অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ল্যান্ডলাইন টেলিফোন - গোলোকেশ্বর সরকার

    বাড়ির ল্যান্ডলাইন ফোনটা  বেজে  উঠল। সকালবেলা। তিওড় --বালুরঘাট। কথামঞ্জুরি ফোনটা তুলল। অপরপ্রান্ত থেকে ছেলে-- কন্ঠে বলে উঠল, " হ্যালো , এটা  কি কথামঞ্জরিদের বাড়ি?" 
     কথামঞ্জরি  উত্তর দিল, " হ্যাঁ।  কেন বলুন তো?" অপর প্রান্ত  থেকে বলে উঠল, " আপনি কি কথামঞ্জরি?" 
     " হ্যাঁ । কী দরকার বলুন তো?" কথামঞ্জরি প্রশ্ন করল।
     ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, " আমি তোমার সাথে  কথা বলতে চাই।"
     কথামঞ্জরিদের  ল্যান্ডলাইন টেলিফোনটা পুরনো মডেলের।  কে ফোন করছে, কোন নম্বর থেকে ফোন আসছে,  সেটা জানা যায় না। উজান প্রস্তাব দিয়েছিল, "কথামঞ্জরি, আমাদের  পুরনো টেলিফোনটা পালটে  নতুন আধুনিক  মডেলের টেলিফোন কেনা যাক।  তাহলে   কোন নম্বর থেকে ফোন আসছে, কে ফোন করছে সেটা  ডায়ালারের ওপর  দেখা  যাবে।"  কথামঞ্জরি বলেছিল, "না, থাক। দরকার নেই। আমাদের  পুরনো টেলিফোনের ডায়ালারের  ভেতর আমাদের দু'জনের ভালোবাসা বাস  করে।  টেলিফোনটির  ডায়ালারের   মধ্যে আমাদের প্রেম  ঘর বেঁধে রয়েছে।  প্রেমের দেওয়াল, প্রেমের দরজা--জানলা,  প্রেমের চৌকাঠ, প্রেমের মেঝে ,ছাউনি দিয়ে তৈরি সেই ঘর।  যদিও  এই টেলিফোনটা উজানই কিনেছিল  আবার উজানই পালটাতে চেয়েছিল, তবু কথামঞ্জরির আপত্তিতে সেটা পালটানো সম্ভব হয়নি। কথামঞ্জরি  টেলিফোনটা কানে ভালো করে ধরে বলল," আপনি কে বলুন তো?"   অপরপ্রান্ত থেকে বলল, "আমি নীলাকাশ।" 
     "রং নম্বর।" বলে  কথামঞ্জরি ফোনটা কেটে দিল।
     উজান বলল, "কে গো?"
     কথামঞ্জরি জানাল, " ভুল  করে আমাদের এখানে কারও  ফোন ঢুকে গেছে।  এখন তো হামেশাই এমন হচ্ছে।  ফোন কোম্পানিগুলো কেন যে এসব ঠিক করতে পারে না কে জানে?" 
     পরের দিন সকালবেলা।  আবার ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল।  কথামঞ্জরি ফোনটা ধরল। হাতে চায়ের কাপ।  কথামঞ্জরি ও উজান চেয়ারে  বসে চা খাচ্ছিল।  কথামঞ্জরি  বলে উঠল, "হ্যাঁলো, আপনি কে বলছেন?"   অপরপ্রান্ত থেকে  পুরুষ কন্ঠে বলে উঠল, " আমি নীলকাশ।  আমি তোমার   সাথে কথা বলতে চাই।" কথামঞ্জরি শান্ত স্বরে  বলল, "দেখুন, আপনি কে তা আমি  জানি  না। এসব আজে--বাজে কথা  আমাকে   বলবেন না। আমাকে বিরক্ত করবেন না।"  অপরপ্রান্ত থেকে আবার বলে উঠল, " আমি নীলাকাশ, তোমার নীলকাশ। আমাকে চিনতে পারছ না কথামঞ্জরি?"  সকালের খবরের কাগজের  আলাদা একটা গন্ধ থাকে।  উজান সকালের টাটকা-- গন্ধযুক্ত--খবরের কাগজ  থেকে মুখ তুলে বলল, " কার ফোন?"   কথামঞ্জরি চেয়ার টেনে উজানের  পাশে বসল।  সকালের  মধুর--  চায়ে চুমুক দিল।  বলল,"কাজকর্মহীন  কোনও বখাটে  লোক হয়তো?" 
     " কী বলছিল?"  উজান  প্রশ্ন করল।
     " ধুর, যতসব উল্টোপালটা  কথা।"   উজান আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
     বিকেলবেলা। আবার ফোন। ফোন  ধরল কথামঞ্জরি।  অপরপ্রান্ত থেকে সেই একই কন্ঠ, " কথামঞ্জরি, আমি  তোমার নীলাকাশ। আমার কথা মনে পড়ছে না কথামঞ্জরি?"  কথামঞ্জরি এবার  রেগে গেল।  বলল, " দেখুন, আপনি  আমাকে  এমন  অমার্জিত, অশালীন  কথা বলছেন কেন? আমাকে  জ্বালাতন  করতে থাকলে আমি পুলিশে জানাতে বাধ্য  হব।  আপনি দ্বিতীয়বার আর আমাকে ফোন করবেন না।" ফোন কেটে দিল কথামঞ্জরি।  উজান  কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কথামঞ্জরি উজানকে বলল, "সেই একই লোক।"   রাগে চোখ--মুখ লাল কথামঞ্জরির।   
     আয়োজন বিদ্যালয়ের  পড়া মুখস্থ করেছিল। মাকে উত্তেজিত দেখে বলল, " মা,  তোমার কী হয়েছে?"  উজান বলল, " আয়োজন, কিছু হয়নি বাবা।  তুমি পড়ো"   আয়োজন  কথামঞ্জরিকে বলল, " মা, আমি এখন আর পড়ব না।"  উজান  আয়োজনকে কোলে তুলে নিল।  উজান বলল, " আয়োজন, তুমি ভালো করে পড়া করো। পড়াশোনা করে তোমাকে অনেক বড় হতে হবে।  তুমি আমার স্বপ্ন। তুমি বড় অফিসার হবে, যাতে  আমি মাথা উঁচু করে গর্ব করে বলতে পারি , তুমি আমার খুব ভালো ছেলে।" আয়োজন আবার পড়তে বসল। 
     সন্ধের সময় আবার  ফোন।  উজান বলল, "দাঁড়াও , দাঁড়াও।  ফোনটা আমি ধরি।"  কথামঞ্জরি বলল," না, না।  আমিই ধরি।"   কথামঞ্জরি  টেলিফোনটা ধরে বলল, "আপনি কী চান বলুন তো?"  ওপ্রান্ত থেকে বলল,"আমি তোমার সাথে একান্তে কথা বলতে চাই।"
     কথামঞ্জরি বলল, "আপনি এমন অশোভন, রুচিহীন কথা বলছেন কেন?  কদর্য কথা বলছেন কেন?"
