অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
মানব-বিবর্তনের রহস্য উদ্ঘাটনে জীবাশ্ম-জেনোমিক (paleo-genomic) প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং ভান্তে পাঁবো (Svante Pääbo)’র ২০২২ সালে নোবেল বিজয় - ড. অমল রায়

ভান্তে পাঁবোর অবলুপ্ত নিয়েনডার্থাল (Neanderthal)আর ডেনিসোভান (Denisovan)মানুষের কৌলিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার এবং ২০২২ সালে শারীরতত্ত্ব/চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের গবেষণায় এক যুগান্তকারী নতুন মাইলফলক। এই আবিষ্কারের পথ সুগম করেছে কৌলিতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের জীন-ম্যাপিং (Gene mapping) বা ডি-এন-এ ক্রম-বিন্যাস (DNA Sequence)প্রযুক্তির উদ্ভাবন। আগে মানুষের ইতিহাস জানার বা নৃ-বিজ্ঞান/নৃতত্ত্ব (anthropology)-এর গবেষণার ক্ষেত্রে যে সকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো তা হলো প্রত্নতত্ত্ব (archaeology - (পুরাতন বস্তুগত নিদর্শন, যেমন প্রাচীন জীবের ধ্বংসাবশেষ বা তাঁদের ব্যবহৃত হাতিয়ার বা অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে অতীত পুনঃনির্মাণ) এবং জীবাশ্মবিজ্ঞান (paleontology) - (জীবাশ্ম পরীক্ষার-নিরীক্ষার মাধ্যমে জীবনের ইতিহাস নির্ধারণ করা)। কিন্তু ভান্তে নৃতত্ত্ব গবেষণার ক্ষেত্রে যে প্রযুক্তি বা বিদ্যা ব্যবহার করেছেন তা হলো প্রত্নতত্ত্ব এবং কৌলিতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের সংমিশ্রনে উদ্ভাবিত এক বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে এক জীবের কৌলিতাত্ত্বিক/ডি এন এ (DNA) গড়নের সাথে অন্য জীবের গড়নের তুলনামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোন জীবের অতীত ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্য নির্ণয়)। বিজ্ঞানের নতুন এই শাখার নাম জীবাশ্ম-কৌলিতত্ব (paleogenetics/paleogenomic)এবং সেই বিবেচনায় ভান্তে পাঁবো একজন জীবাশ্ম-কৌলিতত্ববিদ (paleogeneticist/paleogenomicist)। আজ থেকে মাত্র ত্রিশ  হাজার (৩০,০০০)  বৎসর আগে এই পৃথিবীর বর্তমান মানবগোষ্ঠী হোমো সাপিয়েন্স (Homo sapiens)-এর নিকটতম আত্মীয় বা জ্ঞাতি নিয়েনডার্থাল মানুষ (Homo neanderthalensis) এবং ডেনিসোভান মানুষ (Denisovans/Homo denisova) কেন এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলো, আর আজকের আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) কেন এখনো টিকে রইলো এই রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে ভান্তের এই আবিষ্কার এক নতুন পথের দিক নির্দেশনা দিলো। আর তাই ভান্তে পাঁবোকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের স্বীকৃতি যথার্থ বলেই অনস্বীকার্য।
Svante Pääbo

দীর্ঘকাল ধরে ক্রম-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে বর্তমানের আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হয়েছে সে সত্য আজ থেকে ১৬৩ বৎসর পূর্বে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে চার্লস ডারউইনের “The Origin of Species” গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারলেও মানুষ তাঁর অজানাকে জানার সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই সে আরো বিশদভাবে জানতে চায় কেন-কিভাবে-কখন সে তাঁর আদিম মানুষের রূপ থেকে বর্তমানের আধুনিক মানুষের রূপে আবির্ভূত হলো। ভান্তের এই গবেষণা/আবিষ্কার এই সত্যকে জানার পথে এক বিশাল অগ্রগতি এবং এই অগ্রগতির বিষয়ে একটু সহজ করে বলার জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

