গরুর দুধ কি মানুষের জন্য? - ড. অমল রায়
বিশেষ দ্রষ্টব্য (বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ): এখনকার কথা জানি না, তবে আমাদের সময়ে নীচু ক্লাসে বাংলা পাঠ্য বিষয়ে পরীক্ষায় একটা রচনা লিখতে হতো এবং সাধারণত "গরু রচনা" দিয়েই ছাত্রদের রচনা লিখায় হাতেখড়ি হতো। এটা বলাই বাহুল্য এই রচনার একটা বিশেষ অংশ জুড়ে থাকতো গরুর দুধের মহিমা কীর্তন, কারণ বাঙালি জীবনে ভাত আর মাছের পরেই দুধও একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ক্ষীর, পায়েস আর সন্দেশ সহ দুধ দিয়ে যে কত রকমের মিষ্টি তৈরী হয় আর রসগোল্লা, রসমালাই এবং চমচমের নাম শুনতেই বাঙালি যে অজ্ঞান তাতো বাঙালি মাত্রেরই জানা। আর এই পশ্চিমাদেশের কত রকমারি চীজ (cheese), ইওগার্ট (yogurt) আর আইসক্রিমের কথা নাই বা বললাম। দুধ সম্বন্ধে আমার এই নিবন্ধটি যারা পড়তে শুরু করেছেন তারা হয়তো ভাবছেন এখানে দুধ সম্বন্ধে আরো কিছু মজাদার তথ্য পাবেন - কিন্তু আমি দুঃখিত তাঁদের জন্যে, কারণ আমার এই নিবন্ধটি দুধ সম্বন্ধে একটি ব্যতিক্রমী বা বলা যায় নেতিবাচক আলোচনা এবং তাঁরা আমার এই নিবন্ধটি পরে হয়তোবা হতাশই হবেন। তবে বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে অর্থনৈতিক কারণে বাংলদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যারা দুধ খেতে পারেন না তাদের জন্য সুখবর - দুধ না খেয়ে তাদের স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতিতো হয়ই নি বরং যে কোন কারণেই হোক তাদের দুধ না খেতে পারাটা হয়েছে তাদের জন্যে শাপে বর। আর একটি নিবেদন, যাঁরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে গরুর দুধ মানুষের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় খাবার এবং বয়স্ক মানুষেরা গরুর দুধ না খেলে তাদের দেহের যথাযথ পুষ্টিবর্ধন হবে না এবং গরুর দুধের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনলে তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে, তাদেরকে দয়া করে আমার এই নিবন্ধটি পড়া থেকে বিরত থাকার জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি। কারণ আমার লিখা দ্বারা কারো অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে অপরাধী হতে আমি নিতান্তই নারাজ। তবে যাঁরা পড়বেন তাঁদের এই নিবন্ধটি পড়ার পর কোন মন্তব্য থাকলে আমাকে অনুগ্রহ করে জানালে বিশেষ বাধিত হবো।
প্রাক-কথন:
এই পৃথিবীতে বর্তমানে ইঁদুর, বাদুড়, বিড়াল, কুকুর, ছাগল, বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, মানুষ, গরু, ঘোড়া, বাঘ, ভাল্লুক, হাতি, জিরাফ, ডলফিন, সিল, তিমি সহ প্রায় ৬৪০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী বিদ্যমান। যদিও আকৃতি, প্রকৃতি এবং ওজনের দিক থেকে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিরাজমান (সবচেয়ে ছোট থাইল্যান্ডের এক ধরণের বাদুড় (Kitti's hog-nosed bat) (যার দৈর্ঘ্য ২.৮-৫.৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন মাত্র প্রায় ২.০ গ্রাম এবং সবচেয়ে বড় নীল তিমি যার দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ২৯.৯ মিটার এবং ওজন ১৯৯ মেট্রিক টন), তবে এই পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের মধ্যে অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান (যেমন: তাদের ঘাম গ্রন্থি থাকে , তাদের মাত্র একটি নিম্ন চোয়ালের হাড় থাকে, তারা বাচ্চা প্রসব করে (দুটি ব্যতিক্রমী প্রজাতি ছাড়া), শুধু একবার তাদের দাঁত পুনঃস্থাপিত হয়, তাদের অধিকাংশের শরীরে লোম থাকে), এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সাথে একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য আর তা হলো তাদের স্তন (mammary gland, which is a modified sweat gland) থাকে যেখানে স্ত্রী-প্রাণীদের বাচ্চা প্রসবের পর দুধ উৎপন্ন হয় এবং তাদের স্ত্রী-প্রাণীরা তাদের নবজাত শিশুদের একটা নির্দিষ্ট সময়ধরে অন্য খাবারে অভ্যস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত (weaning) তাদের স্তন্যদুগ্ধের মাধ্যমে খাদ্য-পুষ্টির জোগান দিয়ে প্রতিপালন (nursing) করে। সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাচ্চাই তাদের স্ব স্ব প্রজাতির মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয় - যেমন গরুর বাচ্চা কেবল গরুর দুধই খায়, তেমনি ইঁদুরের বাচ্চা কেবল ইঁদুরের দুধ খায়, ছাগলের বাচ্চা ছাগলের দুধ খায়, বাঘের বাচ্চা বাঘের দুধ খায়, হাতির বাচ্চা হাতির দুধ খায়, সিলমাছের বাচ্চা সিলমাছের দুধ খায়, তিমি মাছের বাচ্চা তিমিমাছের দুধ খায় এবং এই সকল বাচ্চারা যখনি অন্য খাবারে অভ্যস্ত হয় তারা আর মায়ের দুধ খায় না এবং তাদের জীবনের পরবর্তীকালে দুধকে আর তাদের খাদ্য হিসাবে গণ্য করে না। কিন্তু এই নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী বলে প্রচারিত মানুষের ক্ষেত্রে। যদিও সাধারণভাবে একটি মানবশিশু তার মায়ের স্তন্য দুগ্ধ খেয়েই বড় হয় এবং প্রকৃতিগত ভাবে তাই হওয়ার কথা কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্য একটা সময় ছিল যখন আমাদের দুধ শিল্পের গ্ল্যাক্সও (Glaxo) আর ডানো (Dano) পাউডার দুধ উৎপাদন কোম্পানি গ্ল্যাক্সও ওয়েলকাম (Glaxo Wellcome) আর আরলা ফুডস (Arla Foods) কোম্পানির কিছু নাদুস-নুদুস শিশুর ছবি সম্বলিত কিছু ক্যালেন্ডারের ব্যাপক প্রোপাগান্ডার কারণে বেশ কিছু বিত্তবান পরিবারের মায়েরা তাদের বাচ্চাদের তাদের নিজেদের বুকের দুধ না খাইয়ে কৌটার (formula) দুধ খাইয়ে বড় করে। এই সকল গরুর দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি এমন ভাবে ফর্মুলা দুধের পক্ষে প্রচারণা চালায় যে মায়েরা মনে করতে শুরু করে যে তাদের নিজেদের দুধের তুলনায় গরুর পাউডার দুধ তাদের বাচ্চার জন্যে বেশি উপযোগী। আমাদের সুভাগ্যই বলতে হবে এমন ধারণা থেকে আমাদের মায়েরা এখন সরে এসেছেন। আমার ধারণা এখন প্রায় সকল মানুষই জানে এবং মানেও যে মানবশিশুর জন্য তাঁর মায়ের দুধই সর্বোৎকৃষ্ট কারণ একটা মানুষের বাচ্চার জন্মের পর তাঁর পুষ্টি এবং বৃদ্ধির জন্য যে পরিমান পুষ্টি প্রয়োজন প্রকৃতি কৌলিতাত্বিকভাবে তাঁর মায়ের দুধ সেভাবেই তৈরী করেছে। তবে কোন স্বাস্থ্যগত অসুবিধার কারণে কোন মা তাঁর বাচ্চাকে তাঁর বুকের দুধ দিতে অপারগ হলে সেই ক্ষেত্রে অন্য কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধ দিয়ে সেই মানবশিশুকে বাঁচানোর চেষ্টাতো করা যেতেই পারে, তবে স্বাভাবিক অবস্থায় যে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর শিশুর জন্য সেই নির্দিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধই যে সর্বোৎকৃষ্ট এটাতো বোধ করি এখন মানুষের সাধারণ জ্ঞানেরই অন্তর্গত। আর একটি বিশেষ বিষয় এবং সেটিই আমার এই নিবন্ধের মূল বিষয় আর তা হলো - এই পৃথিবীতে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীই একবার তাদের মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পর বা দুধ খাওয়ার বয়স অতিক্রান্ত করার পর বাকি জীবন আর কোন দুধ পান করে না কারণ প্রকৃতিগত ভাবেই দুধ খাবারটিই হলো শিশুদের জন্য। কিন্তু এই গ্রহের তথাকথিত সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ প্রাকৃতিক এই নিয়মটি লঙ্গন করেছে ভীষণ ভাবে। আমরা সব বুড়ো শিশুরা সারা জীবনভর দুধ খাই এবং এই দুধ আমরা খাই গরু, ছাগল বা মহিষের দুধ যা গোমাতা, ছাগমাতা বা মহিষমাতার তাদের প্রসব পরবর্তী সময়ে তাদের শরীরে তৈরী হয় তাঁদের স্ব স্ব বাচ্চাদের লালন-পালনের জন্য। আমরা যারা দুধের জন্য গোপালন করি আমরা জানি গরুর বাচ্চা প্রসবের পর সেই বাচ্চাকে প্রতিদিন মাত্র অল্প কিছু সময়ের জন্য তাকে তাঁর মায়ের দুধ খেতে দিয়ে বাকি সময় তাকে আটকে রেখে অন্তত দুইবেলা সেই গরুর দুধ মানুষ দোহন করে তার নিজের ভক্ষণের জন্য। আমার ছোটবেলায় আমার নিজের বাড়িতে আমিও এটা বরাবরই দেখেছি। আমরা এটা প্রায় সকলেই নির্দ্বিধায় বহুকাল থেকে করে আসছি এই যে মানুষের সেই আত্ম-গরিমায় নির্ভর করে, তাঁর নিজের সৃষ্ট এক অদ্ভুত দর্শনের ভিত্তিতে, যে এই পৃথিবীর সব কিছুই সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছে মানুষের জন্য। এই সদ্য-প্রসূত গোশাবককে তার মাতৃদুগ্ধ খাওয়ার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দস্যুবৃত্তি করে তার মায়ের দুধ খাওয়ার মধ্যে সেই তথাকথিত নীতিশীল মানুষের নৈতিকতার ছোঁয়া কতটুকু আছে সেই আলোচনা আপাততঃ জলাঞ্জলি দিয়ে সেই ছিনিয়ে নেয়া দুধ তাঁর (মানুষের) জন্য কতটুকু উপকারী সেই বিষয়টিই আজ আমার এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
মাতৃদুগ্ধ বনাম গরুর দুধ:
আমার এই নিবন্ধটি যেহেতু বয়স্ক মানুষের গরুর দুধ খাওয়া নিয়ে আর বয়স্ক মানুষেরা যেহেতু মানুষের দুধ খায় না সেই হিসাবে গরুর দুধের সাথে মাতৃদুগ্ধের তুলনা অপ্রাসঙ্গিক। তবে এখনো অনেক মায়েরাই যারা বিভিন্ন কারণে তাদের নবজাত শিশুকে তাদের নিজের স্তন্যদুগ্ধ খাওয়ানোর পরিবর্তে গরুর দুধ বা কৌটার পাউডার দুধ খাওয়ানোর কথা চিন্তা করেন বা খাওয়াতে বাধ্য হন, এই নিবন্ধের বিশেষ আলোচনায় যাওয়ার আগে, তাদের জন্য গরু এবং মানুষের দুধের এই ছোট্ট আলোচনাটুকু হয়তো কোনভাবে কাজে লাগলে লাগতেও পারে।
