অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
দুর্গোৎসব ও সামাজিক কল্যাণ - লাবণ্য কান্তা

   দুর্গাপুজো এখন আর শুধু বৈদিক মন্ত্র পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যেহেতু দুর্গাপুজো সর্বজনীন তাই বর্তমান পুজো পদ্ধতিতে প্রতিবছর নানা নতুন চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে এই উৎসবকে আরো বেশি  সার্বজনীন করে তোলার প্রবণতা বেড়েই চলছে। সারা বিশ্বেই এই দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে। মূলত দুর্গোৎসব বিচিত্র রূপে-রসে- রঙে বর্ণিল। এই পুজোতে যেসব সামগ্রীর  প্রয়োজন হয়ে থাকে, তা একা একজন ব্যক্তির পক্ষে এই পুজোর ব্যয়ভার বহন করে পুজোকে সার্থক করে তোলা কঠিনই শুধু নয় বরং অসম্ভবও হয়ে পড়ে, তাই এই পুজো সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় হয়ে থাকে। এই পুজোতে  যে শ্রমের প্রয়োজন, যে অর্থের প্রয়োজন, যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন তা মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারাই সম্পন্ন করা সম্ভব, তাই মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতি বছর শরৎকালে পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষদের নামে তিল-তর্পণাঞ্জলি অর্পণ করে মহালয়ার দিন দেবীপক্ষে দেবী দুর্গাকে আহ্বান করা হয়। এই পুজো শরৎকালে হয়ে থাকে তাই এই পুজোকে ‘শারদীয়া দুর্গোৎসব’ বলা হয়। বসন্তকালেও দুর্গাপুজো হয়ে থাকে এবং সেই পুজোকে ‘বাসন্তী পুজো’ বলা হয়। বাসন্তী পুজোতে এতটা আড়ম্বর হয় না যতটা শারদীয়া দুর্গাপুজোতে হয়ে থাকে।
     শারদীয়া দুর্গাপুজোতে অকালবোধন করে তবেই পুজা আরম্ভ হয়ে থাকে। দুর্গাপুজো মূলত বসন্তকালেই হয়ে থাকে, কালের পরিক্রমায় শারদীয়া দুর্গাপুজোই সার্বজনীন রূপ নিয়েছে, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণের কোনোরকম ভেদাভেদ না রেখে আনন্দচিত্তে নির্বিশেষে সবাই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিতে পারে। 
তাই তো কবি কাজী নজরুল বলতে পেরেছেন, __  
“এবার নবীন মন্ত্রে হবে জননী তোর উদবোধন
নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে হবে না তোর বিসর্জন।
সকল জাতির পুরুষ নারীর প্রাণ,
সেই হবে তোর পূজা-বেদী, মা, তোর পীঠস্থান। 
সেথা রইবে নাকো ছোঁয়া-ছুঁয়ি, উচ্চ নীচের ভেদ;
সবাই মিলে উচ্চারিব মাতৃ মন্ত্রের বেদ।” 
     বিশ্ব নারীসত্তার মূর্তরূপ দেবীদুর্গা। বিভিন্ন পুরাণাদিতে দুর্গাপুজোর উল্লেখ রয়েছে। সত্যযুগে রাজা সুরথ, ত্রেতাযুগে রাম, দ্বাপরে যুধিষ্ঠির এবং কলিকালে অনেক সাধকগণ এই আরাধ্যা দেবীর আরাধনা –সাধনা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, ভবা পাগলাসহ আরো অনেক সাধকগণ… 
