অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
লাম - চিরঞ্জীব সরকার

     লাম ছ-সাত বছরের একটি ছোট ছেলে। সাউথ সুদানের গৃহযুদ্ধ শুরুর পর ওদের পরিবারটি কেনিয়ার নাইরোবীতে চলে আসে। আমরা নাইরোবীর যে কলোনীর ভিতর থাকতাম লামরাও সেখানের একটি ফ্লাটে এসে উঠে। তাদের পরিবারটি বেশ বড়। অন্তত মা বাবাসহ পনেরজন হবেই। একটা ফ্লাটে ঠাসাঠাসি করে থাকত। লামের চেয়েও ছোট আরও দুটো বাচ্চা ছিল তাঁদের। অর্থাৎ লামেরা বার তের ভাইবোন হবে। আমাদের কলোনিটি বেশ বড় ছিল। শনি রবিবার অফিস বন্ধের দিন আমি কলোনীর চারপাশে হাঁটাহাঁটি করতাম। নাইরোবীতে রাস্তাঘাটে বিদেশীদের বিশেষ করে এশিয়ানদের বেশ সতর্কতার সাথে চলতে হয়। স্থানীয় আফ্রিকানদের ধারনা এশিয়ানদের হাতে অনেক টাকা। এর বেশ কিছুটা সত্যতাও আছে। ইংরেজ আমলে এখানে আসা গুজরাটীরা মূলতঃ আফ্রিকার ব্যাবসা বানিজ্য নিয়ন্ত্রন করত। এদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসলেও ব্যাবসা বানিজ্যের একটা বড় অংশ এখনও তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই এশিয়ানরা একটু অসতর্কতার সাথে পথ চললে ছিনতাইকারীদের হাতে পড়ার সম্ভবনা খুবই প্রবল। আমি নাইরোবীতে আসার পর দুসপ্তাহের ভিতর সন্ধ্যার একটু পরে রাস্তায় হাঁটতে বের হলে মটরসাইকেল আরোহী এ মামাদের কবলে পড়ি। সে থেকে হাঁটার ব্যাপারে নাইরোবীতে অবস্থানকালে আর কোন আপস করিনি।
     আমার হাঁটার  সময় লামের সাথে আবশ্যিকভাবেই দেখা হত। লাম সারাদিনই বলতে গেলে নীচে ঘোরাঘুরি ও খোঁড়াখুড়িঁ করে সময় কাটাত। আমাকে দেখলে তাঁর ধবধবে দাতগুলি বের করে একটি হাসি দিত এবং কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকত। নাইরোবীতে প্রায়শই অল্প পরিমান বৃষ্টি হত। এ বৃষ্টির স্থায়িত্ব খুব একটা বেশি সময় হত না। বৃষ্টি হলেই কলোনীর ঘাসে-ঢাকা মাটি ঘোলা হয়ে যেত। আমি লামকে দেখতাম ও বেশ তৃপ্তি সহকারে এ ঘোলা পানি খাচ্ছে।। প্রথম প্রথম আমার কাছে ব্যাপারটা একটু আশ্বর্যজনক লাগত। কিন্তু কিছুদিন ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম লাম এটা বারবার করছে। আরও কিছুদিন পর লামকে আবিস্কার করলাম ও কয়লা চিবিয়ে খাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে নাইরোবীতে অনেকের বাসায় চারকোলের চুলা থাকে। হঠাৎ করে গ্যাসের সিলিন্ডারের সংকট বা গ্যাস ফুরিয়ে গেলে এ চারকোলের চুলা ব্যাবহার করা হয়। লামের খাদ্য তালিকায় আরো দেখলাম ইট ও পাথরের টুকরা। লাম এছাড়াও অনেক জিনিস মাটি খুঁড়ে খেত। ওর সাথে একটি কাঠী থাকত এবং সেটা দিয়ে সে সারাদিন মাটি খোড়াঁখুঁড়ি করত। কলোনীর দারোয়ান নেকটার ও আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লামের এ কর্মকান্ড দেখতাম। লামকে আমি কখনো অসুস্থ হতে দেখি নাই। লামের বিচিত্র খাদ্যগ্রহনের কর্মকান্ড তার পরিবারও জানত। মাঝে মাঝে ওর এক বড়বোন এসে ওকে তুলে নিয়ে যেত যখন দেখত ও একমনে এ সমস্ত দ্রব্যাদি মহা তৃপ্তিতে ভক্ষন করছে। ব্যাস ওইটুকুই। একটু পরেই লাম যথারীতি নীচে নেমে এসে আবার তার খাদ্যতালিকা অনুযায়ী তার ভক্ষন কার্য শুরু করত।
     লামের খাদ্যতালিকার ব্যাপারটা স্বাভাবিক না হলেও অলৌকিক কিছু নহে। চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে যারা লেখালেখি করেন তাদের লেখা পড়ে ধারনা হয়েছে কারো কারো পাকস্থলী স্ট্রং হাইড্রোক্লোরিক এসিড প্রাকৃতিক ভাবেই নিঃসরন করে যার ফলে এ এসিডের বিক্রিয়ার ফলে অপাচ্যও তাঁরা ভক্ষন করলে সেটা ডাইজেস্ট হয়ে যায়। লাম ভাঙ্গা ভাঙ্গা একটু ইংরেজী জানত। যেহেতু ও একটা কাঠী নিয়ে একটা জায়গায় মাটি খুঁড়ত ওর প্রিয় খাদ্যের সন্ধানে আর আমি কলোনির চারদিকে চক্কর দিতে থাকতাম তাই লামের সাথে আমি মাঝে মাঝে আলাপ করতাম। একদিন দেখি ও খুব আরাম করে কয়লা চিবাচ্ছে? আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইজ ইট টেষ্টি’? ও উত্তর দিল, ‘গুড’। আর একদিন দেখি কাদা মাখা জল হাতের তালুতে কোষ করে উঠিয়ে মহা তৃপ্তিতে গলাধঃকরন করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ’আর ইউ ড্রিংকিং মাড জুস?’ -ও বলল ‘ইয়েস’। আমি বললাম ‘হাউ ডু ইউ ফিল’? ও বলল’ ভেরি গুড’।
     আমি ঠিক করলাম লামকে আমি একদিন আখ খাইয়ে জিজ্ঞেস করব আখের স্বাদ কিরকম। এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশে যেরকম চিনাবাদাম বিক্রি হয় নাইরোবীর রাস্তাঘাটে সেরকম টুকরো টুকরো সাইজ করা পলিথিনে ভরা আখের প্যাকেট বিক্রি হয়। তাই আমি একদিন কয়েক প্যাকেট আখ কিনে একটা লামকে, একটা দারোয়ান নেকটারকে আর একটা নিজের কাছে রেখে কম্পাউণ্ডের ভিতর মনের মাধুরী মিশিয়ে হাঁটছিলাম আর আখ চিবাচ্ছিলাম। লামের আখ খাওয়া শেষ হলে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডীড ইউ এনজয় দি সুগারকেন, ওয়াজ ইট টেষ্টি’? ও এক গাল হেসে উত্তর দিল, ’নট ব্যাড’। আমি দারোয়ান নেকটারকে লামের উত্তরের কথা শুনালে সে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। বুঝলাম লামের টেস্টবাড হয়ত ইট, কয়লা, মাটি এগুলির স্বাদের ব্যাপারে বেশী স্পর্শকাতর।

