অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
বাংলাদেশ এখন কালাপাহাড়দের দেশ (১) - মহসীন বখত

কালাপাহাড়ের নাম কি জানে আজকের বাঙালি প্রজন্ম?  

ঠাকুর কালাচাঁদ রায়ের নাম?

বাঙালির ইতিহাসে এক বিভীষিকা ছিল এই নওমুসলিম। শিশু বয়েসে মাতৃহারা কালাচাঁদকে লালনপালন করেন তার এক মাসিমা। পুত্রস্নেহে পালন করে বড় করেন তাকে। ব্রাহ্মণপুত্র এই কালাচাঁদের প্রেমে পড়ে যায় মুসলিম সুলতানের  এক অষ্টাদশী কন্যা। সুলতানের কানে খবর পৌঁছালে কালাচাঁদকে ধরে নিয়ে শোলে চড়ানোর হুকুম জারি করতে দেরি হয়না। কিন্তু ঘটনার রং পাল্টায়। শোলে চড়ানোর মঞ্চে এসে হাউমাউ করে শোরগোল শুরু করে সুলতানের কন্যাটি । কালাচাঁদের গলায় ঝাপটে ধরে থাকে সে আর কান্না করে বলে , আমাকেও শোলে দাও আগে , কালাচাঁদ ছাড়া আমি বাঁচতে চাইনা। আপন কন্যার এমন আকুল রোদনে ভাবিত হলেন সুলতান। অপূর্ব সৌম্যকান্তি যুবা কালাচাঁদের প্রতি তার মায়া জন্মে যায়। প্রিয় কন্যার আহাজারিতে সুলতানের মন গলে খানিক । শেষে অমাত্যদের পরামর্শে কালাচাঁদকে প্রস্তাব করা হয় আপন ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হলে সুলতান তার এই কন্যাটিকে সম্প্রদান করবেন তাকে , ও  উচ্চপদে  সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেবেন। যুবক কালাচাঁদ সাগ্রহে রাজি হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই এক দুধর্ষ গোত্রঘাতকে পরিণত হয় । সে যে এলাকা দিয়ে তার সেনাবাহিনী নিয়ে হামলে পড়তো সেই বসতিগুলো বিরানভূমিতে পরিণত হয়ে যেত ঝড়ের তান্ডবের মত। একদিন সে তার নিজের অঞ্চলে নিরীহ হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রাকৃতজনদের বসতিতে ঘেরাও দিয়ে সেনা দাবিয়ে দেয়। গ্রামবাসী প্রাণের তরাসে কালাচাঁদের সেই মাসিমাকে মখোমুখি নিয়ে আসেন , এতেও যদি তার মন খানিক ভিজে। কিন্তু কালাচাঁদের ইশারায় তার সেনাদের ঘোটকবাহিনী নিমিষে তছনছ করে পুরো অঞ্চল। মানুষের ভিটেমাটি পর্ণকুঠিরগুলো আগুন লাগিয়ে ছাইভস্ম করে  দেয় সেনাদল , পলায়নপর নিরীহ গ্রামবাসীর উপর দিয়ে তার সৈনিকেরা যুদ্ধের তাজিঘোড়া দাবড়িয়ে হত্যা করে জীর্ণপ্রাণ স্বজাতিদের। আর সেই মাসিমা যিনি পুত্রবৎ আদরে মমতায় বুকে আগলে মাতৃহারা কালাচাঁদকে বড় করেছিলেন সেই মাসিমার পৌড়া দেহটিও তাজি ঘোটকের তীব্র ক্ষুরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাতৃঘাতি কালাচাঁদের কোনো শোক হয়নি মাসিমার রক্তাক্ত দেহকায়া দেখে। স্বজাতির রক্তপিপাসু এমনই এক হিংস্র দানবে পরিণত হয় ধর্মান্তরিত কালাচাঁদ।

এই সেই ঠাকুর কালাচাঁদ রায় । নওমুসলিম  এই যুবা বাঙালির ইতিহাসে ঘৃণিত কালাপাহাড় নামেই কুখ্যাত।

