অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আমাদের বাড়ির কবুতরগুলি – চিরঞ্জীব সরকার

     ক সকালে মুম্বাইয়ের একটা হোটেলের রূমের জানালার পর্দা সরিয়ে ভোরের সূর্যকে দেখছি। জানালার কাঁচ দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যরশ্মি শরীরকে একটু উষ্ণতার পরশ দিচ্ছে। বিহঙ্গকুল মুক্ত ডানায় আধো নীল আধো মেঘের আকাশে উড়ছে। প্রাথমিক এ উড়ার পর হয়ত খাদ্যের সন্ধানে দিগন্তের ওপারে কোন পাহাড়ের বা সমতলের বৃক্ষরাজির কাছে ছুটে যাবে যেমনটা ছুটতে হয় সৃষ্টির সমস্ত প্রানিকুলকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছুটতে হয় মনে হয় মনুষ্যকুলকে কেননা তার ভোগবাসনা পাহাড়তুল্য। পাখিরা দুটো খাদ্যকনায় আহার মিটিয়ে  আপন নীড়ে ছুটে আসে গোধুলীলগ্নের বর্নিল আকাশে বিচরন করে। জীবনান্দের ভাষায়, ’সব পাখি ঘরে আসে সব নদী- ফুরায় এ- এ জীবনের সব লেনদেন;/ থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার  বনলতা সেন’। অবলোকনরত এ পাখিদের ভিতর কবুতর, বাজ ও টিয়ে তিনটি আমার খুবই পরিচিত। টিয়ের ঝাক যখন বাড়ির পিছনের কামরাঙ্গা গাছটির উপর নেমে আসত মোটামুটি আধা ঘন্টার ভিতর তাদের রক্তিম বর্নের ধারালো ঠোট বৃক্ষের ফলগুলিকে কুচি কুচি করে পরিপক্ক হওয়ার পথকে চিরতরে রোধ করে দিত। এরপর তারা ঝাকবেধে আবার কোথাও উড়ে যেত দৃষ্টির সীমানার বাইরে। বাড়ির দক্ষিন দিকের রেইনট্রি গাছটির উপর হাজির হত বিশাল আকারের খয়েরী বর্নের পালক ও হলুদ ঠোটের রাজপাখি। গলা ঘুড়িয়ে যখন দৃষ্টি নিক্ষেপ করত তখন বোঝা যেত এর ভিতর একটা রাজকীয় ভাব আছে। যে সর্পকুলকে আমরা এত ভয় পাই তাদেরকে দেখতাম এ বাজপাখি উঁচু এ বৃক্ষশাখায় ঝুলিয়ে এনে পায়ের নখর দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে ঠোট দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে কত আয়েশে ভোজন পর্ব সমাপ্ত করছে। আর কবুতর সে তো স্যামুয়েল টেলর কোলেরিজের ভাবে, ’ওয়াটার, ওয়াটার, এভরিহোয়েয়ার,/ নর এনি ড্রপ টু ড্রিঙ্ক’। বাড়ির দোতলার একটি লম্বা কক্ষে থাকত কয়েকশ জালালী কবুতর। আর এ কারনেই কক্ষটি সবসময় সরব থাকত এ কবুতরদের বাক বাকুম শব্দে।
     এভাবে ভোরে সেদিন হোটেলের লবিতে বসে যখন কয়েকটি জালালী কবুতরকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করছিলাম তখন মন খুব দ্রুত চলে গেল ফেলে আসা সেদিনের বাড়ির সেই কবুতরগুলির দিকে। বাড়ির একবারেই সামনে দুটি নারকেল গাছ ছিল। অপেক্ষাকৃত লম্বা গাছটি সামনের পুকুর সংলগ্ন ও তার চেয়ে কম উচ্চতায় অন্যটি ছিল দালান সংলগ্ন। এ ছোট নারকেল গাছটিতে নারকেল বা ডাব ধরত হলুদ বর্নের। নারকেল গাছটির লম্বা সবুজ পাতার উপর রৌদ্রকরোজ্বল সকাল ও দুপুরে কবুতরেরা দাঁড়িয়ে থাকত। মৃদুমন্দ বাতাসে পাতা যখন নড়ত তখন ওরাও ঠায় দাঁড়িয়ে দোল খেতে থাকত। মাঝে মাঝে আবার হঠাৎ করে নীল আকাশের দিকে উড়ে যেত। আমারও তখন খুব ইচ্ছে হত ওদের মত কোথাও উড়ে যেতে কেননা তাহলে স্কুলেও যেতেও হবে না,পড়ালেখাও করতে হবে না, স্যারদের বেতের মার খাওয়ারতো প্রশ্নই তখন