উপরে উল্লেখিত টেবিলটির দিকে লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন যে গরুর দুধ এবং মানুষের দুধের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পরিমানের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান এবং এই সকল উপাদানের গুণগত মানও দুই দুধের মধ্যে অনেক ভিন্নতা বিদ্যমান। কারণ প্রকৃতি সঙ্গত কারণেই গরুর দুধের নকশা করেছে গরুর বাচ্চার যথাযথ পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য এবং মানুষের দুধ তৈরী করেছে মানবশিশুর মস্তিষ্ক এবং শরীরের পরিপূর্ণ রূপে বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য। জন্মের পর পরই গরুর বাচ্চার শরীর মানবশিশুর শরীরের তুলনায় অধিক দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় - যেমন জন্মের পর প্রায় ৪০ দিনে গরুর বাচ্চার ওজন দ্বিগুন হয় আর মানুষের বাচ্চার ওজন দ্বিগুন হতে সময় লাগে প্রায় ১৮০ দিন (জন্মের সময় একটি মানুষের বাচ্চার ওজন গড়ে প্রায় ৩.০ কেজি আর একটি গরুর বাচ্চার ওজন গড়ে প্রায় ৩০.০ কেজি থাকে )। কাজেই গরুর দুধে মানুষের দুধের তুলনায় আমিষের (protein) পরিমান বেশি এবং এই আমিষের গুণগত মানও গরুর দুধে এবং মানুষের দুধে এক না। যেকোন দুধে মূলতঃ দুই ধরণের আমিষ থাকে – ক্যাসিন (casein) এবং ওযে–প্রোটিন (whey protein)। গরুর দুধে এই ক্যাসিন ও ওয়ে-প্রোটিনের অনুপাত ৮২ : ১৮, অর্থাৎ মোট আমিষের ৮২ শতাংশ ক্যাসিন এবং ১৮ শতাংশ ওয়ে-প্রোটিন, অপরদিকে মানুষের দুধে এই ক্যাসিন এবং ওয়ে-প্রোটিনের অনুপাত ৩১.৭: ৬৮.৩, অর্থাৎ মোট আমিষের ৩১.৭ শতাংশ ক্যাসিন এবং ৬৮.৩ শতাংশ ওয়ে–প্রোটিন। তুলনামূলকভাবে ক্যাসিন আমিষ হজম করা কঠিন আর তাই মানুষের দুধে ক্যাসিন আমিষের পরিমান কম। আবার এই গরুর দুধের ক্যাসিন আমিষ এবং মানুষের দুধের ক্যাসিন আমিষ; গরুর দুধের ওয়ে প্রোটিন এবং মানুষের দুধের ওয়ে-প্রোটিনের মধ্যেও গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান। ফলে গরুর দুধের আমিষ মানুষের বাচ্চার জন্য উপযোগী নয়। আমিষ তৈরী হয় অ্যামিনো অ্যাসিড (amino acid) দ্বারা এবং মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয়((যা আমাদের শরীরে তৈরী হয় না, খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের গ্রহণ করতে হয়) অ্যামিনো অ্যাসিড হলো ৯টি (lysine, leucine, isoleucine, valine, threonine, tryptophan, methionine, phenylalanine এবং histidine) এবং এর মধ্যে একটি হলো লিউসিন (Leucine)। এই লিউসিন অ্যামিনো অ্যাসিড শরীরের বৃদ্ধির সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কক্ত - মানব শিশুর তুলনায় গরুর বাচ্চার বৃদ্ধি অনেক দ্রুত বিধায় লিউসিন অ্যামিনো অ্যাসিড-এর পরিমান গরুর দুধে (৩.৩ %) মানুষের দুধের (০.৭%) চেয়ে পরিমানে প্রায় পাঁচগুণ বেশি।
মানবশিশুর প্রয়োজনের তাগিদেই মাতৃদুগ্ধে চর্বির (fat) পরিমান গরুর দুধের চেয়ে কিছুটা বেশি (গরুর দুধে ৩. ৬% এবং মানুষের দুধে ৪. ২%) এবং এই দুই ধরণের দুধের চর্বির গুণগত মানেও অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। গরুর দুধে সম্পৃক্ত চর্বির (saturated fatty acid) পরিমান ২.৪%, মনো-অসম্পৃক্ত চর্বির (unsaturated fatty acids) পরিমান ১.১% এবং পলি-অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমান (poly-unsaturated fatty acids) ০.১%; অপরদিকে মানুষের দুধে এই মনো-অসম্পৃক্ত চর্বি (mono-unsaturated fatty acids) (১.৬%) এবং পলি-অসম্পৃক্ত চর্বি (poly-unsaturated fatty acids) (০.৬% )-এর পরিমান গরুর দুধের চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু সম্পৃক্ত চর্বির (saturated fats) (১.৮%) পরিমান অনেক কম। মানুষের দুধে এই অসম্পৃক্ত চর্বি বেশি পরিমানে থাকার সাথে মানুষের মস্তিষ্ক গঠনের জন্য এই অসম্পৃক্ত চর্বির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্ক যুক্ত। আমরা জানি মানুষের মস্তিষ্ক (বা যেকোন প্রাণীর মস্তিষ্ক) মূলত জল এবং চর্বি দ্বারা গঠিত এবং মানবমস্তিষ্ক জন্মের প্রথম এক বৎসর মানুষের শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় অধিক দ্রুতহারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং গরুর ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টাটা ঘটে - গরুর শরীরের বৃদ্ধির হার তার মস্তিষ্কের তুলনায় অধিক। এছাড়াও মানুষের দুধে মানুষের মস্তিষ্ক গঠনের এবং কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় দুটি ফ্যাটি অ্যাসিড - arachdonic acid এবং docosahexaenoic acid থাকে যা গরুর দুধে অনুপস্থিত।
গরুর দুধে ক্যালসিয়ামের (calcium) পরিমান (১২০ মিলিগ্রাম প্রতি ১০০ মিলিলিটার দুধে) মানুষের দুধের (৩০ মিলিগ্রাম প্রতি ১০০ মিলিলিটার দুধে) তুলনায় চারগুন বেশি এবং এর পিছনে সঙ্গত কারণ আছে আর তা হলো জন্মের পর মানুষের বাচ্চার তুলনায় গরুর বাচ্চার দ্রুত বৃদ্ধি এবং মানব শিশুর তুলনায় বৃহত্তর শারীরিক হাড় অবকাঠামোর কারণে গরুর বাচ্চার ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন অধিক। কিন্তু মানুষের বাচ্চার জন্য এই অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম ক্ষতিকর। গরুর দুধে লোহার পরিমান মানুষের দুধের তুলনায় অনেক কম কিন্তু সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস এবং ক্লোরাইডের পরিমান মানুষের দুধের তুলনায় অধিক যা মানুষের বাচ্চার জন্য অনুপযোগী। গরুর দুধে লোহার পরিমান মানুষের দুধের তুলনায় কম থাকার কারণে দেখা গেছে যে মানব শিশুরা তাদের মায়ের দুধের পরিবর্তে গরুর দুধে লালিত-পালিত হয় তাদের শরীরে লোহার অভাব দেখা দেয়।
এছাড়াও মায়ের দুধে মানবশিশুর শরীরে বিভিন্ন রোগজীবাণুর সংক্রমনের প্রতিরোধের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান (anti-infective properties) থাকে যা গরুর দুধে অনুপস্থিত।
বয়স্ক মানুষের খাবার হিসাবে গরুর দুধ:
প্রকৃতিগতভাবেই দুধ বাচ্চাদের খাবার এবং গরুর দুধ গোমাতা তাঁর বাচ্চা জন্ম দেবার পর তাঁর ওলানে তৈরী হয়। এই দুধ মানুষের বাচ্চার জন্য উপযোগী নয় আর বয়স্ক মানুষের জন্যতো নয়ই। কিন্তু এই প্রাকৃতিক সত্য সত্বেও বয়স্ক মানুষেরাও যেহেতু গোদুগ্ধ খায় কাজেই এখানে আলোচনা করবো এই গোদুগ্ধ বয়স্ক মানুষের খাবার হিসাবে কতটা উপযোগী এবং গরুর দুধে নিহিত বিভিন্ন উপাদান বয়স্ক মানুষের শরীরে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
গরুর দুধের আমিষ:
প্রত্যেকটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাতৃদুগ্ধে তাদের বাচ্চাদের প্রয়োজন অনুসারে প্রকৃতি তাদের দুধেও সেইভাবে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সংযোজিত করেছে। প্রতি ১ লিটার মানুষের দুধে প্রোটিনের পরিমান ১১ গ্রাম এবং গরুর দুধে তার পরিমান প্রতি ১ লিটারে ৩৪ গ্রাম এবং ইঁদুরের দুধে ১২০ গ্রাম। তুলনামূলক ভাবে বিবর্তনের নিয়মে সেই প্রজাতির মায়ের দুধে এই আমিষের পরিমান নির্ভর করে জন্মের পর সেই প্রজাতির বাচ্চার বৃদ্ধি হারের উপর ! যে সকল প্রাণীর বাচ্চার বৃদ্ধি হার তুলনামূলকভাবে বেশি তাদের মায়ের দুধে আমিষের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে! জন্মের পর ইঁদুরের বাচ্চার বৃদ্ধির হার গরুর বাচ্চার তুলনায় অধিক আবার গুরুর বাচ্চার বৃদ্ধির হার মানুষের বাচ্চার তুলনায় অধিক এবং আমিষের পরিমানও ইঁদুরের দুধে গরুর দুধের চেয়ে বেশি এবং গরুর দুধে মানুষের দুধের চেয়ে বেশি। দুধে দুই ধরণের আমিষ থাকে: ক্যাসিন (casein) এবং ওয়ে-প্রোটিন (whey protein) এবং এই casein এবং whey protein প্রোটিনের অনুপাত ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীতে ভিন্ন রকম। গরুর দুধে এর অনুপাত ৮২ : ১৮ অর্থাৎ ৮২ ভাগ casein এবং ১৮ ভাগ whey protein; মানুষের দুধে এই অনুপাত ৩১.৭: ৬৮.৩, অর্থাৎ ৩১.৭ ভাগ ক্যাসিন এবং ৬৮.৩ ভাগ ওয়ে প্রোটিন। এর থেকে হিসেবে করে বলা যায় যে মানুষের দুধে ক্যাসিন (casein) নামক আমিষের পরিমান গরুর দুধের চেয়ে প্রায় ৫ গুনেরও কিছু বেশি। আমাদের শরীরে এই ক্যাসিন আমিষ বিপাকের জন্য যে এনজাইম প্রয়োজন হয় তা হলো রেনিন (rennin) এবং শিশুরা যেহেতু মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয় তাই দুধের এই ক্যাসিন আমিষ হজমের জন্যে শিশুদের পাকস্থলীতে এই এনজাইম তৈরী হয় কিন্তু যখন থেকে শিশু মায়ের দুধ খাওয়া ত্যাগ করে অন্য খাবার খেতে শুরু করে তখন মানুষের পাকস্থলীতে এই রেনিন উৎপাদন আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। শিশুর বয়স ৩-৪ বৎসর হয়ে গেলেই সামান্য কিছু পরিমান মানুষ ছাড়া সকলেরই পরিপাক নালিতে আর রেনিন তৈরী হয় না! যদিও গবেষণায় দেখা গেছে বিবর্তনের ধারায় প্রায় ৬০০০ বছর আগে থেকে মানুষ পশুপালন শুরু করে এবং অন্য পশুর (বিশেষ করে গরুর) দুধ খেতে শুরু করে ফলে বিবর্তনের নিয়মে কিছু কিছু মানুষের শরীরে কিছু রেনিন উৎপাদন হলেও তার পরিমান খুবই অল্প তাই এখন দুধ বা দুধের তৈরী খাবার খেলে অনেকেরই বদহজম হয়। গরুর দুধের বেশিরভাগ ক্যাসিন আমিষই মানুষের শরীরে হজম হয় না এবং এবং এই অব্যবহৃত ক্যাসিন আমিষ আমাদের খাদ্যনালিতে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পঁচে গিয়ে একধরণের ঘন শ্লেষ্মা (mucus) তৈরী হয়ে আমাদের শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে (mucus membrane) লেগে থাকে এবং এই ঝিল্লির স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে! আমাদের শরীরে গরুর দুধের অতিরিক্ত ক্যাসিন বিপাকের কোন প্রক্রিয়া বিদ্যমান নেই। গবেষণায় দেখা গেছে গরুর দুধের এই অতিরিক্ত ক্যাসিন আমিষ মানুষের গলার গলগণ্ডের বৃদ্ধি ও থাইরয়েডের অনেক জটিলতার জন্য সরাসরি দায়ী। এ ছাড়াও গরুর দুধের এই অতিরিক্ত ক্যাসিন আমিষ টাইপ ১ ডায়াবেটিস সহ মানুষের অনেক প্রকার রোগ এবং এলার্জির সাথে সম্পর্কিত।
গরুর দুধের শর্করা:
দুধে যে শর্করা থাকে তার নাম ল্যাকটোজ (lactose) এবং এই ল্যাকটোজ বিপাকের জন্য যে এনজাইমটি প্রয়োজন তার নাম ল্যাকটেস (lactase)। এই ল্যাকটেস ক্ষুদ্রান্তে ল্যাকটোজ ভেঙে দেহে এর বিপাকে কাজ করে। শিশুর বয়স ৩-৪ বৎসর হয়ে গেলেই সামান্য কিছু পরিমান মানুষ ছাড়া সকলেরই পরিপাকনালিতে আর ল্যাকটেস এনজাইমটি তৈরী হয় না! মানবশিশু মায়ের দুধ খাওয়া শেষ হওয়ার পর থেকে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে আর ল্যাকটেস এনজাইম তৈরী হয় না, কারণ কৌলিতাত্বিকভাবেই বয়স্কদের জন্য খাদ্য হিসাবে দুধের প্রয়োজন নাই - দুধ প্রয়োজন কেবল ছোট শিশুদের জন্য। তবে গবেষণায় দেখা গেছে উওর ইউরোপের মানুষেরা যারা হাজার হাজার বছর ধরে গোপালনের কারণে তাদের শরীরে কিছু মিউটেশনের ফলে তাদের মাত্র ২ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে ল্যাকটেসের ঘাটতি দেখা যায় এবং এই ল্যাকটেস ঘাটতির পরিমান মধ্য-ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ২৩ শতাংশ এবং এশিয়ানদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ। খাদ্যনালীতে যথেষ্ট পরিমানে ল্যাকটেস এনজাইম উৎপাদন না হলে ক্ষুদ্রান্তে এই ল্যাকটোজ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গাঁজান হয় যার ফলে গ্যাস সৃষ্টি, বদহজম, অন্ত্রে ব্যাথা, ডায়রিয়া, বমি সহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে এবং এই অবস্থাকে বলে ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা (Lactose intolerance.। এই Lactose intolerance এর প্রাদুর্ভাব সব থেকে বেশি দেখা যায় আফ্রিকায় (৫৫ থেকে ৯৯ শতাংশ), এশিয়ায় (৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ ), আদিবাসী আমেরিকান (৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ ) এবং আফ্রিকান -আমেরিকানদের মধ্যে (৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ )!