কালাচাঁদ গত হয়েছে সেই কবে কিন্তু তার রক্তবীজে ছেয়ে গেছে পাললিক বাঙলার সারা ভূখন্ড। তারা কালান্তরে  লতায়পাতায় বেড়েছে কিন্তু মননে মনিষায় তাদেরকে পতিত করে রাখা হয়েছে যুগযুগ ধরে। সেই হাজার বছর আগে এই অঞ্চলের প্রাকৃতজনদের  ব্রাহ্মণ শাসক লক্ষণ-বল্লাল সেনের সময়ে অচ্যুত করে রাখা হয় ইতরজাত চাষা হিসেবে। তাদেরকে নেংটি পরতে হত, হাটু ঢেকে ধুতি পরতে দেয়া হতোনা। সুদ্রের কন্ঠে বেদবাক্য আওড়ালে জিব কেটে দেবার বিধান ছিলো। এইসব দহন-পীড়নের চাপে তাদের অনেকে বৌদ্ধধর্ম নেয়। এরও বহু শতাব্দী পরে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে অনেকে।

সত্যিকার অর্থে এই অঞ্চলের মানুষ সরস বৈদ্যিক ছিলোনা কোনো কালেই। প্রাচীন শৈবদের অস্তিত্ব ছিল । তারা শিবের গাঁজন করতো। শিব কোনো বৈদ্যিক দেবতা নয়। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর প্রত্নখননে ষাড়ারোহী শিবের মূর্তি পাওয়া গেছে। শিব নামের মীথ বিস্তার লাভ করেছিল সেখান থেকেই। খুব সম্প্রতি জেনেটিক গবেষণা রিপোর্টে এই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে , সিন্ধু সভ্যতা স্থানীয় মানুষেরাই গড়েছিল ,ইরান-তুরান থেকে আসা বা স্তেপ তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে ভেসে আসা যাযাবর আর্যদের কোনো সম্পর্ক নাই এই সুপ্রাচীন সভ্যতায়। পশ্চিম বঙের অজয় নদীতীরের ঢিবির প্রত্ন খননে হরপ্পা সভ্যতার সাথে যোগসূত্র সনাক্ত হয়েছে। ঢাকা-নরসিংদি'র ওয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ন খননেও সেই আলামত পাওয়া গেছে। জিন গবেষণায় ধরা পড়েছে এই অঞ্চলের ব্রাহ্মণ থেকে চন্ডাল , হিন্দু-মুসলিম সকলের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এক , অভিন্ন। এই অঞ্চলের মানুষের এই জেনেটিক তথ্যটা মাত্র গত বছরে জানা হল। ডিএনএ গবেষণার ফজিলতে আজকের দিনে বহু অমীমাংসিত তথ্য মীমাংসা পান্তাভাত হয়ে গেছে।

সমুদ্রমেঘলা এই দেশটির মানুষ নিজেদের শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে পায়নি কোনোদিন। খুব অল্প সময়ের জন্য পাল আমলে বাঙালি নিজ দেশের শাসনক্ষমতা হাতে পায়। জুলকারনাইন বা মহাবীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় যে বাঙালি শাসক ছিলেন তাঁকে নাপিত রাজা বলেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে আর্য সাহিত্যে। অথচ সত্য হচ্ছে , পাঞ্জাব রাজ্য যখন নমোনমো করে বেতসলতার মত আলেকজান্ডারের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে সেই সময়ে আমাদের নাপতা রাজার সামরিক ক্ষমতার চিত্র পেয়ে বিশ্ববিজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডারের পিলে চমকে যায়। গুপ্তচরেরা খবর জানায়, গঙ্গারিদির তিন সহস্রাধিক রণহস্তি দাঁড়িয়ে আছে আলেকজান্ডারের সৈন্যদলের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে। ঘোটকবাহিনী আর পদাতিক বেশুমার । গঙ্গা উপত্যকায় রণদামামা বাজাচ্ছে তারা। খবর পেয়ে মন্ত্রণাসভায় বসেন আলেকজান্ডার। সেনাপতিরা বলেন এই গঙ্গারিদি দেশ আক্রমন করা আত্মহত্যার সামিল। বঙ্গের নাপিত রাজার সামরিক ক্ষমতার কাছে মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে এই রাজ্যটি জয়ের আশা ত্যাগ করে ফিরে যান মহাবীর। এটা কোনো কল্পকথা নয়। আলেকজান্ডারের সংগী গ্রিক ঐতিহাসিকরা লিপিবদ্ধ করেছেন এই তথ্যটা। কিন্তু বাঙালি খুবই সরলপ্রাণ ও আত্মঘাতী।  সেই শক্তি বাঙালি ধরে রাখতে পারেনি বেশিদিন। ষড়যন্ত্রপটু কুচক্রীদের কূটচালের ক্রীড়নক হয়ে বাঙালি খুইয়ে ফেলে সকল অর্জন। মাৎস্যন্যায়ের অরাজকতা দমন করে এই বঙের গোপাল নামের শাসক পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম গনতন্ত্র চালু  করেন এখানে। কিন্তু কুচক্র তা আর তিষ্টোতে দেয়না।  