এই প্রজন্মের প্রায় সকল শিক্ষিত মানুষেরই এই পৃথিবীর জীবদেহের মৌলিক কৌলিতাত্ত্বিক উপাদান জীন (Gene), যার মাধ্যমে বংশানুক্রমিক ভাবে এক জীবদেহের বৈশিষ্ট্য অন্য জীবদেহে স্থানান্তরিত হয়, সেই সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা আছে বলেই আমার বিশ্বাস । এই জীন আসলে যে রাসায়নিক উপাদানে তৈরী তার নাম হলো ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (Deoxyribonucleic acid) যাকে সংক্ষেপে বলে ডি এন এ (DNA)। এই ডি এন এ উপাদান অনেক লম্বা থাকে এবং এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এক একটি অংশের নামই হলো জীন (Gene)।এই ডি এন এ-র আকৃতি মইয়ের মতো। এই মইয়ের দুই-পাশটি তৈরী হয় ফসফরাস যৌগ (phosphate) এবং এক ধরণের চিনি (যার নাম ডিঅক্সি-রাইবোস - deoxy-ribose) দ্বারা আর এর ধাপ গুলি তৈরী হয় চারটি নাইট্রোজেন-সমৃদ্ধ বেইস (base) দ্বারা যাদের নাম হলো – এডিনাইন (adenine), থায়মিন (thymine), সাইটোসিন (cytosine) এবং গুয়ানিন (Guanine)। এই ধাপের এক একটি ধাপ তৈরী হয় এডিনাইন-থায়ামিন (A-T) বা সাইটোসিন-গুয়ানিন (C-G) দ্বারা এবং এই ধাপগুলির ক্রম-বিন্যাস প্রত্যেকটি জীবদেহে ভিন্ন ভিন্ন রকম এবং এর বিন্যাসের স্বরূপ নির্ধারণকেই বলে ডি এন এ-ক্রম বিন্যাস নির্ধারণ বা DNA sequencing। এই ডি এন এ সকল জীবকোষের নিউক্লিয়াস(nucleus) এবং জীবকোষের মধ্যে অবস্থিত মাইটোক্রোন্দ্রিয়া (mitochondria)-তে থাকে এবং অনেক প্রকার ভাইরাসেও এই ডি এন এ বিদ্যমান। মানুষের শরীরের প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন (৩০,০০০,০০০,০০০,০০০) কোষের সব কোষে এই ডি এন এ (জীন) বিদ্যমান। জীবদেহের বৃদ্ধি, উন্নয়ন, প্রজনন সহ সকল প্রকার কার্যক্ষম এই ডি এন এ (DNA) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। গত ৪০-৪৫ বৎসর ধরে বিভিন্ন গবেষণার ফলে বিভিন্ন জীবের এই ডি এন এ ক্রম-বিন্যাস  নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর ফল স্বরূপ ১৯৯০ সালে মানুষের সার্বিক ডি এন এ ক্রম-বিন্যাস  নির্ধারণের জন্য হিউমান জিনোম (Human Genome) প্রকল্প যাত্রা শুরু করে এবং মূলত ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে এর কার্যক্রম শেষ হয় এবং এই প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের কোষে অবস্থিত ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের সকল ডি এন এ-র (২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ জীন) প্রায় তিন বিলিয়ন (৩০০০,০০০,০০০) বেইস-জোড়ার ক্রম-বিন্যাস সনাক্ত করা হয়। এর ফলে মানুষের ডি এন এ- ক্রম-বিন্যাসের সাথে অন্যান্য জীবের কৌলিতাত্ত্বিকভাবে পার্থক্য নির্ধারণের জন্য একটি ভিত্তি (base/reference) তৈরী হয়।

