অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ভাষা দিবসে নিজের ভাষায় ভাবনার অধিকার – সুপ্তা বড়ুয়া

মরা যারা অভিবাসী, তাদের জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে এই প্রবাসে জীবনযাপনটা অনেক কষ্টকর। কিন্তু জাতীয় উৎসব/দিবসগুলো যেন আরেকটু বেশির পীড়াদায়ক। কেননা, একে তো এই দূর দেশে সারাটা দিন যেন কর্মব্যস্ততা তার উপর যুক্ত হয় নিজের দেশ আর মাটির সাথে একাত্ম হতে না পারার বিষাদ। ২১শে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ কিংবা বিজয় দিবসগুলোতে আমরা যেন উড়ে যেতে চাই নিজভূমে। বাস্তবতা আমাদের তা করতে দেয় না বটে, কিন্তু বাঙালীরা যেখানেই গেছে তার শেকড়, তার ইতিহাস কখনো ভুলে নি বরং সাথে নিয়ে সমৃদ্ধ করেছে যেখানেই আবাস গড়েছে। তেমনি কথাই ফুটে উঠলো অটোয়া শহরে বাকাওভের ২১শে ফেব্রুয়ারী উদযাপনে।

২০শে ফেব্রুয়ারী রাত ১০টায় শুরু হলো বাংলাদেশ আর কানাডার জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশের মতো ২১শে ফেব্রুয়ারী ভোর ০০:০১ মিনিটে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শহীদ মিনারের(অস্থায়ী) পাদদেশে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্যে নিবেদনই এ অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য।

অনুষ্ঠানে বাকাওভের কার্যকরী কমিটির মহসীন আলী বক্তব্যে উঠে এসেছে ভাষা দিবসের ইতিহাস এবং ২১শে ফেব্রুয়ারীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভের ইতিহাস যেমন, তেমনি অটোয়া শহরের পরিচিত বিশিষ্ট সুবক্তা মহসীন বখত'এর বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে মানব প্রজাতির মাতৃভাষা বিষয়ক ধারণার মিথিক্যাল ব্যাখ্যা এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও। তথ্যসমৃদ্ধ সে বক্তৃতা ঘন্টাখানেক অনায়াসেই শোনাই যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়শনের সভাপতি (কানাডা) আরিফুজ্জামান আরিফ বিভিন্ন ভাষার প্রসঙ্গ তার বক্তৃতায় তুলে ধরেছেন।

অটোয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার মোঃ হারুন আল রশিদ বক্তৃতা রাখেন। আরো উপস্থিত ছিলেন, ফ্রাস্ট সেক্রেটারি অপর্ণা রাণী পাল। বাংলাদেশ এবং কানাডার মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং সহযোগিতা প্রসারের বিভিন্ন প্রসঙ্গ স্থান পায় তাতে। অটোয়া নিপিন-এর মাননীয় সংসদ সদস্য চান্দ্রা আরিয়া তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় সকল বাংলা ভাষাভাষীদের শুভেচ্ছা জানান এবং সকল মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদের কথা মনে করিয়ে দেন।

অনুষ্ঠানে আরো তিনজন সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন, আনিতা ভান্ডাবেল্ট (অটোয়া-পশ্চিম নিপিন), ইয়াসির নাকবি (মূল অটোয়া), মারি-ফ্রান্স লঁলন্দ (অটোয়া-অরলিন্স)।
বক্তব্য রাখেন আনিতা ভান্ডারবেল্ট, সে সময় তিনি বাংলাদেশে তার কয়েকবছর সময় কাটানোর কথা উল্লেখ করেন এবং পরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভাষা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শুভেচ্ছা বার্তা পড়ে শোনান। পরে সে শুভেচ্ছা বার্তা অন্যান্য মাননীয় সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে সকল বাঙালীদের পক্ষে শাহ বাহাউদ্দীন শিশির গ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন সংস্কৃতিক কর্মী উৎপলা ক্রান্তি, কবিতা আবৃত্তি করেন শিউলি হক, রত্না ঘোষ এবং গান পরিবেশন করেন রোয়েনা খানম এবং আমি, সুপ্তা বড়ুয়া।

এমন শীতের রাতেও হিমাঙ্কের নীচে ১৩ ডিগ্রী তাপমাত্রা উপেক্ষা করে প্রাণের টানে অনুষ্ঠানে ছুটে এসেছেন অটোয়ায় বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধাসহ আরো অনেকেই।

