প্রেমের গল্প - শাহনাজ পারভীন
আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক দিলতাজ আপার প্রেমের গল্পের তাড়া ছিলো এ বছরের শুরুতেই। কথা হলেই এটা সেটার পরই শুরু হয়ে যায় আপার তাড়া। কিন্তু কোথায় পাবো সেই প্রেম নামক সোনার হরিণ! তাকে চিনবার আগেই তো চিনে ফেলেছি অতি বাস্তবতার সত্যি সংসারের গল্প। কারণ, জেনেছি প্রেমিক প্রেমিকাদের ঘাসের বিছানায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কচি ঘাসের ডগা ছিঁড়ে যে গল্প হয়, তার অধিকাংশই থাকে মিথ্যেয় জড়ানো। একবার ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে একটা কাজে গেলাম ওকে নিয়ে। জোড়ায় জোড়ায় ঘাসের বিছানায় তাদেরকে অকারণ ঘাসের ডগা ছিঁড়তে দেখে সে বলেছিল
--দেখেছো, অকারণ বসে বসে মিথ্যার বেসাতি করছে!
--তাই নাকি?
--তাই তো। ওরা যা বলছে, সব মিথ্যে। সত্যির কণা মাত্র নেই। অকারণ দিনরাত্রি সময়ের অপচয়। অবশ্য কিই বা কথা থাকে এতো। ঘর নেই, সংসার নেই, বাচ্চাকাচ্চা- ছেলেমেয়ে নেই। বসে বসে অকারণ মিথ্যে স্বপ্ন সাজায়। তারপর দিনশেষে আবার শুরু প্রথম থেকে। একই কথা! যদি বিশ্বাস না হয়, জিজ্ঞেস করতেই পারো। প্রমাণ পাবে।
-- নাহ। তার আর দরকার নেই। তুমি যখন বলেছো, সেটাই ঠিক। প্রমাণের দরকার নেই আমার।
সম্মানিত পাঠক, নিশ্চয়ই এটাকেই আপনারা প্রেম বলবেন। এই যে, প্রমাণ পত্র ছাড়াই এক বাক্যে সব কিছু মেনে নেয়া? তো দিলতাজ আপাকে বলি,
--আপা প্রেম কোথায় পাবো?
--তোমাকে কী আমি সত্যি ইতিহাস লিখতে বলেছি? লিখবে গল্প! পাগলি মেয়ে!
--তাই তো, যা ভালোবাসি তাই তো প্রেম, যা আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় তাই তো প্রেম। যা আমার দিনের কর্মে ব্যাঘাত ঘটায় তাই তো আমার প্রেম!
--হুম।
ইদানিং খুব আমার প্রথম জীবনের গাঢ় কমলা রংয়ের ফোল্ডিং ছাতাটির কথা মনে পড়ছে। যেটি মাথায় চাপিয়ে আমি রোদ, বৃষ্টি আর প্রেম থেকে জীবনকে নিরাপদ রাখতাম। সেই আমার প্রথম প্রেম।
--কী, ছাতা, না কি অন্যকিছু...
--হু। দুটোই। সে।
সে দাঁড়িয়ে থাকতো গালর্স স্কুলের সামনের মোড়ের বড় রাস্তায়। আমরা ঐ রাস্তায় উঠলেই একটু পর সে আমাদের পিছু নিতো। আমাদের মানে আমার আর লিটার।
লম্বা, হ্যাংলা ফর্সা ভদ্র ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকতো ঠাঁই। কখনো কথা বলা হয় নি। তবে কয়েক দিন দেখেছি, কলেজ গেটের আগ পর্যন্ত পিছন পিছন থেকেছে। তারপর কলেজ গেটে ঢুকতো দাপটে। জেলা শহর থেকে আসতো ছেলেটি।
স্থানীয় কারো সাহস ছিলো না আমার দিকে চোখ তুলে তাকাবার। দুই দুটো বড় ভাই ছিলো আমার বাঘের মতো। কামারখালী তাদের নখদর্পণে। কার এতো সাহস ছিলো চোখ তুলে তাকায়, চোখসহ কলজেটা উপড়ে ফেলবে না একটানে!