গরুর দুধের চর্বি:
অন্যান্য উপাদানের মত প্রত্যেক প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর তাদের স্ব স্ব বাচ্চাদের দৈহিক গঠন ও প্রয়োজন অনুসারে তাদের দুধেও চর্বির ভিন্নতা দেখা যায় যেমন গরুর দুধে চর্বির পরিমান প্রায় ৩.৬ শতাংশ, মাতৃদুগ্ধে এর পরিমান ৪. ২ শতাংশ, কিন্তু ধূসর সিলমাছের দুধে তার পরিমান ৫০ শতাংশের বেশি। সিলমাছের দুধে এতো বেশি পরিমানে চর্বি থাকার কারণ হলো সিলের বাচ্চাকে হিম শীতল জলে বেঁচে থাকার জন্যে তার শরীরে অনেক জমা চর্বি অত্যাবশ্যক। আবার মানুষ এবং গরুর দুধে মোট চর্বির পরিমান কাছাকাছি হলেও এতে সম্পৃক্ত এবং অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমানের তারতম্য আছে। গরুর দুধে সম্পৃক্ত চর্বির (saturated fatty acids) পরিমান ২.৫ ভাগ, মনো-অসম্পৃক্ত চর্বির (mono unsaturated fatty acids) পরিমান ১.0 ভাগ এবং পলি অসম্পৃক্ত চর্বির (poly unsaturated fatty acids) পরিমান ০.১ ভাগ, অপরদিকে প্রতি ১০০ গ্রাম মাতৃদুগ্ধে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমান ১.৮ গ্রাম, মনো অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমান ১.৬ গ্রাম এবং পলি অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমান ০,৫ গ্রাম। মানুষের দুধে এই বেশি পরিমান অসম্পৃক্ত চর্বি থাকা মানব শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে অসম্পৃক্ত চর্বির গুরুত্ব নির্দেশ করে। মানব শিশুর জন্মের পর তার শরীরের তুলনায় মস্তিষ্ক অতি দ্রুত বড় হতে থাকে এবং প্রথম এক বৎসরে তার আকৃতি তিনগুন বড় হয়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে যেকোন প্রাণীর মগজ মূলত চর্বি দ্বারা তৈরী এবং মানব শিশুর জন্মের শুরুতে তার মস্তিষ্কের গঠন এবং যথাযথ কার্যকারিতার জন্য যথেষ্ট পরিমানে প্রয়োজনীয় অসম্পৃক্ত চর্বি (unsaturated fatty acids) অত্যাবশ্যক। আমেরিকান হৎপিন্ড এসোসিয়েশন (American Heart Association )-এর মতে গরুর দুধের অতিরিক্ত সম্পৃক্ত চর্বি (saturated fatty acids) এবং কোলেস্টেরল রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোক -এর ঝুঁকি বাড়ে।
ক্যালসিয়াম (Calcium) ও গরুর দুধ:
ক্যালসিয়ামের কথা আসলেই দুধের কথা আসে বা দুধের কথা আসলেই ক্যালসিয়ামের কথা আসে। বয়স্ক মানুষের গরুর দুধ খাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রচারণা হলো যে দুধ না খেলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি ঘটবে এবং হাড় দুর্বল হয়ে ওস্টিওপোরোসিস রোগ (Osteoporosis)-এ আক্রান্ত হবে। দুধ খাওয়া বা না খাওয়ার সাথে শরীরে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ বা এর সাথে ওস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis)-এর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার পূর্বে "ক্যালসিয়াম" এবং "ওস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis)" রোগটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
মানুষের শরীরের অনেক প্রয়োজনীয় উপাদানের সাথে একটি উপাদান হলো খনিজ পদার্থ (minerals)। মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি এবং স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্যে যে ১৫ টি খনিজ পদার্থকে প্রয়োজনীয় (essential) হিসাবে গণ্য করা হয় তারা হলো ক্যালসিয়াম (calcium), ফসফরাস (phosphorus) পটাসিয়াম (potassium), সোডিয়াম (sodium), ক্লোরাইড (chloride), সালফার (sulfur), ম্যাগনেসিয়াম (magnesium), লৌহ (iron), দস্তা (zinc), আয়োডিন (iodine), তামা (copper), ফ্লোরাইড (fluoride)), মলিবডেনাম (molybdenum), ম্যাঙ্গানিজ (manganese), সেলেনিয়াম (selenium) ক্রোমিয়াম (chromium) এবং কোবাল্ট (cobalt - যা ভিটামিন B 12 /cobalamine এর অংশ) । মানুষের শরীরে যে খনিজ পদার্থটি সবচেয়ে বেশি পরিমানে বিদ্যমান তা হলো ক্যালসিয়াম এবং এর পরেরটি হলো ফসফরাস এবং এই দুটি খনিজ পদার্থ দেহের আমিষ-সমৃদ্ধ উপাদানের সহিত মিলিত হয়ে আমাদের হাড় এবং দাঁত তৈরির প্রধান উপকরণ হিসাবে কাজ করে। গড়ে প্রত্যেকটি মানুষের শরীরের প্রায় ২.৩ শতাংশ ক্যালসিয়াম অর্থাৎ একজন ১০০ কেজি ওজনের মানুষের প্রায় ২.৩ কেজি হলো ক্যালসিয়াম এবং আমাদের শরীরের মোট ক্যালসিয়ামের প্রায় ৯৯ শতাংশই থাকে হাড়ে এবং দাঁতে এবং বাকি মাত্র এক শতাংশ থাকে কোষ, রক্ত এবং অন্যান্য তরল অংশে। হাড় এবং দাঁতের গঠন এবং সুরক্ষার জন্য যেমন ক্যালসিয়াম প্রধান উপাদান তেমনি শরীরে ক্যালসিয়াম প্রয়োজনীয় আরো অনেক কাজ সম্পন্ন করতে ভূমিকা রাখে, যেমন হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ, রক্ত জমাট বাঁধা, রক্তনালী এবং মাংসের সংকোচন-প্রসারণ, এনজাইম এবং হরমোনের নিঃসরণ এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সুষ্ঠূ কার্যক্রম। শরীরে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম জমা হলে তাকে বলে হাইপারক্যালসিমিয়া (hypercalcemia) যা শরীরে অন্যান্য খনিজ পদার্থ শোষণে বাঁধা সৃষ্টি করে এবং কিডনির সুষ্ঠূ কার্যক্রমেও বিঘ্ন ঘটায়। হাড় এবং দাঁতের সুরক্ষা ব্যতীত শরীরের অন্যান্য কাজের জন্য ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিলে হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নির্গত হয়ে রক্তে এবং নরম কোষে বাহিত হয়ে শরীরের অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য ক্যালসিয়ামের যোগান দেয়। শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ ক্রমাগত ভাবে কম হতে থাকলে বা অন্যান্য কারণে শরীরে ক্যালসিয়ামের ভয়ানক ঘাটতি দেখা দিলে, হাড় থেকে ক্রমাগত ক্যালসিয়াম নিঃসরণ হতে থাকে এবং এইভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ হাড়ের ক্যালসিয়াম নিঃসরণ চলতে থাকলে হাড় ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে এবং দুর্বল হতে হতে একসময় হাড় ঝাঁজরা ও ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং তখন সামান্য হাঁচিতে, উঁচু-নীচু রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে বা কারো সাধারণ বন্ধু সুলভ আলিঙ্গনে বুকের বা কোমরের হাড় ভেঙে যেতে পারে। মানুষের এই অবস্থাকে বলে ওস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis)। মানুষের শরীরে এই ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিতে পারে বিভিন্ন কারণে। আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম এককভাবে কাজ করতে পারে না - অন্যান্য খনিজ পদার্থের সহযোগে এটি শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ফসফরাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের যথাযথ ব্যবহারের জন্য ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের অনুপাতঃ হতে হয় ২ : ১, অর্থাৎ ২ ভাগ ক্যালসিয়ামের জন্য প্রয়োজন হয় ১ ভাগ ফসফরাস। অতিরিক্ত ফসফরাসযুক্ত খাবার খেলে (যেমন ফসফরাস যুক্ত কোমল পানীয় কোকাকোলা, পেপসি ইত্যাদি) রক্তে ফসফরাসের আধিক্য দেখা দেয় এবং তখন রক্তে এই ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের অনুপাত (২: ১) ঠিক করার জন্য হাড়ের থেকে ক্যালসিয়াম নির্গত হয়ে রক্তে আসে। এখানে উল্লেখ্য যে যদি ক্যালসিয়াম রক্তের এই অতিরিক্ত ফসফরাসকে নিয়ন্ত্রণ না করে, শরীরের এই অতিরিক্ত ফসফরাস জীবনের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। কোমল পানীয় ছাড়া আর যে দুটি খাবারে অতিরিক্ত ফসফরাস থাকে তাহলো প্রাণীজ খাবার এবং দুধ জাতীয় খাবার। মাংসে ক্যালসিয়ামের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি ফসফরাস থাকে। ফসফরাস ছাড়া আরো একটি খনিজ পদার্থ শরীরে ক্যালসিয়ামের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন তা হলো ম্যাগনেশিয়াম (magnesium)। শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণের জন্য ম্যাগনেশিয়াম প্রয়োজনীয়। রক্তের মাধ্যমে হাড়ে ক্যালসিয়াম বহন করার জন্য ম্যাগনেশিয়াম দরকার। তবে আমাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন ম্যাগনেশিয়ামের দ্বিগুণ কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ক্যালসিয়াম গ্রহণ করে কারণ সাধারণভাবে খাবারে ম্যাগনেশিয়ামের তুলনায় ক্যালসিয়ামের পরিমান অনেক অনেক বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে মানুষ কম পরিমান ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে শরীরে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়ামের আনুপাতিক অধিকতর সমতার কারণে শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণ তুলনামূলকভাবে বেশি ভাল হয়। অন্যদিকে আবার অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার শরীরে ম্যাগনেশিয়াম শোষণ বাধাগ্রস্থ করে। এখানে উল্লেখ্য যে গরুর দুধে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের তুলনায় ম্যাগনেশিয়ামের পরিমান খুবই সামান্য। আমাদের পাকস্থলীতে ক্যালসিয়ামের শোষণের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ আর একটি উপাদান হলো ক্যালসিট্রিওল (calcitriol: a form of vitamin D3)। এই ক্যালসিট্রিওল রক্তের মাধ্যমে শরীরে চলাচল করে শরীরে ক্যালসিয়ামের আত্মীকরণ নিয়ন্ত্রণ করে! অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে শরীরে ক্যালসিট্রিওল উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ফলে শরীরে ক্যালসিয়ামের সুষ্ঠূ বিপাক হয় না এবং এই জন্য দেখা গেছে পৃথিবীতে যে সকল দেশে ক্যালসিয়াম গ্রহণের পরিমান কম সে সকল দেশের মানুষের মধ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি জনিত লক্ষণ প্রায় নাই বলেই চলে ।
