অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
জাকির স্যারের পাখি শিকার - চিরঞ্জীব সরকার

জাকির স্যার আমাদের গ্রামে আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত  ‘সৈয়দ বজলুল হক কলেজ’-এর প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন। স্যারের হাত ধরেই কলেজটির যাত্রা শুরু। কলেজটি যখন প্রথম তার কার্যক্রম শুরু করে  তখন তার নিজস্ব কোন জায়গা ছিল না। আমরা যে বিদ্যালয়ে পড়তাম সে বাইশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দোতলার কয়েকটি কক্ষে কিছু ছাত্রছাত্রী নিয়ে কলেজটি তার প্রাথমিক যাত্রা শুরু করে। তারপর ডাঃ দিগেন্দ্র নাথ বসু নামক জনৈক লোকহিতৈশী ব্যক্তি কলেজটির জন্য কিছু জায়গা দান করলে টিনের চাল সম্বলিত লম্বা  একটি স্থাপনার কক্ষে কলেজটি তার প্রথম নিজস্ব ক্যাম্পাস পায়। আজকে কলেজটি অনেক জায়গা নিয়ে সুদৃশ্য ভবন-সম্বলিত সুন্দর একটি বিদ্যানিকেতন।
     আমি এ কলেজের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু বাড়িতে এলেই কলেজটির দিকে ঘুরতে যেতাম কয়েকটি কারনে। এর একটি কারন হল কলেজটিতে যাওয়ার পথে একটি সুন্দর বটবৃক্ষের নীচে বেঞ্চে বসে অতি যত্নে তৈরী করা এক কাপ গরম চায়ের স্বাদ নেয়া। চায়ের দোকানটির মালিক ছিল আমারি সমবয়সী  আশ্রাব আলী। তার সে দোকানটি এখন আর নেই তবে সে জায়গায় এখন অন্য কয়েকটি দোকান হয়েছে। আশ্রাব আলীর মত এত যত্ন করে আমাকে কেউ কখনো চা বানিয়ে দেয়নি। কিছুদিন আগে প্রায় দুছর  পর যখন বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন তার সাথে আবার আমার দেখা হয়েছিল। আশ্রাব আলীর নিজের গাছে ধরা বিশাল একটি পেপে সেদিন আমাকে উপহার হিসাবে দেয়। অনেক আগে কোন এক শীতের সকালে বাড়ির পাশের মাঠের আল ধরে হাঁটছিলাম। নিকটস্থ একটা মাঠ দেখলাম শীতকালীন সবজীতে ভরপুর। ইচ্ছে করে সবজীগুলির পাতায় লেগে থাকা ভোরের শিশিরকনাগুলি হাত দিয়ে মুখে লাগাচ্ছি। সূর্যের আলোকে কুয়াশার চাদর একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল। এরকম ঘন্টা দুয়েক মাঠে মাঠে পদব্রজে ভ্রমন শেষে যখন বাড়ি প্রত্যাবর্তন করি তখন শুনি আশ্রাব আলী এসে নাকি তার ক্ষেতের কিছু মুলা, বরবটি, ফুলকপিসহ আরও কিছু সবজী আমার জন্য রেখে গেছে। বিকেলে আশ্রাব আলীর সাথে তার চায়ের দোকানে আমার দেখা হলে সে বলল, ’আপনাকে দেখলাম আমার ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে, তাই ক্ষেতের কিছু ফসল আপনার জন্য দিয়ে এলাম’। মনে মনে ভাবি কারো জীবনে যদি এরকম একজনও সুহৃদ থাকে তবে তার জীবন সত্যি সত্যিই ধন্য এবং নিজেকে সেদিন খুব ভাগ্যবান মনে হল।
     এ কলেজটিতে যাওয়ার অন্য আরেকটি একটি কারন হল প্রাকৃতিক  সৌন্দর্য উপভোগ করা। জাকির স্যারের আন্তরিক প্রচেষ্টটায় কলেজটিতে তখন একটি সুন্দর ফুলের বাগান তৈরী হয়েছে। গোলাপ, ডালিয়া, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, জবা, অপরাজিতা, বোগেনভেলিয়াহ নানা জাতের ফুল ও লতাগুল্মে ভরপুর ছিল কলেজের এ বাগানটি। এছাড়াও কলেজটির লোকেশনও বেশ মনোমুগ্ধকর। একটি প্রশস্ত খাল প্রবাহিত হয়ে গেছে  ক্যাম্পাসের অদূরেই। সে খালের পাশের বাঁধানো ঘাটে বসে নির্মল বায়ুর স্পর্শ পাওয়া ছিল বাড়তি পাওনা। খালের উপর ছিল একটি পুরানো লোহার সেতু। সেতুটির আবার সুন্দর একটি নাম ছিল। সবাই সে সেতুটিকে বলত ‘মনমোহিনী ব্রীজ’।