আমার মাথায় কমলা রং এর ছাতা থাকতো, আর লিটা আমার পাশে থাকতো। দুজন একটু দূর যেতেই আমাদের সাথে মিশতো বাজার থেকে আসা লম্বু লাভলী আর সেলিনা। লাভলীর বাবা ছিলো দারোগা আর সেলিনার বাবা ছিলো জুট কর্পোরেশনের সিনিয়র অফিসার। ওরা দুজনেই বাজার লাগোয়া পাশাপাশি বাসায় থাকতো।
আর একটু রাস্তা পার হলেই সদাহাস্য শিউলিকে পেতাম। ও আসতো আড়পাড়া ওর নানার বাড়ি থেকে। ও ওখানে থেকেই কামারখালী কলেজে পড়াশোনা করতো। তারপর মিনি। ও আসতো ঢাকা রোডের ওপাড়ে ওদের সরকারি কোয়ার্টার থেকে। ওর আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী।
পর পরই মধুখালীর বাস থেকে নামতো মিতা, লাবণী, চন্দনা। ওদের পিতারা ছিলেন মধুখালী চিনি মিলের কর্মকর্তা। তখন মধুখালী কলেজ তৈরি হয় নি। সেই আশির দশকের কথা।
মাত্র পনের মিনিটের পথ আমরা হৈ চৈ করে কলেজে পৌঁছে যেতাম। তখন তো রিকশার প্রচলন ছিলো না। পায়ে হেঁটেই আমরা যাতায়াত করতাম। কলেজের মুখোমুখি যেয়ে লাকি বের হতো ওর বাসা থেকে। প্রতিদিন প্রায় নিয়ম করে এভাবেই আমরা কলেজে ঢুকতাম। তার একটু আগে পরে ঢুকতো নেভী, শ্যামলী, দূর্গাসহ বেলি আপা। বেলী আপা আসতো মধুমতি নদীর ওপাড় কবি ফররুখ আহমেদের বাড়ি মাঝআইল রেখে কমলাপুর থেকে। এর সাথে যুক্ত হতো আমাদের আরো আরো সহপাঠী।
আমার বাড়ির পরেই লিটার বাড়ি ছিলো। লিটা এসে আমাকে বাসা থেকে নিয়ে যেতো প্রতিদিন। ও ছিল মোল্লা বাড়ির মেয়ে আর আমি মিয়া বাড়ির।
আজ বিস্ময়ে অবাক হয়ে মনে পড়ছে, কলেজ জীবনে একলা একলা কলেজে যাওয়া হয় নি কোনোদিন। প্রতিদিন নিয়ম করে লিটা আর আমি একসাথে বের হতাম।
তার পর পথে আমরা একে, একে, জোড়ায়, জোড়ায়, তিন জন, চারজন- একসাথে অনেক জন মিলতাম।
তার ওপর আমার মাথায় থাকতো জেলা শহর থেকে কিনে আনা সুন্দর বাহারি রঙিন ফোল্ডিং ছাতা। এজন্য রাস্তায় কে আমাদের কার জন্য ঘন্টায় ঘন্টায় অপেক্ষা করতো তা আর খেয়াল থাকতো না, বা খেয়াল রাখার অবকাশ পেতাম না। ওই সময় অবশ্য আমার বান্ধবীদের সবারই কম বেশি বিশেষ কেউ না কেউ ছিল। শুধু আমি আর দূর্গা ছিলাম একা। এ বিষেেয় ওরা আমাদের নিয়ে অনেক মজা করতো। আমাদের কেউ নিজের করে থাকুক সেটাও ওরা চাইতো। কিন্তু আমাদের চাওয়া ছিল ভিন্ন।
এরই মধ্যে লিটার হাতে একটা চিঠি আসে, যার মালিক সে নয়। বুঝতেই পারছেন পাঠক। যেহেতু চিঠিটি তার হাতে পড়েছিল, তাই সে-ই ব্যবস্থা নিয়েছিল বাকিটা। আহারে বেচারা!
