অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ঘরবন্দি শৈশব -সিদ্ধেশ্বর হাটুই

র্তমানে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত একই অবস্থা চোখে পড়ে। হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশব ও তারুণ্যের উদ্যম। তরুণ প্রজন্ম আজ বড়ই ডিজিটাল ও ডিভাইসমুখী অর্থাৎ ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যার ফলে বর্তমানে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আজ থেকে চল্লিশ বছর পূর্বে  আমরা দেখতাম শহরের ছেলে মেয়েরা পড়াশুনো সেরে নানা রকমের খেলাধুলা করত, গ্রাম গঞ্জে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। পড়াশোনার সাথে সাথে খেলাধুলা করাটা একটা রুটিন মাফিক কাজ ছিল। গ্রামে কত ধরনের খেলা হতো –ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, কাবাডি, ছু-কিতকিত, চোর পুলিশ, কানামাছি, লুকোচুরি, মার্বেলখেলা, আরো কত রকমের খেলা খেলত। আজ আর সে সমস্ত খেলা চোখে পড়ে না। বর্তমানে শিশু-কিশোররা গৃহবন্দি অবস্থায় হাঁফিয়ে উঠেছে, যদিও তাদের তুষ্টিসাধনের বেশ কিছু জায়গা রয়েছে, যেমন ধরুন মোবাইল বা ল্যাপটপে গেম খেলা, টি.ভি. দেখা প্রভৃতি। এর ফলে ধীরে ধীরে তারা ওগুলোর উপর অতিশয় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। তাদের আর মাঠে পাঁচজন বন্ধু মিলে খেলার আগ্রহ থাকছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

শৈশব অবস্থায় আমরা মনের মতো খেলার মাঠ পেয়েছি, খেলার সাথীর অভাব ছিল না । ফলে আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতো। আজ আর সে দৃশ্য দেখা যায় না। কী করে যাবে  ? বাড়ির বাইরে এসে খেলাধুলা করার প্রবনতাই তো নেই। অবশ্য তার জন্য আমরা নিজেরা অর্থাৎ গুরুজনেরাই দায়ী। কারণ আমাদের কাজের সুবিধের জন্য সন্তানদের হাতে আমরা মোবাইল তুলে দিচ্ছি , টি.ভি খুলে দিয়ে দেখতে বলছি । তাহলে আর ওদের দোষ কোথায় বলুন ? সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে অবশ্যই খেলাধুলার প্রয়োজন। অন্যথায় শরীর মন দুটোই খারাপ হবে। শরীরচর্চা ও খেলাধুলাতে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন  এর সুফল সারাজীবন ধরে রয়ে যায় ,দেহ সুস্থ সবল থাকে । আর শরীর সুস্থ থাকলে মন ও ফুরফুরে থাকে, যে কোন কাজ ভালো ভাবে করার আগ্রহ বাড়ে।

যে সময়টা বাচ্চাদের শরীর গঠনের উপযুক্ত সময় , সেই সময়টা তারা হেলায় হারাচ্ছে। এর জন্য আমাদের সমাজ অনেকাংশেই দায়ী। কারণ- যদিও শহরে বা গ্রামে কিছু খেলার মাঠ আছে তবে এর অধিকাংশই ব্যবহারের অযোগ্য করে দেওয়া হয়েছে। কত কত খেলার মাঠ আজ দখল হয়ে গেছে। কোথাও আবার রাস্তা বা বাড়ি বানানো বা অন্য কোন কাজের প্রয়োজনে খেলার মাঠ দখল করে নিচ্ছে। ছেলে মেয়েরা খেলাধূলার মতো ফাঁকা মাঠ পাচ্ছে না, ফলে বাড়ির ছাদে কিম্বা মোবাইলে গেম খেলে বা টিভি দেখে সময় কাটাচ্ছে।

কিছু কিছু খেলার মাঠ শহরাঞ্চলে এখনও দেখা যায়, কিন্তু সেগুলো খেলার অনুপযোগী। আবার কিছু মাঠ যদিও আছে সেগুলো আবার বড়দের দখলে, ছোটদের সেখানে স্থান নেই। গ্রামে খেলার মাঠের সংখ্যা শহরের তুলনায় অনেকটাই বেশি, কিন্তু একই হাল। আস্তে আস্তে মাঠগুলো দখল করে বড় বড় বাড়ি হয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে দেখবেন বেশিরভাগ ছেলে মেয়ের শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকছে না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মোটা হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যদি এভাবে চলে তাহলে হয়তো সকলকেই রোগে ভুগতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত আমরাই নষ্ট করছি। একথা যেন আমরা ভুলে না যাই।