আসবে না। কত কবুতর চোখের সামনে দিয়ে দিগন্তে উড়ে গেল আর নারকেল গাছটার ডালে এসে কতবার বসল কিন্তু আমি যেন তখন নির্বিকারভাবে কারাগারের ছোট কক্ষের জানালার লৌহদণ্ড ধরেই অচল হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম শৈশব কৈশোরের সে দিনগুলিতে,, ওদের মত ছুটে যেতে সক্ষম হয়নি মনের স্বপ্নাকাশে। তাইতো স্মৃতিজাগানিয়া এ কবুতরগুলিকে দেখে আবার চলে যেতে ইচ্ছে করে ফেলে আসা সে অতীত দিনগুলির সরল নিরাভরন  গ্রামীন জনপদের সাদামাটা জীবনের অনাবিল  এক আনন্দময় আবহে।
     এ কবুতরগুলি আমাদের বাড়িতে এসে কবে ঠাই নিয়েছে তার ঠিকুজি লেখা নেই। অগ্রজরা বলেছিল তারাও দেখেছে কবুতরগুলি এখানে আছে। আমরা কবুতরগুলিকে কোন খাবার দিতাম না তবে ওদের সুরক্ষা প্রদান করতাম। আমাদের বাড়িতে কবুতর ধরা নিষেধ ছিল। এমনকি এয়ারগান নিয়েও কেউ প্রবেশ করলে তাকে বলা হত কবুতরের দিকে যেন কোন গুলি করা না হয়। কেউ কখনো আমাদের বাড়ির সীমানার মধ্যে শত বছরে একটি কবুতরেরও কোন প্রাননাশ করতে পারেনি। অর্থাৎ আমাদের নিজেদের জীবনের মতই কবুতরগুলিকে আমরা ভালবাসতাম। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কবুতরকে দেখতাম মৃত্যুমুখে ঢলে পড়তে। ওরা যখন মাঠে ঘাটে খাবার খেতে যেত তখন ফসলের মাঠে বিশেষ করে ধানক্ষেতে দেয়া কীটনাশক মিশ্রিত ধান খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যেত। সে এক করুন দৃশ্য। কোন কোন দিন দেখতাম তিন চারটি কবুতরের নিথর দেহ পড়ে আছে। ওদেরকে দেখে শূন্যতায় বুকটা হাহাকার করে উঠত। আমি নিজেও অনেক মৃত কবুতরের ডানা ধরে দূরের ডোবায় ফেলে দিতাম আর মনে মনে মৃত্যু জিনিসটা কি সেটা নিয়ে একা একা ভাবতাম। কাউকে কিছু বলতাম না তবে এ উপলদ্ধি অবচেতন মনে  ঘটেছিল যে মৃত্যু হল এক নিঃসঙ্গ আজানা পথের যাত্রা, যে যাত্রায় নেই কোন কোলাহল, সঙ্গীতের লহরী এ যাত্রায় ধ্বনিত হয় না, লেনদেনটা হয় একেবারেই শূন্য অংকের হিসাবে। এও ভাবতাম আজকের এ মৃত কবুতরগুলোর মত আমাদের সকলকেই অবশ্যই কোন একদিন মৃত্যুর মিছিলে সামিল হতে হবে। কিন্তু সেদিনটা যে কার কবে আসবে তা সবার কাছেই অজানা।
     আমাদের বাড়ির কবুতরের প্রান নিধন করত আর একটা প্রানী সেটা হল বিড়াল। এ বিড়াল যে আমরা পোষতাম ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। অযাচিত অতিথির মত এ বিড়ালরা আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হত। আর একবার উপস্থিত হলে এদের আর ফিরে যাবার কোন ইচ্ছে হত না। এ বিড়ালরা মাঝে মাঝে কবুতর মেরে খেত। কবুতর ধরলে প্রচণ্ড রাগ ও ক্ষোভে শক্ত লাঠি দিয়ে আমি বিড়ালের দিকে ধেয়ে যেতাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হত না। কবুতরকে কিছুই মুখ থেকে ছাড়ত না এ বিড়ালরা। লাঠির আঘাতেও তেমন কিছুই ঘটত না ওদের ইলাস্টিক শরীরে। রাগে আমি একদিন  একটি বিড়ালকে তিনতলার ছাদ থেকে ঠেলা দিয়ে নীচে ফেলে দেই। কিন্তু দেখি একটি বড় পতনের শব্দ ছাড়া আক্ষরিক অর্থে বিড়ালটির কিছুই হয়নি। দেখলাম সে যথারীতি হেঁটে হেঁটে বাগানের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। যদিও এখন মনে হয় কবুতর হত্যা করে বিড়াল যতই অপরাধ করুক না কেন তবুও তাকে উঁচু ছাদ থেকে ঠেলে দেয়া কোনভাবেই সঠিক কোন কর্ম ছিল না কিন্তু তখনতো আর এ বোধশক্তি ছিল না কিশোর একটি বালকের কাছে। এখন বুঝি প্রানীরা তো তাদের স্বভাব অনুযায়ী আচরন করবেই।