কথায় আছে "বাপকা বেটা" অর্থাৎ বাবার মতোই ছেলে - এই কথার এক জ্বলন্ত উদাহরণ ভান্তে পাঁবো। ভান্তের পিতা সুনে বের্গস্ট্রমও (Sune Bergstrom) আজ থেকে ৪০ বছর পূর্বে ১৯৮২ সালে তাঁর মতোই চিকিৎসাবিজ্ঞানেই নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ভান্তের বিখ্যাত বই "Neanderthal Man - In Search of Lost Genomes"-এ তিনি উল্লেখ করেন "আমি বের্গস্ট্রম-এর গোপন বিবাহ বহির্ভুত পুত্র" এবং তিনি বলেন তাঁর কাজে তাঁর বাবার অনেক আগ্রহ ছিল। তবে নোবেল প্রাপ্তির পর তিনি উল্লেখ করেন তাঁর জীবনে যাঁর প্রভাব সবচেয়ে বেশি তিনি তাঁর মা এবং তিনি ব্যথিত যে দুঃখজনকভাবে তাঁর মা তাঁর এই আনন্দ-দিনের অংশীদার হতে পারেন নাই। ভান্তে ১৯৫৫ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৯৯ সালে জার্মানির লিপজিগে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি (Max Planck Institute for Evolutionary Anthropology) প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তিনি এখনও কর্মরত। এছাড়াও জাপানের ওকিনাওয়া ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতেও তিনি এখন উপরি (adjunct)অধ্যাপক (adjunct faculty member) পদে প্রতিষ্ঠিত।

নৃতাত্বিক গবেষণায় যে কাজটি একসময় অনেক বিজ্ঞানীর কাছেই প্রায় অসম্ভব বলে বিবেচিত হতো, ভান্তে এবং তাঁর সহকর্মীরা সেই অসাধ্য কাজটিই সম্পন্ন করেন। তিনি ৩০ থেকে ৪০ হাজার বছর  পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়েনডার্থাল এবং ডেনিসোভান মানুষের জেনোমিক ক্রম-বিন্যাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রথম মাটি খুঁড়ে আদিম মানুষের জীবাশ্ম আবিষ্কার করতে শুরু করেন। আশির দশকের দিকে পাঁবো বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাচীন ডি এন এ নিয়ে কাজ শুরু করেন। তবে কোন জীবিত জীবের ডি এন এ নিয়ে কাজ করা যত সহজ আজ থেকে হাজার হাজার বছর পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জীবের জীবাশ্ম থেকে কৌলিতাত্ত্বিক নমুনা (genetic sample) সংগ্রহ করা ততটাই কঠিন। কারণ সময়ের সাথে সাথে ডি এন এ-র রাসায়নিক পরিবর্তন সূচিত হয় এবং আস্তে আস্তে সেই ডি এন এ ছোট ছোট খন্ডে পরিণত হয় এবং সেই সাথে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং যাঁরা এই জীবাশ্ম সংগ্রহ করে তাঁদের মাধ্যমে অন্যান্য বাহ্যিক ডি এন এ দ্বারাও জীবাশ্ম কলুষিত হয়, ফলে এই জীবাশ্মের আসল ডি এন এ খুঁজে পাওয়া সত্যিই খুব দুরূহ। কিন্তু তাই বলে পাঁবো থেমে থাকেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক করার সময়েই পাঁবোর মনে প্রাচীন জীবাশ্মের ডি এন এ নিয়ে কাজ করার প্রবল ইচ্ছা জাগে এবং পরে ১৯৮৪ সালে তাঁর নিজের দেশ সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পি-এইচ ডি করার সময় তিনি মিশরের ২,৪০০ বছরের পুরানো মমি থেকে ডি এন এ আহরণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁর এই কাজ ছিল তাঁর পি-এইচ ডি (Ph.D)-র মূল গবেষণার বাইরে। পরে তাঁর এই গবেষণার ফল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ম্যাগাজিন “নেচার” (Nature)-এ প্রকাশিত হলে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়, কারণ জীবাশ্ম থেকে ডি এন এ আহরণ কাজটি ছিল এই প্রথম। এর পর পোস্ট-ডক্টরেট ফেলো হিসাবে পাঁবো যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে ড. এল্যান উইলসন (Allan Wilson)-এর সাথে যোগ দিয়ে বিলুপ্ত প্রাণী ম্যামথ (mammoth) ও গুহা ভাল্লুক (cave bear)-এর ডি এন এ আহরণ করেন। কিন্তু তখন থেকেই তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নিয়েনডার্থাল মানুষের ডি এন এ-র ক্রম-বিন্যাস নির্ধারণ এবং কি পরিবর্তনের কারণে অতীতের আদিম-মানুষ বর্তমানের আধুনিক মানুষে পরিণত হলো তা নিয়ে কাজ করা। 

চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ প্রকাশের তিন বৎসর পূর্বে ১৮৫৬ সালে জার্মানির ডুসেলডর্ফ (Düsseldorf)শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পূর্বে নিয়েনডার (Neander) উপত্যকার এক গুহা থেকে কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ একটি মাথার খুলির উপরের কিছু অংশ এবং কিছু হাড় উদ্ধার করে জার্মানির একটি মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করেন। তাঁরা প্রথমে ভেবেছিলেন সেগুলি ভাল্লুকের দেহাবশেষ, কিন্তু কয়েক বছর পরে গবেষণায় প্রমাণিত হলো সেগুলি কোন মানব-সদৃশ আদিম প্রাণীর দেহাবশেষ এবং এই নিয়ে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, কারণে এই ধরণের আবিষ্কার ছিল এই প্রথম, কিন্তু পরে এই ধরণের আরো অনেক হাড়ের খন্ড উদ্ধার করা হয় এবং প্রমাণিত হয় এই গুলি নিয়েনডার্থাল মানুষের দেহাবশেষ।  

পাবো ১৯৯০ সালে জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় (University of Munich)-এ অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়ে প্রথমে তিনি মাইটোক্রোন্দ্রিয়াল (mitochondrial) ডি এন এ নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং পরে ১৯৯৭ সালে মিউজিয়াম থেকে নিয়েনডার্থাল মানুষের কিছু জীবাশ্ম সংগ্রহ করে তার  ডি এন এ ক্রম-বিন্যাসের কাজ শুরু করেন। কিন্তু একটি দূষণ-মুক্ত অবস্থায় এই ডি এন এ ক্রম-বিন্যাসের কাজটি করা ছিল খুবই কঠিন, কিন্তু পাঁবো ও তাঁর গবেষক দল নিরলসভাবে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কয়েকটি নতুন উন্নত পদ্ধতি (technique) আবিষ্কারের চেষ্টায় সফলতা অর্জন করেন। তাঁদের এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাচীন কোন প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে ক্ষয়ে যাওয়া ডি এন এ উদ্ধার করা (extract), অনুলিপি তৈরীকরণ (duplication)এবং দূষণমুক্ত (decontamination)করে সেই প্রাণীর ডি এন এ-র ক্রম-বিন্যাস নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের এই কাজে ১৯৮৩ সালে বিজ্ঞানী ক্যারি মিউলিস (Kary Mullis)-এর আবিষ্কৃত পি সি আর (PCR-Polymerase Chain Reaction) পদ্ধতি (যার মাধ্যমে ৪০ চক্রে একটি ডি এন এ খন্ডের এক ট্রিলিয়ন (১,০০০,০০০,০০০,০০০) প্রতিচিত্র পাওয়া সম্ভব এবং বর্তমানের আণবিক জীববিজ্ঞান (molecular biology)গবেষণায় এবং করোনা ভাইরাস (COVID-19) সনাক্তকরণ কাজে এই প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে) এক বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীকালে তিনি যখন জার্মানির সদ্য প্রতিষ্ঠিত Max Planck Institute for Evolutionary Anthropology-এ পরিচালক হিসাবে যোগ দেন তখন সেখানে গবেষণার এক পর্যায়ে পুরোপুরি দূষণমুক্ত অবস্থায় নিয়েনডার্থাল মানুষের সম্পূর্ণ ডি এন এ-ক্রম-বিন্যাস নির্ণয় করতে সক্ষম হন, এবং ২০১০ সালে তাঁর এই গবেষণার খসড়া ফলাফল “A draft sequence of Neanderthal genome”-শিরোনামে আমেরিকার বিখ্যাত "Science"-জার্নালে প্রকাশ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে তাঁর এই গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল নির্ভুল এটি প্রমাণের জন্য তিনি তাঁর নিজের গবেষণাগারে তাঁর এই পরীক্ষা তিনবার পুনরাবৃত্তি করে এবং আরেকটি নিরপেক্ষ ল্যাবরেটরি থেকে এই গবেষণা পুনরাবৃত্তি করে একই ফলাফল পেয়ে নিশ্চিত হয়ে তিনি তা উক্ত জার্নালে প্রকাশ করেন।

