'পঁচিশে বৈশাখ'এ রবীন্দ্রনাথ - পার্থ সারথী চৌধুরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আমার জ্ঞানের পরিধি সৌর পরিবারের মধ্যে এক মাটির প্রদীপের মত, তবুও ভরসা রবির কিরণ থেকে একটুকু কিরণ নিজের শরীরে নিয়ে নিলে শরীরেরই উপকার হয় রবি কিরণের কোন অপচয় হয় না।
' পঁচিশে বৈশাখ চলছে
জন্মদিনের ধারাকে বহন করে
মৃত্যু দিনের দিকে' -----
তাঁর 'পঁচিশে বৈশাখ ' নামক কবিতাটির শুরুতে কবি লিখেন উপরের এই লাইন কয়টি। কবিতাটি তাঁর 'শেষ সপ্তক' কাব্যগ্রন্হের অন্তর্গত। এটি তাঁর শেষ বয়সে লিখা। কবি যখন জীবনের রস আস্বাদন করে জীবনকে মথিত করে জীবন সায়াহ্নে উপনিত সেই সময়ের। কবির জীবন উপলব্দি এবং জীবনের সঞ্চিত ভান্ডার আর দশজনের মত তবে তা ঋদ্ধ তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তায়। রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব এখানেই এখানেই তিনি স্মরণীয় বরনীয় এবং পূজনীয়। তিনি মহাপ্রাণ তিনি বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন, করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অনুপ্রাণিত করিবেন।
সময় সদা চলমান থামতে জানে না। কোন কিছুর প্রতি সময়ের কোন মায়া নেই, পিছনে ফিরে তাকায় না। কিন্তু এই প্রবহমান বা ধাবমান সময় কোন এক সন্ধানে শ্বাশ্বত সত্যের মত অবিচল স্হির আর সেই শাশ্বত অবিনাশী সত্য হচ্ছে মানুষের মন এবং অনুভূতি।
'রথে চড়ে চলছে সময় ' সময়ের রথে চড়ে চলছি আমরা মানুষেরাও। তবে সময়ের গতি এবং মানুষের মনের গতি এক নয়, সময় ভেঙেচুরে চলে এবং নতুনের সৃষ্টি করে। মানুষের মন সময়ের সাথে চলতে চায় কিন্তু পারে না। কালে কালে মানুষের মন বদলায় বাহ্যিক সময়ের সাথে তাল মিলাতে তার বাহ্যিক অবয়বের পরিবর্তন ঘঠে কিন্তু অন্তরের অনুভূতিগুলির তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। রবীন্দ্রনাথ তা দেখেছেন 'ছোট ছোট জন্ম মৃত্যুর সীমানায়' এবং বলতে পেরেছেন 'নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা'। এ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেকে 'নানা রবীন্দ্রনাথ ' অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। তিনি মিশে গিয়েছেন আমাদের মাঝে মানুষের মাঝে নানা ভাবে আবার নিজেকে লীন করেছেন তার একক সত্তায়। তিনি চিত্রিত করেছেন তার বালক, কিশোর, কৈশোরয, তরুণ যৌবন, যৌবন, প্রৌঢ় এবং বার্ধক্য। এখানে অনুভূতিগুলি চিরকালীন চিরতরুন। সময় বদলিয়েছে মানুষ বদলিয়েছে 'যে সত্য ছিল যাদের জানার মধ্যে/ কেউ নেই তারা।' মানুষ ভুলে যায় তার বালককাল ভুলে যায় সেই বালককালের কথা। কোন এক সময় মনে হয় সে বালক কালের খেলার কথা আনন্দ বেদনার কথা। আবছা মনে পড়ে স্মৃতি হাতড়িয়ে হঠাৎ উঁকি দেয় কোন সকালের কথা বা সন্ধ্যার কথা। তখন কেউ থাকে না পাশে আক্ষেপ জাগে আবার নিজের মনেই ছবি হয়ে ভেসে আসে এক বালক 'ছোট গবাক্ষের কাছে' বসে আছে বাহিরের দিকে চেয়ে। সন্ধ্যায় নিজের মনে আপন ভুবন সৃষ্টি করে সেই রূপকথার নীলপরীর দেশে শিয়রে বালিশের দুই পাশে সোনার কাটি রুপার কাটির গল্প। সেই রাজকন্যার কথা সে-ই যেন সত্য। কল্পনার সেই রাজ্যে সত্য এবং মিথ্যার কী এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ যেখানে সবই সত্য আবার সব কিছুই অলীক, মিথ্যা।