     বিড়ালের অত্যাচার হতে রক্ষা পেতে চটের বস্তায় ভরে অনেক দূরে নদীর ওপারে বিড়ালকে ফেলে দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল কয়েকবার। কিন্তু এক্ষেত্রেও ফলাফল শূন্য। সাত থেকে পঁনের দিনের ভিতর সে বিড়ালগুলি আবার বাড়িতে এসে হাজির হত। যে সন্ধ্যা নদীর অপর পারে বিড়ালগুলিকে নিয়ে ফেলে দেয়া হত সে নদীটি যথেষ্ট প্রশস্ত। বৃটিশ আমলে এ নদীতে স্টিমার  চলত। এখনও বিশাল ঢাকাগামী লঞ্চ চলে নিয়মিত। কিভাবে যে তারা এ নদী ক্রস করে আবার চলে আসত তা এখনো আমার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয়। লোকজন বলত বিড়াল নাকি খনার জিহ্বা খেয়েছে তাই জায়গা চিনতে ও পরিচিত জায়গায় ফিরতে তাদের বেগ পেতে হয় না অলৌকিক শক্তির প্রভাবে। বিড়ালকে আবার মারাও যেত না। একটা বিড়াল মারলে নাকি আড়াই সের লবন দান করতে হয়। আর তা না করলে নাকি এ পাপ থেকে কোনভাবেই মুক্তি ঘটবে না।
     ১৯৭১ সাল।মানব ইতিহাসের অন্যতম এক্সঔডাস ঘটছে লোয়ার যশোর রোড ও এর আশেপাশের জলকাদায় পরিপূর্ন ঝোপঝাড় ও আখ ক্ষেতের ভিতর দিয়ে। জীবন বাঁচানোর জন্য মিলিয়ন মানুষ ছুটছে বর্ডারের দিকে। আমাদের পরিবারও এ কাফেলায় সামিল হয়েছিল  একমাত্র পিতামহ ছাড়া। পিতামহের যুক্তি ছিল মরে গেলে এখানে বসেই মরবে, এ মাটি ছাড়া তার পক্ষে সম্ভবপর নহে। সে সময়ের স্মৃতি আমার মনে নেই। তবে লোয়ার যশোর রোডে আমি পরে গিয়েছি। মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ একাত্তর সালের পরিপেক্ষিতে যশোর রোড নিয়ে বিখ্যাত একটি কবিতা লিখেন যার শিরোনাম ছিল, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। কবিতাটির প্রথম দিকের লাইনগুলি নিম্নরূপ:
“Millions of babies watching the skies/ Bellies swollen, with big round eyes/ On Jessore Road-long bamboo huts/ No place to shit but stand channel ruts’. আমাদের পিতামহ বলেছিল একাত্তর সালে নাকি একটি কবুতর বাদে   অন্য সব কবুতরগুলি কোথাও যেন চলে গিয়েছিল। যুদ্ধের পর আমরা যখন আপন নিকেতনে ফিরে আসি আশচর্যজনকভাবে কবুতরগুলিও আবার কোথা থেকে যেন এ বাড়িতে ফিরে আসে। আর ওই একটি কবুতর হয়ত পিতামহকে সঙ্গ দিয়েছিল।
     বছর কুড়ি আগে হঠাৎ বাড়িতে গিয়ে খেয়াল করি একটি কবুতরও আর দোতলার কক্ষটিতে নেই। সেদিন সত্যিই কেন জানি আমার মনে হয়েছিল এ বাড়িতে হয়ত আমাদেরও আর কবুতরগুলির মত থাকা হবে না। পরবর্তী কয়েক বছরের ভিতর দেখলাম আমার সে আশঙ্কা সত্যে পরিনত হয়েছে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের সবাইকেই একে একে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এখন আমরা বাড়িতে যাই অতিথি হয়ে এবং দুএকটা কবুতরও দেখি বাইরের গাছে, আর গৃহমধ্যে নহে।

চিরঞ্জীব সরকার। মুম্বাই