আমাদের খাদ্য এবং অনেক অভ্যাস যা আমাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি ঘটিয়ে আমাদেরকে অস্টেওপরোসিসের (Osteoporosis) মত ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত করতে পারে সে গুলির মধ্যে কয়েকটি হলো:
•তামাক (tobacco): আমাদের রক্ত ক্ষার (alkaline) ! আমরা অতিরিক্ত অম্ল (acid) উৎপাদনকারী খাবার খেলে আমাদের শরীর অম্ল-ক্ষার সমতা রক্ষা করার প্রয়োজন দেখা দেয় এবং আমাদের এই কাজটি করে আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম। ধূমপান শরীরে অতিরিক্ত অম্ল উৎপাদন করে এবং এই অতিরিক্ত অম্লকে নিরপেক্ষ করার জন্য অনেক সময় শরীরের হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নির্গত হয়।
•মদ (alcohol): মদ যকৃতের (liver) ভিটামিন ডি (vitamin D)-এর সক্রিয়করণ করার ক্ষমতাকে দুর্বল করে শরীরে ক্যালসিয়াম গ্রহণের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্থ করে।
•ক্যাফিন (caffeine); এটি চা, কফি, চকোলেট বা অনেক কোমল পানীয়ে (কোক, পেপসি) এবং অনেক over the counter medicine ((উন্নত দেশে যে সকল ঔষধ কেনার জন্য কোন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন প্রয়োজন হয় না) ঔষধে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে এই ক্যাফিন স্বাভাবিকের তুলনায় হাড় থেকে প্রায় দ্বিগুণ পরিমান ক্যালসিয়াম নির্গত করে অস্টিওপরোসিস রোগে আক্রান্ত হতে ভূমিকা রাখে।
•কোমল পানীয় (soft drinks): অনেক কোমল পানীয়ে ফসফরিক এসিড থাকে। অতিরিক্ত এই ধরণের পানীয় পান করলে রক্তে ফসফরাস মাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং তখন শরীরে ক্যালসিয়াম - ফসফরাসের সমতা (২: ১ ) রক্ষার জন্য হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নির্গত হয়ে রক্তস্রোতে চলে আসে। যদি ক্যালসিয়াম রক্তের এই অতিরিক্ত ফসফরাস নিয়ন্ত্রণ না করে তবে রক্তের এই অতিরিক্ত অম্লতা মানুষের জীবনের ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
•লবন (salt): মাংস জাতীয় খাবারে অনেক সোডিয়াম থাকে এবং গবেষণায় দেখা গেছে শরীর যত বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করে শরীর থেকে তত বেশি ক্যালসিয়াম নির্গত হয়ে যায়।
•এন্টাসিড জাতীয় ঔষধ (antacids): অনেক এন্টাসিড জাতীয় ঔষধে এলুমিনিয়াম (aluminium) থাকে এবং এই এলুমিনিয়াম শরীর থেকে ক্যালসিয়াম নির্গত হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। অধিকন্তু, আমাদের পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিড নির্গত হয় যা শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে কিন্তু এই এন্টাসিড জাতীয় ঔষধ হাইড্রোক্লোরিক এসিডকে নিরপেক্ষ (neutral) করে ফেলে ফলে শরীরে ক্যালসিয়ামের গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
•অপর্যাপ্ত শরীরচর্চা (insufficient exercise): আজ এটা প্রমাণিত সত্য যে যথোপযুক্ত শরীরচর্চার ফলে হাড়ের ভর (mass) এবং ঘনত্ব (density) বৃদ্ধি প্রায় এবং অপর্যাপ্ত শরীরচর্চার পরিণতিতে হাড়ের ক্ষয় হয়। এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে শরীরচর্চা হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নির্গত হওয়ার কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হাড়ের পুনর্গঠনে সহায়তা করে। ব্যায়াম যেমন আমাদের মাংসপেশিকে সবল করতে সহায়তা করে তেমনি ব্যায়াম আমাদের হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ও হাড়কে সজীব রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে! শরীরচর্চা এবং অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ হাড় কাঠামোর উপর চাপ প্রয়োগ করে এবং এর ফলে এই চাপ নতুন হাড় গঠন উদ্দীপিত করে।
•সূর্যালোকের অভাব (lack of sunshine): শরীরে হাড়ের বিপাকে ভিটামিন ডি (vitamin D)বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেহেতু আমাদের শরীরে সূর্যালোকই ভিটামিন ডি তৈরী করার প্রধান উৎস কাজেই দীর্ঘ দিন যাবৎ সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত থাকা বা খুবই স্বল্প পরিমানে সূর্যালোক পাওয়া শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি ঘটাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
•প্রাণীজ খাবার (animal products): তবে উপরের অস্টিওপরোসিস এর এতগুলো কারণ আলোচনা করার পর আর একটি কারণ সম্বন্ধে আলোচনা না করলেই নয় এবং গবেষকদের মতে এই কারণটি হলো একটি প্রধান এবং অনেক বেশি ক্ষতিকর আর সেটি হলো প্রাণীজ খাবার। "প্রাণীজ আমিষই মানুষের জন্য সেরা আমিষ" মাংস শিল্পের এমন একটি ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণার ফলে বেশিরভাগ মানুষই তা বিশ্বাসও করে, কিন্তু বাস্তব সত্যটি হলো তার উল্টা। এমন একটি প্রচারণার ফলশ্রুতিতে অধিকাংশ ধনী দেশগুলিতে মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আমিষ গ্রহণ করে এবং তা মূলত মাংস, ডিম আর দুধ থেকে। বর্তমানে আমেরিকার National Institutes of Health এবং Harvard Medical School-এর সুপারিশ অনুসারে একজন বয়স্ক মানুষের সর্বনিম্ন আমিষ গ্রহণের পরিমান হলো (RDA – Recommended Daily Allowance) প্রতি কেজি শরীরের ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম আমিষ যার অর্থ হলো যার ওজন ৭০ কেজি তার প্রতিদিন আমিষের প্রয়োজন মাত্র ৫৬ গ্রাম। কিন্তু দেখা গেছে গড়ে একজন আমেরিকান ১০০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করে যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। শুধু তাই নয় অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে আসলে মানুষের প্রতিদিন আমিষ গ্রহণের প্রয়োজন সুপারিশকৃত পরিমানের চেয়েও কম। আর এখন মাংস বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর ব্যাপক প্রচারের কারণে বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে যে প্রাণীজ আমিষ উদ্ভিজ্জ আমিষের চেয়ে শ্রেয়তর, কিন্তু সত্যি হলো অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে কোন প্রাণীজ খাবার ছাড়াই কেবল মাত্র উদ্ভিজ্জ খাবার (ফল-মূল, শাক-সবজি, দানাদার, সিমজাতীয়, বাদামজাতীয় শস্য, তেল-বীজ জাতীয় শস্য ইত্যাদি) খেয়েই মানুষ সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবে জীবন- যাপন করতে পারে। আমরা জানি এখন দিন দিন সারা বিশ্বে সম্পূর্ণ নিরামিষাশীর (vegan) সংখ্যা বেড়েই চলছে।
এবার দেখা যাক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত আমিষ - বিশেষ করে প্রাণীজ আমিষ খেলে শরীরে এর প্রতিক্রিয়া কী হয়। আমাদের শরীরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমিষ ভেঙে প্রথমে এমিনো এসিডে রূপান্তরিত হয় এবং এর কিছু যকৃতে (liver) বিপাক হয়ে ইউরিয়া হিসাবে কিডনি দিয়ে বের হয় । কিন্তু যখন শরীরের অতিরিক্ত আমিষ এমিনো এসিড এবং ইউরিয়া হিসাবে মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে নির্গত হয় তখন এর সাথে শরীর থেকে অনেক ধরণের খনিজ পদার্থও বের হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে আমরা খাবার হিসাবে যত বেশি অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণ করি আমাদের শরীর থেকে তত বেশি পরিমানে ক্যালসিয়াম নির্গত হয়ে যায়। গবেষণায় এও দেখা গেছে যে অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার কারণে শরীর থেকে বিশাল পরিমান ক্যালসিয়াম নির্গত হওয়ার ফলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঋণাত্বক (নেতিবাচক) সমতা (negative balance) দেখা দেয়। এই পৃথিবীর আর্কটিক অঞ্চলে বসবাসরত ইনুইটরা (এস্কিমো) অতিরিক্ত আমিষ ভক্ষণকারীদের মধ্যে অন্যতম - কখনো কখনো তারা দিনে ৪০০ গ্রামেরও অধিক আমিষ গ্রহণ করে ফলে তাদের মধ্যে অস্টিওপরোসিস রোগীর সংখ্যাও অধিক ।