রামপ্রসাদীতে সাধক বলছেন, __
“আমি অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি/আর কী যমের ভয় রেখেছি।/
কালীনাম কল্পতরু হৃদয়ে রোপণ করেছি/”
আর কমলাকান্ত বলছেন, __ 
“যেরূপে যে জনা করো এ ভাবনা,/ সেইরূপে তার মানসে রয়/
কমলাকান্তের হৃদি সরোবরে,/ কমলমাঝারে হয় উদয়/”
এবং সাধক ভবা পাগলা যাঁর নাম ভবেন্দ্র মোহন, তিনি মাতৃসাধনা আর সঙ্গীত সাধনায় আনন্দচিত্ত আর মগ্নচিত্তে নিজের নামটাই বদলে ফেললেন; নিজেকে ভবা বলে উৎসর্গ করে গেলেন।সেই তিনি, সেই ভবা পাগলা বলছেন, __
“তুমি পাপ তুমি পুণ্য, সকলি তোমারি দান,
আসন পেতেছি ঠাকুর, মহামানবে প্রাণ, 
খেলিছো পুতুলখেলা হাসে তাই ভবা পাগলা।
পরমে পরম জানিয়া, এসেছি হেথায় তোমারি আজ্ঞায়,
আদেশ করিবা মাত্র যাবো চলিয়া, পরমে পরম জানিয়া।”
সেই ভবাই আবার বলছেন, __
বড় সাধ হয়েছে দেবো জবা,/ তোর ওই দুটি রাঙা চরণে।/
রাঙা পায়ে রাঙা জবা, তুলেছি মা বনের জবা/ রাঙা পায়ে হবে শোভা/
ছড়িয়ে যাবে রাঙা আভা, তোর ওই বিশ্বভূবনে/ তুই যদি মা ইচ্ছা করে ফেলে ফেলিস এই অভাগারে/ আমি ভুল করেছি জবা ছিঁড়ে, আর যাবোনা হুলোবনে/
তোর ওই চরণ পাওয়ার লাগি/শিব হয়েছে মহাযোগী/
আমি যে মা বিষয়ভোগী, ভাগ্যশূন্য জানিনা মনে/” 
এই মহামায়ার চরণ পাওয়ার জন্য শিব হয়েছেন যেমন মহাযোগী, তেমনি সেই শিবকে পাওয়ার জন্য পার্বতী হলেন ‘ঊমা’।পার্বতী থেকে ঊমা হতে কি সাধনা করেছিলেন তিনি?
পার্বতীকে তাই সাধনার বলে, তপের ফলে, ভক্তির যোগে, চিত্তের মোহে এবং শিবশক্তির আকর্ষণের ফলে তাঁকে পঞ্চতত্ত্বকে অতিক্রম করতে হয়েছে। মৃত্তিকা-জল-অগ্নি-বায়ূ-নভঃ এই তত্ত্বকে অতিক্রম করে পার্বতী হয়েছেন ঊমা। 
মহাযোগী না হলে শিব পাবেন না মহামায়াকে আর ঊমা না হলে পার্বতী পাবেন না শিবকে; এইযে পরমে পরম পাওয়ার অবিরাম ভাঙা-গড়া, তার সাথে মানবজীবনেরও ভাঙাগড়ার পক্রিয়া চলে, তাই “শিবই জীব এবং জীবই শিব” শাস্ত্রজ্ঞজন বলেন। 
     এই সেই মহামায়া। তাঁর পুজোর বিভিন্ন নিয়ম-মন্ত্র-তন্ত্র-অন্নব্যঞ্জন- পুষ্প-পত্র- দীপ-ধূপ কতকিছুর যে আয়োজন, প্রয়োজন, তা অতি আশ্চর্য জাগায় মনে। তেমনি একটি আশ্চর্য আচার হলো দেবীর স্নান। এই স্নান হলো দুর্গাপুজোর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। দেবীর এই স্নানীয় অনুষ্ঠানকে বলা হয় মহাস্নান। এই পুজোর আয়োজন শুরু হয় শরৎকালের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীপুজোর অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে। সপ্তমী পুজোর দিন নবপত্রিকার স্নানের পর দেবীর এই মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মূলত দুর্গা প্রতিমার সামনে দর্পণের মধ্যে প্রতিমার প্রতিবিম্বকে স্নান করানো হয়।
এই মহাস্নানের উপকরণগুলো কি?