     অপর প্রান্ত কথামঞ্জরির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে উঠল, "আগামি  পরশু শুক্রবার বংশীহারী টাঙ্গন নদীর ধারে  ইটের  পরিত্যক্ত ঘরে  একা  তোমার সাথে দেখা করতে চাই। একা। একদম একা।   টাঙ্গন ব্রিজের দক্ষিণ দিকে  জনহীন  ফাঁকা মাঠের মাঝে  ইটের  ভাঙাচোরা  সেই  ঘর।  সময় দুপুর দুটো।  আমি জানি, তুমি আসবে।"
     কথামঞ্জরি  বেশ  জোরে বলে উঠল, "আপনার সাহস তো কম নয়!  আপনি এমন জঘন্য, কুৎসিত কথা বলার স্পর্ধা দেখান কীভাবে? আপনার সঠিক পরিচয় কী বলুন তো?"   টেলিফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলে উঠল, "আমি নীলকাশ।  আমি  তোমার বর নীলাকাশ।"   কথামঞ্জরি  ভীষণ রেগে  গেল।  বলে উঠল, "আপনি তো মহা  শয়তান  মশাই।  নিষেধ করা সত্ত্বেও আপনি বারবার ফোন করছেন আর  নোংরা,  বিশ্রী-- বিশ্রী  কথা   বলছেন।"   ও প্রান্ত থেকে বলে উঠল, " কথামঞ্জরি, আমি একদম সঠিক বলছি, আমি তোমার বর নীলাকাশ।"     
     ও প্রান্ত থেকে বলতেই থাকল,  "কথামঞ্জরি, মনে পড়ে, আমাদের বিয়ের পর আমরা একটা সাদা মোটা খাতা কিনেছিলাম। সেই খাতায়  সকলের অগোচরে  প্রতিদিন দশবার আমি লেখতাম 'আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি কথামঞ্জরি'। সেই খাতাটির  সেই পাতায়   আমার লেখার নিচে তুমি   লুকিয়ে-- লুকিয়ে   প্রতিদিন দশবার লেখতে ' আমি তোমাকে অনেক--অনেক ভালোবাসি নীলাকাশ'। এভাবে খাতায়  ছ'মাস  লেখার পর আমরা বুঝেছিলাম, আমাদের দু'জনের মধ্যে ভালোবাসা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।  মনে পড়ে?  কথামঞ্জরির মুখের কথা হারিয়ে গেল। আরে, লোকটা  একথা জানল কীকরে? খুবই গোপনীয়  আমাদের  ভালোবাসার রসায়নের  কথা  বাইরের লোকে  জানল কী ভাবে?  আমি কাউকে বলিনি, আমি যতটুকু জানি  নীলাকাশও  কাউকে কোনওদিন বলেনি। এটা  শুধু আমার  আর নীলাকাশের জানার কথা। এই ঘটনা তো অন্য কারও জানার কথা নয়।
     ও প্রান্ত থেকে আবার বলল, "কথামঞ্জরি,  আমি  বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়  প্রতিদিন  তোমার থুতনিতে হাত লাগিয়ে আদর করে  বাইরে বের হতাম।  যদি বাড়িতে  লোকজন থাকত, তাহলে  নিরাপদ স্থানে তোমাকে ডেকে  তোমার থুতনিতে হাত লাগিয়ে  খাতির  করে  তবেই যেতাম। তুমিও  বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়ার সময়  আমার থুতনিতে হাত দিয়ে থুতনি নাড়িয়ে সোহাগ  করে  তবেই বাইরে যেতে। অন্য কেউ বাড়িতে থাকলে তুমি গোপনে আমাকে ডেকে গোপনভাবে তোমার হাত দিয়ে  আমার থুতনি নাড়িয়ে যত্ন করে  তবেই বাইরে বেরুতে।   আমরা অনুভব করেছিলাম,  এভাবে আমাদের  ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছিল।" 
     কথামঞ্জরি চুপচাপ। গলা শুকিয়ে গেল। হাত--পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। কথামঞ্জরি মনে মনে বলতে লাগল, " ঠিক। একদম  সঠিক বলেছে লোকটা।  কিন্তু আমাদের  স্বামী--স্ত্রীর  'থুতনি ছোঁয়া  আদর' খুবই  গোপনীয়  ব্যাপার। এটা  আমি আর নীলাকাশ ছাড়া  কারও তো জানার  কথা নয়।  কিন্তু এটা কী করে সম্ভব!   নীলাকাশ তো বেঁচে নেই।   আজ থেকে দশ বছর আগে  সে তো মারা গেছে।  নীলকাশের  মৃতদেহ দাহ করার সময় আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম, তাহলে নীলাকাশ কথা বলবে কী  করে?  বেঁচে থাকবে কী করে! কথামঞ্জরি ধপ  করে চেয়ারে  বসে পরল।  হাঁসফাঁস করতে লাগল।  উজান ছুটে এল।  