আমি কি বিদেশী? -অমল রায়
জানিনা আজ কী ভেবে আনমনে আমার কন্যা বললে-
"বাবা তুমিতো বিদেশী হয়ে গেছো। "
মেয়ের কথায় আমি আচমকা আঁতকে উঠে সম্বিৎ ফিরে পাই-
মনে মনে আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবি - সত্যিই কি আমি তাই?
যদিও প্রায় দুই যুগ ধরে আমি আছি দেশের বাহিরে-
বাংলাদেশ থেকে সহস্র যোজন দূরে -এই পৃথিবীর প্রান্তসীমার খুব কাছাকাছি;
নানাহ কারণে দেশে যাওয়া প্রায় হয় না বললেই চলে-
কিন্তু তাই বলেই কি বলা যায় - আমি বিদেশী হয়ে গেছি?
আমিতো এখনো আমার মনের শাদা জমিনে-
নিরালায় আমার শৈশবের অতি আদরের ফুলে ভরা শিউলি গাছটার ছবি আঁকি।
আমারতো এখনো মনে কত অভিলাষ জাগে-
শরতের ভরা-পূর্ণিমা রাতে ডিঙি নৌকায় শুয়ে মেঘনার রূপালী জলে ভাসি।
আমিতো এখনো মনের অজান্তেই মনে মনে-
হেমন্তের খুব সকালে দূর্বাঘাসে জমে থাকা শিশিরে আমার পা ভিজাই।
আমিতো এখনো মনে মনে মনের গহীনে কুয়াশা ঢাকা ভোরে-
সুবর্ণগ্রামের ধানক্ষেতের সরু আইল ধরে হেঁটে হেঁটে দূরে বহুদূরে চলে যাই।
আমার মনতো এখনো আচমকা কেঁদে উঠে-
পৌষের শীতে ধূসর মাটির উঠানে বসে আর সোনা রোদের পরশ পাইনা বলে।
আমিতো এখনো পৌষ-সংক্রান্তির কাক-ভোরে উঠে-
মেঘনার হিম-শীতল জলে ডুব দিয়ে শুচি হয়ে ন্যাড়ার আগুনে উষ্ণ হতে চাই।
এখনতো ফাগুনে অশোক, শাল, শিমুল কৃষ্ণচূড়া, কিংশুক আর মহুয়ার পসরা এসে
আমার মন হাজার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যায়।
এখনোতো মনের অজান্তেই মনটাকে এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায়-
বৈশাখী আকাশে ঈশানকোনে জমে থাকা ভয়ার্ত কাল বৈশাখী ঝড়ের কালো ছায়া।
আমিতো এখনো খাঁ খাঁ করা জ্যৈষ্ঠের দুপুরে-
আমার মায়ের হাতের জলপাই দিয়ে রান্নাকরা পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে চাই।
আমিতো এখনো চৈত্রের শেষ বিকেলে-
কোকিলের কুহু কুহু রব আর "বৌ কথা কও" পাখিটার বিরামহীন ডাক শুনে পাগল হতে চাই।
আমিতো এখনো কল্পনায় শ্রাবণের ভরা বর্ষায়-
মাতাল করা বাদল দিনে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে উতল হাওয়ায় মনের আকাশে ভেসে বেড়াই।
আমিতো এখনো মুষলধারার বৃষ্টির দিনে - মনে মনে মাকে বলি-
"মা আজ তোমার হাতে রান্নাকরা বেগুনভাজা দিয়ে তালভর্তি করে খিঁচুড়ি খাবো।"
আমিতো এখনো আসামের পাহাড় থেকে নেমে আসা আষাঢ়ের ঘোলাজলে-
সারাদিনমানভরি সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে বাবার বকুনি খেতে চাই।
আমারতো এখনো মন খারাপ হলে মন ভাল করার জন্যে–
আমার মায়ের হাতের রান্নাকরা খেজুর গুঁড়ের পায়েস খেতে মন হাহাকার করে উঠে।
আমিতো এখনো আটখানা পয়সা দিয়ে খেয়া পার হয়ে-
মেঘনার ওপারে গিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত হলদে সর্ষেফুলের পাগলকরা গন্ধে আকুল হতে চাই।
আমিতো এখনো কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে-
গুড় আর কুড়ানি নারকেল দিয়ে কত যত্ন করে তৈরী মায়ের হাতের রস্করা খেতে চাই।
আমিতো এখনো কলার ভেলায় খাল পার হয়ে-
বহুদিন ধরে না-দেখা আমার শৈশবের প্রিয় বন্ধু দুলালদের বাড়ি দুর্গাপুরে যেতে চাই।
আমিতো এখনো মনে মনে কতবার মাকে বলি-
"মা কতদিন তোমার হাতে তৈরী নারিকেলের পুলি আর ক্ষীরের পাটিসাপ্টা পিঠা খাই না।"
এখনোতো হেমন্তের তিনসন্ধ্যায় ভাই আর বোনদের সাথে বসে-
হেঁড়েগলায় চিৎকার করে বাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, আর রামপ্রসাদী গাইতে মন চায়।
আমিতো এখনো আমাদের গ্রামের মাঘের মেলায় গিয়ে-
শন-পাপড়ি, হাওয়াই-মিঠাই, ঝালমুড়ি আর বার মসলার চানাচুর খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে চাই।
আমিতো এখনো রথের মেলায় গিয়ে-
বন্ধুদের সাথে নাগরদোলায় চড়তে চাই - সারাদিন ধরে ঘুরে ঘুরে অকারণে হয়রান হতে চাই।।
এখনওতো আমার মন চায় পৌষের রাতে–
সারারাত ধরে যাত্রা দেখে ভোরে বাড়ি ফিরে সারাদিনভর মাতালের মতো ঘুমাই।
আমিতো এখনো বৈশাখী ঝড়ের পরে-
আধ-সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় ঝড়ে পড়া আম কুড়িয়ে খুশির ঢেউয়ে ভাসতে চাই।
আমিতো এখনো আমার সবার ছোট্ট বোনটার সাথে বসে-
বটিতে কেটে কেটে কাঁচা, পাকা আর আধ পঁচা আম খেয়ে মন ভরাতে চাই।
আমিতো এখনো ভরা বাদলের দিনে-
দাওয়ায় বসে বালুতে ভাজা চীনাবাদাম খেতে খেতে দিনভর আড্ডা দিতে চাই।
আমিতো এখনো শ্রাবণের ঘোর বর্ষণ মুখর রাতে –
আমাদের টিনের চালের বৃষ্টির শব্দে কাঁথামুড়ি দিয়ে কর্ণ-কুম্ভের মতো অঘোরে ঘুমাতে চাই।
আমিতো এখনো আবার আমার হারিয়ে যাওয়া দিনে –
ফিরে যাবার জন্যে প্রতিদিন স্বপ্নের ভেলায় চড়ে বাংলাদেশে যাই।
আমিতো এখনো একাকী নিভৃতে নিরালায় আপনমনে -
মনের অজান্তেই গুন্ গুন্ করে গেয়ে উঠি - "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।"
তারপরেও কি তবুও কি এখনও আমার মেয়ে আমাকে আয়েশি ঢংয়ে বলবে?
"বাবা তুমিতো বিদেশী হয়ে গেছো।।"
অমল রায়
ইকালুইট, ক্যানাডা
১৮ ফেব্রুয়ারি , ২০২২ সাল
-
ছড়া ও কবিতা
-
21-02-2022
-
-