অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সুরের নাইটেঙ্গেল যখন কন্ঠ থামাল – চিরঞ্জীব সরকার

প্রয়াত হলেন সুরের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র লতা মঙ্গেশকর। আকাশে লক্ষ লক্ষ তারার মাঝে একটি চাঁদ যেমন জোছনার সাগর লতাও তেমনি সুরের আকাশে  সবচেয়ে বড় আলোকময় পূর্নিমার চাঁদ। হিমালয় পর্বতরাজিতে ছোটবড় অসংখ্য চূড়া আছে কিন্তু এভারেষ্টের চূড়াটি অনন্য। সারা পৃথিবীর সমস্ত শৃঙ্গকে সে অতিক্রম করেছে। আর লতা নিজেই হলেন সঙ্গীতের এভারেষ্ট। যে কোন গানে কি অসাধারন সাবলীল দখল ছিল তাঁর। লতার কন্ঠের নিসৃত সুরে কোটি কোটি মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। সাত বা আট দশকের  দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে ছয়ত্রিশটি ভাষায় ত্রিশ হাজারেরও অধিক  গানে কন্ঠ দিয়েছেন এ কালজয়ী শিল্পী। কোন কোন হিসাব বলছে ডুয়েট গানগুলি নিয়ে তাঁর রেকর্ডকৃত গান প্রায় চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি। লতা লক্ষ লক্ষ সঙ্গীত পিপাসুকে এক বুক শোকের সাগরে ভাসিয়ে পাড়ি দিলেন অপার্থিব জগতে বিরানব্বই বছরের একটি বর্নময় জীবন কাটিয়ে।  
  ‘না যেও না, রজনী এখনো বাকী’-এরকম কথা তাঁর কন্ঠে সে কবে ধ্বনিত হলেও ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী সে রজনীটা সত্যিই শেষ হয়ে গেল, বাকী আর কিছু রইল না। সুরের নাইটিঙ্গেল  কন্ঠ থামিয়ে দিল। কিন্তু যে সুর লতা রেখে গেছেন অগনিত মানুষের হৃদয়ে তা প্রবাহমান থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’-এ অমোঘ বানীকে কেউই এখন পর্যন্ত লঙ্ঘাতে পারেনি, লতাকেও এ বানীর সত্যতায় হয়ত সাক্ষী দিতে হয়েছে মাত্র। মানুষ অমর হয়ে থাকে মানুষের মনে তাঁর কীর্তির মাধ্যমে। লতাও অমর হয়ে থাকবেন সঙ্গীতে তাঁর মহান কীর্তির মাধ্যমে।
     ১৯২৯ সনে জন্ম নেয়া লতা মঙ্গেশকর আসলে একটা দীর্ঘজীবন কাটিয়েই ধরা থেকে বিদায় নিলেন। লতা যাদের সাথে গান গেয়েছেন তাদের অধিকাংশই প্রয়াত হয়েছেন অনেক আগেই। রফি, কিশোর, হেমন্ত, মুকেশ, মান্নাসহ বহু শিল্পী একে একে  বিদায় নিলেও সুরের জগতের টাইটানিকটকি এতদিন অতলান্তিক সুরসাগরে ভেসে থাকলেও কোভিড-১৯ নামক  বরফখণ্ডের আঘাত  ও সাথে নিউমোনিয়াসহ সহগামী কিছু অসুখের ঠেলা এ বয়সে আর সহ্য করতে  না পারায় শেষ পর্যন্ত তাকে ডুবে যেতেই হল। লাখো চোখের ভেজা অশ্রু বিদায় জানালো সুর সম্রাজ্ঞীকে। লতার চিরবিদায় ঘটেছে বটে কিন্তু  আমরা সবাই জানি সঙ্গীতের  সুর পৃথিবীতে বহমান থাকবে, সে সুর লহরীতে লতা নামক  এক সুরসম্রাজ্ঞীর কন্ঠনিসৃত মায়াবী ধ্বনিও পৃথিবীর বহু প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হবে আগামী দিনগুলিতে  কেননা এ অমর সুরতো মানুষের হৃদয়ের একেবারে গহীনে প্রোথিত।
     লতা মঙ্গেশকর এত বড়মাপের  শিল্পী ছিলেন কিন্তু অহঙ্কার তাকে কখনো আক্রমন করতে পারেনি। সাদামাটা একটা শ্বেত বর্নের শাড়িতেই তাকে বেশীরভাগ সময় দেখা যেত। প্রকৃত গুনীরা যে আসলেই বিনয়ী হয় লতা মঙ্গেশকর তার অন্যতম নিদর্শন। অনেক আগে দুরপাল্লার রাত্রিকালীন বাসে চড়ে যখন লতার ‘প্রেম একবার এসেছিল জীবনে;’ও পলাশ ও শিমুল; নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’-এ গানগুলি শুনতাম তখন  এক মধুর অনুভূতি নিয়ে গন্তব্যের পথে যাত্রা করতাম। কত ভাললাগত তার কন্ঠের যাদুকরী সুরে তোলা এ আবেগঘন গানগুলি। কিন্তু যে গানগুলি সে উপহার হিসেবে রেখে  গেছেন আমাদের মাঝে সেতো আজ কেবলি স্মৃতি।
     মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই গান গাওয়া শুরু করেন এ মহান শিল্পী। এতেই বোঝা যায় যে তার জন্মই হয়েছে হয়ত সঙ্গীতের জন্য। লতার বাবাও পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর সঙ্গীতচর্চা করতেন বিধায় সে অনুকুল বাতাবরন পেয়েছেন জীবনের প্রারম্ভেই। কিন্তু তাকে জনপ্রিয় লতা হতে সাহায্য করে ফিল্মের জন্য গাওয়া তার  প্লেব্যাকগুলি। নব্বই বছর বয়সেও সে তার কন্ঠ ধরে রেখেছিলেন। কার সাথে বা কার জন্য গান গায়নি লতা। নার্গিস থেকে প্রীতি জিনতা, মধুবালা থেকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কেউই এড়াতে পাড়বে না লতার সুরতরঙ্গগুলিকে। লতার সঙ্গীত কর্নিকা স্পর্শ করেছে সেকালের মদনমোহন, আর ডি বর্মন, লক্ষীকান্ত পেয়ারেলালসহ হালের এ আর রহমান পর্যন্ত। গজল, ভজন, পপ, ফিল্মী গানা সবি গেয়েছেন তিনি এবং  একি সাথে মানুষের মনও জয় করেছেন সমানতালে।
     বাল্যকালের হেমা পিতার রচিত নাটকে লতিকা চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে হয়ে যান আজকের লতা। মধ্য প্রদেশের ইন্দোরে জন্ম নিলেও গোয়ার মঙ্গেশী শহরের সাথে পারিবারিক আত্মিকতার কারনে হার্দিকর পরিবারটি একটা সময় মঙ্গেশকর পরিবাররূপেই জনগনের কাছে পরিচিতি পায়। লতার মায়ের নাম ছিল সিবন্তী মঙ্গেশকর। ১৯৪২ সালে পিতার মৃত্যু হলে পরিবারটির ভরন পোষনের দায়িত্ব লতার উপরই বর্তায় এবং একারনেই তাকে কয়েকবছরের মধ্যেই তৎকালীন বোম্বেতে যা বর্তমানে মুম্বাই সেখানে চলে আসতে হয় জীবন জীবিকার প্রয়োজনে। বোম্বেতে এসে ওস্তাদ আমান আলী খাঁ সাহেবের কাছে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের উপর বিশেষ তামিল নেন। এর আগেও তিনি কয়েকজন খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞের কাছে ক্লাসিক্যাল বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেন। অর্থাৎ লতার সঙ্গীত জীবনের ভিত্তিটা অত্যন্ত মজবুত ছিল খুব ছোটকাল থেকেই।
     স্বনামধন্য এ শিল্পী ১৯৭৪ সালেই ইংল্যাণ্ডের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করে নিজের আন্তর্জাতিকতার ব্যাপ্তির প্রমান রেখেছেন। ফ্রান্স সরকারও লতা মঙ্গেশকরকে লেজিওঁ দ্য অনার পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সন্মাননা ভারতরত্নসহ বহু পুরস্কারে সন্মানিত হয়েছেন তিনি। ক্রিকেট খেলাও খুব ভালবাসতেন লতা।লণ্ডনের বিখ্যাত লর্ডসের মাঠেও তিনি ক্রিকেট খেলা দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন। ক্রিকেট দল ও খেলোয়ারদের জন্যও সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করেছিলেন।
     লতা, আশা, উষা, মিনা এ চারবোন ও ভাই হৃদয়নাথ প্রত্যেকেই সঙ্গীতজ্ঞ।তবে লতা ও আশা যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে পেরেছে বাকীদের ক্ষেত্রে সেরকম ঘটেনি। মুম্বাইয়ের ব্রীজ ক্যান্ডি হাসপাতালে মৃত্যুর কয়েকসপ্তাহ আগে (৮ জানুয়ারী ২০২২) করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এ মহিয়সী শিল্পী এবং সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্কে।
     ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২২-এর  এক পড়ন্ত বিকেলে  মুম্বাইয়ের ব্রীজ ক্যাণ্ডি হাসপালাতের কাছ থেকেই ফিরছিলাম আর ভাবছিলাম লতা মঙ্গেশকরকে  নিয়ে। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’- বিপ্লবী ক্ষুধিরামের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে লতাজী এ গানটি গেয়েছিলেন। ক্ষুধিরামেরও আর ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফেরা হয়নি, শিবাজী পার্কের জ্বলমান চিতার নীল ধোয়া থেকেও লতাও আর ঘুরে প্রভাকুঞ্জে ফিরে আসবে না। তবে তার সুরপ্রবাহ অমর হয়ে থাকবে। কানে কানে ভাসছে, ’তু যাহা যাহা চলেগা, মেরা ছায়া সাথ্ হোগা/ কাভি মুচকো ইয়াদ করতে যো বহেঙ্গে তেরে আশু/ তো ওহি তো রোক লেঙ্গে উনহে আঁখে মেরে আশু’।

(লেখক) চিরঞ্জীব সরকার। মুম্বাই