শুধু নিয়েনডার্থালই নয়, পাঁবো ও তাঁর গবেষকদল তাদের জীবাশ্ম-জেনোমিক গবেষণার মাধ্যমে আরো একটি ভিন্ন-প্রজাতির মানুষের অস্তিত্ত্ব আবিষ্কারেও সক্ষম হন। ২০০৮ সালে একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ রাশিয়ার দক্ষিণ সাইবেরিয়ার অলটাই পর্বতমালার (Altai mountains) ডেনিসোভা গুহা (Denisova cave) থেকে একটি আঙুলের হাড় উদ্ধার করেন। পাঁবো ও তাঁর দল এই হাড়ের ডি এন এ-র সম্পূর্ণ ক্রম- বিন্যাস সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন এবং তাঁর এই গবেষণার ফলাফল ২০১০ সালে "Genetic history of an archaic hominin group from Denisova Cave in Siberia” শিরোনামে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত “Nature” ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। পাঁবো ও তাঁর দল এই ডি এন এ ম্যাপ নিয়েনডার্থাল মানুষ, অনেক প্রাচীন মানুষ, আধুনিক মানুষ, বনোবো এবং শিম্পাঞ্জির ডি এন এ-র সাথে তুলনা করে নিশ্চিত হন যে এই ডেনিসোভান একটি আলাদা প্রজাতির মানুষ এবং ডেনিসোভা গুহায় এদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় বলে এদের নাম দেয়া হয় ডেনিসোভান (Denisovan)মানুষ।

হাজার হাজার বছর পূর্বের কোন প্রাচীন জীবের জীবাশ্ম থেকে এই জীবের ডি এন এ-র ক্রম-বিন্যাস নির্ণয় করার জন্যে ভান্তের এই নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের বিবর্তন সম্বন্ধীয় জ্ঞানের উৎস ছিল কেবল প্রাচীন মানুষের হাড়গোড় আর তাঁদের ব্যবহৃত হাতিয়ার আর অন্যান্য ব্যবহারিক জিনিসপত্র পরীক্ষা-নির্ভর। ফলে পাঁবোর গবেষণার পূর্বে অনেক প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া গেলেও কেবল বাহ্যিক ভাবে হাড়গোড় আর জিনিসপত্র পরীক্ষা করে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া সম্ভব ছিলনা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আজ থেকে ১৬৬ বছর পূর্বে ১৮৫৬ সালেই নিয়েনডার্থাল মানুষের হাড় পাওয়া গেলেও ২০১০ সালে পাঁবো ও তাঁর গবেষক দলের নিয়েনডার্থাল মানুষের ডি এন এ-র পূর্ণ ক্রম-বিন্যাস (DNA sequence)-এর চিত্র জানার আগ পর্যন্ত এই নিয়েনডার্থাল মানুষ সম্বন্ধে আমাদের খুব সামান্যই জানার সুযোগ হয়েছিল।

