অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
"হারিয়ে যাওয়া শৈশব'' - জাবেদুর রশিদ

অতীতের সেই দূরন্তপনা মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক পীড়া দেয়।নিজের অজান্তে ছোট ছোট সেই ভাল লাগা মূহুর্ত ফিরে পাওয়ার জন্য এই মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে।ইচ্ছে হয় আবার যদি ফিরে পেতাম সেই স্কুল জীবন তাহলে এক দিনও পালিয়ে বেড়াতাম না স্কুল থেকে। সিগারেটের খালি প্যাকেট বিনিময় করে লোহার কড়াইয়ের ভাঙা টুকরো বা মাটির হাড়ির টুকরো দিয়ে ভাস্ক খেলা,মার্বেল খেলা,টেনিস বল দিয়ে থাবাথাবি খেলা(এই খেলার আসল নাম জানা নেই,কোন জায়গায় কেউ খেলতে দেখিনা) বাড়ির পশ্চিমে বিকেল বেলার ফুটবল/ক্রিকেট,কোন হিসাব-নিকাশ ছাড়া  যাদের সাথে ঘুরে-ফিরে জীবনের শুরু শৈশবের সেই বন্ধুদের নিয়ে বাকিটা জীবন যদি কাটিয়ে দিতে পারতাম। বিকেলের সেই খেলার জায়গাটা এখনো আছে, তবে সেখানে এখন কারো বাড়ির পুকুর বা কারো চাষের জমি,শুনেছি স্কুল জীবনে ভাল লাগা সেই সহপাঠিনী আজ পাক্কা গৃহিনী।বন্ধুরা সাবাই আছে তবে জীবনের তাগিদে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।গ্রামের সাথে এখনো সম্পর্ক আছে তবে আমার শৈশবের সেই মানুষজন,খেলার মাঠ,আমার একক রাজ্য নানা বাড়িটা আর আগের মত নেই।একসময় যে বাড়ির চারপাশ পরিপাটি করে সাজানো ছিল আজ তার কিছুই নেই। বাড়িতে কেউ না থাকায় আমি কেন গ্রামের মানুষও এখন যায়না এই বাড়িতে। নানা বাড়ির সামনে যে বিশাল মাঠ ছিল তার দৈর্ঘ-প্রস্থ কমেছে বহুগুণ।সামান্য খেলার জায়গা রেখে সেখানে আজ গড়ে উঠেছে অনেক বসত বাড়ি। যাদের বয়স এখন ১৬/১৭ তারা কল্পনাও করতে পারবে না যে কি বিশাল খেলার মাঠ ছিল এখানে। সারাদিন এই মাঠ যারা মাতিয়ে রাখত তারা সবাই এখন জীবনের স্রোতে ভেসে বেড়াচ্ছেন।  অনেক কিছুই আর আগের মত নেই। সারাদিন স্কুল পালিয়ে কুশিয়ারা পাড় ধরে হেটে বেড়ানো,বর্ষায় নৌকা বাইছ,সারাদিনের কৃতকর্মের জন্য আব্বার হাতে মাইর(উত্তমমধ্যম)খাওয়ার ভয়ে রাতে ঘরের ছাদে লুকিয়ে থাকা বা সন্ধ্যার দিকে পালিয়ে নানা বাড়িতে আশ্রয় নেয়া। বর্ষায় আব্বার সাথে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই গস্তি নৌকার মাছাড় নিছে শুয়ে থাকা,মাছ শিকারে যাওয়ার জন্য বায়না ধরা। কোরবানির ঈদে গরু কেনার জন্য রাণীগঞ্জ হাটে যাওয়া।বৈশাখি হালখাতা অনুষ্ঠানে খাওয়া রসগোল্লা আর নিমকি। দাদা ইংল্যান্ড থেকে বাড়িতে আসলে ফ্লাক্স ভর্তি চা সাথে নিয়ে বাড়ির পশ্চিমে নিজেদের আমন জমিতে নেরা কাটতে যাওয়া।