কথামঞ্জরি বলল, "উজান, একগ্লাস জল দাও।"  উজান তাড়াতাড়ি  করে একগ্লাস জল আনল।  ঢকঢক করে জল খেয়ে  কথামঞ্জরি বলল, "উজান,  নীলাকাশ ফোন করেছিল!  নীলাকাশ কথা বলছিল!"  উজান ভীষণভাবে  চমকে উঠল।  খুবই অবাক হয়ে উজান বলল, "নীলাকাশ! নীলাকাশ ফোন করেছিল! সে তো মারা গেছে।  সে ফোন করবে কীভাবে!"   কথামঞ্জরি বলল, "টেলিফোনে নীলাকাশের গলাটা সরু মনে হচ্ছিল।  হয়তো সে গলার স্বর পরিবর্তন করে কথা বলছিল কিংবা টেলিফোনের রিসিভারে রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে  কথা বলছিল।  তবে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত,  ওই লোকটি নীলাকাশ।"

দুই
     ভয়াবহ  ট্রেন দুর্ঘটনা।  বহু লোক মারা গেছে। শিলিগুড়ি যাওয়ার আগে কথামঞ্জরি  একান্তে  নীলাকাশকে বলেছিল,  " নীলাকাশ, শিলিগুড়ি থেকে আমার জন্য  বাগান--ছাপা   হলুদ রঙের  একটা সুন্দর শাড়ি এনো।  শাড়িটি  এক ঝলক দেখলে মনে হবে, হলুদ  শাড়ির ওপর  'ফুলের বাগান'  নকসা  করা  রয়েছে। সারা শাড়িতে নানা রকম  ছাপা  থাকে। তবে বেশির ভাগ ছাপা থাকে গাছ,  সবুজ  পাতা আর ফুল।" 
     নীলাকাশ বলেছিল, "আনব।  অবশ্যই আনব। আমার  সুন্দরী বউ  আবদার  করেছে, আর  আমি তা না এনে থাকতে পারি?  নিশ্চয়  নিয়ে  আসব।"   উজান ও কথামঞ্জরির একই পাড়ায় বাড়ি।  টিভিতে দেখার সাথে সাথে কথামঞ্জরি  উজানের বাড়ি হন্তদন্ত  হয়ে গিয়ে বলেছিল, "উজান, বালুরঘাট--শিলিগুড়ি  স্পেশাল  ট্রেন শিলিগুড়ির  বাগডোগরা  রেল স্টেশনের  কাছে  অ্যাকসিডেন্ট করেছে।  টিভিতে দেখাচ্ছে । অনেকগুলো বগি লাইনচ্যুত হয়ে  উল্টে গেছে।  বেশ সংখ্যক লোক মারা গেছে; বহুলোক আহত হয়েছে। আমার বুকটা ভীষণ কাঁপছে। হাত--পা অবশ হয়ে  যাচ্ছে। তোমার বন্ধু   শিলিগুড়ি যাবে বলে  ওই  ট্রেনেই রওনা দিয়েছিল।  আমার মনটা অস্থির হয়ে পড়েছে। আমি  বাগডোগরা  অ্যাকসিডেন্টের জায়গায় যাব।  আমি বহুবার ফোন করেছি; তোমার বন্ধু ফোন তুলছে না।  ফোন শুধু 'সুইচ অফ, সুইচ অফ' বলছে।" 
     নীলকাশ তার বাড়ির বেশ কিছু জানলাতে  কালো  কাঁচ লাগাবে বলে কালো কাঁচ আনতে বালুরঘাট-- শিলিগুড়ি  স্পেশাল  ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি রওনা হয়েছিল। 
     উজান বলেছিল, "কথামঞ্জরি, তুমি বাড়ি গিয়ে প্রস্তুত হয়ে নাও।  আমি একটু তৈরি হয়ে নিই।"
     কথামঞ্জুরি বলেছিল, " আমি আর প্রস্তুত হবো না, এই ভাবেই যাব। আমি বসে আছি; তুমি তৈরী হয়ে নাও।"  কথামঞ্জরির চুলগুলো এলোমেলো, চোখ-মুখ উস্কোখুস্কো,  পরনে সাধারন শাড়ি।  কথামঞ্জুরি চুল ঠিক করেনি, চোখ --মুখ পরিষ্কার করেনি,  শাড়ি বদল করেনি। উজানের বাড়িতে বসে ছিল সারাক্ষণ। উজান  খালি গায়ে  পায়জামা পরেছিল ।  সে ঘরের ভেতর গিয়ে জামা-- প্যান্ট পরেছিল।  উজান বৃদ্ধা  মায়ের সাথে থাকে।  উজান বলেছিল, " মা,  তুমি সাবধানে থেকো। আমি কথামঞ্জরির  সঙ্গে বাগডোগরা  যাচ্ছি।"   উজানের মা বলেছিল, "যা বাবা, মেয়েটির ভীষন বিপদ। একা মেয়ে। কেউ নেই ওর।"  তারপর উজানের মা  কথামঞ্জরিকে বলেছিল, " ভয় পাস না  মা। মনটাকে শক্ত কর ।"  বাস  ধরে  কথামঞ্জরি ও উজান  বাগডোগরার  দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছেছিল।  সেখান থেকে সোজা হাসপাতাল,  তারপর মর্গ।  মর্গে গিয়ে দেখেছিল, বা' হাতে  রুপার বালা পড়া একটি মৃতদেহ। চোখ--মুখ কিছু চেনা যাচ্ছিল না। নীলাকাশ বা'হাতে রুপার বালা পড়ত। হাতে বালা পরা ছিল নীলাকাশের শখ।  