যাযাবর আর্য কি ইরান-তুরান আরবের রক্ত ঢুকেছে খুব অল্প কালে কালে। হাজার দুইহাজার বছরের সীমানায় আর একদেহে লীন হয়ে গেছে । এই সত্যটা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন।কেউ বাইরের দেশ থেকে এসে ছিটেফোঁটা বীজ রোপন করলেই তা অটুট থেকে যায়না। বংশপরম্পরায় অগনিত নেটিবদের ভিড়ে তা একই দেহে লীন হয়ে যায়। আরব্য বণিকেরা আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ভারত মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দুই হাজার বছর আগেই এসেছে। আরব্য বণিকেরা খড়বিচালি আর কাঠের জলযানেই জীবনের সারাবেলা কাটিয়ে দিতো,একদেশ থেকে আরেক দেশে যেতো। ইসলামের জন্মেরও  বহু আগে আরবি ভাষার কিছু শব্দ এই অঞ্চলের ভাষার সাথে মিশেছে। যেমন বাবা শব্দটি। হিন্দু মুসলমান সকলেই বাবা ডাকে। কেউ জানেনা এটা আরবি শব্দ। কাদা ছেনে ঘোলা করা কেবল জল ও পানি নিয়ে।  আদ্যিকালে তূর্কী বাবাম শব্দ থেকে আরবরা এই শব্দটি নিয়েছিলো। একজন আরব্য বণিক এদেশ থেকে দুইজন বঙ্গাল রমণীকে বিয়ে করে নিয়ে যায় আর একজনকে উপহার দেয় উত্তর আমেরিকার কোনো এক নেটিব রাজাকে। এই রকম আবছা কিছু তথ্য রয়েছে। এই সেদিন ভারত ভাগের পরেও ইরানের মেয়েরা আমাদের দেশে চশমা ও অন্যসব তৈজসপত্র বিক্রি করতো গ্রামেগঞ্জে। তারা বছর চুক্তির বাকিতে বিক্রি করতো পণ্য। পরের বছর এসে যদি দেখতো গ্রাহক মারা গেছে আর  পাওনা শোধ করার কেউ নাই তাহলে কবরে গিয়ে ঝাড়ুপেটা করতো আর নিজের ভাষায় অকথ্য গালাগাল করতো দিনভর। তখন মহল্লার সকলে মিলে পাওনা মিটিয়ে দিতো । এদের থেকেও লোকে এদের ভাষার বহু শব্দ আপন করে নিতো। এসব গল্প আমরা ছোটবেলা বয়োবৃদ্ধদের মুখে শুনেছি। আর মোঘল শাসনামলে রাজভাষা ফার্সী থাকার কারণে ফার্সীর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়, হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা সেই ভাষাতে উচ্চশিক্ষাও নিতো। ফার্সীতে উচ্চশিক্ষিতদের উপাধি ছিল 'মুন্সী'। এজন্য বাংলা ভাষায় বিপুল পরিমান ফার্সী শব্দ পাওয়া যায়। মোঘল সেনাশিবিরে এক আজব জগাখিচুড়ী বুলি চালু হয় যা ভারতের নানা অঞ্চল থেকে আসা সৈনিকেরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের জন্য ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে সেই উর্দিপরা সৈনিকদের ভাষা থেকে ঝেটিয়ে সংস্কৃত শব্দ বাদ দিয়ে বানানো হয় উর্দু আর আরবি ফার্সী তুর্কি ইত্যাদি ঝেটিয়ে সাফসুতরো করে বানানো হয় হিন্দি। এটা মাত্র তিনশ বছর আগের কেচ্ছা।

