অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
বেড়াল কাহিনী - জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

     রুদ্রদেববাবু কড়া ধাঁচের মানুষ। চাঁচাছোলা ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করেন বলে লোকে ওনাকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। ফ্ল্যাটের অন্যান্য লোকেরা আড়ালে বলে- জিভ তো নয় যেন লঙ্কা। একশটি ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্সের উনি একনাগাড়ে চার বছর ধরে প্রেসিডেন্ট। সৎ, বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে সবাই ওনাকে চেনেন। সরস্বতী পুজো, দুর্গা পুজো বা কোনো অনুষ্ঠানে কোথায়,কখন কি কি হবে সেটায় ওনার কথাই শেষ কথা। পাঁচজনের কাজে উনি নিজের পকেটের পয়সাও খরচ করতেও কার্পণ্য করেন না। আসলে উনি এই ফ্লাট কমপ্লেক্স অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন। ওনার স্ত্রী রত্না আবার আড়ালে মেয়েমহলে ফুট কাটেন যে ওনার কর্তা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। তবে রুদ্রদেববাবু এসব কথা খুব একটা গায়ে মাখেন না।
     সেবার বর্ষার শেষে ফ্ল্যাটের জনা পাঁচেক মেম্বার রুদ্রদেববাবুর কাছে কমপ্লেন জানালেন যে ফ্ল্যাটের নীচে,সিঁড়িতে সবত্র বেড়ালেরা সব ময়লা ছড়াচ্ছে। যত্র তত্র মল মূত্র ত্যাগ করেছে। এঁটোকাটা এদিক ওদিক থেকে নিয়ে আসছে। রাত্রে বিভিন্ন ফ্ল্যাটের সামনে রাখা পাপসে গুটিয়ে শুয়ে থাকছে। পাঁচতলার রবি রাস্তগি আবার বললেন গতকাল রাত্রে লিফট করে নীচে নেমে পা ফেলতেই শুয়ে থাকা এক কালো বেড়ালের লেজে  পা মাড়িয়ে ফেলেছেন। বেটা ঘাপটি মেরে রাতদুপুরে লিফটের সামনে শুয়ে ছিল। রাস্তগিবাবুর ভারী পায়ের চাপ পড়তেই ফাঁশ ফাঁশ করে লাফিয়ে উঠে সেই বেড়াল নাকি পায়ে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে। ওনার ডাক্তার আবার বলেছেন,ওই বেড়ালের যদি ভ্যাকসিন না নেওয়া থাকে,তবে রাস্তগিবাবুকেই পাঁচটা ইনজেকশন নিতে হবে।
     অনেক তর্ক-বিতর্ক,আলোচনার পর যে ছবিটা উঠে এলো যে তিনতলার চম্পাবৌদি আর সাততলার আলীসাহেবের বাড়ির ঝি টুম্পা নাকি বেড়ালদের সিঁড়ির নীচে আর মাঝে মাঝে নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে রোজ খেতে দেয়। রাস্তগি বাবুর হিসেবমতো আগে একটা বেড়াল ছিল, এখন গত দুমাস চারটে বেড়াল রোজ নিঝুম দুপুরে সিঁড়ির নীচে খেতে আসে।
     চারটে মিনি বেড়ালের টানে আজকাল একটা হুলো এসেও নাকি জুটেছে। রাস্তগিবাবুর নজরে এসেছে একটা মিনির পেটটা কেমন ফোলা ফোলা লাগছে।
" ইবার বিরালের বাচ্ছা হইলে হামাদের ফ্লাট ছোড়কর যেতে হবে।" উনি লোককে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। সবে গতরাত্রে বেড়ালের আঁচড়-কামড় খেয়েছেন আর আজ পেটফোলা মিনিবেড়াল দেখেছেন। উনি তেলেবেগুনে জ্বলে আছেন।বিশ্বাসবাবু, শর্মাজী, চাটার্জিকাকু, খন্দকারবাবু, ইন্দিরামাসীমা সবাই রাস্তগিবাবুকে সাপোর্ট করে রুদ্রদেববাবুকে এর একটা বিহিত করতে বললেন।
     রবিবার জিবি মিটিং ডাকা হলো। গোটা সত্তর লোকজনের উপস্থিতিতে বেশ কয়েকজন নিজের বক্তব্য পেশ করার পর রুদ্রদেববাবু জ্বালাময়ী ভাষণের সুরে বিড়াল খাওয়ানোর চরম নিন্দা করে মেম্বারদের থেকে  থেকে পসিটিভ পরামর্শের আহ্বান করলেন।
     গেটের দারোয়ানের কাছে লাঠি রাখতে বলা হলো। বিশ্বাসবাবু আবার একটা কুকুরপোষার পরামর্শ দিলেন। সিঁড়ির নীচে চুপিসাড়ে বেড়াল খাওয়ানোর জন্য চম্পাবৌদি আর টুম্পাকে সতর্ক করা হলো। এরপর নিজের ফ্ল্যাটে চারটি বিদেশি কুকুর রাখা শর্মিলাবৌদি বললেন,
" অবলা জীবদের তাহলে খাওয়ানোর কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গা আর সময় ঠিক করে দেওয়া হোক। কারণ বিড়ালকে খাওয়ানো যাবেনা এমন তুখলকি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। লোকে কোর্টে চলে যেতে পারে।"
     একজন প্রস্তাব দিলেন," বিড়ালপ্রেমীরা ফ্লাট কমপ্লেক্সের বাইরে খাবার দিতে পারেন। ভিতরে কোনো মতেই বেড়ালকে খাওয়ানো চলবে না।"
