অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
হৃদি পেন্ডুলাম - ফরিদ তালুকদার

‘Murphy’s Law (মার্ফিস ল')’--- কুইন আর কিংস্টন (Queen and Kingston Road) রোড এর মিলন মোড়ে তিনতলা দালানটির উপর তলার সবটা নিয়েই এই মার্ফিস ল' পাব (Pub)। পাবের এমন নামের কারনেই হয়তো সবার দৃষ্টি পড়ে এদিকে। তবে আর একটা কারণও হয়তো থাকতে পারে। দালানের পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় দেয়ালের সথে লটকে দেয়া সময়ের ঘড়িটায় অনেকগুলো বছর ধরেই বিকেল তিনটা একুশ মিনিট বেজে আছে! অনতিদূরের সিগনাল লাইটে ব্যাস্ত জীবনের ক্ষণিক থমকে যাওয়া লাইন সেইসব দিনের তুলনায় এখন অনেকটাই দীর্ঘ হয়। পাবের রঙিন পানীয়তে ঠোঁট ভিজিয়ে সময়ের গল্পে মেতে উঠে এখন নুতন প্রজন্মেরা। তাদের পকেটে হাল সময়ের মুঠোফোন সারা বিশ্বের সময় জানিয়ে দেয়! ঘড়িটা এখন যেন তাই পতিত সেই ‘শান্তা বাহার' রেল স্টেশন! যে শুধু কিছু মরচে ধরা লোহালক্কড় আর গুটিকয়েক ভাঙা বগিকে নিয়ে স্মৃতির জাবর কেটে বেঁচে আছে! আর ওরাই কেবল বয়ান দিয়ে যাচ্ছে একদিন এখানে জীবন ছিলো সচল। ছিলো আপন জনের জন্যে আকুল প্রতীক্ষা! ওগুলোর চারপাশ ঘিরে বেড়ে উঠা কিছু গুল্মলতা চৈত্রের নির্জন বাতাসে ঘাড় দুলিয়ে এখন শুধু সাক্ষী হয়ে থাকে সে গল্পের! 
     লিখতে চেয়েছিলাম অন্যকিছু। কিন্তু শুরুটা আবারও হলো বিবর্তন দিয়ে। আমরা বদলাই কিংবা সময় আমাদেরকে বদলে দিয়ে যায়-- যে দূরবীনেই দেখিনা কেন পরিবর্তনটা অনিবার্য। ক্রমশঃ এবং বংশানুক্রমিক। নিত্য দেখা নিত্য সহা এমন বিষয়গুলো তাই কথার প্রসংগে এলেও আমাদের অন্তরাত্মায় তেমন ধাক্কা দেয় না। কিন্তু শত চেষ্টা আর ত্যাগের বিনিময়ে একটু একটু করে গড়ে তোলা স্বপ্নের সোপান যখন মধ্য গগনে উঠতে উঠতেই হঠাৎ ধ্বসে পড়ে নিমিষে তাকে ব্যাখ্যা করি কোন সূত্রে? তাকে তো এতো সহজে হৃদয়ে সমাধিস্থ করা যায় না! ভাবা যেতে পারে এর পেছনে আছে অনেক ভেবেচিন্তে নেয়া কিংবা হঠাৎ করে নেয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আসলে নির্দিষ্ট করে তাও কি বলা যায়? ফলাফল এমন হলো বলেই আমরা বলি সিদ্ধান্তটি ভুল ছিলো। অথচ আরও অসংখ্য নিয়ামকে ফলাফলটা অন্যরকমও তো হতে পারতো? কিন্তু হয়নি। এমন সব ঘটনাগুলোর জন্যেই হয়তো ঐ মার্ফিস ল' এর প্রবাদ!? অনেকটা বাংলার সেই— ‘রাখে আল্লাহ মারে কে / মারে আল্লাহ রাখে কে?’ এর মতন। অর্থাৎ, যে পথেই তুমি যাও এটাই হয়তো হওয়ার ছিলো। প্রকৃতির এ এক জটিল রহস্য! জটিল মনস্তত্ত্ব! আমরা ভাবতে পারি সিদ্ধান্তটা তখন এভাবে না নিয়ে ওভাবে নিলে হয়তো বিষয়টা অন্যরকম হতো। কিংবা ‘কেন যে তখন এ আইডিয়াটা মাথায় আসেনি ভেবে নিজের মাথাকে নিজেই ঠোকাতে ইচ্ছে করে'! অথচ তখনো যে কম ভাবা হয়েছে তাতো নয়? আসলে এই মার্ফিস ল' এর সঠিক ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। অন্ততঃ আমার নেই! 