আর্য আরব ইরান তুরান ছাড়াও এদেশে এসেছিলো পর্তুগীজ জলদস্যু গঞ্জালেসরা। তারা সমুদ্র উপকূলের অঞ্চলগুলোতে  বাঙালি যুবকযুবতিদের ধরে কৃতদাস হিসেবে বিক্রি করতে নিয়ে যেত । এদেশে এই জলদস্যুরা বিয়েসাদি করে সংসার করতো। বাংলা ভাষায় অনেক পর্তুগীজ শব্দ সেই সময় থেকেই  ঢুকতে শুরু করে। কেউ কোনোদিন বলতে শুনিনা যে, এটা জলদস্যুদের শব্দ, এটা বললে জাত যাবে ধম্ম যাবে, ভাষা কলুষিত হবে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের বিকার দিনে দিনে বাড়ছে। বাংলা ভাষার আড়াই শত ব্যাকরণ রচিত হয়েছে, এসবের সিংহ ভাগ বিশেষ করে যেগুলো প্রথম দিকের, সেইসব ব্যাকরণ বাংলা যে একটি আপন শৃঙ্খলে শাসিত হবার মত ভাষা একথা স্বীকার না করেই রচনা করা হয়। এজন্যেই হুমায়ন আজাদ বাঙালিদের আত্মপ্রতারক আত্মপ্রবঞ্চক  ইত্যাকার অভিধা দিয়েছেন মনের খেদ মেটাতে। পূর্তগীজ জলদস্যুরা এদেশে লুন্ঠন করেছে । কিন্তু  একজন পর্তুগীজ ধর্মযাযকের কল্যানে বাংলাভাষার প্রথম টোটাফাঁটা ব্যাকরণ ও ঢাকা আর অপরাপর অঞ্চলের কথ্য দেশী শব্দের তালিকা রচিত হয়েছিল। মোগল আমলের শাসকরা গঞ্জালেসদের কবল থেকে চাষাভুষো মানুষদের রক্ষা করতে পারেনি। তেমন চেষ্টাও করেনি। এই দেশ চিরকাল দস্যু আর লুটেরাদের অভয়ারণ্য থেকে গেলো । আজও । এসব নিয়ে কেউ তেমন কথা বলতে চায়না। মানুষদের দেখি আপন আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত। বাঙালি নিজের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় স্বীকার করতে চায়না প্যারাসাইট আক্রান্ত হয়ে। তারা যে গঞ্জালেসদেরও রক্তবীজ সেকথা মনে রাখেনা।