এই নিয়ে আমাদের নানান আলোচনা সমালোচনা ঝলকানি শেষ হতে না হতেই এরই মধ্যে এক মাঘী পূর্ণিমার বন্ধের দিনে আমরা দশ বান্ধবী কলেজে যাই ইউনুস স্যারের কথামতো প্রাইভেট পড়তে। স্যার বলেছিলেন--
--আগামী কাল কলেজ বন্ধ। আমরা বেশ কিছুটা গ্রামার এগিয়ে রাখবো।
স্যারের কথামতো সেভাবেই ব্ল্যাকবোর্ড ছিলাম আমি। স্যার বলেছিলেন, আজ ব্ল্যাকবোর্ড থাকবে শাহানার দখলে। ও আমাদেরকে পুরনো নিয়মগুলো শেখাবে আগে, তারপর অন্যকিছু...।
এরই মধ্যে হালকা পাতলা গড়নের দুজন যুবক এসে স্যারের মনোযোগ আর্কষনের চেষ্টা করছিল বারবার। স্যার বাইরে যান।
স্যারকে বারবার কি যেন অনুরোধ করছিলো। স্যার রাজি হচ্ছিলেন না।
পরে স্যার কে তারা একটা কাগজ দেখালে স্যার ভেতরে এসে আমাদেরকে ছুটি দিয়ে দেন।
আমরা বিরক্ত হচ্ছিলাম। ভাবছিলাম হয় তো বা তারা ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র হবে। এই কলেজ থেকে ইংরেজি বিহীন ডিগ্রি পরীক্ষা দিতে চায়। তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিগ্রিতে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকেই মাইগ্রেসান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ শেষ কলেজ আমাদের কামারখালী কলেজে রেজিসেট্রশন করতো। তখনো কলেজটির নাম বীরশ্রেষ্ট আব্দুর রউফ ডিগ্রি কলেজ হয়নি। তখনো বেসরকারী কলেজ হিসাবে কলেজটির সুনাম ছিলো।
তো আমরা অসময়ে ছুটি পেয়ে কলেজ লাগোয়া লাকির বাসায় ঢুকে পড়লাম আড্ডা দিতে। খালাম্মা তো মহাখুশি। এটা করে, সেটা করে। কাজের ছেলেটাকে দিয়ে উঠোনে দৌঁড়ে মুরগী ধরায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা মুরগির জন্য অপেক্ষা না করেই অনেক রকম নাস্তা করে আড্ডা দিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা পর রাস্তায় নেমে আসি।
ওমা! সেই দুইজন। একটি বড় কুল গাছের ছায়ায় মটর সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের তো মেজাজ খারাপ। ওদের জন্য আমরা পড়তে পারি নি, ওরা এখন এখানে কেন?
আমরাও তো কম নই রাস্তার রাজা। কলেজ বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা।
তাদেরকে ছেড়ে দিলে তো! আমরা নয়জন আড়াআড়ি ভাবে রাস্তা জুড়ে হাঁটছি। তাদেরকে পাত্তাই দেই নি কোনো। তারাও মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে নির্বিকার পেছন পেছন আসছে। এ ব্যাপারে তাদেরও তাড়া আছে বলে মনে হলো না। অবশ্য একবার আমরা তাদের রাস্তা ছেড়ে দিয়েছিলাম বটে, তারা সামনে যায় নি। আমাদের পিছু পিছু আসে গালর্স স্কুল মোড় পর্যন্ত। আমি আর লিটা বায়ে ঘুরে চলে আসি। ওরাও চলে যায় ওদের মতো।
বিকালে সেজো কাকা বারান্দায় বসে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন সেই দুই যুবকের কথা। আমি দেখেছি কি না?
--হু দেখেছি।
--লম্বা কেমন?
--তাই তো। একজন একটু বেশি। সে দাঁড়িয়ে ছিলো নীচে। স্যার বারান্দায়। অথচ দুজনের মাথা কাছাকাছি।
-- দেখতে কেমন?