নিয়েনডার্থাল মানুষ ইউরোপ এবং এশিয়াতে প্রায় চার লক্ষ (৪০০,০০০) বছর আগে থেকে বসবাস শুরু করে এবং এখন থেকে প্রায় ৩০ হাজার (৩০,০০০) বছর আগে তাঁরা এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভান্তে পাঁবো ও তাঁর সহযোগী গবেষকদের প্রায় দীর্ঘ ৩৫ বৎসরের গবেষণার ফলে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে অতীতের নিয়েনডার্থাল এবং ডেনিসোভান মানুষের এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্তির পূর্বে বর্তমানের আধুনিক মানুষ ইতিহাসের কিছুটা সময় ধরে তাদের কাছাকাছি বসবাস করে, ফলে তাঁদের সাথে আধুনিক মানুষ (Homo sapiens)-এর কোন কোন ক্ষেত্রে আন্ত:সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং দৈহিক মিলন ঘটে এবং এই সম্পর্কের ফলে সন্তানও উৎপন্ন হয়। তবে এই মিলন মূলত ঘটে ইউরোপ এবং এশিয়া অঞ্চলে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বলেন বর্তমানের আধুনিক মানুষের সাথে সাদৃশ্য সম্পন্ন মানুষ (Homo sapiens)-এর উৎপত্তি হয় আফ্রিকায় আজ থেকে প্রায় তিন লক্ষ (৩০০,০০০) বছর আগে এবং তারপর তাঁরা যখন আজ থেকে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার (৬০,০০০-৭০,০০০) বছর আগে আফ্রিকা থেকে মধ্য-প্রাচ্যে আসে এবং পরে ইউরোপ সহ সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তখন ইউরোপ এবং এশিয়াতে আবির্ভুত এবং বসবাসকারী নিয়েনডার্থাল মানুষ (Homo neanderthalensis) এবং ডেনিসোভান (Homo denisova or Homo altaiensis)মানুষের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাঁদের সাথে প্রায় ২০-৩০ হাজার (২০,০০০-৩০,০০০)বছর পাশাপাশি বসবাস করার সুযোগ পায়। এর প্রমাণ মিলে বর্তমানের কোন কোন মানবগুষ্ঠির মধ্যে নিয়েনডার্থাল এবং ডেনিসোভান মানুষের ডি এন এ উপস্থিতি । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় একটি জীন যার নাম EPSA1, যাহা একটি ডেনিসোভান মানুষের জীন, এই জীনটি বর্তমানের তিব্বতের মানুষের মধ্যে পাওয়া গেছে। যেহেতু ডেনিসোভান মানুষেরা উঁচু আলটাই পর্বতমালায় বসবাস করতো তাই তিব্বতের মানুষের মধ্যে এই জীনের উপস্থিতি তাঁদেরকে তিব্বতের মতো উঁচু পার্বত্য এলাকায় খাপ খাওয়াতে সহায়তা করছে। গবেষণায় এও দেখা গেছে যে আমাদের আদিম পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া সব জীনই কিন্তু বর্তমানের আধুনিক মানুষদের জন্য উপকারী নয়। যেমন ২০২০ সালে পাঁবো এবং তাঁর গবেষক দল আবিষ্কার করেন যে কোন কোন আধুনিক মানুষের শরীরে কোন প্রাচীন মানুষের ডি এন এ-র অবস্থিতির কারণে সেই মানুষ SARS বা কোভিডে আক্রান্ত হলে মারাত্বক শ্বাস কষ্টের শিকার হতে পারে। গত বছর (২০২১ সালে)পাঁবো এবং তাঁর দল সংবাদের শিরোনামে আসেন যখন তাঁরা বললেন যে, যে সমস্ত মানুষের কোষের তৃতীয় ক্রোমোজোমে নিয়েনডার্থাল মানুষের কৌলিক বৈশিষ্ট্য (Neanderthal variant) বিদ্যমান তাঁরা করোনা ভাইরাস (COVID-19) দ্বারা মারাত্বক ভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। পাঁবোর গবেষণা মতে আফ্রিকার বাইরে ইউরোপ এবং এশিয়ার জনসাধারণের মধ্যে নিয়েনডার্থাল জীনের পরিমান ১ থেকে ২ শতাংশ। যেহেতু নিয়েনডার্থাল মানুষ আফ্রিকাতে উম্ভব হয়নি তাই আফ্রিকার জনগণের মধ্যে নিয়েনডার্থাল জীন নাই বলেই এখন পর্যন্ত মনে করা হয়, এবং আফ্রিকার বাইরে ডেনিসোভান মানুষের সাথেও যেহেতু আধুনিক মানুষের মিলন ঘটেছে তাই বর্তমানে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন কোন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ডেনিসোভান মানুষ থেকে আগত জীনের পরিমান ১ থেকে ৬ শতাংশ।