বাঙালি হিন্দু হয়েছে , বৌদ্ধধর্ম নিয়েছে ,ইসলাম নিয়েছে। বাঙালি একটা সময় মহামতি বুদ্ধের অমৃত বাণীতে মুগ্ধ হয়ে আর বৈদ্যিক অনুশাসনে ক্লিষ্ট হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছে। বৌদ্ধ শাসন আমলে বাঙালি জ্ঞানগরিমা মনন মনীষায় অল্পসল্প উন্নতি সাধন করতে পারে। ঢাকা বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মত মহান তাপস বেরিয়ে আসেন বাঙালির আপন বংশে। ঢাকা-বিক্রমপুরে আজ কেবল এই যুগন্ধর বাঙালির পৈত্রিক আবাস নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা অভিধায় পড়ে আছে। আমার নিজের এলাকা রাজনগরে  ঢাকা বিক্রমপুরের বৌদ্ধ শাসক মহারাজা শ্রীচন্দ্র স্থাপন করেন চন্দ্রপুর বিদ্যামঠ নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেটাতে সেই সময়ের চালু  জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখায় দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হত।দশম খৃষ্টাব্দতে স্থাপিত এই চন্দ্রপুর বিদ্যাপীঠটি বৃটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরও তিনশত বছরের প্রাচীন ছিল। কিন্তু আমরা ধরে রাখতে পারিনা আমাদের অর্জনগুলো। এই চন্দ্রপুর বিদ্যাপীঠ নিয়ে নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে বিশদ বর্ণনা ও ঢাকা যাদুঘরে রক্ষিত তাম্রফলকটি ছাড়া আর তিলমাত্র অস্তিত্ব অবশিষ্ঠ নাই। বাঙালি আমরা আমাদের সকল অর্জন ধ্বংস হয়ে যায়। বল্লাল- লক্ষণ সেনের কালে ব্রাহ্মণ্য পীড়ণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে , বৌদ্ধ সিদ্ধারা দেশান্তরী হতে বাধ্য হন। যে সিদ্ধারা জ্বালিয়েছিলেন বাংলাভাষার প্রত্নকালের প্রদীপ   বাঙালির, সেইসব রত্নরা প্রাণ নিয়ে  পালাতে বাধ্য হন নেপাল ভুটান,চিনদেশে । আমরা কীর্তিনাশা এক জাতি ধর্মপ্রহারে মরি , ধর্মবিকারেও প্রাণ দেই , স্বজাতির ধনমান প্রাণ হরণ করি !  বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা রচনা করেন বাংলা ভাষার প্রথম প্রদীপ চর্যাপদ।  কিন্তু কর্ণাটকি ব্রাহ্মণ বল্লাল-লক্ষণ সেনের সময়ে বাঙালির ঘটে চরম লাঞ্চনা। বাংলাকে ম্লেচ্ছদের বুলি বলেই বিবেচনা করা হত। দেবভাষা নামে সংস্কৃত ভাষাকে করা হয়েছিলো রাজভাষা। লক্ষণ সেনের মহামন্ত্রী হলায়ুদ মিশ্র রচনা করেছিলেন একশত ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের বই সংস্কৃত ভাষায়। কে হাটু ঢেকে আব্রু করবে কে কেবল নেংটি পরবে,কাদেরকে রৌরব নরকে পুড়তে হবে,বিধবা সতীদের কেমন করে সহমরণে প্রজ্বলিত চিতায় পোড়াতে হবে,কারা বেদবাক্য উচ্চারণ করলে জিব কেটে ফেলতে হবে - এসব। সেই হলায়ুদ মিশ্র কেন লিখলেন তার জীবনের শেষ বইটি একজন মুসলমান সন্তপুরুষ কামেল পীর জালালুদ্দিন তাব্রিজিকে নিয়ে ? সংস্কৃত ভাষায় লিখা বইটির নাম 'শেখ শুভোদয়া'। তিনি লিখলেন, সাধু তাব্রিজির অংগুলিহেলনে আকাশে উড়ন্ত  হংসমালিকার ঝাঁক মাটিতে নেমে আসে, গর্জমান ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র মূহুর্তে ঘুমিয়ে যায় প্রণতির ভংগিতে। তুরুকের ছায়া মাড়ালে যে বামুনের জাত যায় সেই বৈদ্যিক বামুন পীর তাব্রিজির কেরামতির কথা লিখলেন কেন ? রহস্য নিশ্চয় আছে বৈকি। এই বজ্রকঠিন বৈদ্যিক বামুনের আরও অমৃত বাণী আছে যা রহস্যে ঘেরা যেগুলো এই রচনার কোথাও বলা যাবে।

প্রাচীনকালে আরব্য বণিকেরা সমুদ্রপথে এই দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে বানিজ্যের পণ্য নিয়ে আসতো। তারা থাকতো অনেকদিন , বিয়ে করতো।তাদের ক্ষীণ রক্তধারা মিশে যাবার তথ্য আছে। করলা নামের একটা বিষম তিতে সবজি আমরা বাঙালিরা খাই। উস্তা নামেও এই সবজিটিকে জানে বিশেষ করে সমুদ্রপারের বাঙালি। উস্তা বা করলার আসল নাম উসুতুতা। এই সবজি উত্তর আমেরিকার নেটিব বা রেডইন্ডিয়ানদের ভাষার শব্দ। করলাকে তারা এই নামেই ডাকে। এই শব্দের অর্থ হল কমলারাঙ্গা। করলা পাকলে কমলা রঙ ধারণ করে। আরব্য বণিকদের মুখে এই উসুতুতা উস্তা হয়ে যায়। তাদের মাধ্যমেই বাঙালি উস্তা নামের সবজিটি চিনে ও নামটিও নেয়। বাঙালি হিন্দু মুসলিমের ঘরেঘরে জনককে বাবা বলেই ডাকে।এই শব্দটিও আরবি। এই দেশে ইসলাম আসার বহুকাল আগেই আরব বণিকদের মাধ্যমে এই বাবা শব্দটির এখানে প্রচলন হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও নাকি অবাক হয়েছিলেন এই শব্দটির আদি পরিচয় জেনে ।

