অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
মিডিয়া এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন - ড. মিল্টন বিশ্বাস

জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষ্যে ২৬ অক্টোবর (২০২২) জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম ‘‘জাতিসংঘের আঙিনায় শেখ হাসিনা” শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে।সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অনুষ্ঠানের সমস্ত কাজের তদারকি আমাকে করতে হয়েছে। আর সেমিনারে প্রথম থেকে শেষ অবধি আমি উপস্থিত ছিলাম। আমাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, এমপি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তৃতা কিছু মিডিয়া ভুলভাবে উদ্ধৃত করে অসত্য সংবাদ এবং টিভি স্ক্রল প্রচার করেছে- যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ যে সমস্ত বিষয় তাঁকে উদ্ধৃত করে প্রচার করা হয়েছে তা অসত্য।আমি নিজে মন্ত্রী মহোদয়ের পাশে বসে সবটুকু কথা নিজের কানে স্পষ্টত শুনেছি। অথচ যা তিনি বলেননি তাকেই গুরুত্ব দিয়ে শিরোনাম তৈরি এবং টিভিতে স্ক্রল করে প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে আমাদের মনে।  

উল্লেখ্য,  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে চমৎকার একটি বক্তব্য প্রদান করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তাঁর কথায় ছিল অভিজ্ঞতার বয়ান। দেশপ্রেমিক সত্তার উন্মোচন এবং বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের পরিচয়ে সমৃদ্ধ।হতাশার বিষয় হলো এরপর কিছু কিছু মিডিয়া ও টেলিভিশন চ্যানেল পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রচার করে। এগুলোর মধ্যে ‘‘যুদ্ধ ছাড়া আমেরিকার অর্থনীতি চলবে না”, ‘‘ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হলে তাইওয়ানে যাবে আমেরিকা”, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধপ্রিয় দেশ, যুদ্ধ ছাড়া দেশটির অর্থনীতি সচল থাকে না”,  ‘‘যুদ্ধেই সচল থাকে যুদ্ধপ্রিয় আমেরিকার অর্থনীতি”, ‘‘যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করাই হলো যুক্তরাষ্ট্রের মূলকাজ” - এধরনের সংবাদ শিরোনাম দিয়ে এবং টিভি স্ক্রলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জনসাধারণ এবং বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে বিভ্রান্তিকর বার্তা দেওয়া হয়েছে- যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নামে তাঁকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে এধরনের বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারকারী মিডিয়া ও টিভি চ্যানেলগুলোকে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচারের জন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশসহ সঠিক সংবাদ প্রচারের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।এবং প্রতিবাদলিপিটি কয়েকটি পত্রিকায় ছাপানোও হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পরে গত ৫২ বছরে মিডিয়ার ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হলেও সাংবাদিকদের দায়িত্ববোধ ততটা উন্নত হয়নি। এজন্য পরিতাপের সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিকরা এসব নিয়ে অনেক কথা বলে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের গুরুত্ববহ ভূমিকা ছিল। কেবল চাকরি করা নয় বরং দেশ ও জাতির বিবেক হিসেবে সংবাদকর্মীরা বিবেচিত হতেন। বলা হয়ে থাকে সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা সবচেয়ে সম্মানের বিষয় ছিল। একুশ শতকে নানাকারণে সেই সম্মানের জায়গাটা দখল করেছে পুঁজিপতিরা।তবু মিডিয়া বিশ্বব্যাপী মানুষের অধিকারের কথা বলে চলেছে।

মিডিয়াকে বঙ্গবন্ধু নিজের সাধ্যের মধ্যে রেখে প্রসারিত করেন তাঁর শাসনামলে। মুক্তিসংগ্রামে ইত্তেফাক, সংবাদ প্রভৃতি পত্রিকার প্রগতিশীল ভূমিকা তিনি ভালো করেই জানতেন। এজন্য ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের সংবাদপত্রকে স্বাধীন মতপ্রকাশে সুযোগ তৈরি করে দেন।এমনকি সাংবাদিকদের জন্য কল্যাণমূলক কাজে সরকারি দৃষ্টি দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা তৈরি করেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন পাস হওয়া ‘নিউজ পেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ নামে আইনটি করা হয়েছিল তখনকার সাংবাদিক নেতাদের পরামর্শে। এর আগ পর্যন্ত সাংবাদিকদের কোনো বেতন কাঠামো ছিল না। মালিকরা সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন দিতেন না। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। এজন্য ৭৫ সালের ১৬ জুনের পর যেসব পত্রিকা বন্ধ করা হয় তিনি সেসব সাংবাদিক-কর্মচারীর বেতন নিশ্চিত করেছিলেন। তারা এক তারিখ ট্রেজারিতে গিয়ে বেতন নিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’ গণসচেতনতা তৈরিতে মিডিয়ার ভূমিকা বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃত।