রুপার বালা পরা বা'হাত দেখে কথামঞ্জরি  সনাক্ত করেছিল, এটা নীলাকাশের মৃতদেহ।    কথামঞ্জরি  কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।  সুস্থ হওয়ার পর,  নিজেকে  সামলে নিয়ে  কথামঞ্জরি ও উজান দু'জনে মিলে ঠিক করেছিল, মৃতদেহ বাগডোগরাতে  সৎকার করা হবে। সেই মোতাবেক  বাগডোগরাতেই  নীলকাশের মৃতদেহ দাহ করা  হয়েছিল।  বিধ্বস্ত হয়ে  ফিরে এসেছিল কথামঞ্জরি।  খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। উজানের মা উজানকে বলেছিল, "বাবা  উজান, একটা কথা বলব, মনে কিছু করবি না তো?"  উজান  মা'কে অভয় দিয়েছিল, " বলো মা,  আমি মনে কিছু করব না।"  মা বলেছিল, "দেখ বাবা,  কথামঞ্জরি এখন একা। ওর বাবা-মা কেউ নেই।  আবার নীলাকাশেরও   বাবা-- মা ছিল না। ওদের দু'জনের আত্মীয়-স্বজনও ভালো নয়। কথামঞ্জরিকে দেখবার  কেউ নেই। তুই কথামঞ্জরিকে বাঁচা। তুই ওকে বিয়ে কর।"   উজান বলেছিল, "সেটা কী  করে সম্ভব?   মাত্র ক'দিন হলো, কথামঞ্জরি  স্বামী --হারা হয়েছে।   এখন  ওকে বিয়ের কথা বলা  অমানবিক হবে। এটা অসম্ভব।" উজানের  মা বলেছিল, "দিনকাল খুবই খারাপ।   শয়তান লোকেরা ওকে  ভালো থাকতে দেবে না। তুই ওকে বিয়ে করে ওকে  রক্ষা কর।"   উজান সম্মতি জানিয়েছিল।  কথামঞ্জরি রাজি হচ্ছিল না।  সে   বিয়ে করতে  চাইছিল না।   উজানের মা অনেক বোঝানোর পর  চোখের জল বুকে চেপে রেখে  অবশেষে  কথামঞ্জরি সম্মতি  দিয়েছিল।  নীলাকাশ মারা যাওয়ার একুশ  দিনের মাথায় কথামঞ্জরি ও উজান  মন্দিরে  গিয়ে বিয়ে করেছিল  ।  বিয়ের দু' মাস পর  উজানের মা মারা গিয়েছিল।  বছর খানেকের মধ্যে কথামঞ্জরির একটা  ছেলে হয়েছিল।  ছেলের নাম দিয়েছিল --'আয়োজন'। ধীরে --ধীরে আয়োজন বড় হয়ে উঠেছিল। আয়োজন  এখন  সপ্তম শ্রেণিতে  পড়ে।
     কথামঞ্জরি  নীলাকাশের জায়গা-- বাড়ি বিক্রি করে উজানের বাড়িতে থাকত।  উজান বলেছিল, "কথামঞ্জরি,  আমি তোমাকে কোনদিনও কোনও  কষ্ট পেতে দেব  না। তোমাকে আমি সব সময় সুখে রাখব।  আমি জানি, নীলকাশের জন্য তোমার মনে ভীষণ দুঃখ।  নীলকাশকে তুমি খুবই ভালোবাসতে। সেই দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা আমি পূরণ  করতে পারব কিনা জানি না, তবে প্রাণপণ  চেষ্টা  করব তোমাকে আনন্দে রাখতে,  হাসিতে ভরিয়ে দিতে।"  
     কথামঞ্জরি উজানের বুকের উপর মাথা রেখে বলেছিল, "সে বিশ্বাস আমার আছে গো। আমি তোমাকে খুব,খুব  ভালোবেসে ফেলেছি।"
     খুশিতে ভরে উঠেছিল উজান--কথামঞ্জরির জীবন। ওরা  সপরিবারে  সুন্দরবন, দিঘা, পুরী, গ্যাংটক,  দার্জিলিং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিল।  প্রায় বিকেলে  ওরা আশপাশে ঘুরতে বেরুত।   পুকুর পাড়ে বসে গল্প করতে করতে তারা সময় কাটাত। পুকুরে ফুটন্ত পদ্মফুল, শালুকফুলের সৌন্দর্যের দিকে  তাকিয়ে কথামঞ্জরি   বলত, " জানো উজান,  পৃথিবীতে সৌন্দর্য আছে বলেই মানুষ দুঃখ, কষ্ট, যাতনা সহ্য করেও  বেঁচে থাকে। পৃথিবীতে  অপরুপ রুপ  থাকার কারণে   মানুষ  ব্যথা , বেদনা  ভুলে  জীবিত থাকে।"  উজান বলত, " ঠিক বলেছ। একদম ঠিক কথা।"
     মনের মধ্যে চেপে রাখা একটা কথা উজানকে বলার জন্য কথামঞ্জরি  প্রায়ই চেষ্টা করত।  কিন্তু সে  বলতে  পারেনি।   একদিন মনের মধ্যে সাহস এনে  কথামঞ্জরি  উজানকে বলেছিল, " উজান,  তোমাকে আমি  একটা কথা বলতে চাই। কথাটা তোমাকে আমার জানানো উচিত।"  হাসতে--হাসতে উজান বলেছিল, " কথামঞ্জরি,  তুমি হয়তো এখনও  নীলকাশকে পুরোপুরি ভুলতে পারোনি তাই না?"  
