অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
কথামৃত অলকানন্দা নদী ও ফুল - লাবণ্য কান্তা

লকানন্দা নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার ঐশ্বর্যের কথা অর্থাৎ অলকানন্দা নামের সাথে ধনকুবেরে অলকাপুরীর কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনোভাবে যোগ সংযোগ রয়েছে, মূলত  সেই কারণেই নদীটির নাম অলকা হয়েছে। ভাই রাবণের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে কুবের অলকাপুরীতে তাঁর রাজত্ব স্থাপন করেন। কুবেরের সেই অলকাপুরীর বাঁকে হিমালয়ের পাহাড়চূড়া ‘সতোপন্থ’ হিমবাহ থেকে উদগম হয় অলকানন্দার একটি ধারা। অন্য ধারা্টি ভাগীরথী হিমবাহ থেকে উৎসারিত হয়ে দুটি ধারার মিলিত রূপই অলকানন্দা নাম ধারণ করে শতাধিক কিলোমিটার বন্ধুর নদীপথ পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে দেবপ্রয়াগে এসে মিলিত হয়েছে। অলকানন্দার ধারাতে পাঁচটি নদীর ধারা মিলিত হয়েছে। প্রবাহিত ধারা হিসেবে উত্তরাখন্ডের সব থেকে বড় নদী অলকানন্দাই। হিমালয়ের গাড়োয়ালে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অলকানন্দার সাথে মিলিত হয়ে  ‘পঞ্চপ্রয়াগ’ নাম শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার করেছে।

সত্যি মনে প্রশ্ন জাগে ‘প্রয়াগ’ কি? 

সাধারণভাবে বলা যায় দুটি নদীর সঙ্গমস্থলকে ‘প্রয়াগ’ মানা হয়। নদীর এমন মিলনস্থলের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি রোমাঞ্চকর। অদ্ভূত সুন্দর শিলাখন্ড বিছিয়ে রেখেছে তার পাথুরে অঞ্চল, খুব বেশি সময় সেসব শিলাখন্ডের দিকে তাকানো যায় না। মনে ভীতি সঞ্চার হয়। আর পাহাড়ের ধার ঘেঁষে কেবল পাথর আর পাথর, তবুও অসীম অফুরান বৃক্ষরাজি তার শ্যামলীমায়ার ছায়ায় নিবিড় নীরবতার সঙ্গীত বাজায় অনুক্ষণ। অলকানন্দার প্রবাহিত জলরাশি যে প্রয়াগগুলোর ইন্দ্রজাল রচেছে তার মধ্যে        ‘বিষ্ণুপ্রয়াগ’ প্রথম প্রয়াগ। এখানে ধৌলীগঙ্গা এসে অলকানন্দার সাথে মিলিত হয়েছে। প্রয়াগস্থানে দুইধারে কেবল নদীর বয়ে চলার ছন্দ কিংবা গর্জন ব্যতীত অন্য সবকিছুই বিমূর্ত। এই প্রয়াগে ধৌলীগঙ্গার জলরাশি এসে মিলিত হয়েছে অলকানন্দার জলের সাথে যার অপরূপ রূপ ঠিকরে পড়ে আশেপাশে পাহাড় থেকে পাহাড়ে, বৃক্ষ থেকে বৃক্ষে, মানুষ থেকে মানুষে। … 
‘নন্দপ্রয়াগ’ _ হিমালয়ের নন্দা পর্বত থেকে নন্দাকিনী নদীর প্রবাহিত জলধারা এসে অলকানন্দার সাথে মিলিত হয়েছে নন্দপ্রয়াগে। প্রয়াগ শব্দটি-ই যেন শৈল্পিক উপাদানে পূর্ণ। প্রতিটি প্রয়াগের এমন শৈল্পিক রুপ এঁকেছে প্রকৃতি আপন হাতে যার অদ্ভূত রূপশ্রীর মাঝে অলকার চরণধ্বনির যে ঝঙ্কার তার তুলনা কিংবা উপমার যোগ্য আর দ্বিতীয় কিছুটি নেই এই রহস্যাবৃত পৃথিবীতে। সেই সৌন্দর্য এবং অলকার সেই বয়ে চলার মহাকায় রুদ্রাণীর গতির কাছে মাত্র কিছুসময় টিকে থাকা যায়; মনে হয় চারদিকের ঘরবাড়ি, পাহাড় পর্বত, মন্দির, ধর্মশালা সবকিছু চূর্ণ করে নিয়ে যাবে বুঝি! সেখানে মানুষের কাছে নিজের অস্তিত্বকে একটুকরো শুকনো কাঠের মত মনে হয়, কিঞ্চিৎ অসাবধানতায় ঘটে  যেতে পারে নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবার মত অঘটন। এইখানে এসে কীভাবে জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবক এসে জুড়ে নিয়েছে কিছুটা স্থান __ 
“থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।”