     রুদ্রদেববাবু সংখ্যাগরিষ্ঠের বক্তব্যকে সমর্থন করে মিনিট বুকে লিখে রাখলেন -ফ্ল্যাটের বাইরে বেড়াল খাওয়ানো যেতে পারে, কিন্তু ভিতরে কোনো মতেই নয়।
     সবার সই হলো। রুদ্রদেববাবু সবার শেষে সই করে আইন জারি করে দিলেন।
     সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। পুজোর ছুটিতে ওনার একমাত্র মেয়ে বিপাশা হায়দরাবাদ থেকে কলকাতায় এক সপ্তাহের চাকরিতে ছুটি নিয়ে হাজির হলো। গাড়িটা এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে ল্যাপটপে ম্যাটরিমনি ডট কমে বিপাশার পাত্রের সন্ধান করছিলেন। জানালা দিয়ে দেখা গেল বিপাশা বড়ো একটা সুটকেস আর একটা পিচবোর্ডের বাক্স নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। সুটকেশটা ড্রাইভার কাকুর হাতে ধরিয়ে পিচবোর্ডের বাক্সটা নিয়ে লিফট দিয়ে বেশ একটু দেরিতে ওপরে উঠে এলো। মেয়ের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে রুদ্রদেববাবু বাজারে বেরোলেন।
     তিনদিন ধরেই রুদ্রদেববাবু লক্ষ্য করছেন বিপাশা দুপুরে আর রাত্রে প্যাকেটে কি সব নিয়ে ছাদে যাচ্ছে। এই সব মাল্টিপ্লেক্সে ছাদে মিস্ত্রি ছাড়া কেউ একটা সচরাচর ওঠে না। মেয়ে হায়দরাবাদে গিয়ে বিড়ি-সিগারেট খাওয়া ধরেছে বলেও তো মনে হচ্ছে না যে বাবা মাকে লুকিয়ে দুপুরে আর রাত্রে ছাদে গিয়ে সুখটান দিয়ে আসছে। তাহলে তো গন্ধ পাওয়া যেতো।কোনো প্রেমিককে নির্জনে ফোন করতে ছাদে যেতে পারে তবে উনি লক্ষ্য করেছেন যে বিপাশা ছাদে উঠলে ফোন কিন্তু বাড়িতেই থাকছে। রুদ্রদেববাবু ওনার স্ত্রীকে সন্দেহটা বললেন। এই দিনে দুবার মেয়ের ছাদে যাওয়াটাকে যে উনি ভালো চোখে নিচ্ছেন না সেটাও সরাসরি স্ত্রীকে বললেন। মা যদি মেয়েকে একথা না জানায় তবে উনি নিজেই মেয়েকে ওনার আপত্তির কথাটা বলবেন এটা মনে মনে ভেবে রাখলেন।
     দশমীর সন্ধ্যায় বিজয়া সম্মেলনীতে হটাৎ কথাটা  কানে এলো রুদ্রদেববাবুর। এত লোকের ভিড়েও উনি ঠিক শুনলেন দুজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন যে  রুল বানিয়ে প্রেসিডেন্ট নিজেই রুল ভাঙছেন। ওনার ভীষণ রাগ হয়ে গেল।এমন শুভদিনে ওনার পিছনে কিছুলোক ওনার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সমালোচনা করার মতো  কোনো কাজ উনি করেছেন বলে স্মরণ করতে পারলেন না। পিছন ফিরে ওনাদের সাথে ঝগড়া করতেও মন চাইলো না। উনি গুম হয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এলেন। স্ত্রী আর মেয়ে নীচে আনন্দ করতে লাগলো।
     সেই যে সন্ধ্যাবেলায় রুদ্রদেববাবুর মাথা ধরলো, সেটা টাইগার বামে, ক্রোসিনে কিছুতে সারলো না। উনি স্নান করে একটু ধ্যান করতে বসতেই ডোর বেলের আওয়াজ। গল্পগুজব করে স্ত্রী আর মেয়ে কলকাকলি করে  ফিরছে। ওনার আবার রাগটা চাগিয়ে উঠলো। উনি মরছেন মাথার ব্যথায় আর মহারানিরা পায়রার মতো বক বকুম করতে করতে ফিরলেন। পরশু ভোরে মেয়ের হায়দরাবাদে ফেরার কথা। আজ রাত থেকেই বাক্স গোছানো শুরু হবে।
" বাবা, তুমি এতো গম্ভীর না, তোমার সাথে কথা বলতে ভয় লাগে।" বিপাশার কথায় এতো মাথা ব্যথার মধ্যেও রুদ্রদেববাবুর হাসি পেলো। উনি জানেন এরপরেই মেয়ের কিছু আবদার থাকবে। উনি অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন সেই অবদারটা আসবে।
" তোমাকে একটা খুব খুব গুরুদায়িত্ব নিতে হবে কিন্তু বাবা, এই বলে দিচ্ছি।" বিপাশা হেঁয়ালি করে।
" ঘরজামাই আনলে আমাদের সেই গুরুদায়িত্ব নিতে কোনো আপত্তি নেই।"  রুদ্রদেববাবু এতো মাথাব্যথার মধ্যেই মেয়ের সাথে ইয়ার্কি মারলেন।
" উফ বাবা।তুমি না অসহ্য।" বিপাশা রেগে উঠে বলে।
     রুদ্রদেববাবুর মাথা ধরাটা একটু একটু করে কমে আসছে। স্ত্রী এসে চা দিয়ে গেছে। আকাশে হটাৎ আলোর ঝলকানি। আর একটু পরেই গুড়গুড় করে আকাশে মেঘের গর্জন শোনা গেল। বিপাশা দৌড়ে জানলার কাছে চলে গিয়ে জানালা দিয়ে ডান হাতটা বাইরে বের করে বলে উঠলো," ইশ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই আশ্বিন মাসেই বৃষ্টি আসতে হলো?"