দুধ: এবার আসা যাক গরুর দুধের কথায় - গরুর দুধ কি আসলেই আমাদের শরীরের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণের জন্য একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য কি না বা অস্টিওপরোসিস রোগ নিয়ন্ত্রণে কোন ভূমিকা রাখতে পারে কি না। প্রথমেই বলা যাক পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি দেশ যেখানে জনপ্রতি বাৎসরিক দুধ গ্রহণের পরিমান সব থেকে বেশি তারা হলো ফিনল্যান্ড (মাথাপিছু ৪৩০.৭৬ কেজি/বৎসর), মন্টেনেগ্রো (৩৪৯.২১ কেজি/বৎসর), নেদারল্যান্ডস (৩৪১.৪৭ কেজি/বৎসর), সুইডেন (৩৪১.২৩ কেজি/বৎসর) এবং সুইৎজারল্যান্ড (৩১৮.২৩ কেজি/বৎসর) এবং এর মধ্যে দুটি দেশই (ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন) ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত রোগ অস্টিওপরোসিস রোগীর সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসাবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রেও মাথাপিছু দুধ গ্রহণের পরিমান অনেক উপরে (যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্বোচ্চ দুধ গ্রহীতার তালিকায় ১৭ তম - তাদের মাথাপিছু বাৎসরিক দুধ গ্রহণের পরিমান ২৫৪.৬৯ কেজি), কিন্তু এই যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫,০০০,০০০ থেকে ২০,০০০,০০০ লোক অস্টিওপরোসিস-এ আক্রান্ত। পৃথিবীর যে সকল এলাকায় দুধ গ্রহণের পরিমান কম সেখানে অস্টিওপরোসিস এর প্রকোপও কম (আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশ সমূহ)। আফ্রিকার বান্টু (Bantu) মেয়েদের নিয়ে অনেকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে যে তাদের মাথাপিছু আমিষ গ্রহণের পরিমান যুক্তরাষ্ট্রে লোকদের তুলনায় অর্ধেক, কিন্তু তাদের জীবনধারণ পদ্ধতির কারণে (তারা গড়ে ১০টি সন্তানকে লালন-পালন করে) তাদের ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন অনেক বেশি, কিন্তু তাদের মধ্যে অস্টিওপরোসিস রোগ প্রায় অনুপস্থিত। কাজেই অস্টিওপরোসিস এর প্রধান কারণ (মূলত মাংস এবং দুধ জাতীয় খাবার ) শরীরে ক্যালসিয়াম যথাযথ ভাবে শোষিত/হজম না হওয়া । যদিও মানুষ গরুর দুধ খায় এই ভেবে যে দুধ খেলে তার শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হবে না কিন্তু বাস্তবে নির্মম পরিহাস এই যে দুধ খেলে শরীরে দুধের ক্যালসিয়াম গৃহীত হবার পরিবর্তে দুধ অন্যান্য খাবার থেকে শরীরে ক্যালসিয়াম শোষিত হতে বাঁধা সৃষ্টি করে। গরুর দুধের ক্যালসিয়াম স্তুল প্রকারের এবং তা দুধের ক্যাসিন আমিষের সাথে সম্পৃক্ত থাকে বলে আমাদের শরীর তা যথাযথ ভাবে গ্রহণ করতে অপারগ এবং দুধের এই অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম হাড়ের ক্ষতি পূরণের পরিবর্তে এই ক্যালসিয়াম শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমা হয়ে কিডনি পাথর সহ আরো অন্যান্য অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে।
এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে তাহলে আমরা আমাদের শরীরে আমরা ক্যালসিয়াম পাব কোথা থেকে। এখানে প্রথমেই বলে নেয়া ভাল যে এই পৃথিবীতে সকল উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করার জন্যে যে ১৭ টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান তার মধ্যে ক্যালসিয়াম একটি। কাজেই মাটিতে যে সকল উদ্ভিদ জন্মায় তাদের সকলের মধ্যে ক্যালসিয়াম থাকে। তৃণভোজী প্রাণীরা ঘাস খায় এবং এর থেকে তারা তাদের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম পায়। গরুর দুধ যেখানে মানুষের দুধের তুলনায় ৪ গুন বেশি ক্যালসিয়াম থাকে সেই গরু তার সকল ক্যালসিয়াম পায় ঘাস এবং দানাদার শস্য থেকে, কারণ গরু তার অতি শৈশবে মাতৃদুদ্ধ খাওয়ার বয়স পেরিয়ে সারাজীবন আর এক ফোঁটা দুধও খায় না। কাজেই মানুষের জন্য সবুজ পাতা জাতীয় এবং অন্যান্য শাক-সবজি তার ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস হওয়া উচিত। সেই সাথে সকল কাঁচা বাদাম জাতীয় এবং বীজ জাতীয় খাবার, দানাদার জাতীয় শস্য, সীম জাতীয় সবজি, টাটকা এবং শুকনা ফল, এবং বিভিন্ন ধরণের তৈল জাতীয় শস্যে (তিল) প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে। কাজেই আমরা দুধ ছাড়া ক্যালসিয়ামের অভাবে ভুগতে পারি এটা মিথ্যা, মিথ্যা এবং একটি ডাহা মিথ্যা অজ্ঞাত প্রসূত এবং দুধের ব্যবসা জনিত প্রচারণা। কারণ এই পৃথিবীতে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীই শিশু বয়সে তাদের মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ার পর থেকে সারা জীবন আর কোন দুধ খায় না ।
এখানে ক্যালসিয়াম সম্বন্ধে আরেকটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক - শরীরে ক্যালসিয়াম ঘাটতির জন্য ডাক্তাররা হর হামেশাই ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ( calcium supplements - ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট) দিয়ে থাকে কিন্তু এই ক্যালসিয়াম শরীরে গৃহীত হয় খুবই সামান্য। যেকোন প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ আমরা যখন খাবারের মাধ্যমে (জৈব উৎস) গ্রহণ করি তখন তার শোষণ আমাদের শরীরে ভালো হয়! আরেকটি কথা অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে কারণে ওস্টিওপোরোসিস হয় সেই কারণগুলো দূর না করে দোকান থেকে কিনে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট (calcium supplements) খেলে এতে শরীরের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি! Calcium supplements এর বেশিরভাগই হলো সিদ্ধকরা পশুর হাড় বা ডোলোমাইট (dolomite) পাথর যার মধ্যে অনেক সময় লেড (lead) , আর্সেনিক (arsenic) বা পারদ (mercury) -এর মতো বিষাক্ত উপাদান থাকে! কাজেই এই ক্যালসিয়াম জাতীয় ঔষধ আমাদের শরীরের উপকারের পরিবর্তে আরো অনেক ক্ষতি সাধন করে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলাও প্রাসঙ্গিক যে কেন স্বাস্থ্য কর্মীরা এবং ঔষধ কোম্পানির কর্মীরা প্রাণীজ খাবার গ্রহণের সাথে শরীরের ক্যালসিয়াম ঘাটতির বিষয়টি অবজ্ঞা করে থাকেন এই প্রশ্নটি সকল সচেতন মানুষের মনে আসা স্বাভাবিক। এর উত্তরও খুবই সহজ যদি আমরা চিন্তা করি যে বর্তমানে সারা বিশ্বে মাংস, দুধ আর ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। এটাতো বলাই বাহুল্য মানুষকে মাংস আর গরুর দুধ খাওয়াতে যত বেশি প্রলুব্ধ করা যাবে ততই মাংস আর দুধ শিল্পের মুনাফা বৃদ্ধি আর এই অতিরিক্ত মাংস আর দুধ খাওয়ার ফলে যত ক্যালসিয়াম ঘাটতি হবে ততই ঔষধ শিল্পের ক্যালসিয়াম বিক্রি বাড়ানো যাবে, কাজে লাভ দুই দিক থেকেই। কাজেই মানুষ যদি সবুজ শাক সবজি, ফল, বাদাম আর বীজ খেয়ে তাদের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করে ফেলে তবে মাংস, দুধ আর ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট শিল্পের বিরাট লোকসান হতেই হবে। অতএব মানুষ স্বাস্থ্য বিষয়ে যত অজ্ঞ থাকবে এই সকল অর্থ শোষণকারী শিল্পের ততই পোয়াবারো।
পাস্তুরীকরণ ও গরুর দুধ:
এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণীই রান্না করে খাবার খায় না। এমনকি প্রকৃতিতে আমাদের যে নিকটতম আত্মীয় গরিলা, শিম্পাঞ্জি তারাও ফল মূল লতা পাতা পোকা মাকড় ইত্যাদি কোন রান্না করা ছাড়া টাটকা খায় এবং দিব্যি সুস্থ সবলভাবে জীবন-যাপন করে। আমরা সকলেই জানি এমনকি মাংসাশী প্রাণীরা যেমন বাঘ তিমিমাছ তারাও কিন্তু জীবিত প্রাণী শিকার করে জীবন নির্বাহ করে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা কিছু ফল-মূল আর কিছু সবজি ছাড়া প্রায় সবকিছুই রান্না করে খায়। আর এটাতো বলাই বাহুল্য মানব শিশু সহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাচ্চারাই সরাসরি তাদের মায়ের স্তন থেকে দুধ খায়। এখন পর্যন্ত এটি মানব জাতির জন্য আনন্দ সংবাদ যে মানুষ এই প্রাকৃতিক বিষয়টির বিরুদ্ধাচারণ করে মায়ের দুধ সিদ্ধ করে বাচ্চাকে খাওয়ানো শুরু করে নাই। এই আলোচনার শুরুতেই আবারও একটি কথার পুনরাবৃত্তি জরুরী যে দুধ আদৌ বয়স্ক মানুষের খাবার নয়। তবে দুধ বয়স্কদের খাবার নয় তা আমি যতই বলি কিন্তু বাস্তব সত্যি হচ্ছে এই সমস্ত পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য বয়স্ক মানুষ গরু, মহিষ বা ছাগলের দুধ খাচ্ছে এবং তা তারা মূলত চূলায় জ্বাল দিয়ে অথবা বাজার থেকে কেনা পাস্তুরিত দুধ খাচ্ছে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের আগ পর্যন্ত শত শত বছর ধরে মানুষ গরুর দুধ কোন প্রকার সিদ্ধ ছাড়া কাঁচা খেত। গরুর দুধ কাঁচা খেতে গেলে যে বিষয়গুলি জরুরি তা হলো একটি অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গরুর দুধ দোহন করতে হবে যাতে দোহনের সময় গরুর মূত্র, মল, ধুলা, বালি, পোকা, মাকড় বা জীবাণু দ্বারা দুধ দূষিত বা সংক্রমিত হতে না পারে এবং সেই গৃহ পালিত গাভীটি যেন রোগমুক্ত থাকে। আর একটি বিষয় হলো দুধ দোহন করার পর কত দ্রুত এটি গ্রহণ করা যায় । এই প্রসঙ্গে এটি বলা দরকার যে খুব সহজে অণুবীজ জন্মানোর জন্য দুধ একটি অতি উত্তম মাধ্যম; দুধ অতি সহজেই বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য রোগ জীবাণু দ্বারা দূষিত হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে দুধ বাজারজাত করার আগে পর্যন্ত এটি করা সহজ ছিল, কারণ তখন মানুষ তার নিজের প্রয়োজন মিটানোর জন্য তার নিজের বাড়িতে দুই একটা গরু লালন পালন করতো।