     কথামঞ্জরি বলেছিল, "না গো,  সে কথা নয়।"
     " তাহলে আমি লুকিয়ে --লুকিয়ে কোথাও প্রেম করছি, সেই  দুশ্চিন্তা তোমাকে তাড়া করছে তাই না?"
     "না। সেটাও না।"
     " তবে কী  তুমি অন্য কোথাও মন দিয়ে ফেলেছ?  অন্য কাউকে ভালোবাসতে শুরু করেছ?"
     কথামঞ্জরি বিরক্ত  সহকারে  বলেছিল, "কী সব শ্রীহীন  কথা বলছ।  এসব কিছুই নয়।"
     উজান সিরিয়াস  হয়ে বলেছিল, "দেখো কথামঞ্জরি,  আমাদের বিয়ের আগের কোনও বিষয়  নিয়ে তুমি কোনওরকম দুশ্চিন্তা  করবে না। সেটা নিয়ে কোনও রকমভাবে  ভীত থাকবে না। আমি তোমাকে  খুব ভালোবাসি।  তোমাকে  আমি সারা জীবন   একই রকমভাবে ভালোবাসব।" 
     কথামঞ্জরি আবার কিছু বলতে চাইলে উজান  বাধা দিয়ে  বলেছিল, " কথামঞ্জরি,  দ্বিতীয় দিন এ ধরনের কথা আর আমাকে বলার চেষ্টা করবে না।  তাহলে আমি ভীষণ ব্যথা পাব, কষ্ট পাব। বুঝব,  তুমি আমাকে  মোটেই  ভালোবাসো না। সামান্যতমও   ভালোবাসো না।"
     ছোট্ট আয়োজন 'বাবা, বাবা'  বলে উজানকে এসে জড়িয়ে ধরেছিল। উজান আয়োজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিল।  আয়োজনকে  বলেছিল, "তুমি  আমার  জীবন।  তুমি আমার  প্রাণ। কী হয়েছে বাবা? তোমার কী চাই?"  আয়োজন আবদার করেছিল, "বাবা,  আমাকে এখনই  একটা নতুন খেলনা --বাইক কিনে দাও। আমি বাইক চালাব।"   উজান বলেছিল, " আমার ব্যাটা,  আমার একমাত্র  ছেলে বাইক চালাবে আর আমি বাইক কিনে দেব  না এটা  কখনও  হয়?"  উজান সঙ্গে সঙ্গে আয়োজনকে কাঁধে বসিয়ে নিয়ে  খেলনা --বাইক কিনতে চলে গিয়েছিল। কথামঞ্জরি ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
     উজানের  কথামতো কথামঞ্জরি তার  মনের --কথা উজানকে আর বলতে সাহস পায়নি।

তিন
     উজান  একটা চেয়ার টেনে নিয়ে কথামঞ্জরির  পাশে বসল।  উজান বলল, "কথামঞ্জরি এটা কী করে সম্ভব?  নীলাকাশ তো  মারা গেছে। সে কী করে ফোন করবে?  তুমি হয়তো  ভুল শুনেছ।"    কথামঞ্জরি বলে  উঠল, "ভুল নয় গো,  ভুল নয়।"   কথামঞ্জরি নিজের  বসার চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল।  উজান বলল, " ভুল না হলে   এটা কী  কখনও  হয়?  তুমি আর আমি দু'জনেই  তো নীলকাশকে দাহ করার সময় উপস্থিত ছিলাম।"    কথামঞ্জরি  আবার বলে উঠল, "ভুল নয়, ভুল নয় ।  আমি একদম ঠিক বলছি,  এটা নীলাকাশ।"   উজান বলল, " তাহলে  বুঝতে হবে,  দেহ  শনাক্ত করতে তোমার ভুল হয়েছিল।"  কথামঞ্জরি  বলল, "আমি বুঝতে পারছি না।   কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।"   উজান জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা কথামঞ্জরি,   তুমি কী  করে নিশ্চত হচ্ছো, এটা নীলাকাশ?"   কথামঞ্জরি  দৃঢ়ভাবে  বলে উঠল, "এটা নীলাকাশ।  এব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।"  কথামঞ্জরির  বিশ্বাস দেখে উজানের  বুকটা ধড়াস করে উঠল।  ঢোক গিলল সে।  উজান বলল,  " আচ্ছা  কথামঞ্জরি,  এটা নীলাকাশের  ভূত--টূত নয়তো?"  কথামঞ্জরি  মনে মনে ভাবল, তবে কী নীলাকাশ আমাদের স্বামী--স্ত্রীর  ভেতরকার কথা কোনও কারণে  বাইরে  প্রকাশ করেছিল?   কথামঞ্জরির  চোখ--মুখ বিবর্ণ। চুলগুলো এলোমেলো।  ঘাম ঝরছিল দু' কানের পাশ দিয়ে।    তোয়ালা  দিয়ে  ঘাম  মুছতে --মুছতে  কথামঞ্জরি বলল, "জানি না। আমি জানি না  গো।  কথামঞ্জরি  বলে উঠল, " আচ্ছা উজান, ভূত --টূত  কি ফোন করতে পারে?"   উজান বলল, "সেটা তো আমি সঠিকভাবে জানি না।"  উজান  মনে --মনে বলল, কথামঞ্জরিকে ডাক্তার দেখাতে হবে। মাথায়  সমস্যা দেখা দিয়েছে।"  তারপর কথামঞ্জরিকে দু'হাতে ধরে ধীরে-- ধীরে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল। কথামঞ্জরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।  উজান  বলল, " কথামঞ্জরি,  তুমি ঘুমোও। ঠিক  মতো ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যেতে পারে।"   উজান  কথামঞ্জরির   বিছানার পাশে চেয়ার নিয়ে বসে রইল। 