‘কর্ণপ্রয়াগ’ __ পিণ্ডারি নদীর জলস্রোতও এসে মিলিত হয়েছে কর্ণপ্রয়াগে অলকানন্দার সাথে এবং সেখানেও একটি প্রয়াগের সৃষ্টি হয়েছে। পিন্ডারি নদীও হিমালয়ের পর্বতের হিমবাহ থেকেই শুরু হয়ে প্রবাহিত হয়ে এসেছে কর্ণপ্রয়াগে। ‘কর্ণ’নামটি মহাকাব্য ‘মহাভারত’ এর এমন একটি বিশেষ  চরিত্রের নাম যার নামের সাথে প্রসিদ্ধ সুবচন ঘরে ঘরে প্রচলিত রয়েছে। জানা যায়, কর্ণ হিমালয়ের এই স্থানেই, এই অলকানন্দার তীরেই কঠিন তপস্যা করে সূর্যদেবের কাছ থেকে ‘কবচকুন্ডল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সেইজন্যই এই প্রয়াগের নাম কর্ণপ্রয়াগ হয়েছে। কর্ণ সূর্যদেবেরই পুত্র,তাই তিনি প্রভাতে এবং সন্ধ্যায় সূর্যদেবেরই বন্দনা করতেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধচলাকালীন সময়ে দেবী কুন্তী একবার গিয়েছিলেন পুত্র কর্ণের কাছে শেষ মিনতি করতে, তখন সন্ধ্যা এসেছে নেমে যেন অলকার তীরে পুত্র কর্ণ তখন বন্দনারত এই মুহূর্তটিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর “কর্ণকুন্তী সংবাদ” নামক কবিতায় বলছেন, __
“পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার
বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার,
অধিরথসূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত
সেই আমি __ কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ!”

‘রুদ্রপ্রয়াগ’ __ অধিকাংশ নদ-নদীর উৎস হিমালয়ের সরোবর,ঝরণা, হিমবাহ থেকেই। রুদ্রপ্রয়াগে এসে অলকানন্দার সাথে মিলিত হয়েছে যে নদীটি, সে মন্দাকিনী এবং মন্দাকিনীর জলের যে ধারাটি তার উৎসস্থান হিমালয়ের কেদার পর্বত থেকে। কেদারনাথ পর্বতগাত্র থেকে প্রবাহিতা মন্দাকিনী অফুরান জলরাশি নিয়ে এসে রুদ্রপ্রয়াগে অস্তিত্ব বিলীন করেছে এই প্রয়াগে এবং রুদ্রপ্রয়াগের সৌন্দর্যকে অনন্যমাত্রা দিয়েছে। মন্দাকিনীকে স্বর্গের নদী বলা হয়। অলকা এবং মন্দাকিনীর মিলনস্থল রুদ্রপ্রয়াগ নাম কেন হলো? রবীন্দ্রনাথ বলছেন, __
“প্রলয়পিণাক তুলি করে ধরিলেন শূলী
পদতলে জগৎ চাপিয়া,
জগতের আদি-অন্ত থরথর থরথর
উঠিল কাঁপিয়া।” 
এখানে অনন্ত রুদ্রের কথা বলা হয়েছে। অনন্ত রুদ্র হিমালয়ের এই স্থানেই রুদ্ররূপ ধারণ করেছিলেন তাই এই প্রয়াগের নাম রুদ্রপ্রয়াগ হয়েছে।