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় দুধ সংরক্ষণ করলে এতে ব্যাকটেরিয়া সহ অন্যান্য রোগ জীবাণু জন্মানো শুরু করে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের আগে পর্যন্ত দুধ শিল্প কেবল শহর এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল যাতে দুধ বিক্রেতা থেকে অতি দ্রুত দুধ ক্রেতার কাছে পৌঁছতে পারে , কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর বিক্রেতা থেকে ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর সময় বেড়ে যায় ফলে দুধের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে অনেক রোগ যেমন যক্ষা, ডিপথেরিয়া, স্কারলেট ফিভার ছড়াতে শুরু করে। ১৯১২ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে দুধের মাধ্যমে যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে কেবল ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসেই ৬৫০০০ লোক মারা যায়। তারপর একসময় উন্নত দেশসমূহে দুধের মাধ্যমে এইসকল রোগ ছড়ানোর রোধ করার লক্ষ্যে দুধ পাস্তুরীকরণ করা শুরু হয়। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিসিজ কন্টোল (US Centre for Disease Control)-এর তথ্য অনুসারে ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ৭৯ শতাংশ দুধ এবং দুধ সংক্রান্ত রোগের কারণ হলো কাঁচা দুধ এবং দুধ জাতীয় খাদ্য। এখন যদিও বাজারের সব দুধই পাস্তুরিত (১০০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় স্বল্প সময়ের জন্য দুধকে গরম করা হয়) যার ফলে সেই দুধ ফ্রিজে ২-৩ সপ্তাহ অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায় কিন্তু তারফলে দুধে আশ্রিত রোগ জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করা যায় বটে কিন্তু দুধ যে মৃত খাবারে পরিণত হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই । কোন কোন গবেষকদের মত অনুসারে দুধ খুব সতর্কতার সাথে ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে দুধের মাধ্যমে অসুস্থ হওয়া লোকের সংখ্যা অন্যান্য খাদ্যবাহিত রোগ দ্বারা সংক্রমিত লোকের সংখ্যা থেকে তিনগুন বেড়ে যেতে পারে। ফলে দুধ হতে পারে এক ধরণের মারাত্বক খাবার। দুধের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া যথা Salmonella, Listeria, E. coli Brucella, Campylobacter, Cryptosporidium,ইত্যাদি মারাত্বক জীবাণু দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হতে পারে।
এখন একটু আলোচনা করা যাক যে দুধ পাস্তুরিত করার ফলে এর মানগত গুণের কি পরিবর্তন ঘটে। দুধ পাস্তুরিত করার ফলে দুধ বাহিত অনেক রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বটে তবে এই পাস্তুরিত দুধ খাওয়ার পরিণতিতে আমাদের শরীরে যে আরো কত ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে সেই সম্বন্ধে আমরা মোটেও ওয়াকিবহাল নই। প্রথমত গরুর স্বাভাবিক দুধ কোন প্রকার জ্বাল বা পাস্তুরিত না করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খুব বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায় না - নষ্ট হয়ে যায় এবং দুধ নষ্ট হলে আমরা তা সহজেই বুঝতে পারি কারণ এই নষ্ট দুধ জমে ছানার মতো হয়ে যায় এবং আমরা তখন না খেয়ে ফেলে দিতে পারি। আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় বটে তবে শরীরের ক্ষতি হয় না, কিন্তু দুধ পাস্তুরিত করলে অনেক দিন (প্রায় এক মাস) সংরক্ষণ করা যায়, তবে এর মধ্যে এই দুধ নষ্ট হলেও পাস্তুরিত করার কারণে কাঁচা দুধ নষ্ট হলে যেমন জমে গিয়ে ছানার মতো হয়ে যায় পাস্তুরিত নষ্ট দুধ তেমন হয় না ফলে এই নষ্ট দুধ আমরা না জেনে খেয়ে অসুস্থ হতে পারি। পাস্তুরিত দুধ খেয়ে অসুস্থ হবার ইতিহাস অনেক আছে যেমন যে কোন জীবিত কোষ ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর অধিক মাত্রায় উত্তপ্ত করলে এর মধ্যস্থিত সকল এনজাইম নষ্ট হয়ে মৃত কোষে পরিণত হয়। দুধ পাস্তুরিত করা হয় ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় - এর ফলে দুধে বিদ্যমান সকল এনজাইম নষ্ট হয়ে দুধ একটি মৃত খাবারে পরিণত হয়। ফলে পাস্তুরীকৃত দুধ কাঁচা দুধের চেয়ে শরীরের জন্য বেশি ক্ষতিকর। এখানে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত একটি সাময়িকী "Vaccination Enquirer-এর ১৯৩১ সালের এপ্রিল ১ সংখ্যায় দুধ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধের পাস্তুরিত দুধ সম্বন্ধে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি "পাস্তুরীকরণ দুধকে মারাত্বক করে - পাস্তুরীকরণ দরকারি হতে পারে - এমনকি এটা ভালোও হতে পারে, কিন্তু পাস্তুরীকরণ নষ্ট দুধকে ভাল করতে পারে না"। দুধ নিয়ে গবেষক ডাঃ: এন ডব্লিউ ওয়াকার (Dr. N. W. Walker) তাঁর বই "Diet and Salad Suggestions”-এ বলেন যে পাস্তুরিত দুধ খেয়ে ১৯২৮ সালে সানফ্রান্সিসকোতে ১২ জন এবং ক্যানাডার মন্ট্রিয়লে ৫৩৩ জন মারা যায় । Dr. William Ellis, যিনি ৪২ বৎসর যাবৎ দুধ নিয়ে গবেষণা করেন তিনি বলেন পাস্তুরীকরণ মূল্যবান এনজাইম ধ্বংস করে ফলে পাস্তুরীকৃত দুধ কাঁচা দুধের চেয়ে অনেক খারাপ। দশ বৎসর ব্যাপী একটি গবেষণার রিপোর্টে দেখা যায় যে পাস্তুরিত দুধ সব ধরণের হৃদরোগের প্রধান কারণ। ১৯৪৫ সালে আমেরিকাতে কাঁচা দুধ এবং পাস্তুরিত দুধের কারণে যথাক্রমে ৪৫০ জন এবং ১৪৯২ জন বিভিন্ন ধরণের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় ১৯৮২ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপূর্ব তিনটি স্টেটে অন্ত্রের সংক্রামক রোগ (ডায়রিয়া, জ্বর, বমি, পেটব্যথা, মাথাব্যথা)-এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। গরুর কাঁচা দুধ এবং পাস্তুরিত দুধ নিয়ে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে যে বাচ্চারা কাঁচা দুধ খায় তাদের দাঁতের ক্ষয় কম হয়, যে বাচ্চারা পাস্তুরিত দুধ খায় তাদের শরীরে চুলকানি এবং প্রদাহ দেখা দেয় কিন্তু যারা কাঁচা দুধ খায় তাদের এই রোগ হয় না বলেই চলে। আরো দেখা গেছে যে যে বাচ্চারা কাঁচা দুধ খায় তাদের যক্ষারোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যারা পাস্তুরিত দুধ খায় তাদের তুলনায় অনেক বেশি। কুকুরের বাচ্চা নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যাদেরকে পাস্তুরিত দুধ খাওয়ানো হয়েছে তারা mange এবং অন্যান্য উপসর্গে আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু কাঁচা দুধ গ্রহণকারী কুকুরের বাচ্চার সেগুলো হয়নি। আরো দেখা গেছে যে সকল কুকুর বা বিড়ালের বাচ্চাকে শুধু পাস্তুরিত দুধ খাওয়ানো হয়েছে তারা মারা গেছে কিন্তু যাদেরকে কাঁচা দুধ খাওয়ানো হয়েছে তারা বেঁচে রয়েছে। দশটি গরুর বাচ্চা নিয়ে আরেকটি চমকপ্রদ গবেষণায় দেখা গেছে গেছে যে তাদের পাস্তুরিত গরুর দুধ খাওয়ানোর ফলে দশটি বাচ্চার নয়টিই পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পূর্বেই মারা গেছে। পাস্তুরীকরণ করার পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো যে দুধ পাস্তুরীকরণ করলে Salmonela এবং অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার দূষণ থেকে দুধ মুক্ত থাকবে কিন্তু এরও কোন নিশ্চয়তা নেই - ১৯৭৮ সালের অক্টবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে এরিজোনা (Arizona)-তে Salmonela দ্বারা খাদ্য বিষক্রিয়া এক মহামারী আকারে দেখা দেয় যার ফলে ৬৬ লোক আক্রান্ত হয় এবং এটি ঘটে পাস্তুরিত দুধের মাধ্যমে। অতএব শেষে এই কথা বলতে চাই যে প্রথমত দুধ বড়োদের খাবার নয় এবং গরুর দুধ মানুষের জন্য নয় এবং দ্বিতীয়ত গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে দুধ কাঁচা দুধের চেয়ে পাস্তুরিত দুধ দেহের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর, সুতরাং দুধ যদি খেতেই হয় তবে কাঁচা দুধ খাওয়া উচিত। তবে এই কাঁচা দুধ অবশ্যই অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কোন রোগমুক্ত গাভী থেকে দোহনকৃত হতে হবে।
গরুর দুধ ও মানুষের বিভিন্ন রোগ:
প্রকৃতিতে কেন প্রত্যেক প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরই তাঁদের নিজেদের সন্তানদের লালন-পালনের জন্যে তাদের শরীরে দুধ তৈরী হয় তার কারণ খুবই স্পষ্ট - কারণ প্রত্যেকটি প্রজাতি তাঁদের শরীরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের দরকার বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত আলাদা আলাদা রকমের দুধ এবং সেই দুধ কেবল তাঁদের স্ব স্ব প্রজাতির মায়েদের শরীরেই তৈরী হয়! এই সরল সত্যিটির কারণেই কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীই অন্য আর এক স্তন্যপায়ী প্রজাতির দুধ পান করে না! - কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রকৃতির এই মহানিয়মের ব্যতিক্রম ঘটায় কেবল মানুষ নামক এক অতিবুদ্ধিমান স্তন্যপায়ী প্রাণী যে কি না তাঁর মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ার পর থেকে প্রকৃতির এই মহানিয়ম লঙ্গন করে গোমাতার দুধ খাওয়া শুরু করে! আর একটি বিষয় হলো একমাত্র মানুষ ছাড়া এই পৃথিবীর আর কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীই শৈশবে তাঁর মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ার পর থেকে সারাজীবন আর কোন দুধ পান করে না, কারণ মাতা প্রকৃতি দুধ নামক এই বিশেষ খাবারটি তৈরী করেছে কেবল শিশুর পুষ্টির জন্য! মানুষ নামক এই অতি বুদ্ধিমান প্রাণীটি প্রকৃতির এই নিয়মটিও ভঙ্গ করে বয়স্করাও সারাজীবনভর গরু, ছাগল বা মহিষের দুধ খায় এবং এটা সত্যিই এক আশ্চর্যের বিষয় বটে মানুষ নামক এই প্রাণীটি যার মস্তিষ্ক অনেক জটিল, উন্নত, পরিশীলিত, যার বুদ্ধিমত্তা সকল প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং যার বিচার-বুদ্ধি ক্ষমতা অদ্বিতীয় সে কি করে প্রকৃতির এই সরল সত্যিটি উপলব্ধি করতে অপারগ!! প্রকৃতির এই মহানিয়ম ভঙ্গ করে গরুর দুধ খাওয়ার ফলে মানুষ যে বিভিন্ন প্রকার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য! যে প্রকৃতি গরুর দুধ তৈরী করেছে ৩০-৪০ কেজি ওজনের গরুর বাচ্চার জন্য যে নাকি দুই বছরে হয়ে যায় ৬৭৫- ৯০০ কেজি - এই দুধ মানুষের বাচ্চার জন্য কি করে উপযোগী হয় যার জন্মকালীন ওজন মাত্র ৩ -৪ কেজি এবং তার মোটামুটি সর্বোচ্চ ওজন ৪৫ -৯০ কেজি হতে সময় লাগে প্রায় ১৮ বছর !