এই গণসচেতনতা তৈরিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। তিনি নিজে একজন লেখক। জনপ্রিয় কলামিস্ট। তাঁর রয়েছে দশের অধিক গ্রন্থ। দেশ-বিদেশে যোগাযোগের দিক থেকেও তিনি পররাষ্ট্রনীতিকে সমুন্নত করেছেন।দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও জাতিসংঘের আঙিনায় আমাদের অধিকার আদায়ে তাঁর সদা তৎপরতা লক্ষণীয়। 

বলা হয়ে থাকে, গণমাধ্যম জনগণের মতামতকে ঠিক করে দেয়। অর্থাৎ গণমাধ্যমের এজেন্ডা পাবলিক এজেন্ডায় পরিণত হয়। সমাজে নানা ঘটনার মধ্যে কোনটি বেশি আলোচিত হবে বা গুরুত্ব পাবে গণমাধ্যমই তা নির্ধারণ করে দেয়। এর মধ্যে সহজবোধ্য ও দ্রুততম তথ্য প্রাপ্তির উৎস হিসেবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া একধাপ এগিয়ে। অতীত এবং বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যম বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা যেমন নিশ্চিত করতে হয়েছে তেমনি স্বাধীনভাবে কাজ করার যাবতীয় দিক উন্মোচিত।সুশাসন প্রতিষ্ঠার গতি আরও ত্বরান্বিত এখন। আর সুশাসন সুমন্নত অবস্থানে আছে বলেই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ভাল হবে।  

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা তৈরি হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সত্যনিষ্ঠ প্রিন্ট ও টিভি চ্যানেল এবং সামাজিক ন্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনলাইন গড়ে ওঠে। অপরদিকে ২০০৯-২০২২ সাল পর্যন্ত গণমাধ্যমে কর্পোরেট মালিকানার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হলেও তথ্য পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সাংবাদিকতায় উৎকর্ষ অর্জিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত ও সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০১ থেকে ২০০৮ অবধি সেই অগ্রগতি থমকে দাঁড়ালেও এখন পরিস্থিতি মিডিয়ার জন্য অনেক ভালো।

এই ভালো সময়ে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের ঝোঁক মারাত্মকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে দেশকে। মিডিয়া যদি মনে করে থাকে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করলে জনপ্রিয় হবে তাদের হাউজ- তাহলে বোকার বেহেশতে বসবাস করছে তারা।

গত ১৩ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে এদেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক সাফল্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন, ২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল বাংলাদেশের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ এগিয়ে ১৪৪তম হয়েছিল। অথচ ২০১৫ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম। বিএনপি-জামায়াত আমলে গণমাধ্যমের করুণ দশা সকলেরই জানা।   

অবশ্য কর্পোরেট সুবিধার কথা ভেবে গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করা শুরু করেছে। অর্থাৎ আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ সময়েও দেখা যায় বিশ্বের প্রায় ৭৭টি দেশে এখনও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হচ্ছে।বাংলাদেশে ভিন্ন চিত্র। এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রচুর। আর এই স্বাধীনতা লালন করার জন্য দরকার দায়িত্বশীল আচরণ। কারণ এখানে সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন না। বরং মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের সু সম্পর্ক রয়েছে।তারা জানেন কোন মন্ত্রী দেশপ্রেমিক, উদার ও সজ্জন।

তবে এটাও সত্য কোনো কোনো গণমাধ্যম কর্মী নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বেচ্ছাচারীর ভূমিকা পালন করেন। তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণযোগ্যতা ও অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে কেউ কেউ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে দেশদ্রোহী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আজ বিশ্বব্যাপী একথা স্বীকৃত যে, গণমাধ্যমের মাধ্যমেই নিজেদের পরিশীলিত করা যায়। এসব কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য বিকৃত করে প্রকাশ করলে তা দেশ ও জনতার ক্ষতি হিসেবে গণ্য হবে- এটা মনে রাখা দরকার মিডিয়া সংশ্লিষ্ট সবার।সাধারণ মানুষের তথ্য প্রাপ্তির অন্যতম উৎস হল গণমাধ্যম। তা যেন নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনে ব্যস্ত না থাকে। বরং দেশপ্রেমিক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কথা ও বক্তব্যকে নিজের দেশের জন্য যথার্থ বিবেচনা করে বিকৃত না করে প্রচার করতে হবে। 

ড. মিল্টন বিশ্বাস। বাংলাদেশ


(লেখক  বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)