‘দেবপ্রয়াগ’ __ অলকানন্দার জলের ধারায় যে পঞ্চগঙ্গার জল হিমালয়ের আলাদা আলাদা স্থানে মিলনস্থল আলাদা আলাদা প্রয়াগ রচনা করেছে তার মধ্যে দেবপ্রয়াগ-ই সর্বশেষ প্রয়াগ; যেখানে অলকা তার অস্তিত্ব বিলীন করেছে ভাগীরথীর জলে।অলকার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার শুরু এবং শেষ হিমালয়েই হয়েছে। সমতলে সে অনস্তিত্বে বিরাজিতা। দেবপ্রয়াগেই অলকা গঙ্গা নাম ধারণ করেছে ভাগীরথীর জলের সাথে এবং গঙ্গার নাম এই প্রয়াগ থেকেই শুরু হয়েছে; যদিও গঙ্গার উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের গঙ্গোত্রী পর্বতের হিমবাহে।সেখান থেকে ভাগীরথী নদী এসে মিলিত হয়েছে দেবপ্রয়াগে এবং  এখানেই ভাগীরথী এবং অলকানন্দার জলধারা গঙ্গা নাম ধারণ করে ভারতবর্ষ তার পরিক্রমা শেষে বঙ্গপোসাগরে পতিত হয়েছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারত তীর্থ’ কবিতায় বলেছেন, __
“ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর, নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।” 
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির পর নদী কিংবা অলকার কথা আর কিছু বলার থাকে না। কিছু কথা এবার অলকানন্দা ফুলের, সেটিও রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া কিছু বলা প্রায়ই অসম্ভব আশ্চর্য এই যে রবীন্দ্রনাথ না হলে এমন অনেক কিছুর নতুন নাম হতো না! হোক সে ফুল-আলয় কিংবা বিখ্যাত কোনো ব্যক্তিত্বের নাম। যে প্রসঙ্গই আসুক রবীন্দ্রনাথ যেন তার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকেন। তেমনি অলকানন্দা নদী ও ফুলের কাছেও তিনি বৃষ্টির মতো চলে এসেছেন নিজের মহিমা ছড়াতে। জানা যায় অলকানন্দা ফুলের নাম রবীন্দ্রনাথেরই দেয়া। অলকানন্দার ইংরেজি নাম রয়েছে, বৈজ্ঞানিক নাম রয়েছে কিন্তু বাংলা নামটা কোথায় পেতাম আমরা! যদি রবীন্দ্রনাথ না রেখে যেতেন তার বাংলা নাম! এমন অনেককিছুই নামবিহীন থেকে যেতো যদি রবীন্দ্রনাথ না হতেন। অলকানন্দা নামটি ফুলের সাথে কীভাবে যে এত সার্থক হয়েছে তা রবীন্দ্রনাথেরই জানা। এ ফুলের নাম রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন কেবল এটুকুই পরম আশ্চর্যের কাছে নিয়ে যায়, কৌ্তুহলী করে অনেক। 

এ ফুলের স্বর্ণালিশোভা দৃষ্টিকে নন্দিত করে, মনে অপার প্রশান্তি বিলায়, আনন্দ দান করে, কয়েকঘন্টা বসে থাকা যায় তার মনমোহক অপূর্ব আলোকচ্ছটার কাছে।দিনের শেষে ঠিক গোধূলিবেলায় অলকার নীরবতার আলোকদ্যুতির যে মায়া তার কোনো উপমা হয় না যেমন হয়নি অলকানন্দা নদীর বয়ে চলার কোনো উপমা। তাইতো বলা যায় __
সকালের শুভ্রতায় অলকানন্দা
শরতের রূপময়তায় অলকানন্দা। 
নদী ও ফুলের নামে সে এমনি
যেমন নদীর ধারা তেমনি ফুলের মায়া।
সত্যিই এই নদী এই ফুলের রুপময়তার ছন্দময়তার অশেষ বর্ণচ্ছটার অতুলনীয়। সুরভিহীন অলকানন্দা তবুও সুরভি ছড়ায় যেন দিনশেষে সে সৌরভ অস্তরাগে মিশে যায়। 

লকানন্দা গাছের আজ প্রথম প্রস্ফুটন,
কী যে ভালোলাগা! 
কী যে মায়াময়তা, কী যে আকুলতা।
নতুন একটা দিন আসে, নতুন সুর্যের উদিত কিরণরশ্মি দেখে; 
কিন্তু আজ ভুলে গিয়েছিলাম সে কথা।
আজ নতুন অলকানন্দা দিয়েছে নতুন দিনের
নতুন আশা, অনাবিল আনন্দরাশি __
সম্পূর্ণ একটি অন্যরকম চঞ্চলতা,
তার কাঁচা সোনালি রংটা থেকে ঝরছে কেবল স্বর্ণ আভা; 
দুহাত ভরে গেছে আজ তারই অশেষ দানে।
শরতের প্রথম রেশ, নীলগগনে ভাসে টুকরো টুকরো মেঘ
নীল-নীলাঞ্জনার সাথে অলকার কথা হয় বিনিময়।
মেঘদল থমকে দাঁড়ায় অলকার কথায়
ছায়া পড়ে তার সোনালি আভায় মায়াময় বিকেলবেলায়।
সকালের রেখা মিশে যায় দিনের বেলায়
আমি হারায়ে গেছি অলকার হাসিখেলায়।
দিনে দিনে বেড়ে যাবে তার কাছে ঋণ,
লবো আমি তার পুষ্পের দান কি যে দেবো তাকে হায়! 

সত্যি দিনে দিনে প্রতিদিনে, প্রতিটি মুহূর্তে তার দানের ঋণ বাড়ছে। প্রথমদিনে সে দিয়েছে একটি ফুল, তার পরদিন দুটি, তার পরদিন তিনটি, তার পরদিন চারটি; এইভাবে কতদিন যাবে … সে শুধু দুহাত ভরাবে। এ দুহাতে যেন অলকার স্বর্ণালি-সুবর্ণরেখা আঁকা।


লাবণ্য কান্তা। বাংলাদেশ