     দু'একটা উদাহরণ টানার চেষ্টা করি। বেশ কয়েকবছর আগের একটা খবরের কথা মনে পড়ে। ৪০১ হাইওয়েতে (401 Highway) শোল্ডার লাইনে (Shoulder Lane) ইঞ্জিনে ত্রুটি যুক্ত একটি গাড়িকে ঠিক করার জন্যে কসরত করছিলেন তার চালক। তাকে সহায়তা করতে আরেকটি গাড়ি এসে থামে। যতোটুকু মনে পড়ে এই দুই চালকের মধ্যে কোনো পূর্ব সম্পর্ক ছিলোনা। দ্বিতীয় গাড়ির চালকও ঐ হাইওয়ে ধরে যাচ্ছিলেন। সমস্যায় পড়া গাড়িটাকে দেখে সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। সে তার গাড়িটা আগের গাড়ির পেছনে থামিয়ে গাড়ি থেকে বেড় হয়ে আসতেই পেছন থেকে ধেয়ে আসা আরেকটি গাড়ি তাকে অঘাত করে চলে যায়। ভদ্রলোক ঘটনা স্থলেই মারা যান! হৃদয় বিদারক! কি ব্যাখ্যা দিবো? সিদ্ধান্তের ভুল? নাকি অন্যকিছু? নাকি ঐ মার্ফিস ল’? 
     টাইটানিকের কথাই ধরা যাক। দূর্ঘটনাটির কারণ নিয়ে গবেষণায় অনেক কিছুইতো টেবিলে এসেছে। হয়তো ওগুলোর কোনো একটি বা কতিপয় এড়াতে পারলে এমনটি ঘটতো না। কিন্তু এসবের পরেও তো একটা প্রশ্ন জাগে, ঐ সময়ে ঐ স্থানেই এমন বিপুলায়তন এক হিমশৈলের আবির্ভাব হওয়াটা কি জরুরী ছিলো? এ ও কি তাহলে মার্ফিস ল’? জানি না! তবে জানি এ ধরণের ঘটনাগুলো নিঃসীম এক বুকের শূণ্যতায় ডেকে তুলে মধ্য নিশীথে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়ে যায় হৃদয়! প্রতিকার? নাহ্--!  হয়তো দেরী হয়ে গেছে। দেরী হয়ে গেছে হয়তো এক সেকেন্ড, এক মিনিট, এক দিন কিংবা আরও একটু বেশি। সে হোক, কিন্তু গোটা এক জীবনের হিসেবে, এতোদিনের শ্রম সাধনার কাছে তা তো কিছুই নয়!? তা ঠিক, তবে তাতে কী? নির্দয় হাতে সময় তাকে নিয়ে গেছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে তো নয়! অসাহায়ত্ব এখানে অন্তহীন! আক্ষেপ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত!
     যারা ভবিতব্যে নির্বিকার আত্মসমর্পণ করে অভ্যস্ত তাদের ক্ষেত্রে হয়তোবা কষ্টের এমন দহনে শান্তনা খোঁজার একটা পথ থাকে। অতি বাস্তববাদীরাও হয়তো বলতে পারেন যা আর ফিরে পাওয়া যাবে না তাকে নিয়ে হা-হুতাশ করে কিংবা ফের তাকে এপিঠ-ওপিঠ করে দেখে লাভ কী? হয়তোবা। কিন্তু বিষয়টা কি এমনই সহজ? মানুষের মন বলে কথা। হ্যাঁ-- ঘুম ভাঙা রাতের ঐ প্রহরগুলোতে ক্ষরণে মগ্ন হৃদয়ের ভর নিয়ে জীবনকে তো টেনে নিতেই হয় সকাল-সন্ধ্যায়। মানিয়ে নেয়া জীবনে বেশিরভাগ লোকই তাই করেন। কিন্তু অন্তঃশীলা স্রোতে বেদনার তানপুরা কি কখনো থামে? যদি না হয় আমাদের স্মৃতি ভ্রম!?
     সদা বহতা এই জীবনে রাস্তার কোনো মোড়, কোনো স্টেশন, ক্যাফেটারিয়ার কোনো টেবিল, পার্কের বেঞ্চিতে বসে চক্রবালে বিদায়ী সূর্যের বার্তা কিংবা, স্তব্ধ হৃৎপিণ্ডের এই ঘড়িটা ওর স্থীর পেন্ডুলামেও যে কখনো আমাদের টেনে নিয়ে যায় পেছনের জানালায়! ওরা যে তখনো দোলা দিয়ে যায় ডানে-বামে, সামনে-পেছনে এক অব্যাক্ত ব্যাথার আলোড়ন তুলে!!

ফরিদ তালুকদার। টরন্টো, কানাডা
ফেব্রুয়ারী ১৫, ২০২২