     কৌতুহলী মনের জন্য এই প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে। জেনে নেয়া যাক সেসব উপকরণগুলোর নাম __ শুদ্ধজল, নদীর জল, গঙ্গাজল, শঙ্খজল, উষ্ণজল, পঞ্চগব্য, সুগন্ধিজল, কুশঘাস দ্বারা ছিটানো  জল, পুষ্প দ্বারা ছিটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারিকেলের জল, তিল তেল,আখের রস, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, সর্বহারাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুইতীরের মৃত্তিকা, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের র্মৃত্তিকা, সাগরের জল,ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টির জল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল এবং ঝরণার জল।
     দেবী দুর্গার এই মহাস্নান ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে সমাজের কৃষি সম্পদ, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, প্রাণীজ সম্পদ, ভূমিজ সম্পদ প্রভৃতি রক্ষার জন্য সাধারণ মানসে আলোকপাত করা হয়। এই স্নানীয় ক্রিয়াগুলোর মধ্যেই সমাজের চাষা-ভূষা, মুচি-মেথর থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ-মালী-তন্তুবায়- কুম্ভকার-নরসুন্দর-ঋষি-দাস সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্বের সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমণ্বয়বার্তা প্রেরণ করে এবং সামাজের কল্যাণের চিন্তা চেতনা ফুটে ওঠে। 
     পাঁচদিন ব্যাপী এই দুর্গোৎসবে রাষ্ট্রের সকল শ্রেণির মানুষের পদধ্বনিতে মুখর থাকে পুজোর মন্ডপ। পুজো শেষে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের মধ্যেও বিশ্ব মানবতার কল্যাণ কামনা করা হয় এবং সেইসাথে আর্ত-পিড়ীত মানুষের মাঝে সুস্বাদু অন্নব্যঞ্জনসহ ফলমুল বিতরণ করা হয়ে থাকে। দরিদ্রজনের হাতে বস্ত্র  বিতরণসহ নানারকম কল্যাণমূলক কর্ম সম্পাদিত হয়ে থাকে এই বিশেষ উৎসবটিকে ঘিরে। মানুষে  মানুষে মিলন হয়, দেখা সাক্ষাত হয়, মনের আনন্দে সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে আত্নিক মেলবন্ধন সৃষ্টির একটি যোগসূত্র তৈ্রি হয়। পুজো উপলক্ষে প্রতিমা নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভাস্কর্যশিল্পের ঐতিহ্য-বিকাশ এবং আধুনিকতার প্রকাশ ঘটে থাকে।ঢাক-কাঁসর-শঙ্খ এসবও ঐতিহ্য, তারও বিকাশ ঘটে মূলত এই ঐতিহ্যবাহী পুজোর আয়োজনের মধ্য দিয়ে। পুজো উদযাপনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানারকম স্মরণিকা প্রকাশ করে, এসব স্মরণিকা প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য চর্চার পথ সুগম হয় এবং নতুন সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চার একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। মন্ডপে মন্ডপে বিভিন্নরকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠান, আবৃত্তি, সেখানে শিল্পীদেরকে কাছে থেকে দেখার এবং তাঁদের গান-গল্প-কথা-কবিতা শোনার ও দেখার সাধারণ জনগণেরও সুযোগ তৈ্রি হয়। বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণিজনের বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়। এতে করে  পুজোর দিনগুলোতে মানুষের বিনোদনের ঘাটতি পুরণ হয়। এখন এই শারদীয়া সার্বজনীন দুর্গোৎসব একটি মিলনমেলা। তাই শারদীয়া দুর্গাপুজো আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাৎপর্য ভূমিকা পালন করে। সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে প্রেরণার এক অনিঃশেষ উৎস।
