজে লাগায় এবং অন্য কিছুর সঙ্গে বিনিময় করে তখন তার চিন্তাশক্তি স্বরূপে থাকে না এবং স্বাভাবিকভাবেই তা বিনিময়যোগ্য পণ্যে পরিণত হয়। প্রশ্ন হলো সমাজ যাঁদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁরা কি তাঁদের এই শুদ্ধতম চেতনা বা চিন্তাশক্তিকে স্বরূপে পরিচালিত করছেন নাকি বিনিময়যোগ্য পণ্য করে তুলেছেন? উত্তরটা খুবই সহজ। আজকাল বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী নিজের চিন্তাশক্তিকে স্বরূপে পরিচালিত করেন না। এর পেছনে কাজ করে বিশেষ স্বার্থ। যে কোন বিষয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু সেই ভিন্নমত পোষণ করার পেছনে যদি থাকে কোন বিশেষ স্বার্থ কিংবা কোন গোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তি তাহলে তাঁর চিন্তাশক্তি পণ্যে পরিণত হয়। আসলে চিন্তাশক্তির পণ্যায়নের মাধ্যমেই একজন বুদ্ধিচর্চাকারী বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হন। চিন্তাশক্তির এই পণ্যায়ন বর্তমানে সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি ধর্মকেও সঠিক গতিপথ থেকে বিচ্যুত করছে।
বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় একজন বুদ্ধিজীবীর ভুমিকা বা দায়-দায়িত্ব কী- সেটাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। আসলে বুদ্ধিজীবীর কোন সুনির্দিষ্ট ভূমিকা বা কাজ নেই। উদ্ভুত কোন সামাজিক সংকটে সমাজপতি থেকে শুরু করে সর্বসাধারণের ভূমিকা কি হবে- সেটা নির্দেশ করে দেওয়াই বুদ্ধিজীবীর প্রধান দায়িত্ব। বর্তমানে বুদ্ধিজীবীগণ এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। বুদ্ধিজীবীগণ তাঁদের চিন্তাশক্তিকে বিভক্ত করে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করছেন। ফলে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী এখন সুবিধাবাদী হিসেবেও গণ্য হচ্ছেন। বুদ্ধিজীবীদের এই দ্বিমুখী আচরণ তাঁদের চিন্তাশক্তিকে পণ্যে পরিণত করছে। বিখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিত নোয়াম চমস্কি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব’ (The Responsibility of Intellectuals) নামে একটি বহুল আলোচিত নিবন্ধ লিখেন। পরবর্তী সময়ে এই নিবন্ধের ওপর মাইকেল এ্যালবার্টের সাথে এক সাক্ষাৎকারে চমস্কি বলেন- ‘যাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে তারা সমাজের একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী। তারা দ্বিমুখী চিন্তার অধিকারী। দ্বিমুখী চিন্তা হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে কেউ সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দুটি চিন্তা একই সাথে ধারণ করে এবং দুটোতেই বিশ্বাস করে।’ পরস্পরবিরোধী দুটি চিন্তা একই সাথে ধারণ করা ও দুটিতেই বিশ্বাস করা কপটতার সামিল। এটা তখনই করা সম্ভব যখন কেউ তার চিন্তাকে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করতে চায়। চিন্তার এই সুবিধাজনক ব্যবহারই চিন্তাশক্তির পণ্যায়ন।
রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই চিন্তাশক্তির পণ্যায়ন ঘটেছে আশঙ্কাজনকভাবে। জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের এখন স্বরূপে চিনে নেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্বিমুখী আচরণের সীমা অতিক্রম করে এখন অনেক বুদ্ধিজীবী বহুমুখী আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ আমলা ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বৌদ্ধিক দিক থেকে নিম্নস্তরের হওয়ার কারণে এসব ভূঁইফোড় রাজনীতিকরা বুদ্ধিজীবীদের সাথে দুরত্ব বজায় রেখে চলে। কিন্তু বাণিজ্যিক বুদ্ধিজীবীরা কোন না কোনভাবে বাণিজ্যিক রাজনীতিকদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে এবং ঘনিষ্ঠ হয়েও যায়। বাণিজ্যিক রাজনীতিকরা তখন বুদ্ধিজীবীর চিন্তাশক্তিকে কিনে নেয় এবং নিজের মতো করে ব্যবহার করে। এক সময় রাজনীতিবিদগণ বুদ্ধিজীবীদের কাছে যেতেন। এখন বুদ্ধিজীবীরাই রাজনীতিবিদদের কাছে যায়। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতিবিদ নয়, যায় রাজনীতিজীবীদের কাছে। বর্তমানে রাজনীতিজীবী কথাটিই যুতসই। অর্থপূর্ণও বটে। কারণ রাজনীতি করে এখন অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকেরই এখন পেশাগত পরিচয় রাজনীতি। যেমন পেশাগত পরিচয় কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, আইনজীবী ইত্যাদি। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রাজনীতিক বা শাসকদের সম্পর্ক মধুর হয় না। তবে যারা তাদের চিন্তাশক্তিকে পণ্যে পরিণত করেন তারা শাসকের সুনজরে থাকেন। শাসক ও বুদ্ধিজীবীর সম্পর্ক বিষয়ে মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদ নিজাম-উল-মুলক তাঁর সিয়াসতনামা গ্রন্থে লিখেছিলেন- ‘তিনিই উত্তম শাসক যিনি বুদ্ধিজীবীর সান্নিধ্যে থাকেন, আর তিনিই নিকৃষ্টতম বুদ্ধিজীবী যিনি শাসকের সান্নিধ্য কামনা করেন।’ বর্তমান সময়ে শাসকের সান্নিধ্য কামনাকারী বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এতে চিন্তাশক্তির পণ্যায়ন আরো গতিশীল হচ্ছে।
চিন্তাশক্তি পণ্যায়নের আর একটি বড় ক্ষেত্র হলো ধর্ম। সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে এখন ধর্মব্যবসায় নেমেছেন অনেকে। এই ব্যবসায়ীদের ধর্মীয় জ্ঞান খুব বেশি নেই। তবে ধর্মীয় অনুভূতি যে ব্যবসার বিষয় হতে পারে- এটা তারা বুঝেছেন ভালভাবেই। ধর্মব্যবসা আসলে ধর্মচিন্তার পণ্যায়ন। ধর্মচিন্তার সাথে সব সময় যে ধর্মীয় অনুভূতি যুক্ত থাকে সেই ধর্মীয় অনুভূতিকেই কাজে লাগায় ধর্মব্যবসায়ীরা। তাই ধর্মচিন্তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি প্রদর্শনের একটি বিষয় জড়িত থাকে। ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত করার উদ্দেশ্য যতি হয় ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করা তাহলে সেই ধর্মচিন্তা মূল বিষয় থেকে সরে আসে। এখানেই ঘটে ধর্মচিন্তার পণ্যায়ন। ধর্মচিন্তাকে যেখানে ব্যবহার করা হয় বাণিজ্যিক স্বার্থে সেখানে ধর্মচিন্তা শুদ্ধতম ধর্মীয় অনুভূতির বাইরে চলে যায়। ধর্মচিন্তার এই পণ্যায়ন ধর্মকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে। চিন্তাশক্তির পণ্যায়নের ফলে মানুষের নৈতিক অবস্থানও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও এই চিন্তাশক্তির পণ্যায়নকে দায়ী করা চলে। নীতি পরিবর্তন সব সময়ই মন্দ নয়। কুনীতি থেকে সরে এসে সুনীতি গ্রহণ করাকে কেউ মন্দ বলবে না। ব্যক্তিচিন্তার পরিবর্তনও কোন আপত্তিকর বিষয় নয়। পূর্বচিন্তা ভুল প্রমাণিত হলে নতুনভাবে চিন্তা করাই উচিৎ। চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মনোভাব প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু কখন, কোন পরিস্থিতিতে ব্যক্তিচিন্তার পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য সেটা বিবেচনা করা জরুরি।
একজন বুদ্ধিজীবী কখন তাঁর চিন্তার পরিবর্তন করবেন- এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ব্যক্তিচিন্তার বিকাশ কিংবা বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটলে একজন বুদ্ধিজীবী চিন্তার পরিবর্তন করতে পারেন। পরিবর্তিত চিন্তা মানবকল্যাণে আরো বেশি কাজে লাগবে মনে করলে একজন বুদ্ধিজীবী তাঁর চিন্তার পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা কোন কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি তাঁর চিন্তার পরিবর্তন করতে পারেন না। এ ধরণের পরিবর্তন শুধু নীতিবিরুদ্ধই নয়, সর্বসাধারণের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। একজন বুদ্ধিজীবীর দায় ব্যক্তির কাছেও আছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছেও আছে। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে একজন বুদ্ধিজীবী বেশি দায়বদ্ধ। কারণ, বুদ্ধিজীবীকে ক্ষুদ্র স্বার্থ নয়, বৃহত্তর স্বার্থ দেখতে হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের সংকটকালে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হয়। এটা করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীকে নির্মোহ থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে নির্মোহ থাকাই তাঁর প্রধান দায়িত্ব। দার্শনিক প্লেটো তাঁর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে তিনটি শ্রেণির লোকের কথা বলেছেন। শ্রেণি তিনটি হলো উৎপাদক শ্রেণি, সৈনিক বা যোদ্ধা শ্রেণি এবং দার্শনিক শ্রেণি। আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিক শ্রেণিই শাসক শ্রেণি। প্লেটো বুদ্ধিজীবী নামে কোন আলাদা শ্রেণির কথা বলেননি। আসলে বুদ্ধিজীবী বলতে কোন আলাদা শ্রেণি হয় না। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেই এমন কিছু মানুষ আছে যাঁরা বুদ্ধিজীবীর পর্যায়ভুক্ত। একটি রাষ্ট্র বা সমাজকে সমৃদ্ধ করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন যোগ্য একটি শিক্ষক শ্রেণি। এই শিক্ষক শ্রেণিই রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে গড়ে তুলবেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণেই একটি সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার এই শ্রেণিটি ছাড়াও আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি হলো সাংস্কৃতিক কর্মী। সাংষ্কৃতিক কর্মীরা দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনধারা সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকর্মের মাধ্যমে সারাবিশ্বে তুলে ধরেন। এই সাংস্কৃতিক শ্রেণি যে কোন সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি। শিক্ষক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কর্র্মীদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি হয় আর একটি শ্রেণি যাঁরা সুশীল সমাজ নামে পরিচিত। এই সুশীল সমাজ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার বৌদ্ধিক জ্বালানি সরবরাহ করেন। তাই সুশীল সমাজকে বুদ্ধিজীবী বলে সমীহ করা হয়। হালে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়া অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অমার্জিত। অতীতেও বুদ্ধিজীবীগণ সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে আপোষ করে চলতেন। তবে সেটা খুব বেশি নগ্নরূপে নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজস্ব চিন্তার সাথে আপোষ না করার জন্য বুদ্ধিজীবীগণ নির্যাতিত হতেন। অনেকক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিতেন। সক্রেটিস থেকে শুরু করে এ যুগের হুমায়ুন আজাদ পর্যন্ত অনেকেই জীবন দিয়েছেন। কিন্তু নিজস্ব চিন্তার সাথে আপোষ করে আত্মস্বার্থে চিন্তাকে পণ্যে পরিণত করেননি। কিন্তু এখন উল্টোচিত্রই চোখে পড়ে বেশি। পদপ্রাপ্তির প্রত্যাশা, স্বীকৃতি ও আর্থিক লোভের বশবতী হয়ে একজন বুদ্ধিজীবী এখন তাঁর চিন্তাকে ঘাটে ঘাটে ফেরি করেন। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হন। বাজার অর্থনীতির হাওয়ায় উথলে ওঠা পণ্যায়নের এই ঢেউয়ে বুদ্ধিজীবীগণ অন্তত তাঁদের চিন্তাকে পণ্যে পরিণত করবেন না- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
আলী রেজা
প্রাবন্ধিক, সাহিত্যচিন্তক
টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ
-
নিবন্ধ // মতামত
-
27-08-2021
-
-