বিগত ২০০ বৎসরে দুধ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং বিভিন্ন সায়েন্টিফিক জার্নালে এইগুলি প্রকাশিতও হয়েছে এবং বিভিন্ন কারণে এইগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি। এর একটি কারণ এই যে দুধের পক্ষে দুধ ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপক প্রচার। সে যাই হোক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষের অনেক রোগের ক্ষেত্রে গরুর দুধের ভূমিকা রাখে - যেমন হৃদরোগ, ক্যান্সার, থাইরয়েড সমস্যা, বাত (arthritis), মাইগ্রেন মাথাব্যথা (migraine), বিভিন্ন ধরণের এলার্জি, ঠাণ্ডালাগা (সর্দি-কাশি), বাচ্চাদের কান পঁচা (ear infection), হে-জ্বর (hay fever), শ্বাসজনিত রোগ (ব্রংকাইটিস (bronchitis), sinusitis, হাঁফানি (asthma), ,নাক দিয়ে জল পড়া, Irritable bowel syndrome and Crohn's disease (.a type of inflammatory bowel disease (IBD) সহ আরো অনেক রোগ গরুর দুধ খাওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্য যেকোন খাবারের তুলনায় গরুর দুধ মানুষের শরীরে অনেক বেশি শ্লেষ্মা (mucus) তৈরী করে এই ঘন শ্লেষ্মা মানুষের শ্বাসতন্ত্রকে উত্তেজিত করে এবং শরীরে জলীয় পদার্থ (fluid) পরিবহনে বাঁধা সৃষ্টি করে এবং শরীর থেকে বর্জ্য নির্গমন প্রক্রিয়ায় (elimination process ) প্রচন্ড নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয় দুধের কারণে তৈরী এই অতিরিক্ত শ্লেষ্মা শরীরের বিভিন্ন গহব্বরে (cavities) অবস্থিত mucus membrane উপর একটি আবরণ সৃষ্টি করে এর কার্যক্ষমতা হ্রাস করে এবং এর ফলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ দৃষ্টিতে সহায়তা করে। আমাদের শরীর এই শ্লেষ্মা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের শরীরকে অনেক খেসারত দিতে হয় - আমাদের শরীরের অনেক মূল্যবান শক্তির অযথা অপচয় হয় । এই অতিরিক্ত শ্লেষ্মা আমাদের শরীরের কাশিরও কারণ। ড: নরম্যান ডব্লিউ ওয়াকার (Dr. Norman W. Walker) যিনি একজন গ্রন্থিতন্ত্র (glandular system) বিশেষজ্ঞ এবং গরুর দুধের ক্যাসিন (casein) আমিষ নিয়ে প্রায় ৫০ বৎসর যাবৎ গবেষণা করেন, তাঁর মতে মানুষের থাইরয়েডের সমস্যার জন্য গরুর দুধের ক্যাসিন একটি প্রধান কারণ। তিনি আরো বলেন বর্তমানের পাস্তুরিত দুধ আরো বেশি ক্ষতিকর। এবং আর এক জন গবেষক ড: উইলিয়াম এ এলিস (Dr. William A. Ellis), যিনি ছিলেন একজন ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসক (Osteopathic physician) এবং অস্ত্রপ্রচার বিশেষজ্ঞ এবং তিনি দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য নিয়ে ৪২ বছর গবেষণা করেন, তাঁর গবেষণা মতে মানুষের দুধ খাবারের সাথে অনেকগুলো রোগ জড়িত এবং তার মধ্যে হৃদরোগ, বাত, এলার্জি, এবং মাইগ্রেন মাথাব্যথা অন্যতম। তিনি দুধ সম্বন্ধে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন, এক:মানুষের শরীরে মেদ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য। এবং দুই: তিনি বলেন তাঁর ৪২ বৎসরের মেডিক্যাল পেশায় প্রায় ২৫০০০ রক্ত পরীক্ষায় দেখেন যে বয়স্ক মানুষ যারা দুগ্ধজাত খাবার খান তাদের দেহে পুষ্টি গ্রহণের ক্ষমতা যারা দুধজাত খাবার খান না তাদের তুলনায় অনেক কম এবং শরীরে এই কম পুষ্টি গ্রহণ করার ক্ষমতার কারণে তারা দীর্ঘ মেয়াদি অবসন্নতায় (chronic fatigue) ভুগেন। গবেষণায় এও দেখা গেছে যে গরুর দুধ মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরণের এলার্জিক রিএকশনের প্রধান কারণ। ড: এলিস এবং ড: ওয়াকার তাদের গবেষণায় আরো রিপোর্ট করেন যে গরুর দুধ অনেক ক্ষেত্রেই হৃদরোগ এবং বুকের ব্যাথার কারণ। ড: এলিস বলেন মানুষের প্রায় ২০০ বছর যাবৎ জানা যে দুধ থেকে তৈরী চিজ (cheese) মানুষের মাথা ব্যাথার কারণ। ১৯৭৪ সালের ৬ জুলাই সংখ্যার বিখ্যাত ম্যাগাজিন Nature -এর একটি নিবন্ধে প্রকাশিত হয় যে অনেক ধরণের চীজে এমন একটি আমিষ পাওয়া গেছে যা মানুষের মাইগ্রেন মাথাব্যাথার কারণ। আমরা এক সময় প্রোপাগান্ডা শুনেছি যে দুধ খাওয়া আলসার (ulcer) -এর জন্যে উপকারী এবং আলসার আক্রান্ত রোগীদের দুধ খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হতো, কিন্তু বাস্তবে সত্যিটা হলো এর উল্টো। দুধ থেকে উৎপাদিত মাখন ছাড়া দুগ্ধজাত আর সকল খাবার শরীরে অম্ল (acid) উৎপাদনকারী এবং যেকোন অম্ল উৎপাদনকারী খাদ্য আলসারের জন্য ক্ষতিকর, ফলে দুধ জাতীয় খাবার আলসারে আক্রান্ত রোগীদের রোগ আরো গাঢ় করে। অন্ত্রের আর একটি ভীষণ বেদনাদায়ক এবং অস্বস্তিকর রোগ হলো ulcerative colitis যা কোলন ক্যান্সারের (colon cancer)-এর পূর্বাবস্থা (precursor) । দুগ্ধজাত খাবার কেবল শুধু এই রোগের কারণেই না, দেখা গেছে যে ulcerative colitis-এ আক্রান্ত রোগীদের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলে তাদের colitis -এর নাটকীয় অগ্রগতি দেখা দেয়। অনেক প্রকার উচ্চ আমিষযুক্ত খাবারের সহিত দুগ্ধজাত খাবার কোলন ক্যান্সারের (colon cancer) জন্যও দায়ী বলে গবেষণায় দেখা গেছে। শুধু তাই না গবেষণায় এও দেখা গেছে যে অতিরিক্ত দুধ এবং চীজ (cheese) প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্যেও ঝুঁকিপূর্ণ। আর আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে গরুর দুধ মানুষের শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণে বাধা সৃষ্টি করে ফলে অতিরিক্ত দুধ খাওয়ার ফলে মানুষের শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং এর পরিণতিতে একসময় সে অস্টিওপরোসিস রোগেও আক্রান্ত হতে পারে। আমরা জানি কম চর্বিযুক্ত এবং কম কোলেস্টেরল যুক্ত এবং বেশি আঁশযুক্ত খাবার মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়। গরুর দুধে অতিরিক্ত সম্পৃক্ত-চর্বি (saturated fatty acids) এবং কোলেস্টেরল (cholesterol)-এর উপস্থিতি এবং আঁশ (fibre) না থাকার কারণে পুষ্টি মানের দিক থেকে গরুর দুধ বয়স্ক মানুষের জন্য একটি নিম্ন মানের খাবার। শিশুদের হঠাৎ মৃত্যু (sudden infant death syndrome )-এর কোন একটি নির্দিষ্ট কারণ না জানা না থাকলেও গরুর দুধ খাওয়ানোর সাথে শিশুদের এই SIDS-এর সম্পর্ক আছে বলে অনেক গবেষকরা মনে করেন !
শেষ কথা :
গরুর দুধ যে মানুষের জন্য নয় গরুর দুধ যে প্রকৃতিগত এবং কৌলিতাত্বিকভাবে কেবল গরুর বাচ্চার জন্যই একটি আদর্শ খাবার হিসাবে তৈরী হয়েছে এবং এই দুধ যে মানবশিশুর জন্য উপযোগী নয় আর বয়স্ক মানুষের জন্য যে নয়ই বরং বয়স্ক মানুষরা খেলে উপকারের পরিবর্তে বিভিন্নভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে এর পক্ষে অনেক গবেষণালব্ধ তথ্য এবং সাধারণ জ্ঞান ও কিছু নৈতিক যুক্তি এই প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হলো। তবে মানুষের গরুর দুধ খাবার বিপক্ষে আমি যত যুক্তি তর্ক বা তথ্যই উপস্থাপন করিনা কেন এর পরও যে এই গ্রহের এক বিপুল সংখ্যক মানুষ গরুর দুধ একটি উপাদেয় খাবার হিসাবে খেয়েই যাবে এই বিষয়ে আমি সচেতন। এর কারণও আছে বেশ - এক: হাজার হাজার বছর ধরে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে আসছে যে দুধ তাদের জীবনধারণের জন্যে একটি অপরিহার্য খাবার এবং এটি অনেকটা ধর্মীয় বিশ্বাসের মতোই তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। কাজেই এই গরুর দুধ যে মানুষের খাদ্য হিসাবে মোটেও উপযোগী নয় এর সপক্ষে আমি যতই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত বা নৈতিক যুক্তি বা সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিতে আলোচনা করিনা কেন, এতদসত্বেও অধিকাংশ মানুষেরই দুধ সম্বন্ধে যে প্রাচীন বিশ্বাস আছে সেই বিশ্বাস তাঁরা ধরে থাকবেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় তামাক/ ধূমপানের কথা - এটা খুব বেশি দিন আগের কথা নয় ধূমপান এই সারাবিশ্বে কি ব্যাপকভাবেই না প্রচলিত ছিল - কে কত দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতে পারে সে সমাজে নিজেকে ততই অভিজাত শ্রেণীর বলে এক ধরণের অহমিকা দেখাতে পারতো। কিন্তু গত প্রায় দুই দশক ধরে ধূমপানের অপকারিতা সম্পর্কে কিছু মানুষের পরিশ্রম সাধ্য ব্যাপক প্রচারের কারণে এখন এটি সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ধূমপান বিষপানের সমতুল্য এবং এখন পৃথিবীর সর্বত্রই সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লিখা হয় যে "ধূমপান ক্যান্সারের কারণ।" কিন্তু এতদসত্বেও কি সব ধূমপায়ীই ধূমপান ত্যাগ করেছে? এমনকি ক্যানাডার মতো একটি উন্নত দেশেও কোন কোন অঞ্চলের মানুষ ব্যাপকভাবে ধূমপান করে। আবার এটাও ঠিক ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর এটা জেনেও কিছু কিছু মানুষ সারাজীবনভর ধূমপায়ী হয়ে থাকবে এবং এর মধ্যে সকলেই আবার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হবে না এবং কিছু কিছু ধূমপায়ী আসক্ত মানুষ হয়তো দীর্ঘ জীবনও লাভ করতে পারে, কারণ সকল ক্ষতিকর পদার্থই সকলকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না, কিন্তু তাই বলেই কি আমরা বলতে পারবো ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল? তেমনি আমাদের শরীরে গরুর দুধের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা জেনেও এবং এই বিষয়ে কিছু মানুষ সম্যক জ্ঞাত হওয়া সত্বেও, দুধ তাদের খাদ্য তালিকায় থেকেই যাবে এবং সেই সিগারেট খাওয়ার মতোই তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক হয়তো ভালভাবে বেঁচেও থাকবেন, তবে অনেকেই যে দুধ আহারের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারেন এটাও সমানভাবে সত্যি। আর সেই সাথে বিশাল দুধ শিল্পের দুধের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণাতো আছেই। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না Identifier for Advertisers (IDFA 2021 Economic Impact Study-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই দুধ শিল্প প্রায় ৭৫৩ বিলিয়ন ডলারের শিল্প। আজ যদি আমেরিকার সব মানুষ দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয় তবে কালই সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে, কাজেই দুধ শিল্প এটা কখনোই সহজে হতে দিবে না। তবে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের ভিত্তিতে "আমি দুধ খাব কি খাবনা" এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ অধিকারতো আমার আছেই।
সবশেষে আরো কয়েকটি কথা যেন না বললেই নয় । জন্মের পর মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেবার পর থেকে আমরা প্রায় সকলেই গরুর দুধ আর এই দুগ্ধজাত খাবার আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ এবং এই গরুর দুধের উপকারিতা সম্বন্ধে এতো কথা শুনার পর আমার এই প্রবন্ধে মানুষের জন্যে গরুর দুধের অপকারিতার কথা শুনে আপনি যে এক মহা বিভ্রান্তিতে পড়বেন সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ রূপে সচেতন। তবে আপনাকে এই বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কয়েকটি বিষয় আবার অতি সঙ্কেপে মনে করিয়ে দিতে চাই ।