     আমাদের এই দেশ ষড়ঋতুর দেশ। এখানে খরা-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়, মহামারীসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। এমন দুর্যোগের সময় কখনো কখনো ক্ষেত্রবিশেষে এবং বিশেষ প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন পুজো কমিটির সিদ্ধান্তে তখন পুজোর সমস্তরকম আড়ম্বর পরিহার করে,প্রতিকী পুজো বা ঘটপুজো অথবা খুব সাধারণ পুজোর আয়োজন করে থাকেন এবং পুজোর জন্য ধার্য্য অর্থ মানবকল্যাণের জন্য দান করে থাকেন। তাই এই শারদীয়া সার্বজনীন দুর্গোৎসবকে জনকল্যাণের উৎসও বলা যেতে পারে।  
     শরৎকাল মানেই মানুষের মনে দোলা দিয়ে ওঠে শারদীয়া এই এক উৎসবের নাম। দেবীর আগমনের জন্য প্রকৃতি অপরূপ সাজে সাজিয়ে নেয় নিজেকে। নদীর কিনারায় কাশফুলের সমারোহ আগাম বার্তা নিয়ে আসে, রাতের ঝরা শিউলি ফুল গ্রামের মেঠোপথে সুরভি বিলায়, পাখিরা কলকাকলিতে সরব হয়ে ওঠে, ভোরের শিশির দুর্বাদলের ওপর তার সৌন্দর্য ছড়া্য়। প্রকৃতির এই নীরব আয়োজনের সবটুকুই যেন দেবীর আগমনী বার্তা জানায়। তাঁর আগমনে পৃথিবীর সমস্ত আসুরিক শক্তির বিনাশ হয়ে পুনরায় শান্তি স্থাপন হয় এমনি ভক্তকুলের মনে আশা জাগানিয়া আশা জেগে থাকে। এইজন্য দুর্গা দেবীকে দুর্গতিনাশিনী বলা হয়ে থাকে। কৈ্লাশ শিখর থেকে তিনি আসেন প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে,  মুলত আমরা দেখি এই দুর্গোপুজোতে বিবাহিতা মেয়েরা বাবার বাড়িতে যায় তার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে, তেমনি দুর্গাদেবীও সপরিবারে শরৎকালে আসেন ঘরে ঘরে এবং বিজয়ার দিন তিনি ফিরে যান পুনরায় কৈ্লাশে। তাঁর চলে যাওয়ার পর বিবাহিতা সেসব মেয়েরা পুনরায় চলে যায় শ্বশুরবাড়িতে। দেবী দুর্গার এই আসা যাওয়ার মাঝে নারীশক্তিতে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়। নারীরা নতুন শক্তিতে পুনরায় জেগে ওঠে এবং সমাজের নতুন দিন, নতুন আলো, নতুন গান, নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। 
     দুর্গা আমাদের মা-বোন-স্ত্রী-কন্যারাই, তারাই যুগে যুগে সংসার-সমাজের শক্তিরুপে বিরাজিতা মহাশক্তি, সৃষ্টির রচনার সূত্র নিজ অস্তিত্বে ধারণ করে নতুন প্রাণের সৃষ্টি করে। নতুন প্রাণ, নতুন গান, নতুন সমাজ, পরিবর্তনের ধারার এক প্রবল স্রোত এই মহামায়া শক্তি।
     তাইতো শারদীয়া বিকেলে উত্তরের হাওয়ায় কাশের বনে ঢেউ খেলে, ধানের খেতের সবুজে চোখ একেবারে ডুবে যায়, শিউলিগাছ থেকে শিউলিফুল নিঝুম রাতেরবেলায় মিষ্টি সুরভি বিলায়…   আকাশ-বাতাস থেকে যেন পুজোর গন্ধ ভেসে আসে, মন হারায় অতীতের হারিয়ে যাওয়া দিনের মাঝে, হাসিখেলার রঙের মাঝে আর জন্ম-মৃত্যুর সকল দুঃখ-সুখ মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

লাবণ্য কান্তা। বাংলাদেশ