এ বিষয়ে একদিন আমার এক আদিবাসী বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল । ওর নাম সাগেন , আমরা একসঙ্গে মাঠে খেলাধুলা করেছি বহুদিন ধরে । ও খুব ভালো ফুটবল খেলত, সেদিন ওর সঙ্গে আমার চায়ের দোকানে দেখা। দোকানে দুজনে চা পান করতে করতে গল্প করছিলাম।
সাগেন আমাকে বলল –‘তোর শরীরটা একটু লেগেছে, তখন আমি বললাম-“আর তোরটা তো আরো বেশি।“
সাগেন হাসলো, আর বলল ---
“দেখ ভাই বর্তমানে আর মাঠে যাই না, কোন বন্ধু নেই, হাতে সময় অল্প, তারপর সংসারের কাজকর্ম করে ইচ্ছে হয় না। তবে একদিন ছেলের আবদারে ছেলেকে নিয়ে মাঠে গিয়েছিলাম , ছেলে মাঠে ছুটছে আমিও ওর সাথে একটু একটু হাঁটছি, হঠাৎ ছেলে চিৎকার করে ওঠে-“ও মা গো..আঃ আঃ করে, গিয়ে দেখি পায়ে রক্ত পড়ছে আর পায়ের ভেতরে একটা ভাঙা কাঁচের টুকরো ঢুকে আছে। আস্তে আস্তে টেনে কোন রকমে কাঁচের টুকরোটা বার করলাম । রক্ত থামানোর জন্য আমার রুমালটা দিয়ে পা টা বেঁধে দিলাম। কারা যেন মদ খেয়ে বোতল গুলো ভেঙে রেখে গেছে তাতেই ওর লেগেছে। তাছাড়া  যখন পাকা রাস্তার কাজ চলছিল তখন গোটা মাঠটাতে ছোট ছোট পাথর নামিয়ে রেখে ওরা কাজ করছিল, ওরাতো আর পরিষ্কার করে দেয়নি। ওই মাঠে আর খেলা যাবে না তাই আর ইচ্ছে নেই।
আমি মনে মনে একটা কথা ভেবে সাগেনকে বললাম- ’দেখ ভাই সব কিছু পাল্টে যাচ্ছে, আমাদের যখন খেলার বয়স ছিল কত খেলেছি বল, আর আজ কী অবস্থা, খেলার জন্য একটাও উপযুক্ত মাঠ অবশিষ্ট নেই। কী হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের‘!
সাগেন হেসে বলল –“ঐ মোবাইলেই সব হবে !
যুগের সঙ্গে তাল তো মেলাতে হবে ভাই।

এটা ধ্রুব সত্যি এমন একটা দিন আসছে খেলার মাঠগুলো সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গড়ছে ইমারত, বাজার আর নষ্ট হচ্ছে একটা বড় সম্পদ। খেলার মাঠগুলোকে সংরক্ষণ করে না রাখতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে কিন্তু খেলার মাঠ থাকবে না । এবিষয়ে সকলের মনোনিবেশ করা উচিৎ, অন্তত ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে। আর যারা খেলার মাঠে অপকর্ম করে সকলে মিলে তাদের চিহ্নিত করে আইননানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। চেষ্টা করলে মানুষ পারে ,

পুরানো স্মৃতি গুলো বার বর মনে পড়ে। শুধু আমার নয় শহর-গ্রামে যেখানেই যারাখেলাধুলা করেছেন তারা একটু ভাবুন কত সুন্দর ছিল মাঠগুলো । চোখ বন্ধ করে মাঠে দৌড়ানো যেত। কিন্তু আজ সেখানে মনের মধ্যে ভীতি গ্রাস করে, তাহলে কীভাবে শৈশব খেলাধুলা করবে।

সকলের একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন খেলার মাঠে কখোনই কু-কর্ম আমরা করব না। যদি কোন অপরাধ করা ব্যাক্তিদের আমরা অপকর্ম করতে দেখি বাধা অবশ্যই দেবো। খেলার মাঠের যত্ন নেবো, এবং পরিস্কার রাখবো,
আর উঠবে আওয়াজ আকাশে বাতসে….
এই হোক আমাদের অঙ্গীকার- শৈশব জাগান মাঠ বাঁচান।
খেলার মাঠ জীবনের একটা অংশ, আমরা তাকে কখনোই হতে দেবো না ধ্বংস।
গড়ব আমরা শরীর –মন , বুঝেছি শরীর অমূল্য ধন , হোতে দেবো না কোন মতে খেলার মাঠের বিসর্জন।

সিদ্ধেশ্বর হাটুই
সুখাডালী/সারেঙ্গা/বাঁকুড়া