     রুদ্রদেববাবুর স্ত্রী টিভিটা চালিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সংবাদে প্রতিমা বিসর্জনের ছবিগুলো লাইভ দেখছিলেন। বিপাশা জানালার পাশ থেকে বেরিয়ে হনহন করে ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাতে একটা ছাতা হাতে আবার বেরিয়ে এসে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো।
" বাবা, এক্ষুনি ছাতাটা নিয়ে ছাদে চলো। কুইক, কুইক।"  আদেশের সুরে বাবাকে বলতে রুদ্রদেববাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " এই রাত্রে,বৃষ্টির মধ্যে ছাতা হাতে দশতলার ছাদে যেতে বলছিস?"
" হা। এসো, আমার পিছন পিছন এসো। মা, তুমিও আসতে পারো।"
     রুদ্রদেববাবু ছাদে উঠলেন। প্রায় মাস ছয়েক পর ছাদে এলেন। ছাদের লাইট জ্বালিয়ে দেখলেন বিপাশা ছাতাটা খুলে বিশাল ছাদের মাঝখানে জলের ট্যাংকের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। উনিও মেয়ের পিছু পিছু এগোলেন। ট্যাংকের নীচের  ফাঁকা জায়গায় কিছু আবর্জনা, কাঠের টুকরো আর ভাঙা টাইলস আছে। পিচবোর্ডের বাক্সটা দেখে উনি চিনতে পারলেন যে এটাই বিপাশার হাতে উনি ওর আসার দিনে দেখেছিলেন। উনি খুব অবাক হয়ে দেখলেন বিপাশা পরম আদরে সেই পিচবোর্ডের বাক্স থেকে দুটো কচি সাদা বেড়াল ছানা বার করে ছাদে রাখলো। বেড়ালছানা দুটো এতই ছোট যে সোজা দাঁড়াতে না পেরে বার বার মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিল। ছানাদুটো বিপাশার পায়ের সাথে সেঁটে বসলো। দুটো বেড়ালছানার মধ্যে  একটা বেড়ালছানা হাতে নিয়ে বাবার হাতে জোর করে ধরিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলে বিপাশা বলে উঠলো, " বাবা, এগুলো স্ট্রিট বেড়াল না হয়ে যদি তোমার বাড়িতে তোমার মেয়ের মতো থাকে তাহলে কি তুমি রাগ করবে?"
     উনি পিছনে তাকিয়ে দেখলেন যে ওনার স্ত্রী ওনাদের পিছু পিছু ছাদে হাজির হয়ে মিটিমিটি হাসছেন। একশো ফ্ল্যাটের প্রেসিডেন্ট রুদ্রদেববাবু কি যে বলবেন ভেবে উঠতে পারলেন না। কিন্তু এটা লক্ষ্য করলেন মাথা ব্যথাটা সম্পূর্ণ সেরে গেছে। হাতে ধরা কচি বেড়ালটার "মিউ" ডাকে রুদ্রদেববাবু বিপাশার জন্মের দিনে ফিরে গেলেন। সদ্য জন্মানো বিপাশাকে নার্স তোয়ালে মুড়িয়ে ওনার হাতে দিতেই শিশুটি "ওয়া" বলে কেঁদে উঠেছিল। ফ্ল্যাটের প্রেসিডেন্ট থেকে যেন উনি বাবায় ফিরে এলেন।
     রুদ্রদেববাবু ফ্ল্যাটের পশুপাখি রাখার আইন পরিবর্তন করার জন্য সেক্রেটারি খন্দকারবাবুকে ফোন লাগালেন।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