অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
একটি বিবাহ যাত্রা – চিরঞ্জীব সরকার

ছর দশেক আগের কথা। আমাদের বানারীপাড়ার পাশের উজিরপুর থানা যা এখন উজিরপুর  উপজেলা নামে পরিচিত সেখানে  আমার পরিচিত এক দিদির একমাত্র ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের নির্ধারিত তারিখের কয়েকদিন আগে আমার সে দিদি আমাকে বলল ‘দাদা, আপনি কিন্তু অবশ্যই আমার ছেলের বিয়েতে যাবেন’। দিদির আমন্ত্রনটা ছিল তার হৃদয় থেকে উৎসারিত একেবারে খাঁটি। এ আমন্ত্রন উপেক্ষা করা যায় না। আসলে সবাই বুঝতে পারে কোনটা লোকদেখানো কৃত্রিম আর কোনটা একেবারেই সাবলীল  ও আন্তরিক। এছাড়াও দীর্ঘদিন একটানা বিভিন্ন মেগা শহরে থাকছি। ছোটকালের গ্রামীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা থেকে এক প্রকার বঞ্চিত বহুদিন থেকেই। মরুভূমিতে জল যেরকম দূর্লভ আর আমার কাছ থেকেও গ্রামীন সে সহজ সরল জীবনের দৃশ্যপট সেরকম এক প্রকার ক্রমশঃ দূর্লভ হয়ে যাচ্ছিল। অট্টালিকার শহরগুলির খণ্ডিত আকাশের নীচে যাপিত জীবন ভিতরে ভিতরে ভীষন ছটফট করছিল। সেই ছোটকালে কত বিয়ে দেখেছি। আমাদের বাড়ির কাছেই একটি বাজনাদার পরিবার ছিল। যেকোন অনুষ্ঠানে তাদের ডাক পড়ত। বড় অনুষ্ঠান হলে ব্যাণ্ডপার্টি চলে আসত। আমি বাজনাদারদের পাশে বসে তাদের বাজনা বিশেষ করে  ক্লারনেট, কর্নেট, সানাই, ব্যাগপাইপ ইত্যাদিতে তোলা সুর মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে বসে শুনতাম। গ্রামে কোথাও বাজনার শব্দ ভেসে আসলে অবশ্যই সেখানে ছুটে যেতাম। এখানে উল্লেখ্য যে আমাদের ওখানে তখন প্রতিবছরই ‘সূর্যমনি’ নামক একটা মেলা অনুষ্ঠিত হত। মেলাটি এখনো টিকে আছে তবে আগের সেই জৌলসে অনেক ভাটা পড়েছে বিভিন্ন কারনে। সে মেলাতে বসত সার্কাসের আসর। সার্কাস দলটির নাম ছিল ‘দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাস’। সে সার্কাসেও এ বাজনাদাররা বাজাত। সূর্যমনির মেলায় পুতুল নাচেরও আসর বসত। এখন বিভিন্ন কনসার্ট দেখার আমন্ত্রন পাই এবং মাঝে মাঝে দুএকটা দেখতেও চলে যাই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ছোটকালের সে লোকজ শিল্পীদের তোলা সুরে যে ভাললাগার  বিমোহন ছিল তার সাথে অন্য কিছুর তুলনা চলে না।
     বিয়ে যেহেতু একবারে কাছে না হলেও দূরেও নহে তাই খুব একটা তাড়াহুড়া ছিল না। নদীপথে ট্রলার ভাড়া করে যেতে হবে। স্থানীয় বাজারের খালের পাশে অনেক ট্রলার থাকে। যেকোন সময় গেলেই ভাড়া করা যাবে। একা একা গেলে খুব একটা মজা হবে না। তাই পাশের বাড়ীর আমার কাকা সম্বন্ধীয় তিনজনকে ও শহীদ ভাই নামে আরও একজনকে রাজী করালাম  বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সনাতন ধর্মালম্বীদের বিয়ের লগ্ন সাধারনত মধ্য রাত্রিতেই হয় এরকম একটা ধারনা আমার মাথার মধ্যে কাজ করে  কারন ছোটকালে যত বিয়ে দেখেছি রাত এগারটা বা বারটার আগে তার কোনটারই শুরু হতে দেখেনি। একারনে বেলা গড়িয়ে গেলে বাজারে একজনকে পাঠালাম ট্রলার ঠিক করতে। যেখানে সর্বোচ্চ আধাঘন্টার ভিতর ফেরার কথা ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেলেও তার কোন নাম নিশানা পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইলে কল দিচ্ছি কিন্তু কোন উত্তর নেই। ঘন্টা দুয়েক পর সে এসে জানাল বহু খোঁজাখুঁজির পরও  কোন ট্রলার পায়নি। আমি বললাম ট্রলার পাওয়া যায়নি ঠিক আছে কিন্তু এতগুলি যে মোবাইলে কল দিলাম তার কেন কোন উত্তর দেয়া হয়নি। উত্তরে সে বলল,  ট্রলার খোঁজতে গিয়ে সে এতটাই ব্যস্ত ও টেনশনে ছিল যে মোবাইলের কলের দিকে তার কোন খেয়াল ছিল না।