বর্ষাকালে বাড়িতে থাকলে একইভাবে চা নিয়ে রাজকীয় কায়দায় মাছ শিকারে যাওয়া। যদিও আব্বা শিকার করে মাছ মারলে সেই মাছ দাদার নৌকায় তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া কোন মাছ শিকার করা হতনা উনার।চারপাশের বদলে যাওয়া সবকিছুর সাথে সাথে দাদার দেশে আসার যে অলিখিত নিয়ম ছিল তাও বদলে গেছে চিরদিনের জন্য। যে মানুষ বছরে দুইবার না পারলেও একবার আসতেন আমাদের টানে তার আসা হয়না প্রায় ৮ বছর হল। আর আসতে পারবেনও না কোনদিন।আমাদের সবার জীবন বদলেছে বদলেনি  চানাচুর ফেরি করে বেড়ানো আনফর আলীর জীবন। শারীরিক ভাবে তেমন ভাল না থাকলেও সে এখনো চানাচুর ফেরি করে আগের মত।বাজারের গলিতে ডালের সাথে রঙ মিশিয়ে সুন্দর ডাইলের বরা বানানো সেই মানুষটা এখনো দেখলাম বাজারের গলিতে বসেন তার কেরোসিনের চুলা আর বেতের ঢালা সাজিয়ে। প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে আইসক্রিম শব্দটা যার মালাই আইসক্রিম আর এসিড মিশ্রিত নুন্তা আইসক্রিম খেয়ে শিখেছিলাম তার দেখা পাইনা অনেকদিন হল।বাজারে এখন আর কদ্দুছ মিয়ার চায়ের স্টলের সিংগারা পাওয়া যায় না,কোন দোকানে পাওয়া যায় না হজমি বা ইকোনোডেক্স কলম।এখন আর স্কুলের সামনে বা বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করে কেউ হাওয়ার মিঠাই বিক্রি করে না, পুরাতন জিনিসের বদলে কেউ আর দেয় না ঘি চমচম নামের এক আজব খাবার বা মটর ভাজা।স্কুল পালিয়ে বেড়ানো যার কাজ তার কোন প্রিয় শিক্ষক থাকার কথা নয় আমার ছিলনাও তা। তাই খুব একটা মিস করিনা তাদের। গ্রামে গেলে এখনো দেখা মিলে 'মরার আগে মরতে হবে' এই বাণী শুনিয়ে পরিক্ষার আগে পরিক্ষা দিতে উদ্বুদ্ধ করা সেই কাঞ্চন স্যারের। তবে আগে যেমন খুব একটা কাছে যাওয়া হতনা তেমনটা হয় এখনো । সামনে পরলে শুধু সালাম বিনিময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ আমাদের বন্ধন। ইসলাম শিক্ষা পড়ানো সেই মোল্লা স্যারও আছেন স্কুলে। অবাক হওয়ার কিছু নাই  আজ অবদি মোল্লা স্যারকে মোল্লা স্যার হিসেবে জানি উনার নাম জানা হয়নি এখনো। জানার যে চেষ্টা করেছি তাও কিন্তু নয়। যার জন্য গণিতে ৩৩ এর উপরে নাম্বার তুলতে পারা সেই শশাঙ্ক স্যার শুনেছি আর আগের মত নেই অনেকটা অগোছালো তাহার জীবন।ইংলিশে ভাল না করার জন্য নিয়মিত ব্যত্রাগাত করা মনোধন স্যার এখন নেই স্কুলে। ক্লাশে ঢুকে আজগুবি সব গল্প বলা আমিন স্যার স্কুল ছেড়েছেন কবে মনে নেই। প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা সেই রব স্যার আছেন আজ অবধি।  প্রাইমারিতে যে শিক্ষক গলা ফাটিয়ে স্কুলের নামের সাথে সাথে নিজের নাম মুখস্থ করাতেন সেই নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ স্যার কেমন আছেন জানা নাই।