এই ভূখণ্ডে কৃষি সমাজের প্রান্তিক ভূমিপুত্ররা নিজেদের কল্পনায় বানিয়েছিল খড়বিচালির কাঠামোতে মাটি লেপে নিজেদের এক দেবী সেই আদ্যিকালে। নাম দিয়েছিল চন্ডি। আর্যরা ধর্ম ব্যবসা ফাঁদতে এসে কাহন বানায়। তারা এসে বলে, আহারে এই দেবী কি কেবল চন্ডি,উনি হলেন আমাদের দেবাদি দেব মহাদেব নটরাজ শিবের কন্যা । উনার নাম আদতে পার্বতি , তোমরা চন্ডি নামে ডাকো আরকি। বৈদ্যিকদের কথা শোনে সরলপ্রাণ প্রান্তিক মানুষেরা খুশি হয়। তারা বৈদ্যিকদের বলে, সত্যি যদি তোমরা আমাদের মা চন্ডিকে দেবী বিবেচনা করো তবে মন্ত্র দাও।তোমরা যে দেবভাষায় পবিত্র মন্ত্রের কথা বলো সেই মন্ত্র। কপালে চন্দ্রকলি আর গলায় রুদ্রাক্ষের জপমালা ও নামাবলি গায় বৈদ্যিকেরা ধর্মবানিজ্যের সুযোগ পেয়ে বলে,তাহলে পূজার জন্য মঙ্গলঘট সাজাও। সেই থেকে শুরু। একটার পর  আরেকটা কাহন রচনা করে জগাখিচুড়ী বানিয়ে জোড়াতালি দিয়ে হিন্দু নামের ধর্মটির ঝমঝমাঝম রমরমা ব্যবসাটি জমে ওঠে। এই অঞ্চলের প্রাকৃত ভূমিপুত্রদের কল্পনার মাতৃদেবি চন্ডির নাম দেওয়া হল দুর্গা। অন্ত্যজ মানুষদের মন প্রফুল্ল রাখতে দুর্গাপূজোয় চন্ডিপাঠ যোগ করে দেওয়া হয়। এজন্যে আজও দুর্গাপূজোয় চন্ডিপাঠ মেনডেটরি । কিন্তু যতই চন্ডিপাঠ হোক গল্পটা কায়দা করে চলে গেলো এই অঞ্চলের ভূমিপুত্রদের অস্তিস্ত্বের বিরূদ্ধে। বৈদ্যিকরা এই অঞ্চলটাকে বিবেচনা করতো অশুচি অপবিত্র দেশ যেখানে দেবতা বিষ্ণুর পদধূলি পড়েনি। ধর্ম ব্যবসা ফেঁদে বসার আগে তারা বলতো এই দেশের মানুষ অসুর জাতি , নিষাদ এরা , পাখির মত কিচিরমিচির করে আর কাঁচা মাংস ভক্ষণ করে। এই দেশে কেউ যেন না যায় , আর কেউ যদি যাও তাহলে প্রাশ্চিত্য করে বিষ্ণুপদাম্বুজ ভূমিতে ফিরে আসবে। তারা প্রাকৃতজনদের দেবী চন্ডিকে বানালো অসুরনাশিনী দশানন দেবীরূপে যার হাতের ত্রিশূল পায়ের কাছে পড়ে থাকা অসুরের বক্ষ বিদীর্ণ করছে। রহস্যের কথা হলো বাংলা ছাড়া সারা ভারতবর্ষের কোথাও দুর্গা নামের কোনো দেবী নাই , দুর্গাপূজাও নাই। আদতে প্রাচীন শৈবধর্মীদের আবছা গল্প মাথায় রেখে এই ভূমির মানুষেরা নিজেদের সনাতনী বিবেচনা করে আসছে। কৃষিপ্রধান এই পলিমাটির দেশের ভূমিপুত্রদের মাতৃভক্তি ছিল , এজন্য তারা দেবতা বানায়নি কল্পনায় , বানিয়েছে মা চন্ডি , মা কালি , বানিয়েছে মা মনসা। তারা মাটির ধরাধামকে ডাকতো বসুমাতা নামে। প্রাচীন আরবের প্যাগান সংস্কৃতিও ছিলো মাতৃভক্তির। তাদের প্রধান দেবতা যদিও হুবাল বা লা কিন্তু  আরাধ্য ছিলো দেবী আল লাত , আল