     এবার সত্যি সত্যিই একটা সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি বলে মনে হল। কথা দিয়েও যদি বিবাহ অনুষ্ঠানে না যাই তবে দিদি কি মনে করবে। পাশের বাড়ীর দুকাকা যাদের রাজী করেছিলাম আমার সাথে যোগদানের জন্য তাদেরকে বললাম সমস্যার কথা। তারা সমাধান দিল, হাতে আর সময় নাই, রেডি হয়ে এখনি বের হতে হবে, বাজারে গেলে একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। সেমতে আমরা এহেন কয়েকজন বরযাত্রী যানবাহনের কোন নিশ্চিত ব্যবস্থা ছাড়াই ওয়েডিং পার্টিতে যোগদানের জন্য বাড়ি হতে বের হলাম। ট্রলার যেখানে থাকে সেখানে সত্যিই কোন ট্রলার নেই। এহেন সমস্যা শুনে বাজারের এক ছোট ভাই যার সেখানে একটি দোকান আছে সে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। তার নিজের একটি ট্রলারও আছে তবে সে  ট্রলারটি যে চালায় সে এখন নেই। এখন উজিরপুর যেতে হলে সে ছোটভাইকেই নিজের ট্রলার চালিয়ে যেতে হবে। ছোট ভাইটি ট্রলার চালাতে কতটা দক্ষ সে সম্বন্ধে আপাতঃ কোন ধারনা নেই। বিকল্পও কিছু দেখছি না। একটা বিকল্প আছে তবে সেটা অন্যদের জন্য বিব্রতকর হবে বলে বিবেচনা করছি না। শুনেছি বরপক্ষও একটি ট্রলার নিয়ে কনের বাড়িতে যাবে বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর বাইশারীর দিকের খেয়াঘাট থেকে। আমরা গেলে অবশ্যই সে ট্রলারে আমাদের জন্য আসন ছেড়ে দিবে। কিন্তু সেটাতো ঠিক হবে না। বরসহ তাদের আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীদের দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই সে ট্রলার ভর্তি হয়ে যাবার কথা। আমরা চারজন গিয়ে সেখানে এখন  উপস্থিত হওয়া কোভাবেই সমীচিন হবে না।
     ঘাট থেকে সন্ধ্যায় ট্রলার ছেড়ে দিল। সন্ধ্যা নদীর এপারের ঘাটে এসে দেখলাম বরের বাড়ির ট্রলারটি অপেক্ষারত। আমার প্রতিবেশী দুজন কাকার সাথে মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্প করছি। দুজনেই খুব আমুদে। কিছুক্ষন পর শুনতে পেলাম বাজনার শব্দ। বুঝতে পারলাম বর যাত্রা শুরু করেছে। একটু পর দুটো ট্রলারই কনের বাড়ি উজিরপুরের দিকে ছুটে চলল এবং কিছু সময়ের মধ্যেই বর যে ট্রলারটিতে সেটা আমাদের ট্রলারটি ছাড়িয়ে বহুদূরে চলে গেল। আমাদের ট্রলারটির মালিক তথা চালক বুঝলাম চালক হিসাবে প্রফেশনাল না, অকেশনাল অর্থাৎ একান্ত প্রয়োজন পড়লে সে হয়ত এটা মাঝে মাঝে চালায়। বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর বানারীপাড়ার দিকের অংশটায় নদীর অনেক জায়গা জুড়ে চর। আমাদের চালক ট্রলারটি চরে উঠিয়ে দিয়েছে। এখন বাশের লগী দিয়ে ঠেলতে হচ্ছে। এদিকে আবার বিশাল কচুরীপানার দল ভাসতে ভাসতে এসে আমাদের ট্রলারটির  চারদিক ঘিরে ফেলেছে। এখন ট্রলারটির চলাচলে টুইন সমস্যা তৈরী হল। ইঞ্জিন চালাতে গেলে ট্রলারের প্রপেলারের পিছনের দিকটার অংশ কচুরীপানামুক্ত রাখতে হবে। আবার চলার জন্য সামনের দিকটার কচুরীপানা পরিস্কার করে পথ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। লগীর ঠেলাঠেলিতে কাজ হচ্ছে না। চালক নদীতে নেমে পড়ল। তার জন্য মনটা খারাপ লাগছে। উপকার করতে এসে সে এখন কি কষ্টের ভিতর পড়ল। আমরাও লগী ঠেলে, হাত দিয়ে কচুরীপানা সরিয়ে আপ্রান চেষ্টা করছি এ অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে। অবশেষে বিধাতা সুপ্রসন্ন হল। সবার সন্মিলিত প্রচেষ্টায় চর থেকে ট্রলারটি নিস্ক্রান্ত হয়ে কচুরীপানার দঙ্গল অতিক্রম করে আবার যাত্রা শুরু করল। মানুষ বরযাত্রী হয়ে যায় একটু ফিটফাট পোশাকে। কিন্তু ট্রলার সচল করার কাজ করতে গিয়ে জলকাদা ছিটে আমাদের সে ফিটফাট ভাবটা আর বজায় থাকল না।