ছবিঃ নাইরোবী, কেনিয়া

     একদিন সকালে দেখি কম্পাউণ্ডের ভিতর একটা ট্রাক ঢুকেছে। লামেদের ফ্লাট থেকে জিনিসপত্র নামানো হচ্ছে। সাউথ সুদানের গৃহযুদ্ধরত দুপক্ষ শান্তি স্থাপনে সন্মত হয়েছে। এ সুযোগে লামের পরিবারও এবার নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করছে। জিনসপত্র নামানো শেষ হওয়ার পর আর একটা মাইক্রোবাসে দেখলাম লামের পরিবারের সবাই উঠছে। আমি তখন কম্পাউণ্ডের ভিতর হাঁটছিলাম। লামের জন্য কেন জানি আমার খুব খারাপ লাগছিল। যখন মাইক্রোবাসটা ছেড়ে দিবে তখন লাম যে সিটের পাশে বসেছে আমি বাহির থেকে ওখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে লামের বাবা মাইক্রোর কাঁচটা সরিয়ে দিল। লামকে দেখলাম অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে থাকতে। শুধু লাম না, ওদের পরিবারের সবাই আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। এখানে ওদের কেউ নেই, তাই ওদের কারো বিদায় জানাতে আসার প্রশ্নই উঠে না। তবুও যখন একজনকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ওদের মনে হয় খুব ভাল লেগেছিল। লামের সাথে আমি হ্যাণ্ডসেক করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করি কারন চোখের জল আর আমি ধরে রাখতে পারছিলাম না।
     ওদের গাড়ি চলে যাবার পর এলোমেলোভাবে ভাবতে থাকি এ পৃথিবীর পান্থশালায় কিছু কিছু অতিথির সাথে কিছুদিনের জন্য আমাদের দেখা হয়। তারপর হঠাৎ একদিন যে যার গন্তব্যে চলে যায়। একটা বৃক্ষে রাতে বিভিন্ন জাতের বিহঙ্গ বা পক্ষীকুল আশ্রয় নেয় এবং ক্ষনিকের পরিচয়ে আবদ্ধ হয় কিন্তু প্রভাতে সব পাখি যার যার নিজস্ব দিকে উড়ে যাবে। এতে বিচলন কোথায়!

চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা