অটোয়া, রবিবার ৫ মে, ২০২৪
“নীড়ের সন্ধানে” জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টির প্রথম উপন্যাস

“নীড়ের সন্ধানে” জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টির প্রথম উপন্যাস
    -ইকবাল কবীর রনজু

য়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ালেখা করছেন লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টি। ২০০৫ সালে পাবনায় জন্ম গ্রহন করা এ লেখিকা পড়া লেখার পাশাপাশি করেছেন সাহিত্য চর্চা। ২০২২ সালে কিশোরী লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টির প্রথম উপন্যাস “নীড়ের সন্ধানে” প্রকাশিত হয়। বাইটি প্রকাশ করেছে ইনভেন্ট পাবলিকেশন, ১২০ মুক্ত বাংলা শপিং কমপ্লেক্স-ঢাকা। প্রচ্ছদ করেছেন প্রকৌশলী নাইমুল হাসান। ১৭৪ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য ৩১০ টাকা।  ২০২২ সালে ঢাকায় বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশের বই মেলায় “নীড়ের সন্ধানে” উপন্যাসটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

“নীড়ের সন্ধানে” উপন্যাসটির পান্ডুলিপি পড়ে অভিমত লিখতে গিয়ে সামরিক চিকিৎসা সার্ভিস মহাপরিদপ্তরের সাবেক মহা পরিচালক মেজর জেনারেল (অবঃ) ড.মোঃ ফসিউর রহমান লিখেছেন- প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীন, স্বতন্ত্র। বেড়ে ওঠার পথ পরিক্রমায় অর্জিত নতুন অভিজ্ঞতা আমাদের সমৃদ্ধ করে। সাহিত্যে কল্পনা ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ গতানুগতিক হলেও সাহিত্য রচনা মোটেও সহজসাধ্য নয়। ইতিবাচক কল্পনাপ্রবণ মনের সুপ্ত যে ইচ্ছা সাহিত্যে প্রকাশ পায় সে সাহিত্য, মনোচিন্তা রচয়িতাকে এক ধাপ এগিয়ে নেয় পূর্ণতার পথে। “নীড়ের সন্ধানে” উপন্যাসটি এমনই এক রচনা।

ষোলো বছর, এ আর এমন কি বয়স। এ বয়সে দেখা বা জানার গভীরতা খুব বেশি না হলেও এগারো বছর বয়স থেকে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে পরিবার থেকে পৃথক থাকায় এ উপন্যাসের লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টি পরিবারের গুরত্ব, পরিবার বঞ্চিত অনাথ, এতিম, পথশিশুদের দুঃখ বেদনার যে সামান্যটুকু দেখেছে তার সাথে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে কাঁচা হাতে “নীড়ের সন্ধানে” উপন্যাসটি লিখেছে।

উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র অনাথ শিশু কবির ও খালিদ বি.কে.সি হোমস নামক একটি আশ্রমে বেড়ে ওঠে। অন্য চরিত্রগুলোকেও ছোট করে দেখার উপায় নেই। কাহিনীর বর্ণনায় বার বার এসেছে বি.কে.সি হোমসের কথা। বিকাশ আঙ্কেলের তত্ত্বাবধানে আশ্রমে বড় হয়েছে উপন্যাসটির অন্যতম চরিত্র কবির, সাজিদ, রফিক, খালিদ। চরিত্রগুলো প্রাণবন্ত হয়েছে লেখিকার বর্ণনায়। খালিদের মতো ভাল বন্ধুর সাহচর্যে কিভাবে হতাশাবাদী কিশোর কবির আশাবাদী হতে শেখে, স্বপ্ন দেখতে শেখে, নিজস্ব গণ্ডির বাইরে বেরোতে পারে তার নিখাদ বর্ণনা এ উপন্যাসের সাহিত্য মূল্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বিকাশ আঙ্কেলের মতো খালিদ আর কবিরও নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবেনি এ উপন্যাসে। হোমস থেকে মাধ্যমিক ও কলেজের পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নতুন বন্ধুদের সাহচর্যে এলেও শিকড়কে ভোলেনি তারা। নৈতিকতার প্রশ্নে অটল থেকে বিপথগামীদের ভুল শুধরে দেবার চেষ্টা করেছে সাহসিকতার সাথে। 

মকসুদ সাহেবের পরিবারে যুক্ত হয়ে ফের পরিবারের সুখ সান্নিধ্য পায় খালিদ ও কবির। এ পরিবারে আপনজন হয়ে উঠতে সময় লাগেনি তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু জয়, শান্ত, অবিন, রাসেলকে সাথে নিয়ে বিভিন্নভাবে মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করে তারা। জার্নালিজমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ তাদের। প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে বাঁধাপ্রাপ্ত হলেও ঝুঁকি নিয়ে, কৌশলে বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়েছে সামনে। 

হোমসটাকেই তাদের শিকড় মনে হয়। এই নীড় কে তাজা রাখতে কবির ও খালিদ যেকোনো ত্যাগ ন্বীকারে প্রস্তুত। হোমসে বাচ্চার সংখ্যা বাড়লে নতুন শাখা খোলা হয়। বিকাশ আঙ্কেলের মৃত্যুর পর  অশ্রমের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় তারা; যেখানে শিকড়ের সন্ধানে বার বার ফিরে আসে অনাথ, এতিম, সুবিধা বঞ্চিতরা।

সৌভাগ্যক্রমে পিতা হিসেবে কন্যার গ্রন্থ সমালোচনা লিখতে বসেছি। তাই পক্ষপাত দোষে যেন দুষ্ট না হই সেটি মাথায় রেখে এক কিশোরীর লেখিকা হয়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও উপন্যাসটির সমালোচনা লিখছি।

করোনা কালীন সময়ে ক্যাডেট কলেজ ছুটি থাকায় প্রায় বছর খানেক গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন কিশোরী লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টি। অবসর সময় গুলো কাজে লাগিয়ে পান্ডুলিপিটি তৈরী করে একদিন আমার হাতে দিয়ে যখন বলে, “বাবা দেখতো কিছু হলো নাকি, একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছি” তখন আমি বিশাল পান্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে বিস্মিত হই। পরম মমতায় একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে পান্ডুলিপিটির। অফিসে গিয়ে ফের দেখি। নিজে লেখা লেখির সাথে যুক্ত থাকায় বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেই। জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টির মা ফিরোজা পারভীনও একজন লেখিকা। তিনটি একক কাব্য গ্রন্থ রয়েছে তার। তার সহায়তায় আলোর মুখ দেখে উপন্যাসটি।

উপন্যাসটির চমৎকার প্রচ্ছদ যেমন সবাইকে আকৃষ্ট করবে তেমনি ভাবে কাহিনীর পূর্বাপর ঘটনাবলী একজন পাঠককে শেষ পর্যন্ত পড়তে আকাঙ্খা বোধ জাগাবে। উপন্যাসটির পরতে পরতে যেন বাঁক। প্রতিবন্ধকতা। এসকল প্রতিবন্ধকতা ডিঙাতে মেধা, মননশীলতার পরিচয় দিয়েছে লেখিকা। হোমসের জীবন, ক্যাম্পাসের জীবন, কর্মক্ষেত্রের জীবন আলাদা আলাদা হলেও সব কিছু যেন এক সুতোয় গেঁথেছে সমগ্র উপন্যাসে। ধৈর্য্য, সাহস, একাগ্রতা প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিতে কিভাবে সহায়ক হয়ে ওঠে সেটি দেখানোর চেষ্টা করেছেন লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টি। অনৈতিকতা প্রশ্রয় পায়নি উপন্যাসটির কোথাও। বরং যেখানে অনৈতিকতা সেখান থেকে কিভাবে বেড় হওয়া যায় তার পথ নির্দেশ করার চেষ্টা রয়েছে এ উপন্যাসে।

এ উপন্যাসে লেখিকা বার বার যে বিকেসি হোমসের কথা বলেছেন সেই বিকেসি হোমসে যে সকল অনাথ শিশু বড় হয়েছেন, প্রতিতিষ্ঠিত হয়েছেন তাদের অনেকেই মনে রেখেছে হোমসকে। অনেকে যেমন শিকড় ভুলে যান তেমনি ভুলে গেছেন এ হোমসটার কথাও। উপন্যাসের শেষ দিকে এসে যখন হোমসের ৫০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হচ্ছিল তখন এ উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন হোমসে বড় হওয়া অনেকেই। বিকাশ আঙ্কেলের অভাব পূরণে উপন্যাসটির অন্যতম চরিত্র কবির হোমসের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে কেউ একজন কবিরকে প্রশ্ন করে বসে, “এই হোমসে কাজ করতে গিয়ে আপনাদের নিজস্ব স্বপ্নে কি কোন ব্যাঘাত ঘটছে ?” কবিরের সোজা উত্তর-“স্বপ্ন সবাই দেখে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু স্বপ্ন থাকে। আমাদের ও ছিল। অল্প বয়সে আমরা যখন পরিবারকে হারিয়েছিলাম তখন বিকাশ আঙ্কেল আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ছোট বেলা থেকে আমি এই হোমসে বড় হয়েছি। বিকাশ আঙ্কেল, খালিদ, রফিক, সাজিদ, হোমসের বাঁকিদের সহচর্যে বেড়ে উঠেছি আমি। এখানে প্রতিটা পদক্ষেপে আমি কারো না কারো সাহায্য পেয়েছি। এখানেই শিখেছি কিভাবে মানুষকে সাহায্য করতে হয়। তাই আমার লক্ষ্য ছিল মানুষকে সাহায্য করা। কখনো যদি কারো উপকার করতে পারি তাহলে মনের ভিতরে এক অদ্ভুদ শান্তি পাই।

লেখিকার মতে, সব সময় ক্যারিয়ারের পেছনে না ছুটে আমাদের উচিত মাঝে মাঝে ছোট বেলায় ফিরে যাওয়া। আমাদের ভাল লাগা গুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। শিকড়কে তো তাজা রাখতেই হবে। তবেই আমাদের প্রতিটা ক্ষণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। যেখান থেকে জীবনের নামতা শুরু সেখানে তো ফিরে আসতেই হবে। 
কাঁচা হাতে প্রথম লেখা উপন্যাস “নীরের সন্ধানে” পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। কিছু ভুল ত্রুটি থাকলেও পাঠক সাধুবাদ জানিয়েছেন কিশোরী লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টিকে।

ইকবাল কবীর রনজু
চাটমোহর, পাবনা, বাংলাদেশ