     মনে মনে যখন একটু সুখ অনুভব করছি ঠিক তখনি ঘটল দ্বিতীয় বিপত্তি। একেবারে হেড-অন -কলিশন। ছোট্ট একটি ডিঙ্গি নৌকা চালিয়ে আসছিল বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে এমন একটি ছেলে। আমাদের ট্রলারটি গিয়ে সে ডিঙ্গি নৌকাটিকে সরাসরি আঘাত করলে ডিঙ্গি নৌকাটি উল্টে যায় এবং  ডিঙ্গির চালক সে ছেলেটি নদীতে ছিটকে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতবাক। একটু ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি অবলোকন করতে লাগলাম। বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারত যদি আমাদের ট্রলারের ঘূর্নয়মান প্রপেলারের ব্লেডে  ছেলেটির দেহে লাগত। সেটি সৌভাগ্যক্রমে ঘটেনি যদিও সে ছিটকে পড়েছে প্রপেলারের একেবারেই কাছে। এছাড়াও দেখলাম ডিঙ্গি নৌকাটি উল্টে গেলেও ডুবে যায়নি। আর্কিমিডিসের থিউরী মোতাবেক ডিঙ্গি নৌকাটি এ অবস্থায়ও হয়ত তার নিজস্ব ওজনের চেয়ে বেশী ওজনের তরল অপসারন করেছে, তাইতো নৌকাটির এ ভেসে থাকা। আমরা ছেলেটাকে ও তার নৌকাটিকে উঠাতে সর্বোচ্চ সাহায্য করলাম। এতবড় একটা অপরাধ করার পরও ছেলেটি আমাদের কিছুই বলল না বরং আমারা যে তাকে ও তার নৌকাকে উদ্ধারে সাহায্য করেছি তার জন্য আমাদের কাছে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। এটা হতে পারে ছেলেটি স্বভাবগত কারনেই এরকম ভাল প্রকৃতির। অথবা পরিস্থিতি অনুধাবন করে সে এরকম ভাল আচরন করছে। আমরা কয়েকজন একদিকে নির্জন একটা বড় নদীতে আর সে এখানে নদীমধ্যে একা। এমতাবস্থায় সেতো একরকমের অসহায়। এমতাবস্থায় আমাদের সাথে বিবাদে জড়ালে সে তো পারবে না এ বিবেচনাবোধেও তার হয়ত এ নরমসুর। এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে আমিও একিরকম আচরন করতাম। বিধাতাকে মনে মনে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি কি ভয়াবহ বিপদ থেকে সে রক্ষা করেছে। ছেলেটির যদি কিছু হত তাহলেতো সেদিন পানি অন্য দিকে গড়াত।
     রাত আটটা নটার দিকে মেয়ের বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় আমাদের ট্রলার থামল। মেয়ের বাড়ি যাওয়ার মেঠোপথ জলকাদায় একেবারেই নরম। যাক্, মেয়ের বাড়িতে পৌঁছানোর পর বরযাত্রীদের বেশ যত্ন করা হয়েছে। ভোজন পর্বের পর বিবাহযজ্ঞ শুরু হল। সমস্ত ক্লান্তি ঘুচে গেল। আমরা কয়েকজন মেয়েপক্ষের লোকদের অনুরোধে তাদের সাথে বিয়ের নাচানাচিতেও অংশগ্রহন করলাম। জীবনের একটা দিনেও যদি একটু নির্মল আনন্দে অংশগ্রহন করা যায় সেটাও কি কম পাওয়া। রাত দেড়টার দিকে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে দুটার দিকে আমরা আবার ফেরার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।
     ফিরতি যাত্রা যখন শুরু করি তখনি হালকা একটু বৃষ্টি হচ্ছিল তবে আকাশ ঘন মেঘাচ্ছন্ন। ঘন্টাখানেক পর আমরা মাঝ নদীতে ঝড়ের কবলে পড়লাম। প্রচণ্ড ঠেউ, প্রবল ঝটকা বাতাস ও ভারী বৃষ্টির কবলে পড়ে আমাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বুঝতে পারলাম একটু এদিক ওদিক হলে ট্রলার ডুবে যাবে। এরকম প্রায় আধা ঘন্টা জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি পরিস্থিতে অবস্থান করে নদীর একটা কিনারে অবশেষে ট্রলারটি পৌঁছতে সক্ষম হয়। বৃষ্টি তখনো থামেনি। ডাঙ্গায় উঠে আমরা ঝড় থামার জন্য অপেক্ষা করলাম। শেষে কাকভেজা হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরলাম। এত কিছুর পরও মনে হয় একটা ভয়ংকর কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা লাভ করেছি সে দিনটিতে। সাদামাটা হলেতো আর মন ধরে রাখত না।

চিরঞ্জীব সরকার। বাংলাদেশ