--তা তো দেখি নি, কাকা।
আমার উত্তর শুনে ভাবীরা হেসেই খুন। বলে কি মেয়ে, ছেলে দেখেছে কিন্তু ছেলে দেখতে কেমন তা জানে না!
আমি আমার বোকামিতে নিজেই লজ্জা পাই। আসলেই তো, এতটা ঘন্টা! কিন্তু একবারও চোখ তুলে দেখা হয় নি। অবশ্য ওইভাবে দেখার সুযোগও ছিলো না, প্রয়োজনও মনে করিনি। তারাও তো সুযোগ থাকা সত্বেও আমাদের সামনে আসে নি। কথা বলে নি। আর আমার দরকারটা কী?
পরে জেনেছি, ঐ যুবকদ্বয় যশোর থেকে মোটর সাইকেলে করে এতটা পথ গেছে আমাকে প্রাথমিকভাবে দেখতে! স্যারের যশোরের এক প্রিয় বন্ধু এই ব্যাপারে তাদেরকে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন।
তারপর দিনক্ষণ ঠিক করে তারা যখন আমাকে অফিসিয়ালি আমাদের বাড়িতে দেখতে যায়। তখন সে ভাবীর মাধ্যমে আমার সাথে এক মিনিট আলাদা কথা বলতে চায়। তার কথা ছিল,
--আমাদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তা হলে তো হবে না। পাত্রীর পছন্দের ব্যাপারটি সে নিজে মুখে জানতে চায়।
এখান থেকেই তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। তৈরি হয় এক ধরনের আগ্রহ। বিয়ের ডেট শুরু হওয়া থেকে বিয়ে পর্যন্ত দিন কি এক ছটফটানি কাজ করতো। প্রতিদিন চলতো ক্ষণ গণনার, দিন গণনার হিসাব। কি এক মায়া, কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকের মধ্যে খচখচ করতো। সেই রকম এখনো করে। কোন কাজে বাইরে গেলে বার বার ফোন করে বিরক্ত করে ছাড়ি। কোথায় আছে, দেরি হচ্ছে কেন, ইত্যাদি। জানি না, এইগুলো প্রেম নাকি? এইগুলো যদি প্রেম হয়, তাহলে তাই। তার সাথে আমি রচনা করছি দিবারাত্র প্রেমের পদাবলি। তারপর বিয়ের রাতে সে আমাকে প্রথম বলে,
-- নতুন চাকরি। অর্নামেন্টস বেশি দিতে পারি নি।
আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। অর্নামেন্টস বুঝতে পারছিলাম না। তার দিকে তাকাতেই সে বললো,
--গহনা।
সেই থেকে অকপটে তার কাছে কিছুই জিজ্ঞেস করতে আমার লজ্জা হয় না। এতো এতো পড়াশোনা করি, বেঁধে গেলেই হাতের কাছে ডিকশনারি থাকা সত্ত্বেও তাকেই জিজ্ঞেস করি নিদ্বির্ধায়।
এই আমার ভালোবাসা। এই আমার প্রেম। চলছি একসাথে পঁয়ত্রিশ বছর।
এখন চলছে করোনা সময়। মহান আল্লাহকে বলেছি, এই মহামারিতে যদি মৃত্যু হয়, দুজনেরই এক সাথে হোক। আর যদি বেঁচে বর্তে থাকি তো এক সাথেই রেখো।
কারণ-
পিঞ্জরের মধ্যে যখন ছোট্ট পাখিটা ধুকপুক করে নিরন্তর,
আঁকুপাঁকু মন ছুঁতে চায় কি যেন,
সে তা দেখতে পায় অনন্ত। বুঝে যায় মুহূর্তে।
লেখক: ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, অধ্যক্ষ, তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, যশোর।
সভাপতি, দ্যোতনা সাহিত্য পরিষদ, যশোর।
সম্পাদক: নান্দনিক ধারার সাহিত্য কাগজ দ্যোতনা; ছড়া সাহিত্যের কাগজ ছড়াঘর।
-
গল্প//উপন্যাস
-
22-03-2023
-
-