অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ফাউন্ডেশন অব জিওপলিটিক্স: ইউক্রেন যুদ্ধের নিয়ামক - এস ডি সুব্রত

     রোনা মহামারীর কবলে পুরো পৃথিবী বিপর্যস্ত । টানা দুই বছরের বেশি সময়  ধরে চলা ক্রান্তিকাল পেরিয়ে যখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ঠিক তখনি বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার বারতা নিয়ে শুরু হয় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ । সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালায় । 
     এক সময়ের ক্ষমতাধর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার  পর রুশরা দেশের বাইরে বিভিন্ন সময়ে  অনেক সামরিক অভিযান চালিয়েছে। জর্জিয়া , ক্রিমিয়া , বেলারুশ , কাজাখস্তান । সর্বশেষ ২০২২ সালে  ইউক্রেন ।কোথাও দেশ দখল, কোথাও কোনো দেশের অংশবিশেষ দখল, কোথাও নিজের পছন্দের একনায়ককে জনরোষ থেকে রক্ষা, কোথাও ‘স্বাধীনতা’কে মদদ দিতে এসব অভিযান চালানো হয় । জাতিসংঘ, ই ইউ এবং ন্যাটো জোটকে  পাত্তাই দিচ্ছে না রাশিয়া ।
     পশ্চিমের প্রচারমাধ্যম বর্তমানে এককভাবে পুতিনকে একজন যুদ্ধবাজ  শাসক হিসেবে তুলে ধরছে। বাস্তবে  দেখা যায় রাশিয়ার দিক থেকে এসব অভিযান কোনো একক ব্যক্তির সামরিক রোমাঞ্চ নয়। প্রতিটি অভিযানের পেছনে আছে রুশদের ভবিষ্যৎ ভৌগোলিক পরিকল্পনার ব্যাপক সমন্বিত ভাবনাচিন্তা প্রভাব ।  বিশ্বের প্রখ্যাত লেখক এবং বিশেষজ্ঞগণ  রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের কারন হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন যৌক্তিক তথ্য । তারা বলেন রাশিয়ার চলমান যুদ্ধদর্শনকে বুঝতে পুতিনের দিক থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে তাকাতে হবে  অন্য  একজনের দিকে । যাকে ইউক্রেন যুদ্ধের খলনায়ক হিসেবে বর্ননা করেছেন তারা । সেই খলনায়ক হিসেবে যার  নাম উঠে এসেছে তিনি হলেন লেখক আলেকসান্দর দাগিন । এই আলেকসান্দর দাগিন পুতিনের অন্যতম উপদেষ্টাও । ৬০ বছর বয়সী দাগিনকে বলা যায় বর্তমান রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক  তাত্ত্বিক ব্যাক্তি ।  তাঁকে উগ্র জাতীয়বাদী বলা হয়  ।  তাঁকে উগ্র   জাতীয়তাবাদে ধারক ও বাহক বলা হলেও  রুশ শাসকশ্রেণির ওপর তাঁর  প্রভাবকে  অস্বীকার করেন না বিশ্লেষকরা ।
     দাগিন বহু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন।   মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন অতীতে। দাগিনের নিজস্ব ওয়েবসাইট দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি  বেশ কয়েক  ভাষায় তাঁর চিন্তাকে ছড়িয়ে চলেছে। ওয়েব সাইটে লিখেছেন ‘যিনি বাম ও ডানের সীমানায় আটকে নেই—তবে অবশ্যই মধ্যপন্থীদের বিরুদ্ধে’।  ‘মধ্যপন্থী’ বলতে দাগিন উদারনৈতিক গণতন্ত্রীদের বোঝান। দাগিনের স্বঘোষিত ‘প্রতিপক্ষ’ উদারনৈতিক-গণতান্ত্রিক আদর্শ।  আর এই আদর্শের বড় কেন্দ্র হিসেবে রয়েছে আমেরিকা। মস্কোতে জন্ম নেওয়া দাগিন বড় হয়েছেন সমাজতন্ত্রের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে।  দাগিন নিজের রাজনৈতিক দর্শনে যুক্ত করেছেন আধ্যাত্মবাদ ও ধর্মকে। তাঁর পাঠক ও শ্রোতাকে সব সময় ‘পুরোনো সোনালি দিনগুলো’র  স্বপ্ন দেখান দাগিন—যেখানে চলতি উদারনৈতিক গণতন্ত্র থাকবে না, যেখানে ‘রাষ্ট্র’ হবে সর্বেসর্বা, যেখানে প্রচারমাধ্যম কেবল ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর কথা শোনাবে। এ রকম  ভবিষ্যৎকে ত্বরান্বিত করতে দাগিন রাজনীতিকে  কাজে  লাগানোর তাগিদ দেন সবাইকে ।