এক: যারা মানুষের গরুর দুধ খাওয়ার পক্ষে প্রচারণা চালায় তাদের প্রধান যুক্তি হলো বয়স্ক মানুষেরা দুধ না খেলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হবে যা আমাদের শরীরের হাঁড়ের স্বাস্থ্যের জন্য প্রধান উপাদান। গরুর দুধে ক্যালসিয়াম অনেক আছে এটি সত্য - কিন্তু প্রশ্ন হলো গরুর দুধের এই ক্যালসিয়াম মানুষের শরীরে শোষিত হয় কতটুকু? আর তা যদি হতোই তবে ধনী দেশসমূহে যেখানে মানুষের গরুর দুধ খাওয়ার পরিমান অনেক বেশি তবে সেখানে ক্যালসিয়ামের মারাত্বক অভাবজনিত যে রোগটি, অস্টিওপোরোসিরিস প্রাদুর্ভাব কেন সব থেকে বেশি হবে? দ্বিতীয়ত, যে গরুর দুধে এতো ক্যালসিয়াম থাকে সে তার শরীরে ক্যালসিয়াম পায় কোথা থেকে - কারণ গরু তো দুধ খায় না। উত্তরটা হলো গরু তার ক্যালসিয়াম পায় ঘাস আর বিভিন্ন দানাজাতীয় শস্য থেকে। এখানে উল্লেখ্য মাটিতে যে উদ্ভিদ জন্মে তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করার জন্য ক্যালসিয়াম একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কাজেও সব উদ্ভিদেই ক্যালসিয়াম থাকে। অতএব মানুষ যদি যথেষ্ট পরিমানে সবুজ শাক-সবজি, বাদাম এবং ফল-মূল খায় তবে অনায়াসেই সে তার শরীরের ক্যালসিয়ামের চাহিদা যথাযথ ভাবে পূরণ করতে সক্ষম হবে। শুধু তাহাই না গরুর দুধের ক্যালসিয়াম মানুষের শরীরের কাজে লাগার পরিবর্তে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমা হয়ে কয়েকটি রোগের সৃষ্টি করতে পারে যেমন কিডনি, গলব্লাডারের পাথর, চোখের ছানি পড়া, হাড়সন্ধিতে (joints of bones) ব্যাথা ইত্যাদি।
দুই: বয়স্ক মানুষের শরীরে ল্যাকটেস এনজাইম (lactase enzyme) এর অভাবের কারণে গরুর দুধের প্রধান চিনি (শর্করা) ল্যাকটোজ যে অনেক মানুষই হজম করতে পারে না এটা আজ একটি সরল সত্য কারণ lactose intolerance এখন মানুষের একটি রোগের নাম এবং এটিকে পুঁজি করে আবার বাজারের বেশি দামের ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ বিক্রি অনেক দুধ কোম্পানিই আরো কিছু অতিরিক্ত মুনাফাও হাতিয়ে নিচ্ছে।
তিন: দুধের প্রধান আমিষ হলো ক্যাসিন (casein) এবং গরুর দুধে ক্যাসিনের পরিমান মাতৃদুগ্ধের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি এবং এই আমিষের বিপাকের জন্য আমাদের শরীরে যে এনজাইমটি প্রয়োজন তার নাম হলো রেনিন (rennin) এই রেনিন শিশুদের শরীরে তৈরী হয় কারণ এই প্রকৃতির নকশা অনুসারে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শিশুদের একমাত্র খাবার তার মায়ের দুধ এবং এই দুধের আমিষ বিপাকের জন্য তার শরীরে এই রেনিন তৈরী হয় কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন আর তার দুধ খাওয়ার প্রয়োজন নাই তখন আস্তে আস্তে তার শরীরে এই এনজাইম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
চার: গরুর দুধের অতিরিক্ত সম্পৃক্ত চর্বি (saturated fatty acids) এবং কোলেস্টেরল (cholesterol) মানুষের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয় ।
পাঁচ: আমাদের শরীরটাও একটা গাড়িরই মতন - পেট্রোল চালিত গাড়িতে যেমন আমরা কেরোসিন ব্যবহার করতে পারি না তেমনই যে খাবার আমাদের শরীরের জন্যে অনুপযোগী তেমন খাবার আমরা ক্রমাগত খেতে থাকলে হিতে বিপরীত হবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যাপারটা এমন নয় যে কোন ক্ষতিকর খাবার খেলে আমাদের শরীর ইহার কোন ক্ষতিকর বা কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না ঘটিয়ে আমাদের শরীর থেকে এটি নির্বিঘ্নে বের হয়ে যাবে! তার পরিবর্তে যা হয় তা হলো - আমাদের শরীরের পক্ষে অনুপযোগী খাবার শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের বুদ্ধিমান শরীর এটাকে বর্জ্য হিসাবে বিবেচনা করে শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশন তন্ত্রের (lymph system) মাধ্যমে তাকে শরীর থেকে নিষ্কাশনের চেষ্টা করে এবং এতে করে শরীরের অনেক মূল্যবান শক্তির অযথাই অপচয় হয়; শুধু তাহাই নয় অনেক সময় এই বর্জ্য বা বিষ শরীর থেকে নির্গত হওয়ার পরিবর্তে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জমা হয়ে নানা প্রকার রোগের সৃষ্টি করে। অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়ার সাথে সম্পর্কিত এমন কয়েকটি রোগ হলো বিভিন্ন ধরণের প্রদাহ, বাত, মাইগ্রেন মাথা ব্যাথা, থাইরয়েড সমস্যা, হাঁপানি, Irritable bowel syndrome, টাইপ ১ ডায়াবেটিস ইত্যাদি। দুধ নিয়ে গবেষণায় এও দেখা গেছে যে পৃথিবীর যে সকল অঞ্চলে যে সকল শিশুদের গরুর দুধে লালন-পালন করা হয় তাদের মধ্যে multiple sclerosis রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়!
কাজেই শেষ কথা হলো গরুর দুধের যে প্রধান চারটি তিনটি উপাদান - আমিষ, শর্করা, চর্বি এবং ক্যালসিয়াম এর সব কয়টাই মানুষের শরীরে বিপাকের পক্ষে অনুপযোগী। এবার আপনি নিজেই সচেতন ভাবে সিদ্ধান্ত নিন আপনার এবং আপনার বয়স্ক বাচ্চার জন্য গরু, মহিষ বা ছাগলের দুধ খাওয়া কতটা সমীচীন ।
শেষ দ্রষ্টব্য: মানুষ সর্বভূক প্রাণী হিসাবে পরিচিত অর্থাৎ লতা-পাতা থেকে শুরু করে পোকা, সাপ, ব্যাঙ হাঙ্গর- তিমি সবকিছুই তাঁর খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। আমরা জানি কিছু কিছু প্রাণী আছে তারা কেবল তৃণভোজী আবার কিছু প্রাণী আছে তারা কেবল মাংসাশী। তবে মানুষ সর্বভুক প্রাণী হিসাবে আখ্যায়িত হলেও মানুষের হাত, চোয়াল ও দাঁতের গড়ন, পরিপাক তন্ত্রের দৈর্ঘ্য এবং গড়ন অনুযায়ী তৃণভোজী প্রাণীর সাথেই অধিক মিল। আর মানুষের প্রাণীজ খাবার গ্রহণের সাথে যে তাদের নানাবিধ রোগের (হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি) সম্পর্ক জড়িত তা আজ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত, তাই এখন দেখা যাচ্ছে দিন দিনই স্বাস্থ্যগত কারণে অনেক মানুষই পূর্ণাঙ্গ নিরামিষাশী (vegan) হয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে পৃথিবীর ১৯৪ টি সদস্য দেশ নিয়ে গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) এবং যেখানে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন সম্পর্কিত ৮০০০-এরও বেশি পেশাজীবী কাজ করে এর ওয়েবপেইজ থেকে "স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস" বিষয়ে তাদের তথ্য-চিত্রটি নিম্নে সরাসরি বাংলায় উপস্থাপন করলাম। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো বয়স্কদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে তারা প্রাণীজ খাদ্যের (মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি) সম্বন্ধে কিন্তু একটি শব্দও উল্লেখ করেনি।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (Healthy Diet)
“একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস সকল প্রকার অপুষ্টি থেকে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করে এবং তা স্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের ভিত্তি। ইহা ডায়বেটিস (diabetes), হৃদরোগ (cardiovascular diseses), কয়েক প্রকার ক্যান্সার (cancer), এবং মেদবহুলতার (obesity) সাথে সংযুক্ত কিছু অবস্থা সহ অসংক্রামক (noncommunicable) রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে। শারীরিক কার্যক্রমমহীনতা সহ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এই বিশ্বের প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকির একটি ।
ফল, (fruit) শাক-সবজি (vegetables), সীম এবং ডাল (legumes), বাদাম (nuts)-, এবং দানাদার (grains) জাতীয় শস্যের প্রাচুর্য্য এবং লবন (salt), চিনি (free sugar) এবং চর্বি (বিশেষ করে সম্পৃক্ত চর্বি (saturated fats) এবং ডালডা (trans fat)) জাতীয় খাবারের স্বল্পতা সমৃদ্ধ খাবারের উপকারিতা আজ প্রমাণিত। মাতৃদুগ্ধে শিশু লালন এবং অল্পবয়স্ক ছেলে মেয়ে এবং পিতা-মাতার শিক্ষা উদ্যোগের মাধ্যমে জীবনের শুরুতেই একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। এবং এর উপকারিতা উচ্চশিক্ষার ফলাফল, উৎপাদনশীলতা এবং জীবনব্যাপী সুস্বাস্থ্যের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় ।
তবে, অনেক কারণেই একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের সুযোগ থাকে না, বিশেষ করে নিম্ন- এবং মধ্য-আয়ের দেশগুলিতে এবং অনেক অবস্থায় যেখানে খাদ্য অনিশ্চয়তা সর্বাধিক যেমন সশস্র সংঘর্ষ। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী আনুমানিক ২০০ কোটি মানুষ নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং যথেষ্ট পরিমান খাদ্যের নিশ্চয়তা থেকে বঞ্চিত। অত্যধিক প্রক্রিয়াজাত (processed) খাদ্যের বিস্তৃতি, দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিবর্তিত জীবনাচরণ অধিক সংখ্যক মানুষের অতিরিক্ত ক্যালোরি (energy), চর্বি (fats), চিনি (free sugars এবং লবন (salt) সমৃদ্ধ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমার এই লিখায় যে তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ কৃতিত্ব প্রাপ্য ড. হার্ভে ডায়মন্ড এবং ক্যারোলিন ডায়মন্ড-এর! আমার এই সম্পূর্ণ লিখাটির মূল ভিত্তি তাদের যৌথ ভাবে লিখা দুইটি এবং হার্ভে ডায়ামন্ডের এককভাবে লিখা তিনটি বই ! এই বইগুলির নাম আমি তথ্যসূত্রে সংযোজন করলাম! ১৯৮৫ সালে প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যবিধি (natural hygiene ) নীতির উপর ভিত্তি করে হার্ভে ডায়মন্ড ম্যারিলিন ডায়মন্ড এর সাথে যৌথভাবে Fit for Life নামে একটি সাড়াজাগানো বই লিখেন! এখানে উল্লেখ্য যে তিনি তাঁর এই বইগুলিতে দুধ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে দুধ নিয়ে গবেষণার দুই শতাধিক সায়েন্টিফিক নিবন্ধ রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করেছেন! কেউ এই গুলি দেখতে চাইলে তার লিখা বইগুলি পড়তে পারেন! আপনারা যারা বই পড়তে আগ্রহী তারা Frank এবং Oski-র লিখা “Don’t Drink Your Milk – The Frightening New Medical Facts About the World’s Most Overrated Nutrient” বইটিও পড়তে পারেন !
তথ্যসূত্র (References):
1.Diamond, H. and Diamond, C. 1985. Chapter 10: Dairy Products. In “Fit for Life”. (pp. 104-113). Warner Books, New York, Boston.
2.Diamond, H. and Diamond, C. 1989. The Case Against Diary Products. In “Fit for Life” II: Living Health – The Complete Health Program (pp. 241-269). New York, Grand Central Publishing
3.Diamond, H. 2003. Dairy Products. In “Fit for Life not Fat for Life”. (pp. 253-262). Health Communications, Inc. Deerfield Beach, Florida.
4.Diamond, H. 2007. Dairy Products. In Living Without Pain. (pp. 221, 250-257). VP Nutrition. Osprey, Florida, US.
5.Diamon, H. Dairy Products, In Fit for Life – A New Beginning – The Ultimate Diet and Health Plan. (pp. 199-201). Citadel Press. Kensington Publishing Corp.
6.Frank, A. and Oski, M. D. (2013). Don’t Drink Your Milk – The Frightening New Medical Facts About the World’s Most Overrated Nutrient. 3rd Edition. TEACH Services Inc. Calhoun, GA30701, USA”
7.Wikipedia, Milk; Breast milk
8.World Health Organization webpage – Fact Sheets – Healthy Diet
9.Ziegler , E.E. 2011. Consumption of cow's milk as a cause of iron deficiency in infants and toddlers; Nutr Rev.. 2011 Nov;69 Suppl 1:S37-42. doi: 10.1111/j.1753-4887.2011.00431.x.
10.ছবি ক্রেডিট : Google internet
মার্চ ৫, ২০২২ সাল
ড. অমল রায়
ইকালুইট, নুনাভুট, ক্যানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
06-03-2022
-
-