পুনশ্চঃ ছোট ছোট মাতৃভাষাগুলো বড় বাণিজ্যিক, পুঁজিবাদী ভাষার দাপটে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগতই। যেমন এই কানাডা এমন প্রগতিশীল দেশ হওয়া স্বত্বেও এখানকার আদিবাসীদের ভাষা ভালো নেই, যেমন ভালো নেই আমাদের দেশের প্রান্তিক জনগণের আঞ্চলিক ভাষা কিংবা আদিবাসী চাকমা, মারমাদের ভাষা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমার এক কলিগের সাথে এই অনুষ্ঠান কথা প্রসঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন বললো, কিছু বছর আগে জুলি ব্ল্যাক কানাডার জাতীয় সঙ্গীতে মাত্র একটি শব্দ পরিবর্তন করেছিলো বলে, সে সময় কি পরিমাণ তিরস্কার শুনেছিলেন। এই দেশের জাতীয় ভাষা ফরাসী আর ইংরেজি, কোথাও চট করে খুঁজে পাবেন না আদিবাসীদের (যাদের এরা বলে 'নেটিভ') ভাষা। নানা রকম অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক শোষণের পাশাপাশি ভাষাগত শোষণও থেমে থাকে নি তাদের বিরুদ্ধে। এই দেশটারও আদি নিবাসীদের ভাষাতে তাদের শিক্ষাক্রম নেই, সেটা নিয়ে আমরা খুব একটা আগ্রহী নই। কিংবা দেশে অন্তত আদিবাসীদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাক্রমের দাবী অনেক পুরানো, সে সম্পর্কে আমরা উচ্চবাচ্য করি না।

দেশে থাকতে অনেকেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতাম বলে নানা ভাবে ব্যঙ্গ করতো। আমাদের নিজ অঞ্চলে, চট্টগ্রামেই। অথচ চট্টগ্রামের বাইরে থেকে যারা আসতো তাদের সাথে আমাদের (শুদ্ধ?) বাংলা ভাষায় কথা বলতে হতো। এ জন্য আমাদের ভোগান্তি কম হতো না। কিন্তু চাঁটগাইয়া আমাদের মাতৃভাষা এবং বাংলা ভাষারই আদি আরেকটি রূপ, পালির আর আদিবাসী চাকমাদের ভাষার সাথে যার মিল আরো বেশিই। সেই চাঁটগাইয়া ভাষা সকলের কাছে পরিচিত হতো অশুদ্ধ (???) বলে?

যেই দেশের মানুষ নিজে তার মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য লড়াই করে, সেই দেশেই যখন প্রান্তিক আঞ্চলিক মানুষরা কিংবা সংখ্যালঘু আদিবাসীরা নিজেদের মাতৃভাষা চর্চা আর বিকাশের সুযোগ পায় না, তখন ভাষা দিবসের তাৎপর্য কি একটুও মিয়্রমাণ হয় না? আমরা সকলের মাতৃভাষাকে সম্মান জানাবো। দেশে পারি নি তো কি হয়েছে, এই প্রবাসে থেকে হলেও বাংলাদেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার কথা কি আমরা মনে করিয়ে দিতে পারি না কিংবা এই দেশের আদিবাসীদের ভাষার অধিকারের কথা মনে করিয়ে দেওয়াও কি আমাদের ভাষা দিবস গৌরব আরো বৃদ্ধি করবে না? আমরা নিজেরা অত্যাচারিত হয়েছি দেখেই আমরা জানি, ভাষার শোষণ সে কতটা তীব্র। আমরা যেন আমাদের সেই শোষণের ইতিহাস পড়ে নিজেরা শোষক হয়ে না উঠি। আমাদের ভাষা যেন অন্য কারো ভাষার উপর দখলদারিত্ব না করে। সকল মাতৃভাষাকে রক্ষার তাগিদে আর কর্মে যেন আমরা এই দিবসকে আমরা আদতেই সম্মানিত করি, সেই কামনাই রইলো। ভবিষ্যতে নানা ভাষাভাষীদের মানুষদের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান আরো আলোকিত হবে, সেই প্রয়াস রইলো। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও যেন আমরা সচেতন করি সকল ভাষাকেই সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শনে। 

সুপ্তা বড়ুয়া
অটোয়া, কানাডা