     জাকির স্যারের সাথে হাতেগোনা  কয়েকবার ছাড়া আমার খুব একটা সাক্ষাত হয়নি। তবে ওনার সম্বন্ধে নানাবিধ কথা শুনতাম যেমন উনি নাকি শীতকালেও পানি ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করে খেতেন। ওনার কাশি সত্ত্বেও নাকি এ অভ্যাস চালিয়ে যেতেন। আরও শুনতাম উনি নাকি শিকার করতে খুবই পছন্দ করেন এবং ওনার হাত  শিকার করার ব্যাপারে খুবই দক্ষ। ওনার লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়েই এ শিকার পর্বটি সমাপ্ত করতেন। শিকার ভাল কি মন্দ সে ব্যাপারে না গিয়ে শিকার নিয়ে শুধুমাত্র একজনের অনুভূতির কথা এখানে লিখছি যা আমি অনেক আগের কোন একটা খবরের কাগজের সাময়িকীর পাতায় পড়েছি। এক সাক্ষাতকারে পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো তার পিতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্বন্ধে বলেছেন যে তার পিতা মাঝে মাঝেই শিকারে বেড়িয়ে পড়তেন। বেনজীর ভুট্টো তখন ছোট্ট একটি মেয়ে, বাবার সাথে একদিন ঘুরতে বের হয়েছেন। সেদিন  পাহাড়ী একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে তার পিতা  হঠাৎ করে একটি সুন্দর সবুজ টিয়ে পাখিকে অকারনে গুলি করেন। পাখিটি তাদের পায়ের কাছে এসে রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে। বেনজীর বলেছেন তার পিতার যেদিন ফাঁসি কার্যকর করা হয় সেদিন অন্য কিছু বাদ দিয়ে কেন যেন  সে নির্দোষ রক্তাক্ত টিয়েটির ছবি তার মানসপটে বারবার ভেসে আসছিল।
     একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ করিডোরে জাকির স্যারের সাথে হঠাৎ আমার দেখা হয়ে গেল। প্রাথমিক কিছু কথাবার্তার পর স্যার আমার হবি বা শখ কি সেটা জিজ্ঞেস করলেন। আমি কি উত্তর দিব সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। তখনতো হবি অনেককিছুই। সিগারেটের পরিত্যক্ত প্যাকেট সংগ্রহ করে চারামারি খেলা, সূতাকাটা ঘুড়ির পিছনে দৌড়ানো, বড়শি দিয়ে পুটি মাছ ধরা, খালে নেমে সেখানে একটানা ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দেয়া এর কোনটা বলব ভেবে পাচ্ছি না। আমাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে স্যার ভেবেছিলেন আমি হয়ত ‘হবি’ শব্দটির অর্থ বুঝিনি। তাই আমাকে বললেন, ’কি কি করতে সবচেয়ে বেশী পছন্দ কর তুমি এটাই হল হবি, আমার হবি হল হান্টিং’। মুখ ফসকে তখন আমি স্যারকে বলে ফেললাম, ‘স্যার, আমার হবি হল হাঁটা’। এখন আমার মনে হয় আমি সেদিন আনমনে আমার প্রকৃত হবিই সেদিন স্যারকে বলে ফেলেছিলাম। হেঁটে হেঁটে এক নির্মল আনন্দ সদা অনুভব করি। এ মাটি, জল, কাঁদা, নক্ষত্রে ভরা রাতের আকাশ, শিশিরভেজা দূর্বাদল, ফসল কাটা দিগন্তের মাঠের দিকে কিংবা পিচঢালা নগর- বন্দরে অগনিত মানুষের ভিড়ে তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে হেঁটে কত জনপদে দেখছি মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি, সুখ দুঃখের কত আলেখ্য। আগ্রার তাজমহলের পিছনে দেখেছি স্রোতহীন যমুনাকে, নেপালের পশুপতিনাথের প্রাঙ্গনে দেখেছি চিতায় দাহরত শবদেহ থেকে উৎসারিত নীল ধোঁয়া, সদরঘাটের লঞ্চের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে নদীর নৌকা থেকে পন্য উঠানো শ্রমজীবি মানুষদের আপ্রান প্রচেষ্টা। হাঁটতে হাঁটতেই একদিন মাদ্রিদের হুয়ান কার্লোস পার্কের ঝোঁপে দেখেছি বুনো খরগোসদের এক প্রানচঞ্চল ছোটাছুটি, কোলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যালের সামনে সদ্য বিবাহিত এক দম্পতির ফুচকা খাওয়ার সে কি আনন্দঘন মুখাবয়ব কিংবা কোন এক ভরা দুপুরে একাকী নির্জন মাইটি মেকং নদীর স্বচ্ছ প্রবাহমান বিশাল স্রোতধারার দিকে তাঁকিয়ে হঠাৎ করে মনে মনে জেগে উঠা সঙ্গীতের ছত্র, “তব লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল/ বীনা বাদীনির শতদল দলে করিছে সে টলমল”।
     কয়েক দশক আগে এক সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন জাকির স্যারের কক্ষে গল্প করতে হাজির হই। কিন্তু গিয়ে দেখি স্যার জ্বরে কাঁপছেন। গায়ে লেপ। স্যারের চোখ দেখলাম জ্বরের প্রভাবে লাল হয়ে গেছে। কে যেন এসময় এখানে এসে বলল, ‘স্যার মুরী বাড়িতে শামুকখোল পাখি পড়েছে’। আমি মুরী বাড়িটির নাম শুনেছি আগে, কিন্তু কোনসময় যাওয়া হয়নি। ও বাড়িতে নাকি পরিযায়ী পাখিরা আসে। জাকির স্যারকে দেখলাম একথা শোনামাত্র বিছানা থেকে উঠে পড়লেন এবং বাদল নামক কলেজের এক কর্মচারীকে তার বন্দুক ও গুলি নিয়ে আসতে নির্দেশ দিলেন। আমিতো হতবাক যে লোকটা একটু আগে জ্বরের প্রভাবে লেপ গায়ে দিয়েও কাঁপছিলেন তিনি এখন যাবেন হেঁটে হেঁটে পাখি শিকার করতে। আমি স্যারকে বললাম, ‘আপনার তো গায়ে অনেক জ্বর, এখন এভাবে বের হওয়া ঠিক হবে না’। উত্তরে স্যার আমাকে যা বললেন তার মোদ্দাকথা হল তিনি যদি এখন না যান তবে তার শরীরের জ্বর আরো বাড়বে।
     শিকারদলে আমরাও স্যারের অনুগামী হয়ে কিছুক্ষন হাঁটার পর অবশেষে সে মুরীবাড়িতে পৌঁছলাম। একটা বৃক্ষের শাখায় দেখলাম বেশ কিছু পাখি বসে আছে। কিন্তু সে বৃক্ষটির অবস্থান চারপাশে পানি এরকম একটি ক্ষেতের মাঝখানে টিলার উপরে। অর্থাৎ ওখানে যেতে হলে অগভীর পানির ভিতর দিয়েই হেঁটে হেঁটে পৌঁছতে হবে। অদম্য জাকির স্যারকে দেখলাম তার ফুলপ্যান্টটা হাটু পর্যন্ত গুটিয়ে বন্দুক নিয়ে গাছটির কাছাকাছি চলে গেলেন। পাখির দিকে তাঁক করে একটি গুলি ছূড়লেন। চারটে পাখি ভূপাতিত হল একগুলিতে। একটা পাখিও স্যার নিজের জন্য না রেখে তার অনুগামী দলের চারজনকে দিয়ে দিলেন। পাখিগুলি ছিল শামুকখোল যা আমরা স্থানীয় ডায়ালেক্টে বলি শামুকভাঙ্গা। আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার, আপনার নিজের জন্য তো  একটা পাখিও  রাখলেন না, এত কষ্ট করে শিকার করলেন’। জবাবে  স্যার বললেন, পিওর হান্টিং ইজ মাই প্লেজার, নট ইটিং ইটস্ মিট’ অ্যাট অল’।

চিরঞ্জীব সরকার। মুম্বাই