     চোখ বন্ধ করে কথামঞ্জরির মনে পড়ল,  তার আর নীলকাশের মধ্যে প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল।   নীলকাশ বাসে করে রায়গঞ্জ থেকে বাড়ি ফিরছিল।  বাসটি  হেমতাবাদ বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালে সুন্দরী কথামঞ্জরি বাসটিতে উঠেছিল। কোন সিট ফাঁকা  ছিল না।  সকলে  সিটে বসেছিল।   কথামঞ্জরি নীলকাশের  কাছে গিয়ে বলেছিল, "এই যে দাদা,  এটা মহিলা-- আসন।"  কথামঞ্জরির  কথা শুনে নীলকাশ তার  পাশে বাসের গায়ে  'মহিলা'  লেখা দেখেছিল। নীলাকাশ বসার আগে  লেখাটা  খেয়াল  করেনি। নীলাকাশ  বুঝেছিল যে, আসনটি ছাড়লেই  তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে  হবে। তাই আসনটি থেকে সে উঠছিল না। কথামঞ্জরি বলে উঠেছিল, "এই যে দাদা, উঠুন।  না হলে জোর করে উঠাব।  মহিলাদের আশপাশে  ঘুরঘুর করার খুব শখ তাই না?   শখ  ঘুচিয়ে দেব।"  নীলকাশ আর কথা বাড়ায়নি।  বাসের সব লোক দেখছিল।  সে আসন ছেড়ে দিয়ে লজ্জায় বাসের একদম শেষে এসে বাসের রড ধরে দাঁড়িয়েছিল।  কন্ডাক্টর সকলের ভাড়া নিচ্ছিল, কিন্তু নীলাকাশের ভাড়া নিচ্ছিল না। একসময় নীলাকাশ টাকা বের করে কন্ডাক্টরকে বলেছিল, "দাদা, আমার ভাড়া নিচ্ছেন না কেন? ভাড়া না নিলে আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাব।" কন্ডাক্টর উত্তর দিয়েছিল, "আপনার ভাড়া হয়ে গেছে।" নীলাকাশ বলেছিল, "আমাকে আর লজ্জা দেবেন না কন্ডাক্টরদা।"  কন্ডাক্টর  জানিয়েছিল, "যে --মেয়েটা আপনার সাথে ঝগড়া করেছিল, সে--ই আপনার ভাড়া দিয়ে  দিয়েছে।"  এরপর থেকে কথামঞ্জরি আর নীলকাশের প্রেম শুরু হয়েছিল। 
     কথামঞ্জরি ধড়ফড়  করে বিছানায় উঠে বসল। পাশে চেয়ারে বসে থাকা উজানকে বলল, "আচ্ছা উজান,  এমন তো হতে পারে নীলাকাশ ওই ট্রেনে উঠেছিল ঠিকই,  কিন্তু কোনও  কারণবশত মাঝরাস্তায় কোনও এক স্টেশনে নেমে গিয়েছিল। তারপর পথ হারিয়ে ফেলেছিল।  আমরা যাকে নীলাকাশের দেহ  বলে শনাক্ত করেছিলাম, সৎকার করেছিলাম,  সেটা  নীলকাশ ছিল না,  ছিল অন্য কারও  দেহ।   নীলাকাশ হয়তো  কিছুদিন পর  পথ চিনে--চিনে বাড়ি ফিরে  এসেছিল,  আমাকে  তোমার   সাথে নতুন  করে সংসার  করতে দেখে আমার সাথে আর দেখা করেনি।"  
     উজান বলল, "কী  বলব?  আমিও  ঠিক বুঝতে পারছি না।"  আবারও  কথামঞ্জরি টেবিলে --ঢেকে--- রাখা এক গ্লাস  ঢকঢক করে খেল।  কথামঞ্জরি উজানকে  বলল, " উজান, এটাও তো হতে পারে যে,  ট্রেন--দুর্ঘটনায়  নীলকাশের মাথায় লেগেছিল,  স্মৃতি লোপ পেয়েছিল,  এখন সুস্থ হয়ে  সব  কথা মনে পড়েছে।  এখন  বাড়িতে আসতে চাইছে।"  পরক্ষণে কথামঞ্জরির  মনে দ্বিধা  জন্ম নিল। নিজে-- নিজে  বলে উঠল, "কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব! আমি তো নীলকাশের স্ত্রী ছিলাম।  কোনও  স্ত্রী  তার  স্বামীর দেহ  চিনতে ভুল করতে পারে না। কখনই না। তাছাড়া নীলকাশের শরীরে যে জামা --প্যান্ট পাওয়া গিয়েছিল বলে পুলিশ দেখিয়েছিল,  সেই জামা-- প্যান্ট পরেই তো  নীলকাশ ট্রেনে  উঠেছিল। আমি তাকে স্টেশনে ট্রেনে উঠিয়ে  দিয়েছিলাম। তাহলে নীলাকাশ বেঁচে থাকতে পারে কীভাবে! এটা তো অসম্ভব!"