বালকত্ব পেরিয়ে কৈশোর, দুরন্ত কৈশোর সবই যেন স্বপ্নময়। সবই যেন রঙিন সুষমায় সুষমা মন্ডিত।
তারপরই আসে তরুণ যৌবন। স্বর্গ্বের অপ্সরীরা নেমে আসেন ধূলার ধরণীতে। মনের আয়নায় উঁকি দেয় কত সুন্দর সুন্দর মুখশ্রী। কত আসে আবার কত চলে যায় হারিয়ে যায় হয়তো কেউ থেকে যায় স্হায়ী আসন পেতে 'কোন কোন দূতী '। হয়তো রবীন্দ্রনাথের মনে এমনি কেউ এসেছিলেন। ইনি কি আন্না তড়খড় না অন্য কেউ। অবশ্য তা রবীন্দ্র গবেষকদের গবেষণার বিষয় আমাদের না। আমাদের কাছে তা চিরকালীন তরুণ যৌবনের ছবি। আমরা স্বপ্নের মাঝে শুনি তার কন্ঠের অস্পষ্ট কথা।
তরুণ যৌবন পেরিয়ে আমরা পৌছে যাই ভর যৌবনে। ধীরে ধীরে পরিচিত হতে থাকি জীবনের সাথে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সাথে। এই সময়ে আনন্দের সাথে সাথে আমরা শুনি বিরহীর বাশির সুর কোকিলের কোকিল কন্ঠ তখন মনে হয় ' বিরহী কোকিলের কুহু বর'। শেষ হয়ে আসে জীবনের মেঠো পথে হাঁটা। মেঠো পথের ধূলা সবুজ ঘাস পেরিয়ে আমরা এসে মিলিত হই জীবনের প্রস্হর পথে রবীন্দ্রনাথের কথায় 'পাথর বাধানো রাজপথ।'
পাথর বাধানো রাজপথ বেয়ে আমরা এসে মিলিত হই জনসম্মুখে পরিচিত হই জীবনযুদ্ধের সাথে। এ যে বন্ধুর পথ হাসি কান্না আশা নিরাশা হতাশায় ভরা যাকে বলা চলে 'জীবনের রণক্ষেত্র'। হিংসা দ্বেষ জয় পরাজয়, এখানে সন্মূখীন হতে হয় নানা ঘাত প্রতিঘাতের সাথে। জীবনের রুদ্ররূপ মোকাবেলা করতে কখনো নিতে হয় 'ভেরি' হতে হয় ক্ষত বিক্ষত। মেনে নিতে হয় জয় পরাজয় দ্বেষ বিদ্বেষ রাগ অনুরাগ। এই কঠিন পথে চলেই নির্ধারিত হয় মানুষের জীবনের নিজস্ব কক্ষপথ। এপথে এভাবেই মানুষের জীবন এগিয়ে চলে। এই দুর্গম পথ বেয়ে মানুষ একদিন পৌছে যায় জীবনের প্রৌঢ়ত্বে। মানুষ হিসাব মিলাতে চায় চাওয়া পাওয়া, পাওয়া না পাওয়া সমাপ্তি অসমাপ্তির হিসাব। জীবনের এই চরম ক্ষণে ব্যর্থতার গ্লানি চরিতার্থের প্রাপ্তিতে এক জঠিল সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে মানুষ পৌঁছে যায় জীবনের শেষ বেলায়। জীবন সায়াহ্নে উপনিত মানুষ তার সৎ কর্মের জন্য পায় মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা। ঘনিয়ে আসে সময় কবির ভাষায় মানুষ বলে 'দাও আমাকে ছুটি'।
প্লেটো বলেছেন কবিদের মধ্যে এক 'দৈবী প্রেরণা' (divine frenzy) প্রবেশ করে এবং দৈবী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ কবিরা যা সৃষ্টি করেন সাধারণ মানুষের মাঝে মিলে মিশে তা একাকার হয়ে হয়ে যায়। সেই আমি আর স্বতন্ত্র আমি থাকে না হয়ে যায় প্রত্যেকের আমি, আমরা, হয়তো এরি নাম রবীন্দ্রনাথের 'জীবন দেবতা '।
রবীন্দ্রনাথ কবিতার শেষে এসে ছুটি নিতে চেয়েছেন এবং আমাদের দিয়েছেন এক পরিপূর্ণ জীবন চিত্র। 'পঁচিশে বৈশাখ ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তার জীবন চিত্রিত করে করেছেন একজন মানুষের জীবনের কাব্যিক চিত্রণ। পঁচিশে বৈশাখে কবিকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
পার্থ সারথী চৌধুরী। সিলেট
-
নিবন্ধ // মতামত
-
06-05-2022
-
-