দাগিনের  সেই তাগিদ  বিশেষ করে রুশদের জন্য । সেই তাগিদের ফসল তাঁর ‘ফাউন্ডেশন অব জিওপলিটিকস’ গ্রন্থ। এখানে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন  কীভাবে রাশিয়াকে আবার আশপাশের অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জায়গায় যেতে হবে। বইটি দ্রুত রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও রাশিয়ার বিভিন্ন সামরিক প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য হয়ে গেছে জনপ্রিয়তার কারণে ।
     প্রথম জীবনে দাগিন ন্যাশনাল বলশেভিক পার্টির ব্যানারে ভোটাভুটির রাজনীতিতে নেমেছিলেন।  সফল হতে পারেননি । এরপর তিনি  সহজ রাজনীতির বদলে রাশিয়ার শাসক এলিটদের উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দিয়ে প্রভাবিত করার পথে নামেন এবং সফল হন। দাগিন তাঁর এই কৌশলের নাম দিয়েছেন অধিরাজনীতি । তাঁর মতে, রাজনীতিতে সফল হওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পাল্টানো এ সময়ে বেশি প্রয়োজন । আর এ কাজকেই তিনি বলছেন অধিরাজনীতি। ইউরোপে অনেকে দাগিনের এই অধিরাজনীতিকে আন্তোনিও গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্বের একধরনের নবায়িত রূপ হিসেবে দেখছেন। 
     দাগিন মনে করেন, সাম্য ও সমানাধিকার একটা বাতিল ধারণা। ইউরোপকে এখন মনোযোগ দিতে হবে ‘ইউরেশিয়া’ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায়, যে সাম্রাজ্যে নায়কের আসনে থাকবে রুশরা । রাজনীতি ও প্রশাসনে রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, ধর্ম ও চার্চের প্রভাব ফিরিয়ে আনতে চান দাগিন।  এ রকম ভাবনার কারণে দাগিনকে রাশিয়ার বাইরে ইউরোপের অনেক উগ্র জাতীয়তাবাদীও গুরু মানছে। তুরস্কের জাতীয়তাবাদীদেরও তিনি বেশ আকর্ষণ করছেন তাঁর এ কৌশলগত তত্বের মাধ্যমে ।   দাগিনের প্রভাব বাড়ছে আমেরিকার রিপাবলিকানদের ওপরও। পুতিনকে ‘লৌহমানব’ করে তুলেছে দাগিনের দর্শন। দাগিন নিজে তৈরি হয়েছেন ইতালির ফ্যাসিস্ট জুলিয়াস ইভোলার আদর্শিক প্রভাবে। ইভোলাকে মনে করা হয় আধুনিক ইউরোপের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অন্যতম গুরু। এই ইভোলার ভক্ত আবার যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানদের অনেকে; বিশেষ করে স্টিভ ব্যানন, যে ব্যানন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন। এদিক থেকে দাগিন ও আমেরিকার অনেকের মধ্যে দার্শনিক দূরত্ব বেশি নয় ।
     পুতিনের ভাবনা-চিন্তা-সিদ্ধান্তে দাগিনের বেশ প্রভাব আছে। কেউ কেউ দাগিনকে বলছেন পুতিনের ‘রাসপুতিন’। আরও বেশি খোঁজখবর রাখা ব্যক্তিরা বলছেন দাগিন হলেন ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’। রাসপুতিন ও আজকের দাগিনের চেহারায় অবিশ্বাস্য মিল। জারদের আমলের রাসপুতিন যেভাবে শাসকদের সম্মোহিত করতেন, দাগিনও একালের রাশিয়ার অভিজাতদের আরও বড় সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন যৌক্তিকতা দেখিয়ে । দাগিনের ১৯৯৭ সালে লেখা ‘ফাউন্ডেশন অব জিওপলিটিকস’ বইটিকে পুতিনের গত ২০ বছরের বিদেশনীতির গাইড বই হিসেবে গণ্য করা হয় । রাশিয়ার বাহিনী ইউক্রেনে ঢুকে পড়া নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিস্ময় তৈরি হলেও এ ঘটনা যে ঘটানো হবে, সেটা দাগিন ২০০৮ সালেই বলে রেখেছিলেন। সে সময় জর্জিয়ায় রুশদের অভিযানের সময় দাগিন দক্ষিণ ওশেতিয়ায় গিয়েছিলেন এবং জর্জিয়ায় তাঁর দেশের সামরিক অভিযান সমর্থন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তিবলিশ, ক্রিমিয়া, ইউক্রেনসহ এসব অঞ্চল রুশদের।’ সর্বশেষ আগ্রাসনকালে ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন হতে পুতিনকে  যেভাবে  দাগিন উৎসাহ জোগালেন, ঠিক সেভাবেই ২০০৮ সালে দক্ষিণ ওশেতিয়াকে ‘স্বাধীন’ করে রাশিয়া নিজ কবজায় নেয়। জর্জিয়ার দক্ষিণ ওশেতিয়া, ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ইত্যাদি এলাকায় যারা রুশ বসন্তের গোড়াপত্তন করেছে, সবাই দাগিনের ভক্ত। দাগিন আলাপ-আলোচনায় বরাবরই ইউক্রেনকে ‘নিউ রাশিয়া’ বলতেন। পুতিনও এখন সেটাই অনুসরণ করেন। রাশিয়া যখন জর্জিয়ায় সেনা পাঠায়, দাগিন সে সময় ২০০ ‘স্বেচ্ছাসেবক’ নিয়ে ওখানে সেমিনার করে বলছিলেন, এই লড়াই দুটি ‘সভ্যতার সংঘাত। ২০১৪ সালের ১০ জুলাই বিবিসিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে দাগিন আরেকবার খোলামেলাভাবে পুতিনকে ইউক্রেন দখলের আহ্বান জানান।  পুতিনের  অভিযানসমুহ  দাগিনের সুপারিশমতো ‘বৃহত্তর রাশিয়া’ গড়ারই পদক্ষেপমাত্র। ক্রিমিয়ার মতো ইউক্রেন অভিযানের পর বিভিন্ন জরিপে রাশিয়াজুড়ে জনগণের মধ্যে পুতিনকে পছন্দের হার বেড়েছে। এভাবেই দাগিন-পুতিন মৈত্রীর ভেতর দিয়ে নতুন শতাব্দীতে নতুন রাশিয়ার নবজন্ম হচ্ছে, যা ১৯৯০ সালে ভেঙেপড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের চেহারার একদম বিপরীত।
     ইউক্রেন অভিযান কতটা সুপরিকল্পিত, সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অর্থনৈতিক অবরোধ প্রশ্নে দাগিন-পুতিন জুটির অভিমত দেখেও বোঝা যায়। এ অবরোধকে এই জুটি নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। দাগিনের মতে, এ রকম অবরোধ তাঁদের অনুমানে ছিল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রধানত রাশিয়ার বড় ধনীরা, যারা রাজনৈতিক বিশ্বাসে উদার গণতন্ত্রী এবং পশ্চিমের মিত্র। তাদের দুর্বল হওয়া রাশিয়ায় ‘দেশপ্রেমিক’দের শক্তি জোগাবে । দাগিন তাঁর আলোচনায় রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্বকে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নজর রাখতে বলেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে উদ্বেগের শেষ নেই। সেখানে অনেকের অভিমত, প্রেসিডেন্ট পদের জন্য হিলারির প্রচারণায় রাশিয়ার নাক গলানোর কারণ আসলে দাগিনের দার্শনিক উসকানি।  দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে দাগিন এও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উদারনৈতিক আদর্শ আর কিছু নয়, স্বর্গে যাওয়ার পথে এক বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতামাত্র।  তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আন্তজাতি বিভেদেও রুশদের নাক গলাতে বলেন। এগুলো তাঁর কাছে রাশিয়ার ‘কেন্দ্রীয় কাজ’। এ রকম কাজের জন্য এক শক্তিশালী ‘রাজত্ব’ দরকার। সেই লক্ষ্যে যে পুতিন ইউক্রেনে হাত বাড়িয়েছেন, তাতে রাশিয়ার শাসক-কুলীনদের অন্তত সন্দেহ নেই। দাগিনের মতে রাশিয়ার রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত—একদিকে আছে উদার গণতন্ত্রীরা, অন্যদিকে দেশপ্রেমিকেরা। ইউক্রেন অভিযান দেশপ্রেমমূলক এক অগ্রাভিযানমাত্র।এ যুদ্ধে র প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে । বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ যুদ্ধ চায়না, চায় শান্তি । তবে এ শান্তির পথ  কতদূর ? 

এস ডি সুব্রত
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ ‌