চার
     কথামঞ্জরি উজানকে দুশ্চিন্তায় না ফেলার জন্য   উজানকে না জানিয়ে একা   লুকিয়ে--লুকিয়ে  টাঙ্গন নদীর ধারে টাঙ্গন ব্রিজের দক্ষিণ দিকে    ফাঁকা  মাঠের মধ্যে ইটের তৈরি ভাঙা  ঘরের কাছে পৌঁছল।  ঘরের দরজা জানলা কিছুই নেই।  দূর থেকে কথামঞ্জরি  দেখতে পেল,  ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটা দশ --এগারো  বছরের সুন্দর ফর্সা ছেলে।  পিঠে একটা স্কুল --ব্যাগ। সাথে একজন বয়স্ক লোক।    কথামঞ্জরিকে দেখেই  বয়স্ক  লোকটি  ঘরের পেছনে চলে গেল।   ছোট্ট ছেলেটি দৌড়ে কথামঞ্জরির কাছে এল।  কথামঞ্জরির  দু'হাত ধরে নিয়ে গিয়ে কথামঞ্জরিকে ঘরের সামনে থাকা বড় পাথরের টুকরোর ওপর বসাল।   কথামঞ্জরির  সামনে বসে  ছোট ছেলেটি   বলল, "কথামঞ্জরি, আমি নীলাকাশ।"   কথামঞ্জরি অবাক হয়ে বাচ্চা ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।  ছেলেটি আবার বলল, " কথামঞ্জরি, আমি তোমার বর নীলাকাশ।"  আরও  অবাক হয়ে গেল  কথামঞ্জরি।    ছেলেটি আবার বলল, "কথামঞ্জরি,  আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?  আমি নীলাকাশ।  তোমার  নীলাকাশ।"  ঘরের পেছন থেকে  লোকটি বেরিয়ে এল। কথামঞ্জরিরকে  বলল, "ও আমার ছেলে। নাম--'আরণ্যক'।  আমার একমাত্র  ছেলে। পড়াশোনা করে।  আরণ্যক আগের জন্মের কথা বলতে পারে। ওর  কথা অনুযায়ী,  পূর্বজন্মে ওর নাম ছিল নীলাকাশ। ওর স্ত্রীর নাম ছিল কথামঞ্জরি। সেই কথামঞ্জরি  হচ্ছেন --আপনিই।"  কথামঞ্জরির  মুখের কথা হারিয়ে গেল। শুধু  আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল  ছেলেটির  মুখের  দিকে।  কথামঞ্জরি খেয়াল করেছে, আরণ্যক বয়সে ছোট।  তাই তার  কন্ঠস্বর সরু। কিন্তু তার বাচন ভঙ্গি, কথা বলার ধরন  বড়দের মতো।   লোকটি আবার বলল, " আরণ্যকের  জন্মের পর ওর কোনও  অপারেশন হয়নি।  অথচ ওর ডান হাতে তিনটি  অস্পষ্ট  সেলাইয়ের  দাগ।   তেল মাখলে দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়।  আরণ্যকের  বক্তব্য অনুসারে, এটা ওর আগের জন্মের  অপারেশনের দাগ।  লোকটি  আরণ্যকের   জামা খুলে হাতের  দাগগুলো দেখাল। লোকটি আবার ঘরের পেছনে চলে গেল। 
     কথামঞ্জরির   চোখের সামনে  ভেসে উঠল,  নীলাকাশের  ডান হাতের  সেলাইয়ের তিনটি  দাগ।  সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ছোট্ট  আরণ্যকের  দিকে। কথামঞ্জরি বোবা  হয়ে গেল। ভাষাহীন।  মুখের ভাষা হারিয়ে গেল।  শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরণ্যকের দিকে।
     আরণ্যক  কথামঞ্জরির  কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। কানে--কানে কী যেন বলতে লাগল। কথামঞ্জরির  চেহারায়  একটা সতেজ ভাব   চলে এল।  চিকচিক করে উঠল চোখ। উজ্জ্বল হয়ে উঠল সারা মুখ।   আলো  যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল তার মুখমন্ডল দিয়ে।  চকচক করতে লাগল তার গাল।  আরণ্যক  হাঁটু গেড়ে কথামঞ্জরির  সামনে বসল। পিঠ থেকে স্কুল ব্যাগটি নামাল। ব্যাগের  ভেতর থেকে কাগজে মোড়া একটা কিছু বের করল।  কাগজটি খুলল। কথামঞ্জরির  সামনে মেলে ধরল।  কথামঞ্জরি দেখতে পেল,  আরণ্যকের  হাতে  খুব সুন্দর একটি বাগান --ছাপা--  হলুদ শাড়ি। আরণ্যক শাড়িটি  এগিয়ে দিয়ে বলল, "কথামঞ্জরি,   তুমি আমার কাছে  একটা ভালো  বাগান-- ছাপানো -- হলুদ শাড়ি আবদার করেছিলে।  আমি তোমার জন্য   সুন্দর একটা  বাগান--ছাপ--হলুদ শাড়ি এনেছি।"  
     ঘরটির একটু দূরে  একটি   পাকুড় গাছে  পাখিরা সুমিষ্ট সুরে গান গাইতে লাগল। ডালে--ডালে নাচতে লাগল তারা।  টাঙ্গন নদীর জলে ঢেউ খেলতে লাগল।  আকাশের মেঘে তবলা--ডুগির ছবি ফুটে উঠল।  দূরে কোথাও ডেকে উঠল  'বউ কথা কও'  পাখি।
     কথামঞ্জরি বোবা  হয়ে গেল। নিশ্চুপ।  ভাষা হারিয়ে গেল তার।   আরণ্যক বলল, "কথামঞ্জরি, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আগে যেমন ভালোবাসতাম, এখনও তেমন ভালোবাসি, ভবিষ্যতেও তেমনই ভালোবাসব।"     আরণ্যক শাড়িটি কথামঞ্জরির হাতে   সযত্নে তুলে দিল। কথামঞ্জরি  কিছু বলতে পারল না।  শুধু অবাক চোখে  এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরণ্যকের দিকে।  আরণ্যকের চোখ, চোখের পাতা, ভুরু, কপাল , চিবুক, গাল,   সূক্ষ্মরুপে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে  লাগল।  কান, নাক,  আঙুল, ঠোঁট, চুল, হাত, পা, উচ্চতা  নিখুঁত ভাবে  খুঁটিয়ে -- খুঁটিয়ে  দেখতে লাগল।   যেন আরণ্যকের চেহারা  তার দেহের মধ্যে এঁকে নিচ্ছিল। 