মানাত ,আল উজ্জা। তারা এই দেবীদেরও কল্পনা করেছিলো লা নামের একক ঈশ্বর বা হুবাল দেবতার কন্যারূপে। তারা এই দেবীদেরই আরাধনা করতো। আদতে বৈদ্যিকদের শীর্ষ কোনো দেবী নাই , পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনো দেবী হয়না , দেব হয়। আর্যদের আরেকটা ইরানীয় শাখা অগ্নি উপাসক জরাথ্রুষ্টবাদীদের কোনো শীর্ষ দেবী নাই , আছে আহুর মাজদা নামের দেব। এই বঙের হিন্দু-মুসলিম সকল মানুষের পূর্বপুরুষ আদি ভূমিপুত্রদের আরেক দেবীর নাম মনসা বা বিষহরি। জনসংখ্যা ছিল অল্প, চারদিকে জায়জঙ্গল আর সাপখোপের রাজ্য ছিল বিধায় সাপের চোবল থেকে বাঁচতে কল্পনায় বানায় দেবী মনসাকে তারা। বিষহরি মনসাকে নিয়ে কান্ড ঘটে গেছে একখান, যা বৈদ্যিক সাহিত্য 'সদুক্তিকনামৃত' নামের সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে জানি আমরা। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর এসেছিলেন রাড়-বঙ্গে ধর্ম প্রচারের খায়েসে। তাঁর সাথে ছিলেন চৈনিক কিছু অনুসারী। গৌরবর্ণের সুদর্শন আর বিশালদেহী মহাবীর সফেদ আলখাল্লায় শোভিত হয়ে এসেছিলেন। কান্তিময় প্রশান্ত চেহারা যেন স্বর্গ থেকে দেবদূত নেমে এসেছেন। এসে দেখলেন পথের ধারে বৃক্ষতলায় চন্ডির থান , কোথাও মনসার মৃৎমূর্তী। দেখলেন পাককাদার খাদে পড়ে লুটোপুটি খেলছে ন্যাংটো বালকের দল। মহাবীর তাদের ডেকে বললেন,  , হ্যাঁরে বালকের দল,তোমরা উদোম কেন ? আর বৃক্ষতলায় এই মৃন্ময় মূর্তিটা কার বলতে পার ? বালকেরা বলে , আমাদের মা মনসা। বিষহরি আরেক নাম। দেবদূত জিজ্ঞেস করেন , তিনি তোমাদের কি উপকার করেন আর কেমন করে তোমরা তার আরাধনা কর? বালকেরা অপার আনন্দ নিয়েই বলে , তিনি বিষাক্ত সাপদের চোবল থেকে আমাদের বাঁচান। আমরা তার সামনে নাচগান করে মা মনসার প্রশংসা করি। দেবদূত ভেবে বলেন ,সর্বসাশ ! ইনি কোনো সত্যিকার স্বর্গলোকের দেবী নয়, আর এভাবে অপবিত্র ভাষায় কোনো মন্ত্র হয়না। দেবভাষায় মন্ত্র দিতে হয়। তোমাদের গুরুজনদের গিয়ে বলো তারা পাপাচার করছে। দেবদূতের মৃদু এই ভৎসনায় ন্যাংটো বালকের দল ক্ষীপ্র হয়ে পাককাদা ঢিল ছুঁড়ে  দেবদূতদের শুভ্র পোশাক বিনষ্ট করে দেয়।পোষা সারমেয় লেলিয়ে দেয় লে লে করে। রাড়-বাংলার দুষ্ট বালকের দল ও কুকুরের তাড়া খেয়ে মহাবীর পালালেন। তিনি ফিরে গিয়ে জানালেন , এই দেশ অসভ্য অসুরের দেশ সেখানে কেউ যেয়োনা , যদি যাও তবে বিষ্ণুর পদযোগের পবিত্র ভূমিতে  ফিরবে প্রাশ্চিত্য করে। 
---  চলবে

মহসীন বখত
অটোয়া, কানাডা