বর্তমান মানুষের নিকটতম আত্মীয় নিয়েনডার্থাল মানুষ আজ থেকে প্রায় ৩০-৪০ হাজার বছর পূর্বে এই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে - আমরা হোমো সেপিয়ানরা এখনো টিকে আছি, কিন্তু তাঁরা কেন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেলো তা এখনো এক মহারহস্য। তবে এই রহস্যও একদিন উদ্ঘাটন হবে এমনটিই একজন মানুষ হিসাবে আমার আশাবাদ।  

আমার এই লেখা শেষ করার আগে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ভান্তে পাঁবোর সারা জাগানো বই “Neanderthal Man – In Search of Lost Genomes” থেকে নিয়েনডার্থাল এবং ডেনিসোভান মানুষ সম্বন্ধে কিছু মজার তথ্য এখানে দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না । পাঁবো এবং তাঁর গবেষকদলের নিয়েনডার্থাল আর ডেনিসোভান মানুষের জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণার উপর ভিত্তি করে নিয়েনডার্থাল আর ডেনিসোভান মানুষের যে নকশা (model) তৈরী করা হয়েছে তা হলো নিয়েনডার্থাল মানুষ ছিল একটু ভারী প্রকৃতির – মাংস-বহুল নাদুস-নাদুস দেহ এবং পায়ের আকৃতি ছিল বর্তমানের মানুষের অনুপাতে কিছুটা খাটো, আর মুখমন্ডলের মধ্যভাগ একটু সামনের দিকে ঝোঁকানো এবং নাক অনেকটা বড় এবং চওড়া। ডেনিসোভান মানুষের আকার-আকৃতিও ছিল অনেকটা নিয়েনডার্থাল মানুষেরই মতো - লম্বা, চওড়া এবং কিছুটা সামনের দিকে ঝোঁকানো মুখমন্ডল, বড় নাক আর লম্বা মাথার খুলি এবং চওড়া বুক আর নিতম্ব।

সবশেষে একটি হাসির কথা - ২০১০ সালে আমেরিকার “Science” ম্যাগাজিনে নিয়েনডার্থাল মানুষ সম্বন্ধে পাবো’র সাড়া জাগানো গবেষণা প্রবন্ধটি ছাপানোর পর তিনি সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে অসংখ্য ই-মেইল পান। এর মধ্যে তিনি ৪৭টি ই-মেইল পান যেখানে তাঁরা সবাই লিখেছেন যে তাঁরা মনে করেন যে তাঁরা নিজেরা নিয়েনডার্থাল প্রজাতির মানুষ এবং এর মধ্যে ৪৬ জনই হলেন পুরুষ। হাহা! তবে এখানেই শেষ নয়। আরো মজার ব্যাপার হলো ১২ জন মহিলা তাদের ই-মেইলে লিখেছেন যে তাঁরা মনে করেন যে তাঁদের স্বামীরা নিয়েনডার্থাল প্রজাতির পুরুষ আর একজন মাত্র পুরুষ লিখেছেন যে তিনি মনে করেন যে তাঁর পত্নী নিয়েনডার্থাল মানবী। হাহাহাহাহা। 

তথ্য ঋণ:
১.  ২০১৪ সালে প্রকাশিত ভান্তে পাঁবোর বিখ্যাত বই "Neanderthal Man – In Search of Lost Genomes” 
২.  ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত নোবেল পুরস্কার সংক্রান্ত অনেক প্রবন্ধ 
৩.  উইকিপেডিয়া

ড. অমল রায়
অক্টোবর ৯, ২০২২ সাল 
ইকালুইট, নুনাভুট, ক্যানাডা।
…………

দ্রষ্টব্য: প্রিয় পাঠক, আপনাদের জ্ঞাতার্থে সবিনয়ভাবে জানাচ্ছি যে আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালের ঢাকা বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে " উল্টো রথে উৎসে ফেরা' নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। বইটির প্রকাশক "মহাকাল" প্রকাশনী। আপনারা যদি বইটি কিনতে আগ্রহী হন তবে দয়া করে আমার সাথে এখানে দেয়া আমার ই-মেইলে যোগাযোগ করবেন:royamalk@gmail.com  আপনাদের প্রতি আমার অগ্রিম শুভেচ্ছা আর কৃতজ্ঞতা।