পাঁচ
     কথামঞ্জরির মনে  পড়ল,  বিয়ের পর সে আর নীলাকাশ দু'জনে মিলে মালদা ওয়াটার-- পার্কে গিয়েছিল।  কথামঞ্জরি  ভালো একটা  চুড়িদার কিনতে চেয়েছিল।  নীলাকাশ বলেছিল, "মালদা শহরে ভালো চুড়িদার পাওয়া যাবে।"  মালদায়  কেনা  চুড়িদারটি  কথামঞ্জরির খুব পছন্দ হয়েছিল।   সেই চুড়িদার পরেই কথামঞ্জরি ওয়াটার --পার্কে গিয়েছিল। পার্কের ভেতর জলে নামার জন্য জামা --প্যান্ট ভাড়া পাওয়া যায়।  নীলকাশ  একটা হাফপ্যান্ট ও একটি গেঞ্জি ভাড়া নিয়েছিল।  কথামঞ্জরি  চুড়িদার পরে  জলে নেমেছিল। বাজনার তালে --তালে জলের মধ্যে দু'জন খুব সাঁতার কেটেছিল। একটি ঘরে  মধ্যে ওপর  থেকে বৃষ্টির মতো  জল ঝরছিল  আর বাজনা  বাজছিল।   বাজনার তালে-- তালে কৃত্রিম বৃষ্টির সাথে  দু'জনে  খুব ডিসকো-- নাচ নেচেছিল।  নিরাপত্তারক্ষীরা  তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল, যাতে কোথাও কোনও  অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।  নিরাপত্তারক্ষী বাঁশি বাজিয়ে জানিয়েছিল, "সকলে জল থেকে উঠে পড়ুন। সময় শেষ  হয়ে গেছে।"  কথামঞ্জরি ও নীলকাশ  পোশাক পরিবর্তন করে বুকভরা আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।   নীলাকাশ যে ডিসকো --নাচ নাচতে পারে , কথামঞ্জরি সেদিন প্রথম জানতে পেরেছিল। 
     আরণ্যক কথামঞ্জরির দিকে এক নজরে  তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। যেন কথামঞ্জরির  রুপকে ওর  দু'চোখে আটক করছিল, বন্দি করে নিচ্ছিল। কথামঞ্জরিকে বলল, "কথামঞ্জরি, আমি তোমাকে আর কোনওদিন বিরক্ত করব না, জ্বালাতন করব না।  তোমার সঙ্গে  কখনও দেখা করব না, আর কোনওদিন তোমার সাথে যোগাযোগ করব না। তুমি স্বামী সংসার নিয়ে ভালো থেকো, সুখে থেকো। 

পরিশিষ্ট 
     আরণ্যকের  বাবা ঘরের পেছন থেকে সামনে থেকে বেরিয়ে এল।  বলল, "আরণ্যক,  অনেকটা সময় হল।  বাড়িতে তোমার মা অপেক্ষা করছে। তোমার মা  তোমাকে নিয়ে  আবার দুশ্চিন্তা শুরু  করবে।"  আরণ্যকের বাবা সামনে অনেকটা এগিয়ে গেল। এমন দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল, যাতে করে আরণ্যক ও কথামঞ্জরির কোনও কথা যেন তার কানে না আসে।     আরণ্যক  কথামঞ্জরিকে বলল, "কথামঞ্জরি,  আমি কোথায় থাকি, কোথায় আমার বাড়ি, কী আমার  ঠিকানা তা আমি তোমাকে জানাতে পারছি না।   তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে, শরীরের প্রতি যত্ন নেবে।"   
     বাবা  এসে  আরণ্যকের  হাত ধরল।  বাবার হাত ধরে আরণ্যক  বাড়ি ফিরে চলল।  পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে  টাঙ্গন নদী। আরণ্যকের  মনটা  খারাপ।  চুপচাপ হয়ে গেছে একদম।  কথা বলছে  না  আর।  কথামঞ্জরি  উঠে দাঁড়াল।  হলুদ--শাড়িটি তার হাতে ধরা।  আরণ্যক যাচ্ছিল আর পেছনে ফিরে--ফিরে কথামঞ্জরিকে  দেখছিল। কথামঞ্জরি দেখছিল  আরণ্যককে।  বাবার হাত ধরে হাঁটতে --হাঁটতে আরণ্যক অনেক দূর চলে গেল। 
     কথামঞ্জরির ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
     হাহাকার করতে লাগল তার মনের ভেতর।  অস্থিরতা দেখা দিল তার দেহের মধ্যে।
     ওরা  দু'জন  আরও দূরে চলে গেল।  আরও আবছা হয়ে  গেল।   আবছা হতে --হতে   দৃষ্টির বাইরে চলে গেল ওরা।
     টনটন করে ব্যথা  করে উঠল  কথামঞ্জরির শরীরের  মধ্যটা। বুকের ভেতরে একরাশ  শূণ্যতা।  শুধু শূণ্যতা আর শূণ্যতা।
     কথামঞ্জরি  ওদের--  হারিয়ে-- যাওয়া  পথের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল।  একসময় ওদের নিখোঁজ-- হয়ে --যাওয়া-- পথের শেষ মাথায়  বাতাসের মধ্যে   অস্পষ্টভাবে   নীলাকাশের ছায়ামূর্তিকে দেখতে  পেল। কথামঞ্জরি অস্ফুট স্বরে  হাওয়ার ছায়ামূর্তিকে   বলে উঠল, "নীলাকাশ, আয়োজন তোমার ছেলে,  তোমার সন্তান।"

গোলোকেশ্বর  সরকার 
দক্ষিণ  দিনাজপুর, 
পশ্চিমবঙ্গ,  ভারত